বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রে নাটকে এবং সাহিত্যে আটপৌরে ভাষার ব্যবহার নিয়ে একটি উদ্বেগের কথা উঠে এসেছে। মেহতাব খানম, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও সৌমিত্র শেখরকে ধন্যবাদ জানাই বিষয়টি নিয়ে তাদের সুচিন্তিত মতামত জানানোর জন্য। মেহতাব খানমের উত্থাপিত প্রসঙ্গটি ছিল মূলত টেলিভিশন নাটকের সংলাপ নিয়ে, ফলে আশা ছিল নাট্যজনদের কেউ মতামত দেবেন এবং দেখলাম সরয়ার ফারুকী সেটা দিয়েছেনও। ফলোআপ হিসেবে ১১ নভেম্বর প্রথম আলো-য় সৌমিত্র শেখর তার আলোচনাটিকে শুধু নাটকের সংলাপে সীমিত রাখেন নি, বরং সাম্প্রতিক সাহিত্যচর্চায় আটপৌরে ভাষার “যথেচ্ছ” অনুপ্রবেশ নিয়েও তার উদ্বেগের কথা বলেছেন।
টেলিভিশন নাটকে, সিনেমায় বা সাহিত্যে আটপৌরে ভাষার অনুপ্রবেশকে “যথেচ্ছ” মনে হওয়ার কারণ কি? সরয়ার ফারুকীর বক্তব্যে তো মনে হচ্ছিল যে, আটপৌরে ভাষার প্রয়োগ নিয়ে তাদের সুনির্দিষ্ট চিন্তা রয়েছে। কার ইচ্ছায় ও চিন্তায় তাহলে আটপৌরে ভাষা “মানভাষা”য় প্রবেশাধিকার পাবে? সৌমিত্র শেখর বলছেন সেটা শতবর্ষ আগের অবিভক্ত বাংলার ভাষাচিন্তক ও সংস্কৃতিবোদ্ধাদের ইচ্ছায় বা সিদ্ধান্তে। তারা বহু গবেষণা করে নদীয়া শান্তিপুর অঞ্চলের বাংলাকে প্রমিত বাংলা বলে ঠিক করে গিয়েছিলেন। তাদের সেই সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের পর একশ বছর গত হল, অবিভক্ত বাংলা বিভক্ত হল, এবং দুই বাংলার সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতা দুই মেরুর দিকে ধাবমান হল। অল্প কিছু সাহিত্য আর সামান্য কিছু “জীবনমুখী” গান ছাড়া আর কোন্ বিষয়টা দুই বাংলার কনজিউমাররা এখন শেয়ার করে বলা মুশকিল। একদা অবিভক্ত, কিন্তু বর্তমানে পরস্পর থেকে নানাভাবে দূরে সরতে- থাকা দুই বাংলা চিরকাল একইভাবে ভাষাব্যবহার করতে থাকবে, এটা কেমন আবদার? আর রাষ্ট্রীয় বাস্তবতার কারণেই গ্লোবালাইজেশনের চাহিদা দুইবাংলার কাছে দুরকম, যেহেতু পশ্চিমবাংলা একটা বড় ন্যাশন স্টেটের অংশ আর পূর্ববাংলা নিজেই একটা ন্যাশন স্টেট। যে বাংলায় পশ্চিমবঙ্গ আজ সাহিত্য সাংবাদিকতা কি টেলিভিশন নাটক করছে, তার মধ্যে হিন্দি বা “হিংলিশ” ভাষার দাপট কীরকম আছে? কতটা প্রমিত আজ প্রমিত বঙ্গের বাংলা? প্রমিত বাংলার জন্য শতবর্ষ আগে বেঁধে দেয়া সেই স্ট্যান্ডার্ড থেকে একা পূর্ববাংলাই সরে আসছে, এটা বোধহয় ঠিক নয়।
মেহতাব খানমের উদ্বেগ তবু সময়োচিত, ঢাকাই উচ্চবিত্তের “ডিজুস” কালচার দিয়ে আমাদের কল্পনার আবহমান বাংলা নিয়ন্ত্রিত হোক সেটা তিনি বা সরয়ার ফারুকী কেউই চান না। ফারুকীও তার লেখায় সেই উদ্বেগের পে সাফাই গেয়েছেন এবং “জাতীয়” মিডিয়াকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে উত্তরণের পথ বাতলেছেন। কিন্তু ভাষা মূলত মতাসম্পর্কের দ্যোতক, এবং সে কারণেই এই ধরনের উদ্বেগ মূলত মধ্যবিত্তের, যেহেতু মধ্যবিত্ত এটা ভাবতে পছন্দ করে যে তারাই “জাতীয়” সংস্কৃতির মুখ্য আধিকারিক। এই যুদ্ধ দৃশ্যত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মধ্যকার একটি সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধ যেখানে তাদের উভয়ের কুরুত্রে হচ্ছে মিডিয়া। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের নিজ নিজ শক্তিশেল তো আছেই। উচ্চবিত্তের টাকা থাকলেও মধ্যবিত্তের আছে লোকবল আর উচ্চকিত হবার নৈতিক অধিকার। মিডিয়াব্যক্তিত্ব সরয়ার ফারুকী যেভাবে মেহতাব খানমের উদ্বেগকে সমর্থন জানিয়েছেন তা দেখে মনে হচ্ছে এই কৌরব-পান্ডবের যুদ্ধে তিনি যেন কর্ণ! মন মধ্যবিত্তের দিকে, কাজ করছেন উচ্চবিত্তের ভাষায়!
বলাবাহুল্য, নিম্নবিত্ত সমাজ এই যুদ্ধে উপেতি। গরিব রিক্সাঅলার আবার ভাষা কি? সে তো আমাদেরই বেঁধে-দেয়া ভাষাব্যবস্থায় চলবে, নাকি? অথচ, আমরা খেয়াল করিনা যে, “ডিজুস” বাংলার আগেই নিম্নবিত্তের নিজস্ব বাংলা প্রমিত বাংলার বিরূদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তাদের মিডিয়ায়। তাদের মিডিয়া? কেন, দেখছেন না সেই মিডিয়ার দাপটে আমাদের নামী ব্যান্ডশিল্পীদের কাঁধে গামছা, পরনে জিনসের বদলে আলখাল্লা, আর মমতাজকেও দেখুন! সবচে বেশি এলবামের গায়িকা হিসেবে ইতোমধ্যেই গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এ নাম উঠেছে তার। হ্যাঁ, অডিও ক্যাসেটই নিম্নবিত্তের মিডিয়া এবং এই কেন্দ্রাতিগ মিডিয়াটি কোনোরকম বিজ্ঞাপনী প্রশ্রয় ছাড়াই বর্তমানে দেশের সবচে দ্রুত বর্ধনশীল মিডিয়াগুলোর একটা। খেয়াল করে শুনে দেখুন, সেখানেও একরকমের বাংলার চল আছে, যা নিম্নবিত্ত বা নগর গরিবের বাংলা। আমার প্রস্তাব এই ধারার বাংলাকেও বর্তমান তর্কে সামিল করা হোক। তাকে পাশ কাটানোর একাডেমিক আভিজাত্য থেকে মুক্ত হোক ঢাকাই মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত।
এবার সাহিত্যের ভাষা প্রসঙ্গে আসা যাক, যেহেতু সৌমিত্র শেখর সাহিত্যে আটপৌরে ভাষার ব্যবহারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তার ঔচিত্যবোধ প্রখর, আটপৌরে বাংলায় রচিত সাহিত্য জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে প্রচার অনুচিত বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু কেন? ঢাকাই মিশ্র আটপৌরে বাংলা শেষবিচারে এক ধরনের আঞ্চলিক বাংলাই বটে। মেহতাব খানমের আপত্তির কারণ তো বোধগম্য, তিনি আজকালকার টেলিভিশন-দেখা ছেলেমেয়েদের “শুদ্ধ” বাংলায় কথা বলার েেত্র নাটকের ভাষাকে প্রতিবন্ধক ভাবছেন। কিন্তু আঞ্চলিক বাংলায় সাহিত্য তো নতুন কিছু নয়। তাহলে এখন আপত্তি উঠছে কেন? বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করি।
প্রথাগত ধারণাটি হল, আঞ্চলিক বাংলা ততণ পর্যন্ত “বৈধ”, যতণ তা উদ্ধৃতি এবং বন্ধনীচিহ্নের মধ্যে থাকে। যেমন, সংলাপ আঞ্চলিক হতে পারে, যদি সেই সাহিত্য কোনো এক আঞ্চলিক জীবনযাত্রার আখ্যান হয়। কিন্তু কথকের বা বর্ণনাকারীর ভাষা হতে হবে অবশ্যই “মানভাষা”, যেহেতু তিনি সাহিত্যিক হিসাবে বাইডিফল্ট মধ্যবিত্ত। তিনি “শুদ্ধ” বাংলায় চাষাভুষার জীবন নিয়ে আলেখ্য রচনা করবেন, আর সততার খাতিরে চাষাভুষার মুখের ভাষা সেরকমই বহাল রাখবেন। তাতে আপত্তি নেই। আপত্তিটা তখনই বাঁধে যখন সাহিত্যের ন্যারেটর বা বর্ণনাকারীর ভাষা প্রমিত বাংলা থেকে বিচ্যুত হয়। এ যেন সাহিত্যিকের এবং সাহিত্য-বিচারকের কেন্দ্রীয় চরিত্র থেকে মধ্যবিত্তের আধিপত্যকে খারিজ করে দেওয়ার সামিল! সাহিত্যে আটপৌরে ভাষার ব্যবহার নিয়ে আপত্তির জায়গাটা, আমার ধারণা এখানেই।
বর্তমান পরিসরে এ নিয়ে বিস্তারিত বলবার সুযোগ নেই। ঐতিহাসিকভাবে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে কেন্দ্রে বিবেচনা করেই সাহিত্যের প্রতিষ্ঠান এবং নন্দনতত্ত্বের প্রতীকগুলো গড়ে ওঠেছে। এখন কোনো সাহিত্যিক যদি সেই নির্মাণকে মান্য না করেন, তবে আশংকার ঘণ্টি স্বাভাবিকভাবে প্রথমেই বাজবে সাহিত্যের প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কারণ তারাই মানদন্ডের রক এবং এর মাধ্যমে সহজেই তাদের আধিপত্য ধরে রাখা যায়। কিন্তু এটা আমরা ভাবি না যে প্রাতিষ্ঠানিক মধ্যবিত্ত ভাবনা আর সমাজে বিদ্যমান মধ্যবিত্ত ভাবধারা এক নয়। আবার এটাও হাস্যকরভাবে মনে করি যে, কেবল মধ্যবিত্তই চিরকাল অপরাপর শ্রেনীসমূহের পে শিল্পসাহিত্য করবে। কিন্তু ভাষা তো প্রবহমান ঘটনা, সে সমাজে বিদ্যমান শ্রেনীসমূহের মতাসম্পর্কের দর্পণও বটে। তাকে “প্রমিত” বাংলা নাম দিয়ে শতবর্ষ আগের কোনো সমঝোতার ঘেরাটোপে আটকানোর চেষ্টা অর্থহীন, কিভাবে অর্থহীন ফারুকী সেটা সংেেপ বলেছেন। আমার বলবার বিষয় হল, যে বিচারে আমরা সাহিত্যের চরিত্রগুলোর মুখে আঞ্চলিক ভাষাকে বৈধ ভাবি, সেই একই বিচারে বর্ণনাকারীর আঞ্চলিক ভাষাকেও বৈধ ভাবতে পারি। সাহিত্যিকের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি থেকে মধ্যবিত্তকে রেহাই দেয়ার দরকার কিছু আছে, কারণ মুষ্টিমেয় কিছু বাদে মধ্যবিত্তের একটি বিরাট অংশ কিন্তু সাবঅল্টার্ন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছে। বর্তমানের সাহিত্যিক মধ্যবিত্ত কিন্তু সেই উদ্বেগ থেকে বিকশিত হচ্ছে। ফলে, জীবনের প্রয়োজনে, হরহামেশাই তাকে প্রমিত বাংলার বাউন্ডারি টপকাতে হচ্ছে।
আরেকটা বিষয়, প্রমিত বাংলার সাথে শুধু যে উচ্চবিত্তের গ্লোবালাইজড ডিজুস বাংলা মিশছে তা নয়, মিশছে শাহআলম সরকার/মমতাজের “ফাইট্টা যায়” বাংলাও। একইভাবে, নিম্নবিত্তের বাংলায়ও গ্লোবালাইজেশনের প্রভাব পড়ছে এমন দেখতে পাই। এটাকে মিলনমেলা বা কুরুত্রে যাই বলুন, তা থেকে মধ্যবিত্তীয় প্রমিত দূরত্ব বজায় রাখা অসম্ভব, কার্যত সেটি প্রমিত বাংলাকে আরেকটা মৃতভাষায় পরিণত করার সামিল। বরঞ্চ এই নেয়াদেয়ার প্রক্রিয়ায়, শ্রেণীসমূহের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের এই প্রকাশ্য ও গোপন যুদ্ধে কোন্ শ্রেণীর ভাষা কিভাবে বদলাচ্ছে সেটা দেখার বিষয়। শিল্পসাহিত্য বা নাটক সেই যুদ্ধের ময়দান হতে প্রস্তুত, আর অন্যান্য “আনুষ্ঠানিক” প্রয়োজন মেটাবার জন্য না হয় প্রমিত বাংলাই থাকুক।
শনিবার, ১৬ আগস্ট, ২০০৮
শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০০৮
বুড়ো হাবড়া তুঁত
এর মধ্যে এক টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক আর ক্যামেরাম্যানকে দেখে ডাক্তার রীতিমত থ। এসব কেন, কে ইনি? ডাক্তার-নার্সরা জিজ্ঞাসু। এতিমের মত প্রায়-একা পড়ে থাকে যে কোমা-নিবাসী লোকটা, তার জন্য ক্যামেরা কেন? আজকাল ক্যামেরা কি সস্তা হয়ে গেল নাকি? একজন এসে সাংবাদিককে নিরস্ত করতে চেষ্টা করলেন। বললেন, এখানে ছবি তুলতে পারমিশন লাগবে। পারমিশন নিয়ে আসেন। সাংবাদিক পোড় কম খান নাই। তিনি ান্ত দেয়ার ভাব করলেন, কিন্তু ক্যামেরা তার আপন গতিতে চলল।
হঠাৎ করেই ডিউটি নার্স আমাদের সবাইকে বাইরে যেতে বললেন। মুস্তফা ভাইয়ের বেডের চারপাশে দ্রুত পর্দা টেনে দেয়া হল। হাসপাতাল তার সবচেয়ে প্রিয়তম অকুস্থল, লিখেছিলেন তিনি। কিন্তু এখন পর্দা কেন? পর্দা মানে তো যবনিকা! তখনো তো তার বুক উঠানামা করছে। স্পষ্ট দেখছি যে!
ঐ টা আর্টিফিসিয়্যাল, ডাক্তার এবার আরো ঠান্ডা। মেশিনের ইফেক্ট। কার্ডিয়্যাক ম্যাসেজ দেয়া হল এই মাত্র, ফলাফল শূন্য। ‘এক্সপায়ার’ করার পরও এই ম্যাসেজ দিয়ে অনেককেই ‘ফেরত’ এনেছেন, ডাক্তার জানালেন ঐশ্বরিক হাসিযোগে। প্রযুক্তি মানুষের দেখার ধরণকেও বদলে বুঝি এভাবে। নইলে এখন বুক উঠানামা-করা কবি মুস্তফা আনোয়ারকে কত না সহজে একটি মৃতদেহ বলে মানছি আমরা! মৃতের সংজ্ঞা পাল্টে যাচ্ছে, মৃত্যুর সংজ্ঞা পাল্টে যাচ্ছে!
আইসিইউ-তে মড়াকান্না বারণ। তাই ভাইয়ের শোক প্রকাশের জন্য প্রৌঢ় বোনকে ব্লকের বাইরে আসতে হল। তিনি বুকফাটা কাঁদলেন আয়শা ঝর্নার গলা-ধরে। একাই। কী সব যেন বলছিলেনও? আমি শুনতে চেষ্টা করি। বোঝা যাচ্ছে না, ভাঙা ভাঙা সব বাক্য। হয়তো তাদের পিঠাপিঠি শৈশবের ফ্রেজিং, যার ধ্বনিমূল্য আছে। হয়তো তাদের অর্থমূল্য ভাইয়ের মৃত্যুর সাথে সাথে চিরকালের জন্য হারাল। হয়তো এই ধ্বনিগুলোরও মৃত্যু ঘটবে আজ। মনে পড়ল, মুস্তফা আনোয়ার লিখেছিলেন, এতোদিন রসায়ন লেখাপড়া শিখলাম খামাখা, চল্লাম, বিদায়।
কদিন ধরে বিকাল হলেই আকাশ কাল হতে আরম্ভ করে। শামিমা বিনতে রহমান বলছিলেন, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। মেঘলা আকাশের জন্য হয়ত নয়, হয়ত এই মরণটুকুর নিউজমূল্য নিয়ে বার্তাপ্রধানের সাথে ফাইট দেয়ার জন্য! লাশ কোথায় যাবে? যশোরে? যশোরে কি তুঁতগাছ আছে? যার নিচে ‘দুই রফিকের’ জন্য অমেয় জলের ধারা খুলে দেবেন এই কবি? আমাদের এই চিরতরুণ নিভৃতিপ্রিয় বান্ধব?
নিচে নামতে নামতেই বৃষ্টি। বৃষ্টি টিপটিপ করে পড়ছে হাসপাতালে, ম্যানহোলে, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ আর স্যালাইন ব্যাগ যেখানে ফেলে দেয় সেই ডাস্টবিনে। লম্বা করিডোর দিয়ে এক রোগীকে চাকাওলা স্ট্রেচারে শুইয়ে ঠেলতে ঠেলতে লিফটে ঢোকাচ্ছে কয়েকজন। বৃষ্টি আর বাতাস মিলে হাসপাতালের মত নীরব আর দর্শনার্থীর মত উদ্বিগ্ন একটি দ্বৈততা। আমার খুব চায়ের ইচ্ছা পেল।
আলকাৎরার রাতে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকব কবে, এমনি-দিনে,
বৃষ্টিতে, আ! সে ঘরকাতর সিঁড়িপথ, অজগর লম্বা।
ওপরে, পিজি-র আইসিইউ-তে শেষ ঘুমে তলিয়ে গেছেন আমাদের প্রিয় কবি মুস্তফা আনোয়ার। জীবিতাবস্থায়, কী কবিতায় কী জীবনে, তরুণদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তিনি। সাহসী আর স্বত্বাভিমানশূন্য এই কবি তাঁর কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন আমাদের মত মাত্র বিশোর্ধ তরুণ কবিদের। চার দশকের কবিতাচর্চা দিয়েও যে নিভৃতিকে তিনি ভাঙেন নাই, একটি সাদামাটা মৃত্যুসংবাদ সম্বল করে আমি সেটা ভাঙার জন্য পত্রিকা অফিসে যাচ্ছি!
গরিবের বিনোদন
- আপনে গো টিভি-তে কি জি-সিনেমা আছে?
- আছে।
- স্টার প্লাস?
- স্টার প্লাস তো নাই!
- না থাকলে কেমনে চলে? স্টার প্লাসের সিরিয়াল না দেখলে আমার ঘুম আহে না।
শহুরে গরিবগোষ্ঠীর কাগুজে মতায়ন নিয়ে উচ্চ/মধ্যবিত্তের সমাজে নানান চুটকি চালু আছে। গার্মেন্টস শিল্পের প্রসারে সমাজ থেকে যেভাবে ‘কাজের বুয়া’ নামক শ্রেণীটি বিদায় নিচ্ছে, তা বিত্তবানের জন্য বেশ দুশ্চিন্তার। তাই, যারা গার্মেন্টস-মোহমায়ার চক্করে না গিয়ে এই প্রাচীন পেশায় বর্তমান আছেন, তারা পাণ্ডা প্রজাতি থেকে কিন্তু কোনো অংশে কম মহান নন। আর, বলা হয়, সেই মহত্বের পূর্ণ মূল্য আদায় করতেও সম তারা। ফলে, নিয়োগকর্তার টেলিভিশনে কী কী চিত্তাকর্ষক চ্যানেল আছে, সেইটা কখনও তাদের কর্মস্থল নির্বাচনের ক্রাইটেরিয়া হয়ে দাঁড়ায়। এরকম সম্ভাবনাকে চুটকি বানিয়ে খুব একচোট হাসেন তারা।
তারা আসলে হাসেন কী নিয়ে? স্পষ্টতই গরিবের বিনোদন-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। যেন ‘বিনোদন’ নামক কর্মকাণ্ডে বিত্তবানেরই একচ্ছত্র অধিকার! গরিব বিনোদন চাইলে তাদের হাসি পায়। বিত্তবানের বুয়াসংকট বা ডিমান্ড-সাপ্লাই পেজগির চক্করে গরিব তার বিনোদন আদায় করে নিচ্ছে, এটাই হাসির উপলক্ষ।
বিনোদন-বাজারে গরিব ঢুকল কিভাবে
বাংলাদেশে সত্তর দশক পর্যন্ত অডিওভিজুয়াল বিনোদনমাধ্যমগুলো মোটামুটি মধ্যবিত্তের এখতিয়ারে ছিল। যারা বিনোদনমাধ্যমে ‘রুচির পতন’ দেখতে পান তারা সেটা দেখতে শুরু করেন আশি দশকের গোড়া থেকে। তার আগে Ñ কী চলচ্চিত্র, কী সঙ্গীত, কী টেলিভিশনে দাপট ছিল মধ্যবিত্তের। মূলধারার ভিতরে থেকেই আলমগীর কবির ‘সূর্যকন্যা’ বা ‘সীমানা পেরিয়ে’র মত ছবি বানাচ্ছেন, অডিওতে ধুন্ধুমার বাজছে হেমন্ত, মান্না দে বা শ্যামল মিত্র। আর টেলিভিশনের পক্ষে একটা হার্ডঅয়্যার হিসাবেও তখন মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমের বাইরে আসা সম্ভব ছিল না।
অডিও বাণিজ্যে গরিবের পক্ষে প্রথম সত্যিকারের ব্রেক-থ্রু ঘটে সঙ্গীতশিল্পী মুজিব পরদেশী-র আবির্ভাবের সাথে সাথে। তার আগে, সত্তর দশকে ব্যান্ডগুরু আযম খান ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’ গেয়ে গেয়ে একটা পরিবেশ তৈরি করেন বটে, কিন্তু সেই গান যতটা না ‘গরিবের গান’ তার চেয়ে বেশি ছিল ‘গরিবের জন্য গান’। শ্রেণীদূরত্ব কম থাকায় জনপ্রিয়তা বাড়ল বটে, কিন্তু সেই গানের জন্য গরিবের কানের তৃষ্ণা তৈরি হল না সেভাবে। একইভাবে, ফকির আলমগীর যেসব গান গেয়েছেন তা শেষপর্যন্ত গণসঙ্গীতের মধ্যবিত্তপনা। নিম্নবর্গের মানুষের বিদ্রোহ নিয়ে মধ্যবিত্তের নিজস্ব কল্পনা এবং ভ্যালু জাজমেন্ট।
আশির গোড়াতেই মুজিব পরদেশী এসে গাইলেন ‘আমি বন্দী কারাগারে’। হামলে পড়ল গরিব, কান ভারি হয়ে উঠল মধ্যবিত্তের। এসব আবার কী ধরনের গান? কাদের জন্য? প্রথম প্রশ্নের উত্তর তাদের দরবারে হয়ত এখনও পৌঁছায় নাই, কিন্তু দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব মিলল চটজলদি: এসব হচ্ছে গরিবের গান।
গরিব তাহলে গানও শোনে? তাও ক্যাসেট কিনে পয়সা খরচ করে? ততদিনে মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাঠানো পয়সায় গ্রামে গ্রামে ক্যাসেট প্লেয়ার ছড়িয়ে পড়ছে। মুজিব পরদেশীর ‘কলঙ্কের ঢোল’ এর কাটতি হল রেকর্ড পরিমাণ। সেই প্রেরণায় রেকর্ড কোম্পানিগুলো গ্রামে-গ্রামে ঘোরা বয়াতিদের ধরে-ধরে ক্যাসেট বের করল বেশ কিছু। সেগুলোও মন্দ চলল না।
শহুরে শিক্ষিত শ্রেণী এটাকে একটা আকস্মিক ঘটনা হিসাবেই দেখল শুরুতে। তাদের কেউ কেউ শংকা প্রকাশ করলেন রুচির পতন বিষয়ে, কারো কারো কাছে মনে হল এটা কোনো মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর কীর্তি। এরকম একটা সিদ্ধান্তহীনতা যখন চলছে, মমতাজ তখন দৃশ্যপটে এলেন ভীরু ভীরু পায়ে। সেটা আশি দশকের শেষাশেষি।
মাত্র পাঁচ বছর ব্যবধানে বাংলাদেশের অডিও বাজারের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলেন মমতাজ। তার জন্য গান লিখতে থাকলেন আরেক বয়াতি শাহ আলম সরকার। এসব গানে চরিত্র হিসাবে আসতে থাকল শহরের অদৃশ্য আর বোবা জনগোষ্ঠী: গার্মেন্টস শ্রমিক, রিকশাওলা, বাস ড্রাইভার, বেওয়ারিশ লাশ ইত্যাদি। এসব গানে প্রেম মানে হল অতি অল্প সময়ের মধ্যে কিছু জরুরি বোঝাপড়া, বিরহ মানে হচ্ছে ছেড়ে-আসা গ্রামের প্রতি টান বোধ করা, মৃত্যু মানে হচ্ছে দাফনকাফন ছাড়া ভূগর্ভস্থ হওয়া, নৈঃশব্দ মানে হচ্ছে চোখের সামনে বড়লোকের দুর্নীতি দেখে দেখে মুখ বন্ধ রাখার চর্চা। তারা এসে পপুলার বাংলা গান থেকে প্রবল বিক্রমে হটিয়ে দিলেন সংখ্যালঘু শিক্ষিত বেকার, বিলাসী এবং বিরহী প্রেমিকদের। সর্বাধিক একক এলবামের গায়িকা হিসাবে মমতাজের নাম উঠল গিনেস বইতে। ‘বুকটা ফাইট্টা’ গেল শিক্ষিত মধ্যবিত্তের! তাকে ‘অশ্লীল’ আখ্যা দেয়া হল নানান তরফ থেকে, বলা হল এগুলো ‘অপসংস্কৃতি’ এবং ক্ষতিকারক।
কিন্তু ঠেকানো গেল না তাকে: মমতাজই হয়ে উঠলেন গরিবের বিনোদন-আইকন। তাকে ঘিরে আশপাশের পালাবদল আরো মজাদার। ক্যাসেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেক আর সঙ্গীতার দীর্ঘদিনের আধিপত্যে ভাগ বসাল সিলেট বেজড শাহজালাল রেকর্ডিং। নিম্নবর্গের উত্থানের তাত্ত্বিক কিংবা কর্পোরেট প্রেরণায় ব্যান্ড শিল্পী জেমসের কাঁধে গামছা ওঠল, মাকসুদ আর বিপ্লব জিনস ছেড়ে বাউলের আলখাল্লার ভেতর ঢুকে পড়লেন। তাদের এলবামের প্রমোশনালে এবং স্টেজ শো-তে গীটারের সমান মর্যাদা পেতে শুরু করল দোতারা। ড্রামের চেয়ে কখনও কখনও দেশী ঢোল দড় হয়ে ওঠল। বাজার ফিরে পাওয়ার আশায় অবশেষে মমতাজের সাথে ডুয়েট এলবাম করলেন অনেক নামীদামী শিল্পী। একসময় যেটা ‘পাপ’ ছিল, ক্রমে সেটাই হল পাপস্খালন।
যে গরিব এতকাল দূর থেকে তার মনিবের টেলিভিশন বা মিউজিক প্লেয়ারের নীরব অনাকাঙ্ক্ষিত গ্রাহক হয়ে ছিল, ক্রমে তারাই হয়ে দাঁড়াল এর রুচিনির্ধারক। বিত্তবানের নিন্দা কিংবা ভ্রুকুটি কোনোটাই আর এই প্রবাহের রাশ টেনে ধরতে পারল না। গরিবের মমতাজ-বন্যায় ভেসে গেলেন ছোটবড় অনেক জনপ্রিয় সঙ্গীত তারকা। সিনেমা হলের দখল গরিব সত্তর দশকেই নিয়েছিল, এখন দখল নিল অনেকটা টেলিভিশন আর প্রায় সবটা অডিও বাজারের। ‘রুচিশীল’ বিত্তবানের জন্য কেবল বাকি থাকল রাইফেলস স্কয়ার, বসুন্ধরা কিংবা আইডিবি ভবনের দুয়েকটা ডিভিডি-র দোকান। কিন্তু কতদিন?
গরিব এত বিনোদন চায় কেন
সায়দাবাদ ধলপুর সিটিপল্লী বস্তিতে অডিও-ভিডিওর পাঁচ-পাঁচটা চালু দোকান দেখে আমার মনে এই প্রশ্নের উদয় হল। কথা বললাম একজন দোকান-মালিকের সাথে। এর আগে তার দোকান ছিল মধ্যবিত্ত এলাকা মালিবাগে। সেখান থেকে গুটিয়ে তিনি এসেছেন এই বস্তিতে, শ্রেয়তর ব্যবসার আশায়। তার অ্যাডভেঞ্চার যে সফল, সেটা আকর্ণ হাসি থেকেই বেশ বোঝা যাচ্ছিল। একটা বস্তিতে পাঁচ-পাঁচটা অডিও-ভিডিওর দোকান, একটাও ব্যাংক নেই, এনজিও আছে দুতিনটা।
ব্যাংক নাই, কিন্তু ব্যাঙের ছাতার মত সঞ্চয়ী সমিতি আছে বস্তিতে। তারাও এনজিও, নানান হারে গরিবকে টাকা জমাতে উদ্ধুদ্ধ করে, তারপর এক সুন্দর সকালে সবাই ঘুম ভেঙে উঠে দ্যাখে, সমিতির সাইনবোর্ড উধাও। বস্তির খুব কম লোককেই দেখেছি যাদের জীবনে একবার এরকম দু-দশহাজার টাকা খোয়া যায় নাই। সাইনবোর্ড উধাও হয়, নতুন সাইনবোর্ড আসে, নতুন নতুন মুচলেকা সহ। কিন্তু যে লাউ সেই কদু-ই শেষপর্যন্ত।
বস্তির গরিব আসলে কতটা আয়গরিব? স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন নিয়ে একবার বস্তিতে কাজ করতে গিয়ে তাদের রোজগারের ডাটা নিতে হয়েছিল। দেখলাম, তাদের অনেকের রোজগার আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের চেয়ে বেশি। কিন্তু তবু তারা গরিব, নিম্নমধ্যবিত্তও নয়। কারণ, নিম্নমধ্যবিত্ত উত্থানরহিত নয়। তাদের সম্ভাবনা আছে স্বচ্ছল জীবনের, বস্তির গরিবের সেটা নাই। তাদের জন্য আছে এক কঠিন পাপচক্কর:
গরিবের বিনোদন মানে চিত্তবিনোদন কেন
‘বিনোদন’ -- এই শব্দটাকে যেভাবেই বলা হোক, গরিবের তাতে স্পষ্ট আপত্তি থাকে। এটা আমি ঢাকা শহরের প্রায় সব বস্তিতে দেখেছি। টেলিভিশন দেখাকে তাদের কাছে ‘বিনোদন’ মনে হলেও গানবাজনা শোনা-কে তারা কোনোভাবেই স্রেফ ‘বিনোদন’ হিসেবে ভাবে না। ভাবলে কী তি, আমি ভ্যানচালক মজিবুরকে জিজ্ঞেস করি। মজিবুর অল্পকথার মানুষ, কিছুটা নাটকীয়তা পছন্দ করে। আমাকে সে নিয়ে গেল ধলপুর বস্তি-লাগোয়া সরকারি সিটিপল্লী নামক তিনতলা ভবনের ছাদে। বলল, দেখেন তো, আমাদের বস্তিরে কী মনে অয়?
নয়ন খুলে গেল আমার। দেখলাম প্রত্যেকটা ঘরের চালের ওপর হয় লাল না-হয় সবুজ পতাকা।
মজিবুর বলল, লাল মানে মাইজভাণ্ডার আর নীল মানে সুরেশ্বর। বস্তিগুলোতে এই দুইটাই তরীকা। লাল হোক আর নীল হোক, গান দিয়াই আমরা আল্লারে ডাকি। আর কোনো রাস্তা নাই। প্রত্যেক বিষ্যুদবার বস্তিতে সুরেশ্বর তরীকাপন্থীদের গানের মজমা হয়। সারারাত গান হয়, জ্ঞান হওয়ার পর এই নিয়মের ব্যতিক্রম কেউ দেখে নাই বস্তিতে। এটাও একটা সাংগঠনিক প্রক্রিয়া, সমবায়ের ভিত্তিতে এর খরচনির্বাহ হয়। শহুরে বস্তিতে নেয়া নানান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ব্যর্থতাকে ভেংচি কাটার জন্যই কি এই গানের মজমা চালু আছে?
ভিক্ষা করে নদীভাঙা গুলবানু। বলল, বাপজান, আমাগো রক্তের মইধ্যে গান গো। আমাগো আর কিছুই নাই। খালি গানই আছে। অন্ধ কুদ্দুসও একই কথা বলল।
গান কেন স্রেফ ‘বিনোদন’ নয়? বড় ক্যানভাসে ভাবা যাক। শহরে গরিব আসে নিরুপায় হয়ে, ভাগ্যান্বেষণে। নদীভাঙা, ভিটাবেচা, সহায়শূন্য উন্মুল এই জনগোষ্ঠী। হাড়পেঁষা শ্রমের বিনিময়ে শহর তাদের খাদ্য দেয়, কোনোরকম থাকার সংস্থান দেয়। বিনিময়ে কেড়ে নেয় স্বাধীন প্রকাশভঙ্গি, বাকস্বাধীনতা এবং আরো কিছু মূল্যবোধ। এই শহরে যে রিকশা চালায়, তার মুখ দেখি না আমরা, শুধু পাছা দেখি। যে ভিা করে, তার হাত দেখি। এইরকম অদেখার চাপে তাদেরও মুখে মুখোশ চেপে বসে। তারা মধ্যবিত্তের দাপুটে মূল্যবোধের উপরিগ্রাহক হয়ে যায়। হঠাৎ করে তাদের দেখলে মনে হবে, তারা যেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বড় গ্রহীতা। মনে হবে, যেন নগরসভ্যতার অ্যালিয়েনেশন তাদের মজ্জাগত। মনে হবে, অসহায় অভিবাসনের কোনোই বেদনা নাই এইসব উন্মুল মানুষের চোখেমুখে। শহরের রুচি অনুযায়ী এমনি একটি শাদা মুখ পরে থাকে শহুরে গরিব।
অন্ধ কুদ্দুস যেমন বলে, দিনশেষে বস্তিতে যখন ফিরে আসে কর্মকান্ত মানুষ, তখন তার আয়নার সামনে দাঁড়ানো ফরজ হয়ে যায়। একমাত্র সঙ্গীত-ই পারে তার সারাদিনের মুখোশ খুলে তাকে নিজের অতীতের সামনে, সত্যিকারের বেদনাগুলোর সামনে দাঁড় করাতে। উদর কিংবা যৌনবিনোদন তাকে সেই বিশ্রামটুকু দেয় না। নিজের আবছা হতে-থাকা অস্তিত্ব, সেটা যত বেদনাময় হোক, তাকে হারাতে না দেয়াই গরিবের সবচেয়ে বড় বিনোদন। এবং প্রয়োজন। এজন্যেই গান। আর সে কারণেই গানকে তারা বিনোদন বলতে রাজী নন। এই গানই তাদের ধাঁধিয়ে যাওয়া চোখ থেকে মেট্রোপলিটান শহরের নিয়নবাতিগুলো খুলে নেয়। একচিলতে ঘরে কয়েক ঘণ্টার ঘুম ঘুমায় তারা, যদিও সেখানে দুঃস্বপ্নের ভেতর তাড়া করে আগুন আর বুলডোজার।
বস্তির আগুন ও 'দুর্ঘটনা'র মিথ
বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক বছর পূর্তির দিনটি আর কারো মনে না থাকলেও নিমতলী বালুর মাঠ বস্তির হতভাগ্য মানুষদের আজীবন মনে থাকবে। কারণ ঐ দিনটিতেই এক “রহস্যজনক” আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে গেছে এই বস্তির দুহাজার ঘর। পত্রপত্রিকায় সেই লতিয়ে-ওঠা ইনফার্নোর ছবি দেখতে দেখতে মনে পড়ল মাত্র কিছুদিন আগে এমনি এক আগুনে বেগুনবাড়ি বস্তির পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার কথা। মনে পড়ল: মহাখালি, কমলাপুর, মোহাম্মদপুরসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলো বস্তিতে একের পর এক আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে গত এক বছরে। বস্তিলোভী আগুনের কি অদ্ভূত ডিসিপ্লিনড ধারাবাহিকতা, এই সরকারের আমলে!
বস্তিতে আগুন লাগে কিভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজেই দেন অনেকে, চুলা থেকে! চুলার আগুন নাকি কাচা ঘরবাড়িতে নিমেষেই ছড়িয়ে পড়ে! আর আমাদের মাননীয় ফায়ার ব্রিগেডের মহান দমকল গাড়ি বস্তির চিপাগলিতে ঢোকার রাস্তা পায় না! এত এত প্রশিণ তাদের দেয়া হয়, কিন্তু বস্তিতে গিয়ে আগুন নেভানোর কোন প্রশিণ পান না তারা! অথচ কিছুদিন আগেও জীবনবাজি রেখে তাদের আমরা এনটিভি ভবনের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছি। আশ্চর্য লাগে, যেখানে ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক লোক (পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০০৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৩৭.৪%) বস্তিতে বসবাস করে, সেখানে বস্তিতে কাজ করার মত প্রস্তুতি ফায়ার ব্রিগেড-এর মত এমন একটা সংস্থার নেই!
তবে বস্তিতে আগুন নেভানোর জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নেয়ার কী দরকার, তারাও বলতে পারেন, যেখানে ঢাকা শহরের ৯৬ ভাগ বস্তিতে কোনোদিন নাকি আগুনই লাগেনি (সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের ২০০৫ এর মেজার ইভালুয়েশন)! চমকে ওঠার মত তথ্য, বিশেষত যারা পত্রিকা পড়েন বা আমার মত যারা দাতাসংস্থার শাদা ছাতা ছাড়াই বস্তিতে ঘোরাঘুরি করেন। মাত্র ৪ভাগ বস্তিতে যদি আগুন লাগার ঘটনা ঘটে থাকে, তবে এই সংখ্যা নিশ্চয়ই ঢাকা শহরের অন্যান্য জায়গায় (যথা অফিস আদালত, রাজপথ, বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন, উচ্চ/মধ্যবিত্ত আবাসন) আগুন লাগার ঘটনা থেকেও কম।
কিন্তু আসলে কি তাই? কড়াইল বস্তির আগুনের হলকা এখনো আমার গা থেকে বেরয়, নিমতলী বালুর মাঠ বস্তি এই নিয়ে তিনবার পুড়ল, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের বস্তি কিংবা বেগুনবাড়ি বস্তি তো আগুনে পুড়ে ছাই হয়েই গেছে। এভাবে বলতে থাকলে এক পৃষ্ঠা শুধু নিশ্চিহ্ন বস্তির নামই লিখতে হবে। জানতে ইচ্ছা হয়, সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের প্রতিবেদন কি পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বস্তিগুলোকে হিসাবে ধরেছে? পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বস্তির হিসাব কি রাখেন কেউ? সরকার, এনজিও, বা দাতাসংস্থা? তারা না লিখলে কারা লিখবেন সেসবের ইতিহাস?
বস্তি নিয়ে কাজ করার স্বল্প অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সব বস্তিই পোড়ে না। প্রথমত, যেসব বস্তি আকারে বড় এবং প্রকারে সংগঠিত, বুলডোজার ঢুকলে লোকজন একে প্রতিহত করতে দাঁড়িয়ে যায়, আগুন লাগে সেসবেই। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেকটি অগ্নিকাণ্ডের েেত্রই ফায়ার ব্রিগেড সময়মত অকুস্থলে পৌঁছাতে পারে না, কিংবা পেীঁছালেও কাজ করতে পারে না, আর কাজ করতে পারলেও বস্তির সবগুলো ঘর পুড়ে ছাই হওয়ার আগে আগুন নেভাতেও পারে না! তৃতীয়ত, বেশির ভাগ েেত্রই সরকারী সংস্থাগুলো এটাকে বলে “দুর্ঘটনা”, বস্তিবাসী বলে “নাশকতা”, আর পত্রপত্রিকা লেখে “রহস্যজনক”। লিখেই তারা খালাস, কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চোখে পড়েনি কখনও, বস্তির অগ্নিকাণ্ডের “রহস্যভেদ” করেন নি কেউ, না সাংবাদিক, না তদন্ত কমিটি। চতুর্থত, উচ্ছেদ করলে সরকার তবু পুনর্বাসনের আশ্বাস দেয়, আগুনে পোড়া মানুষের কপালে পুনর্বাসনের বিবৃতিও জোটে না। আমাদের আপামর বধিরতার সৌজন্যে এভাবেই তলিয়ে যায় তাদের দুর্বল গলার হাহাকার!
তৃতীয় বিশ্বে, বিশেষত ট্রপিক্যাল দেশগুলোতে পরিকল্পিত নগরায়ন আর পরিকল্পিত বস্তি উচ্ছেদ সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এর পেছনে মদদ আছে নব্য-উদারনৈতিক অর্থনীতির প্রবক্তা বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ-এর মত সংস্থার। বস্তিবাসী গরিব মানুষ নগর অর্থনীতিতে কি ভূমিকা রাখছে সেটা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তারা ঠেকাতে চায় অ-প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিকে। ফলে তাদের নানারকম ফর্মুলা। সরকারের ধরন অন্যরকম হলে এই ফর্মুলাগুলো ঘাড়ে চেপে বসে। এরকম দৃষ্টান্ত কম্পুচিয়া, কেনিয়া, থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ায় বিস্তর দেখা গেছে। সেসব দেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে যারা লিখেছেন, তাদের প্রায় সবাই একমত যে, বস্তি উচ্ছেদের সবচেয়ে নির্মম কিন্তু ধন্বন্তরী পদ্ধতি হল আগুন লাগিয়ে দেয়া। শারীরিকভাবে উচ্ছেদ করা হলে আপনি হয়ত সাততলা বস্তি থেকে সহায় সম্পদ নিয়ে খিলতে বস্তিতে গিয়ে উঠতে পারবেন, “পরিকল্পিত” নগরায়নের স্বার্থে আপনাকে আপনার ভুখা পেটসমেত শহরের বাইরে তো পাঠানো যাবে না! কিন্তু আগুনের শক্তি অনেক! সে শুধু আপনার ঘরই পোড়ায় না, কপালও পোড়ায়, সংগ্রাম করার দুর্মর ইচ্ছাকেও পুড়িয়ে দেয়। পোস্ট ট্রম্যাটিক ডিসঅর্ডার নিয়ে লেখা একটি নিবন্ধে দেখেছি কিভাবে, ঢাকা শহরের বস্তিপোড়া মানুষেরা এই রোগের শিকার হয়ে থাকেন। এভাবে, বছরের পর বছর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে জীবনকে যে কয়েক ইঞ্চি ওপরে তুলতে পেরেছিলেন আপনি, এক আগুনে ওখান থেকে আবার সেই পুরনো জায়গায়। কিংবা তার চেয়েও আরো গভীর তিমিরে। এই শহরের আগ্রাসী চাহিদাকে দু’দিন ঠেকিয়ে রেখে সংগ্রামে নামার মত সামর্থও বাকি থাকে না তখন। জয়তু, পরিকল্পিত নগরায়ন! লাগে রাহো, দুর্ঘটনার মিথ!
বলছিলাম, পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বস্তির ইতিহাস কোথায় লেখা হয়? সেই ইতিহাস লেখা হয় হতভাগ্য নগর গরিবের বোবা বেদনায়, তার ভাগ্যবদলের সংগ্রামে নিদারুণ পরাজয়ে, আর প্রফেসর ইউনুসের নির্মীয়মান জাদুঘরের দরজা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা দারিদ্র্যের ঠা ঠা অট্টহাসির মাঝে। সেই ইতিহাস আর এই পরিহাস সরকার ও তার উন্নয়ন সহযোগী এবং সামাজিক ব্যবসায়ীদের তুলার প্যাড-পরা কান পর্যন্ত পৌঁছাবে কবে?
বস্তিতে আগুন লাগে কিভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজেই দেন অনেকে, চুলা থেকে! চুলার আগুন নাকি কাচা ঘরবাড়িতে নিমেষেই ছড়িয়ে পড়ে! আর আমাদের মাননীয় ফায়ার ব্রিগেডের মহান দমকল গাড়ি বস্তির চিপাগলিতে ঢোকার রাস্তা পায় না! এত এত প্রশিণ তাদের দেয়া হয়, কিন্তু বস্তিতে গিয়ে আগুন নেভানোর কোন প্রশিণ পান না তারা! অথচ কিছুদিন আগেও জীবনবাজি রেখে তাদের আমরা এনটিভি ভবনের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছি। আশ্চর্য লাগে, যেখানে ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক লোক (পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০০৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৩৭.৪%) বস্তিতে বসবাস করে, সেখানে বস্তিতে কাজ করার মত প্রস্তুতি ফায়ার ব্রিগেড-এর মত এমন একটা সংস্থার নেই!
তবে বস্তিতে আগুন নেভানোর জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নেয়ার কী দরকার, তারাও বলতে পারেন, যেখানে ঢাকা শহরের ৯৬ ভাগ বস্তিতে কোনোদিন নাকি আগুনই লাগেনি (সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের ২০০৫ এর মেজার ইভালুয়েশন)! চমকে ওঠার মত তথ্য, বিশেষত যারা পত্রিকা পড়েন বা আমার মত যারা দাতাসংস্থার শাদা ছাতা ছাড়াই বস্তিতে ঘোরাঘুরি করেন। মাত্র ৪ভাগ বস্তিতে যদি আগুন লাগার ঘটনা ঘটে থাকে, তবে এই সংখ্যা নিশ্চয়ই ঢাকা শহরের অন্যান্য জায়গায় (যথা অফিস আদালত, রাজপথ, বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন, উচ্চ/মধ্যবিত্ত আবাসন) আগুন লাগার ঘটনা থেকেও কম।
কিন্তু আসলে কি তাই? কড়াইল বস্তির আগুনের হলকা এখনো আমার গা থেকে বেরয়, নিমতলী বালুর মাঠ বস্তি এই নিয়ে তিনবার পুড়ল, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের বস্তি কিংবা বেগুনবাড়ি বস্তি তো আগুনে পুড়ে ছাই হয়েই গেছে। এভাবে বলতে থাকলে এক পৃষ্ঠা শুধু নিশ্চিহ্ন বস্তির নামই লিখতে হবে। জানতে ইচ্ছা হয়, সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের প্রতিবেদন কি পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বস্তিগুলোকে হিসাবে ধরেছে? পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বস্তির হিসাব কি রাখেন কেউ? সরকার, এনজিও, বা দাতাসংস্থা? তারা না লিখলে কারা লিখবেন সেসবের ইতিহাস?
বস্তি নিয়ে কাজ করার স্বল্প অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সব বস্তিই পোড়ে না। প্রথমত, যেসব বস্তি আকারে বড় এবং প্রকারে সংগঠিত, বুলডোজার ঢুকলে লোকজন একে প্রতিহত করতে দাঁড়িয়ে যায়, আগুন লাগে সেসবেই। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেকটি অগ্নিকাণ্ডের েেত্রই ফায়ার ব্রিগেড সময়মত অকুস্থলে পৌঁছাতে পারে না, কিংবা পেীঁছালেও কাজ করতে পারে না, আর কাজ করতে পারলেও বস্তির সবগুলো ঘর পুড়ে ছাই হওয়ার আগে আগুন নেভাতেও পারে না! তৃতীয়ত, বেশির ভাগ েেত্রই সরকারী সংস্থাগুলো এটাকে বলে “দুর্ঘটনা”, বস্তিবাসী বলে “নাশকতা”, আর পত্রপত্রিকা লেখে “রহস্যজনক”। লিখেই তারা খালাস, কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চোখে পড়েনি কখনও, বস্তির অগ্নিকাণ্ডের “রহস্যভেদ” করেন নি কেউ, না সাংবাদিক, না তদন্ত কমিটি। চতুর্থত, উচ্ছেদ করলে সরকার তবু পুনর্বাসনের আশ্বাস দেয়, আগুনে পোড়া মানুষের কপালে পুনর্বাসনের বিবৃতিও জোটে না। আমাদের আপামর বধিরতার সৌজন্যে এভাবেই তলিয়ে যায় তাদের দুর্বল গলার হাহাকার!
তৃতীয় বিশ্বে, বিশেষত ট্রপিক্যাল দেশগুলোতে পরিকল্পিত নগরায়ন আর পরিকল্পিত বস্তি উচ্ছেদ সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এর পেছনে মদদ আছে নব্য-উদারনৈতিক অর্থনীতির প্রবক্তা বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ-এর মত সংস্থার। বস্তিবাসী গরিব মানুষ নগর অর্থনীতিতে কি ভূমিকা রাখছে সেটা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তারা ঠেকাতে চায় অ-প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিকে। ফলে তাদের নানারকম ফর্মুলা। সরকারের ধরন অন্যরকম হলে এই ফর্মুলাগুলো ঘাড়ে চেপে বসে। এরকম দৃষ্টান্ত কম্পুচিয়া, কেনিয়া, থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ায় বিস্তর দেখা গেছে। সেসব দেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে যারা লিখেছেন, তাদের প্রায় সবাই একমত যে, বস্তি উচ্ছেদের সবচেয়ে নির্মম কিন্তু ধন্বন্তরী পদ্ধতি হল আগুন লাগিয়ে দেয়া। শারীরিকভাবে উচ্ছেদ করা হলে আপনি হয়ত সাততলা বস্তি থেকে সহায় সম্পদ নিয়ে খিলতে বস্তিতে গিয়ে উঠতে পারবেন, “পরিকল্পিত” নগরায়নের স্বার্থে আপনাকে আপনার ভুখা পেটসমেত শহরের বাইরে তো পাঠানো যাবে না! কিন্তু আগুনের শক্তি অনেক! সে শুধু আপনার ঘরই পোড়ায় না, কপালও পোড়ায়, সংগ্রাম করার দুর্মর ইচ্ছাকেও পুড়িয়ে দেয়। পোস্ট ট্রম্যাটিক ডিসঅর্ডার নিয়ে লেখা একটি নিবন্ধে দেখেছি কিভাবে, ঢাকা শহরের বস্তিপোড়া মানুষেরা এই রোগের শিকার হয়ে থাকেন। এভাবে, বছরের পর বছর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে জীবনকে যে কয়েক ইঞ্চি ওপরে তুলতে পেরেছিলেন আপনি, এক আগুনে ওখান থেকে আবার সেই পুরনো জায়গায়। কিংবা তার চেয়েও আরো গভীর তিমিরে। এই শহরের আগ্রাসী চাহিদাকে দু’দিন ঠেকিয়ে রেখে সংগ্রামে নামার মত সামর্থও বাকি থাকে না তখন। জয়তু, পরিকল্পিত নগরায়ন! লাগে রাহো, দুর্ঘটনার মিথ!
বলছিলাম, পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বস্তির ইতিহাস কোথায় লেখা হয়? সেই ইতিহাস লেখা হয় হতভাগ্য নগর গরিবের বোবা বেদনায়, তার ভাগ্যবদলের সংগ্রামে নিদারুণ পরাজয়ে, আর প্রফেসর ইউনুসের নির্মীয়মান জাদুঘরের দরজা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা দারিদ্র্যের ঠা ঠা অট্টহাসির মাঝে। সেই ইতিহাস আর এই পরিহাস সরকার ও তার উন্নয়ন সহযোগী এবং সামাজিক ব্যবসায়ীদের তুলার প্যাড-পরা কান পর্যন্ত পৌঁছাবে কবে?
মাহমুদুল হক, প্রতিদিনের রুমাল ও চিরদিনের সাহিত্য
এক.
প্রয়াত হলেন আমাদের অন্যতম প্রধান কথাশিল্পী মাহমুদুল হক। বিরাশি সালের পর থেকে আর কিছুই লেখেন নি এই প্রতিভাধর লেখক, সেই অর্থে এটি তাঁর দ্বিতীয় প্রয়াণ। যাঁর প্রয়াণের ব্যথাটুকু আমরা গত দুদশক ধরেই আমাদের প্রতিদিনের জীবনে ও রুমালে বয়ন করে চলেছি, তাঁর শরীরী প্রস্থানের ফলে কেবল আমাদের এই অভ্যাসটুকুরই ইতি ঘটল। প্রশ্নটি কিন্তু রয়েই গেল: মাহমুদুল হক আমাদের কেমন আত্মীয়? প্রতিদিনের, নাকি চিরদিনের?
মাহমুদুল হকের পাঠক কিন্তু এই প্রশ্নের জবাবে কোনো পরিষ্কার পজিশন নেয় না। তাঁকে প্রতিদিনের হুমায়ুনের কাতারে রাখতে সে অপারগ, আবার চিরদিনের হাসান-ইলিয়াস চত্বরেও তাঁর আসন পেতে দিতে দোনোমনা সে। কোনো খাপেই যেন এই তলোয়ার ঢোকে না। সমস্যা কি তলোয়ারটির? নাকি আমাদের সাহিত্যরুচির?
লণীয়, মাহমুদুল হক আটটি উপন্যাস এবং কমপে এগারটি গল্প লিখেছেন তাঁর দুদশকের সাহিত্যজীবনে। তুলনায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস দুটি, এবং হাসান আজিজুল হক তো এই কিছুদিন হল উপন্যাস লেখায় হাত দিলেন। তবু তাঁর পাঠকের দাবি, অনেক কম লিখেছেন এই লেখক। আবার কোনো কোনো বোদ্ধা ভাবেন যে, বিশাল ক্যানভাসের বা মহৎ কোনো উপন্যাস লেখেন নি তিনি। ধন্দ লাগে, এ হেন প্রত্যাশার হেতু কী? যা লিখেছেন মাহমুদুল হক তা নিয়েই আমরা কেন সন্তুষ্ট হতে পারি না? সে কি আমরা তাঁর মাঝে অমিত সম্ভাবনা দেখেছিলাম বলে, নাকি তিনি আমাদের ক্যাটাগোরাইজেশনের নৌকাটিকে মাঝ নদীতে ছেড়ে গিয়েছেন বলে? টানাহেঁচড়া কিছু হয়েছে, হয়ত আরো হবে, কিন্তু তাতে বিশেষ ফল হয় নি। মাহমুদুল হক আসন পেতেছেন এমন একটি নো-ম্যানস ল্যান্ডে যা বিদ্যমান সাহিত্য সমালোচনাধারার জন্য অস্বস্তির।
মনে পড়ে হুয়ান রুলফো-র কথা: নাতিদীর্ঘ একটা উপন্যাস, আরেকটা উপন্যাসের প্রতিশ্রুতি আর গোটা তের-চৌদ্দখানা গল্পই তাঁর সারাজীবনের সাহিত্যকীর্তি। তা দিয়েই তাঁকে গোটা লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের পুরোধা মেনে নিতে কষ্ট হয় না। কাফকা যেমন। মার্কেজ বলেন যে, গোটা লাতিন আমেরিকান যাদুবাস্তব সাহিত্য কাফকার মেটামরফোসিস পাঠের ফলাফল। বোঝা যাচ্ছে যে, মহৎ সাহিত্য মানেই ইউলিসিস বা ওয়র এন্ড পীস নয়, চল্লিশ পৃষ্ঠার একটি মেটামরফোসিস থেকে জন্মাতে পারে একটি গোটা মহাদেশের সাহিত্য, যেমন একটি ছেঁড়াখোড়া ওভারকোট থেকে বেরুতে পারে গোটা রুশ সাহিত্য। “জাতির বৃহত্তর ইতিহাস” রচনার দায় সাহিত্য কেন নেবে? সাহসী সাহিত্যিক তার পাঠক-সমালোচকের প্রত্যাশায় চালিত হবেন, নাকি তিনি চলবেন তার আত্মার আদেশে? দায় চাপাতে চাইলে তিনি তো দেখি অবলীলায় বলেন “বরং নিজেই তুমি লেখ নাক’ একটি কবিতা”! এ কারণেই হয়ত মহৎ-এর নেশা আর বৃহৎ-এর পেশা মাহমুদুল হকের সাহিত্যে আমরা দেখি না। যারা মহৎ মহৎ ভাবাদর্শের বাটখারা এজেন্ডা আকারে নিজের সাহিত্য আর প্রত্যাশা আকারে অন্যের সাহিত্যের ওপর চাপান, তারা ভুলে যান সাহিত্য অনেক রকম। কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের সংজ্ঞা সে নিজেই তৈরি করে।
এই আলাপ থেকে পাঠক আশা করি এটা ধরে নেবেন না যে আমি সাহিত্যকে স্বয়ম্ভূ থাকতে বলছি বা বলছি অন্যান্য জ্ঞানকাণ্ডের সাথে যোগাযোগহীনতাই কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের লক্ষণ। যোগাযোগ নিশ্চয়ই থাকবে, তবে সাহিত্যের দরকার স্বায়ত্তশাসন। সে কেন ইতিহাসের দাসত্ব করবে, বা সমাজবিজ্ঞানের? নিজের পাটাতনে শক্তপায়ে দাঁড়িয়েই সাহিত্য অপরাপর জ্ঞানকাণ্ডের সাথে যোগাযোগ করুক। নিজের জানলা দিয়েই জগত দেখুক, সর্বোপরি। মাহমুদুল হকের সাহিত্য আমাদের মনোভূমির দিকে তেমনি একটি জানলা খুলে দেয়।
দুই.
ভাষাব্যবহার দিয়েও মাহমুদুল হক আমাদের সাহিত্যে স্বতন্ত্র হয়ে থাকবেন। অসামান্য ভাষাশিল্পী তিনি, শামসুর রাহমান লিখেছিলেন জীবন আমার বোন-এর ব্যাক কাভারে। কিন্তু তাঁর ভাষা কি নৈরাজ্যময়? আমার মনে হয় না। ভাষার নৈরাজ্য অন্য জিনিস। কাব্যধর্মী বর্ণনামাত্রই যুক্তিহীন নৈরাজ্যময় এটা ভাবা বাতুলতা। বাংলাভাষার বিদ্যমান যুক্তিশৃঙ্খলার বাইরে মাহমুদুল হক খুব হাঁটাচলা করেছেন এমন মনে হয় নি। বরং ছুরির মত ধারালো, চাবুকের মত নির্মেদ, আয়নার মত ঝকঝকে যে ভাষাটি মানিক-তারাশঙ্কর হয়ে পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের অন্বিষ্ট হয়ে উঠছিল, মাহমুদুল হক সেই স্রোতে গা ভাসান নি। ভাষাপ্রশ্নে তিনি হাঁটলেন উল্টোদিকে, কিছুটা রবীন্দ্র-বঙ্কিম হয়ে সংস্কৃত নন্দনকাননে। তাঁর বর্ণনা অসম্ভব কাব্যভণিতায় ভরা, হাওয়াই মিঠাই-এর মত ফোলানো ও মনোলোভা। তিনি জানতেন এই ফোলানোটুকুই সাহিত্য, বাদবাকিটুকু হয় নিজ নিজ সময়ের দাস, না হয় মরিচার খাদ্য। কথার যাদুকর তিনি, প্রগলভতাই তাঁর সাহিত্যের শক্তি। বকবকাইন। এই কাব্যভণিতার কারণেই আমরা ভেবে বসি তিনি এক ফুরফুরে পাঞ্জাবি-পরা সাহিত্যিক, জানলা খুলে যতটুকু জগত দেখা যায় তাইই দিলখোশ লিখে দিয়েছেন! কতটা বালখিল্য এই ধারণা, তা বোঝার জন্য মাত্র দুটো গল্পই যথেষ্ট: ‘বুড়ো ওবাদের জমাখরচ’ এবং ‘সপুরা ও পরাগল’। ভয়ংকর দুটো গল্প, পড়তে পড়তে ভাবি, তাঁর ভাষার কী দারুণ মতা, কী অবলীলায় এমনিতর নিষ্ঠুরতার পাতালে সিঁড়ি নামিয়ে দেয়! এখানেই মাহমুদুল হক আলাদা, গদ্যের ভাষাকে তিনি মুক্তি দিয়েছেন দলিলি প্ররোচনা থেকে, প্রত্যবাদ থেকে, নিজে আষ্টেপৃষ্ঠে লিপ্ত হয়ে পড়েন ভাষা, চরিত্র ও বিষয়বস্তুর সাথে, সাহিত্যিকের নির্মোহ দূরত্ব তিনি মানেন নি। এখন পর্যন্ত তিনিই আমাদের একমাত্র ঘুমে-হাঁটা মোহগ্রস্ত সাহিত্যিক। এই সাহিত্যের পাঠ তাঁর কাছ থেকে নেয়ার জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত? আমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
তিন.
পড়ছিলাম মাহমুদুল হকের একমাত্র গল্পগ্রন্থ প্রতিদিন একটি রুমাল। ঘটনাচক্রে সাহিত্যপাঠ আমার এবারের উদ্দেশ্য নয়, আমি মধ্য ষাট থেকে মধ্য সত্তর দশকের ঢাকাশহরের একটা চেহারা পেতে চাইছি তাঁর গল্প থেকে। প্রথমেই থমকালাম সপুরা ও পরাগল পাঠ করে। ১৯৬৪ সালে লেখা এই গল্প, যেখানে সপুরা এক নারী ভিক্ষুক যার পা নেই কিন্তু আছে “কলসীর কানা উপচানো ফেনার মতো স্বাস্থ্য” যা বিব্রত পথচারীর চোখে রঙ ধরায়। গল্পের কেন্দ্রীয় টেনশনটি ফ্রয়েডীয় যা বিস্তৃত সবুরা, পরাগল, মালগনি মিয়া ও মায়মুনা নামক চারটি চরিত্রের পারস্পরিক যৌন আচরণের মাঝে। আলাপের বিষয় এটা নয়, বরং এই টেনশনটি যে প্রেেিতর ওপর ছড়ানো তাকে খুলে দেখা যাক। গল্পের সময়কাল ষাট দশকের ঢাকা এবং প্রোপট ঢাকার ভিক্ষুক নেটওয়ার্ক। অবিশ্বাস্য এক চিত্র হাজির করেন মাহমুদুল হক ষাট দশকীয় ঢাকাই ভিক্ষাবৃত্তির। সেখানে মালগনি মিয়া এক ভিক্ষাব্যবসায়ী যে কিনা সপুরা, পরাগল মিয়ার মত আরো অনেক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকের সংগ্রাহক, ইম্প্রোভাইজার, নিয়ন্ত্রক ও আশ্রয়দাতা। এসব ভিুকের রোজগারের বেশির ভাগই চলে যায় মালগনি মিয়ার ট্যাকে। পরাগল মালগনির সহযোগী, নুলোভিখিরির পরিবহনের দায়িত্ব তার। আরো জানা যায় যে, ভিক্ষাবৃত্তির সুবিধার জন্য সপুরার পা কেটে ফেলে পরাগল, হাত মুচড়ে ভেঙে দেয় অন্য একটি কচি মেয়ের।
লণীয় যে, মালগনির আস্তানাটি কোনো বস্তিতে কি না সেটা গল্পে পরিষ্কার নয়। বরং মনে হয় এটা আলাদা কোনো জায়গা, পোড়োবাড়িমত, যেখানে ভিক্ষুকদের থাকার আবাস তৈরি করেছে মালগনি। অর্থাৎ তাদের বৃহত্তর সমাজ গড়ে ওঠেনি তখনো। এতদূর পর্যন্ত জিনিসটা সমাজবিজ্ঞানের জন্য স্বস্তিদায়ক, কারণ ষাট দশকের ঢাকা তখনো এমন ম্যাসিভ আকারে ‘সিটি অব স্লামস’ হয়ে ওঠে নি বলে সেও সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু ভিক্ষা ইন্ডাস্ট্রির যে চেহারা মাহমুদুল হক তুলে ধরেন, নিশ্চিত যে এটি সমাজ গবেষককে কিছু হলেও অপ্রতিভ করে দেবে। ঢাকাই ভিক্ষাবৃত্তির ওপর কোনো বড় ধরনের অনুসন্ধানী গবেষণা হয় নি, বস্তি-গবেষণার অংশ হিসেবে যতটুকু এসেছে সেটা ছাড়া। হালে সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকার ৩০ নভেম্বর ২০০৭ সংখ্যায় ‘কোটি টাকার ভিক্ষা ব্যবসা নেটওয়ার্ক’ নামে যে প্রতিবেদনটি রয়েছে মাহমুদুল হকের স্যা অনুযায়ী ষাট দশকের চিত্রটি তার চেয়ে বহুগুণে ভয়ানক। কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধু ভিক্ষুকদের নিয়ে একটি গবেষণাকর্ম করেছেন যেটির কথা তাঁর মুখে শুনেছি। কই, এত নারকীয় দশা তো তিনিও দেখেন নি এই কালে এসেও। তাহলে কি ভিুকদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে? নাকি সমাজবিজ্ঞানের পক্ষে সেই অতলে যাওয়া মুশকিল, যেখানে সাহিত্য পৌঁছায়?
এবার ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’ গল্পটির কথা ধরা যাক। ১৯৭৪ সালের ঢাকাকে নিয়ে গল্প। সেখানে আলতাফ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র যে কিনা ঢাকাশহরে মৌজমাস্তিমোটরকারমেয়েমানুষ করে বেড়ায়। তারও আনন্দ প্রদর্শনে, আর এর জন্য সে বেছে নেয় তার পুরনো বন্ধু মফস্বলের গোবেচারা কলেজ শিক সবুজকে। সবুজের তাড়না হল ঢাকায় বদলির, যেহেতু ওর স্ত্রী-সন্তান ঢাকায় বসবাস করে। ফলে এই নির্বিরোধী চরিত্রটিকে আলতাফের খেয়ালখুশির ঝড়ে বিপন্ন হতে হয়। মনে রাখতে হবে এটি স্বাধীনতা-উত্তর ঢাকা, কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী নয়। ঐ সময়ের যা ইতিহাস তাতে মাহমুদুল হক খোলাসা না করলেও আমরা আঁচ তরতে পারি আলতাফ চরিত্রটি কাদের রিপ্রেজেন্ট করে। তখন রীবাহিনীর যুগ, আবার গণবাহিনীরও যুগ, আওয়ামী সমাজতন্ত্রের ফিকে প্রতিশ্র“তির সামনে জাসদের তরুণ তুর্কিদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র! বৈশ্বিক মতাদ্বন্দ্বটির ছোট একটি রিহার্সাল ঘটানোর জন্য একটা খুব গোছানো পাপেট শো! এমতাবস্থায় আলতাফ চরিত্রটি যার কাছে বদলির তদবির করা যায় অর্থাৎ সে সরকারের কাছের লোক, আবার যে কিনা গলির মুখে ছেড়ে-আসা গাড়ি হাইজ্যাক হয়ে যায় কিনা সেই টেনশনেও থাকে, আবার স্রেফ ইতিবাচক ‘রেসপন্স’ না-পাওয়ায় রিকশারোহী এক অচেনা তরুণীকে গাড়িচাপা দিয়ে অবলীলায় সেই ঘটনাকে ফিলোসোফাইজ করে ফেলে। আলতাফ যেন শুধু তিয়াত্তরের ঢাকা নয়, গোটা সরকারব্যবস্থার প্রতীক হয়ে ফুটেছে এই গল্পে! গাড়িচাপা দিয়ে তরুণীকে খুন করার পর নির্ভার আলতাফ তার উদ্বিগ্ন ও বিপর্যস্ত বন্ধুকে উপদেশ দিচ্ছে, “ভুলে যাওয়ার মতা পর্বতপ্রমাণ হওয়া চাই।” সত্যিই তো! ভুলে যাওয়ার পর্বতপ্রমাণ মতারই প্রমাণ যেন আমরা দিয়েছি বাহাত্তর-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে। একদলীয় বাকশাল, প্রতিরোধের গণবাহিনী, রিলিফের কম্বলচুরি থেকে পঁচাত্তরের মুজিব হত্যাকাণ্ড সবই আমাদের ভুলে যাওয়ার অপরিসীম মতার স্মারক।
এই যে দুই দশকের দুরকম ঢাকার চেহারা আমরা দেখেছি মাহমুদুল হকের গল্পে, তাতে কি অতিরঞ্জন আছে খানিকটা? সমাজবিজ্ঞানী হয়ত বলবেন ’৬৪-র ঢাকাকে একটু বেশি যেন বীভৎস দেখায় ‘সপুরা ও পরাগল’ গল্পে, আবার ইতিহাসবিদ ভাবতে পারেন ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’ গল্পে তিয়াত্তরের যে ঢাকা তা যেন সামান্য বেশি নাটকীয়। এরকম ফয়সালা হলে সেটা তাদেরই, সাহিত্যিকের এই প্রশ্নের জবাব দেবার দায় নেই। দরকারও নেই। আমরাও চাই সাহিত্য অপরাপর জ্ঞানকাণ্ডগুলোকে আরো অনুসন্ধানী করে তুলুক। মাহমুদুল হকের ঢাকা আমার সামনে সে ধরনের পথ খুলে দেয়, দেখতে পাই।
চার.
শুরুর প্রসঙ্গে ফিরি। প্রতিদিনের সাহিত্যই রচনা করেছেন মাহমুদুল হক। সেটা করতে গিয়ে প্রতিদিনের কিশেগুলোকে তিনি তাঁর জাদুকরী ভাষার কারুকাজ দিয়ে রিপু করে দিয়েছেন। বড় একটি ক্যানভাসের এক কোনে তিনি তার ছবি এঁকেছেন, বাদবাকি ক্যানভাসে যা যা আছে বা থাকবে তার সুস্পষ্ট ইশারাসহ। ফলে বাকি ছবিটুকু আঁকার দায়িত্ব পাঠকের ওপর বর্তায়। দৃষ্টান্ত দিই: তাঁর প্রায় সব উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয় কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু সেই মুক্তিযুদ্ধ তাঁর উপন্যাসে সরাসরি নয়, বরং সবসময় কোন-না-কোন ভনিতার আড়ালে হাজির থাকে, হোক সেটা জীবন আমার বোন, কিংবা হোক সেটা খেলাঘর। এইই হল প্রতিদিনের দেখার ভঙ্গি।
আবার, প্রতিদিনের জীবন যতখানি ভাবাদর্শচালিত তারচে অনেক বেশি বৈপরীত্যময়, একঘেঁয়ে, পৌনঃপুনিক এবং অনাবশ্যক সব ডিটেইল-এ ভরা। তাকে সাহিত্যিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য যে অস্ত্রটি হাতে নিয়েছিলেন মাহমুদুল হক সেটি, আগেও বলেছি, তাঁর ভাষা। এই ভাষা নৈরাজ্যের নয়, এই ভাষা এর পাঠককে আক্রমণ করে না, কারণ নিজেই সে ঘোর-আক্রান্ত, ফেননিভ, উপশমমূলক। মাহমুদুল হক তাঁর সময়ের সেই বিরলতম লেখক যিনি জানতেন একমাত্র ভাষাব্যবহারের জাদুতেই পৃথিবী বারবার নবীনা হয়ে ওঠে। প্রতিদিন। চিরদিন।
প্রয়াত হলেন আমাদের অন্যতম প্রধান কথাশিল্পী মাহমুদুল হক। বিরাশি সালের পর থেকে আর কিছুই লেখেন নি এই প্রতিভাধর লেখক, সেই অর্থে এটি তাঁর দ্বিতীয় প্রয়াণ। যাঁর প্রয়াণের ব্যথাটুকু আমরা গত দুদশক ধরেই আমাদের প্রতিদিনের জীবনে ও রুমালে বয়ন করে চলেছি, তাঁর শরীরী প্রস্থানের ফলে কেবল আমাদের এই অভ্যাসটুকুরই ইতি ঘটল। প্রশ্নটি কিন্তু রয়েই গেল: মাহমুদুল হক আমাদের কেমন আত্মীয়? প্রতিদিনের, নাকি চিরদিনের?
মাহমুদুল হকের পাঠক কিন্তু এই প্রশ্নের জবাবে কোনো পরিষ্কার পজিশন নেয় না। তাঁকে প্রতিদিনের হুমায়ুনের কাতারে রাখতে সে অপারগ, আবার চিরদিনের হাসান-ইলিয়াস চত্বরেও তাঁর আসন পেতে দিতে দোনোমনা সে। কোনো খাপেই যেন এই তলোয়ার ঢোকে না। সমস্যা কি তলোয়ারটির? নাকি আমাদের সাহিত্যরুচির?
লণীয়, মাহমুদুল হক আটটি উপন্যাস এবং কমপে এগারটি গল্প লিখেছেন তাঁর দুদশকের সাহিত্যজীবনে। তুলনায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস দুটি, এবং হাসান আজিজুল হক তো এই কিছুদিন হল উপন্যাস লেখায় হাত দিলেন। তবু তাঁর পাঠকের দাবি, অনেক কম লিখেছেন এই লেখক। আবার কোনো কোনো বোদ্ধা ভাবেন যে, বিশাল ক্যানভাসের বা মহৎ কোনো উপন্যাস লেখেন নি তিনি। ধন্দ লাগে, এ হেন প্রত্যাশার হেতু কী? যা লিখেছেন মাহমুদুল হক তা নিয়েই আমরা কেন সন্তুষ্ট হতে পারি না? সে কি আমরা তাঁর মাঝে অমিত সম্ভাবনা দেখেছিলাম বলে, নাকি তিনি আমাদের ক্যাটাগোরাইজেশনের নৌকাটিকে মাঝ নদীতে ছেড়ে গিয়েছেন বলে? টানাহেঁচড়া কিছু হয়েছে, হয়ত আরো হবে, কিন্তু তাতে বিশেষ ফল হয় নি। মাহমুদুল হক আসন পেতেছেন এমন একটি নো-ম্যানস ল্যান্ডে যা বিদ্যমান সাহিত্য সমালোচনাধারার জন্য অস্বস্তির।
মনে পড়ে হুয়ান রুলফো-র কথা: নাতিদীর্ঘ একটা উপন্যাস, আরেকটা উপন্যাসের প্রতিশ্রুতি আর গোটা তের-চৌদ্দখানা গল্পই তাঁর সারাজীবনের সাহিত্যকীর্তি। তা দিয়েই তাঁকে গোটা লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের পুরোধা মেনে নিতে কষ্ট হয় না। কাফকা যেমন। মার্কেজ বলেন যে, গোটা লাতিন আমেরিকান যাদুবাস্তব সাহিত্য কাফকার মেটামরফোসিস পাঠের ফলাফল। বোঝা যাচ্ছে যে, মহৎ সাহিত্য মানেই ইউলিসিস বা ওয়র এন্ড পীস নয়, চল্লিশ পৃষ্ঠার একটি মেটামরফোসিস থেকে জন্মাতে পারে একটি গোটা মহাদেশের সাহিত্য, যেমন একটি ছেঁড়াখোড়া ওভারকোট থেকে বেরুতে পারে গোটা রুশ সাহিত্য। “জাতির বৃহত্তর ইতিহাস” রচনার দায় সাহিত্য কেন নেবে? সাহসী সাহিত্যিক তার পাঠক-সমালোচকের প্রত্যাশায় চালিত হবেন, নাকি তিনি চলবেন তার আত্মার আদেশে? দায় চাপাতে চাইলে তিনি তো দেখি অবলীলায় বলেন “বরং নিজেই তুমি লেখ নাক’ একটি কবিতা”! এ কারণেই হয়ত মহৎ-এর নেশা আর বৃহৎ-এর পেশা মাহমুদুল হকের সাহিত্যে আমরা দেখি না। যারা মহৎ মহৎ ভাবাদর্শের বাটখারা এজেন্ডা আকারে নিজের সাহিত্য আর প্রত্যাশা আকারে অন্যের সাহিত্যের ওপর চাপান, তারা ভুলে যান সাহিত্য অনেক রকম। কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের সংজ্ঞা সে নিজেই তৈরি করে।
এই আলাপ থেকে পাঠক আশা করি এটা ধরে নেবেন না যে আমি সাহিত্যকে স্বয়ম্ভূ থাকতে বলছি বা বলছি অন্যান্য জ্ঞানকাণ্ডের সাথে যোগাযোগহীনতাই কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের লক্ষণ। যোগাযোগ নিশ্চয়ই থাকবে, তবে সাহিত্যের দরকার স্বায়ত্তশাসন। সে কেন ইতিহাসের দাসত্ব করবে, বা সমাজবিজ্ঞানের? নিজের পাটাতনে শক্তপায়ে দাঁড়িয়েই সাহিত্য অপরাপর জ্ঞানকাণ্ডের সাথে যোগাযোগ করুক। নিজের জানলা দিয়েই জগত দেখুক, সর্বোপরি। মাহমুদুল হকের সাহিত্য আমাদের মনোভূমির দিকে তেমনি একটি জানলা খুলে দেয়।
দুই.
ভাষাব্যবহার দিয়েও মাহমুদুল হক আমাদের সাহিত্যে স্বতন্ত্র হয়ে থাকবেন। অসামান্য ভাষাশিল্পী তিনি, শামসুর রাহমান লিখেছিলেন জীবন আমার বোন-এর ব্যাক কাভারে। কিন্তু তাঁর ভাষা কি নৈরাজ্যময়? আমার মনে হয় না। ভাষার নৈরাজ্য অন্য জিনিস। কাব্যধর্মী বর্ণনামাত্রই যুক্তিহীন নৈরাজ্যময় এটা ভাবা বাতুলতা। বাংলাভাষার বিদ্যমান যুক্তিশৃঙ্খলার বাইরে মাহমুদুল হক খুব হাঁটাচলা করেছেন এমন মনে হয় নি। বরং ছুরির মত ধারালো, চাবুকের মত নির্মেদ, আয়নার মত ঝকঝকে যে ভাষাটি মানিক-তারাশঙ্কর হয়ে পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের অন্বিষ্ট হয়ে উঠছিল, মাহমুদুল হক সেই স্রোতে গা ভাসান নি। ভাষাপ্রশ্নে তিনি হাঁটলেন উল্টোদিকে, কিছুটা রবীন্দ্র-বঙ্কিম হয়ে সংস্কৃত নন্দনকাননে। তাঁর বর্ণনা অসম্ভব কাব্যভণিতায় ভরা, হাওয়াই মিঠাই-এর মত ফোলানো ও মনোলোভা। তিনি জানতেন এই ফোলানোটুকুই সাহিত্য, বাদবাকিটুকু হয় নিজ নিজ সময়ের দাস, না হয় মরিচার খাদ্য। কথার যাদুকর তিনি, প্রগলভতাই তাঁর সাহিত্যের শক্তি। বকবকাইন। এই কাব্যভণিতার কারণেই আমরা ভেবে বসি তিনি এক ফুরফুরে পাঞ্জাবি-পরা সাহিত্যিক, জানলা খুলে যতটুকু জগত দেখা যায় তাইই দিলখোশ লিখে দিয়েছেন! কতটা বালখিল্য এই ধারণা, তা বোঝার জন্য মাত্র দুটো গল্পই যথেষ্ট: ‘বুড়ো ওবাদের জমাখরচ’ এবং ‘সপুরা ও পরাগল’। ভয়ংকর দুটো গল্প, পড়তে পড়তে ভাবি, তাঁর ভাষার কী দারুণ মতা, কী অবলীলায় এমনিতর নিষ্ঠুরতার পাতালে সিঁড়ি নামিয়ে দেয়! এখানেই মাহমুদুল হক আলাদা, গদ্যের ভাষাকে তিনি মুক্তি দিয়েছেন দলিলি প্ররোচনা থেকে, প্রত্যবাদ থেকে, নিজে আষ্টেপৃষ্ঠে লিপ্ত হয়ে পড়েন ভাষা, চরিত্র ও বিষয়বস্তুর সাথে, সাহিত্যিকের নির্মোহ দূরত্ব তিনি মানেন নি। এখন পর্যন্ত তিনিই আমাদের একমাত্র ঘুমে-হাঁটা মোহগ্রস্ত সাহিত্যিক। এই সাহিত্যের পাঠ তাঁর কাছ থেকে নেয়ার জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত? আমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
তিন.
পড়ছিলাম মাহমুদুল হকের একমাত্র গল্পগ্রন্থ প্রতিদিন একটি রুমাল। ঘটনাচক্রে সাহিত্যপাঠ আমার এবারের উদ্দেশ্য নয়, আমি মধ্য ষাট থেকে মধ্য সত্তর দশকের ঢাকাশহরের একটা চেহারা পেতে চাইছি তাঁর গল্প থেকে। প্রথমেই থমকালাম সপুরা ও পরাগল পাঠ করে। ১৯৬৪ সালে লেখা এই গল্প, যেখানে সপুরা এক নারী ভিক্ষুক যার পা নেই কিন্তু আছে “কলসীর কানা উপচানো ফেনার মতো স্বাস্থ্য” যা বিব্রত পথচারীর চোখে রঙ ধরায়। গল্পের কেন্দ্রীয় টেনশনটি ফ্রয়েডীয় যা বিস্তৃত সবুরা, পরাগল, মালগনি মিয়া ও মায়মুনা নামক চারটি চরিত্রের পারস্পরিক যৌন আচরণের মাঝে। আলাপের বিষয় এটা নয়, বরং এই টেনশনটি যে প্রেেিতর ওপর ছড়ানো তাকে খুলে দেখা যাক। গল্পের সময়কাল ষাট দশকের ঢাকা এবং প্রোপট ঢাকার ভিক্ষুক নেটওয়ার্ক। অবিশ্বাস্য এক চিত্র হাজির করেন মাহমুদুল হক ষাট দশকীয় ঢাকাই ভিক্ষাবৃত্তির। সেখানে মালগনি মিয়া এক ভিক্ষাব্যবসায়ী যে কিনা সপুরা, পরাগল মিয়ার মত আরো অনেক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকের সংগ্রাহক, ইম্প্রোভাইজার, নিয়ন্ত্রক ও আশ্রয়দাতা। এসব ভিুকের রোজগারের বেশির ভাগই চলে যায় মালগনি মিয়ার ট্যাকে। পরাগল মালগনির সহযোগী, নুলোভিখিরির পরিবহনের দায়িত্ব তার। আরো জানা যায় যে, ভিক্ষাবৃত্তির সুবিধার জন্য সপুরার পা কেটে ফেলে পরাগল, হাত মুচড়ে ভেঙে দেয় অন্য একটি কচি মেয়ের।
লণীয় যে, মালগনির আস্তানাটি কোনো বস্তিতে কি না সেটা গল্পে পরিষ্কার নয়। বরং মনে হয় এটা আলাদা কোনো জায়গা, পোড়োবাড়িমত, যেখানে ভিক্ষুকদের থাকার আবাস তৈরি করেছে মালগনি। অর্থাৎ তাদের বৃহত্তর সমাজ গড়ে ওঠেনি তখনো। এতদূর পর্যন্ত জিনিসটা সমাজবিজ্ঞানের জন্য স্বস্তিদায়ক, কারণ ষাট দশকের ঢাকা তখনো এমন ম্যাসিভ আকারে ‘সিটি অব স্লামস’ হয়ে ওঠে নি বলে সেও সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু ভিক্ষা ইন্ডাস্ট্রির যে চেহারা মাহমুদুল হক তুলে ধরেন, নিশ্চিত যে এটি সমাজ গবেষককে কিছু হলেও অপ্রতিভ করে দেবে। ঢাকাই ভিক্ষাবৃত্তির ওপর কোনো বড় ধরনের অনুসন্ধানী গবেষণা হয় নি, বস্তি-গবেষণার অংশ হিসেবে যতটুকু এসেছে সেটা ছাড়া। হালে সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকার ৩০ নভেম্বর ২০০৭ সংখ্যায় ‘কোটি টাকার ভিক্ষা ব্যবসা নেটওয়ার্ক’ নামে যে প্রতিবেদনটি রয়েছে মাহমুদুল হকের স্যা অনুযায়ী ষাট দশকের চিত্রটি তার চেয়ে বহুগুণে ভয়ানক। কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধু ভিক্ষুকদের নিয়ে একটি গবেষণাকর্ম করেছেন যেটির কথা তাঁর মুখে শুনেছি। কই, এত নারকীয় দশা তো তিনিও দেখেন নি এই কালে এসেও। তাহলে কি ভিুকদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে? নাকি সমাজবিজ্ঞানের পক্ষে সেই অতলে যাওয়া মুশকিল, যেখানে সাহিত্য পৌঁছায়?
এবার ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’ গল্পটির কথা ধরা যাক। ১৯৭৪ সালের ঢাকাকে নিয়ে গল্প। সেখানে আলতাফ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র যে কিনা ঢাকাশহরে মৌজমাস্তিমোটরকারমেয়েমানুষ করে বেড়ায়। তারও আনন্দ প্রদর্শনে, আর এর জন্য সে বেছে নেয় তার পুরনো বন্ধু মফস্বলের গোবেচারা কলেজ শিক সবুজকে। সবুজের তাড়না হল ঢাকায় বদলির, যেহেতু ওর স্ত্রী-সন্তান ঢাকায় বসবাস করে। ফলে এই নির্বিরোধী চরিত্রটিকে আলতাফের খেয়ালখুশির ঝড়ে বিপন্ন হতে হয়। মনে রাখতে হবে এটি স্বাধীনতা-উত্তর ঢাকা, কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী নয়। ঐ সময়ের যা ইতিহাস তাতে মাহমুদুল হক খোলাসা না করলেও আমরা আঁচ তরতে পারি আলতাফ চরিত্রটি কাদের রিপ্রেজেন্ট করে। তখন রীবাহিনীর যুগ, আবার গণবাহিনীরও যুগ, আওয়ামী সমাজতন্ত্রের ফিকে প্রতিশ্র“তির সামনে জাসদের তরুণ তুর্কিদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র! বৈশ্বিক মতাদ্বন্দ্বটির ছোট একটি রিহার্সাল ঘটানোর জন্য একটা খুব গোছানো পাপেট শো! এমতাবস্থায় আলতাফ চরিত্রটি যার কাছে বদলির তদবির করা যায় অর্থাৎ সে সরকারের কাছের লোক, আবার যে কিনা গলির মুখে ছেড়ে-আসা গাড়ি হাইজ্যাক হয়ে যায় কিনা সেই টেনশনেও থাকে, আবার স্রেফ ইতিবাচক ‘রেসপন্স’ না-পাওয়ায় রিকশারোহী এক অচেনা তরুণীকে গাড়িচাপা দিয়ে অবলীলায় সেই ঘটনাকে ফিলোসোফাইজ করে ফেলে। আলতাফ যেন শুধু তিয়াত্তরের ঢাকা নয়, গোটা সরকারব্যবস্থার প্রতীক হয়ে ফুটেছে এই গল্পে! গাড়িচাপা দিয়ে তরুণীকে খুন করার পর নির্ভার আলতাফ তার উদ্বিগ্ন ও বিপর্যস্ত বন্ধুকে উপদেশ দিচ্ছে, “ভুলে যাওয়ার মতা পর্বতপ্রমাণ হওয়া চাই।” সত্যিই তো! ভুলে যাওয়ার পর্বতপ্রমাণ মতারই প্রমাণ যেন আমরা দিয়েছি বাহাত্তর-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে। একদলীয় বাকশাল, প্রতিরোধের গণবাহিনী, রিলিফের কম্বলচুরি থেকে পঁচাত্তরের মুজিব হত্যাকাণ্ড সবই আমাদের ভুলে যাওয়ার অপরিসীম মতার স্মারক।
এই যে দুই দশকের দুরকম ঢাকার চেহারা আমরা দেখেছি মাহমুদুল হকের গল্পে, তাতে কি অতিরঞ্জন আছে খানিকটা? সমাজবিজ্ঞানী হয়ত বলবেন ’৬৪-র ঢাকাকে একটু বেশি যেন বীভৎস দেখায় ‘সপুরা ও পরাগল’ গল্পে, আবার ইতিহাসবিদ ভাবতে পারেন ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’ গল্পে তিয়াত্তরের যে ঢাকা তা যেন সামান্য বেশি নাটকীয়। এরকম ফয়সালা হলে সেটা তাদেরই, সাহিত্যিকের এই প্রশ্নের জবাব দেবার দায় নেই। দরকারও নেই। আমরাও চাই সাহিত্য অপরাপর জ্ঞানকাণ্ডগুলোকে আরো অনুসন্ধানী করে তুলুক। মাহমুদুল হকের ঢাকা আমার সামনে সে ধরনের পথ খুলে দেয়, দেখতে পাই।
চার.
শুরুর প্রসঙ্গে ফিরি। প্রতিদিনের সাহিত্যই রচনা করেছেন মাহমুদুল হক। সেটা করতে গিয়ে প্রতিদিনের কিশেগুলোকে তিনি তাঁর জাদুকরী ভাষার কারুকাজ দিয়ে রিপু করে দিয়েছেন। বড় একটি ক্যানভাসের এক কোনে তিনি তার ছবি এঁকেছেন, বাদবাকি ক্যানভাসে যা যা আছে বা থাকবে তার সুস্পষ্ট ইশারাসহ। ফলে বাকি ছবিটুকু আঁকার দায়িত্ব পাঠকের ওপর বর্তায়। দৃষ্টান্ত দিই: তাঁর প্রায় সব উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয় কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু সেই মুক্তিযুদ্ধ তাঁর উপন্যাসে সরাসরি নয়, বরং সবসময় কোন-না-কোন ভনিতার আড়ালে হাজির থাকে, হোক সেটা জীবন আমার বোন, কিংবা হোক সেটা খেলাঘর। এইই হল প্রতিদিনের দেখার ভঙ্গি।
আবার, প্রতিদিনের জীবন যতখানি ভাবাদর্শচালিত তারচে অনেক বেশি বৈপরীত্যময়, একঘেঁয়ে, পৌনঃপুনিক এবং অনাবশ্যক সব ডিটেইল-এ ভরা। তাকে সাহিত্যিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য যে অস্ত্রটি হাতে নিয়েছিলেন মাহমুদুল হক সেটি, আগেও বলেছি, তাঁর ভাষা। এই ভাষা নৈরাজ্যের নয়, এই ভাষা এর পাঠককে আক্রমণ করে না, কারণ নিজেই সে ঘোর-আক্রান্ত, ফেননিভ, উপশমমূলক। মাহমুদুল হক তাঁর সময়ের সেই বিরলতম লেখক যিনি জানতেন একমাত্র ভাষাব্যবহারের জাদুতেই পৃথিবী বারবার নবীনা হয়ে ওঠে। প্রতিদিন। চিরদিন।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)