বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

কখনো যাই নাই বিদ্যাকূট

চোখের সামনে পুড়ছে আমার মনসুন্দর গ্রাম
আমি যাই নাই রে, আমি যাই নাই

- কফিল আহমেদের গান

১.
কখনো যাই নাই বিদ্যাকূট!

উরখুলিয়া গেছি, বিদ্যাকূটের পাশের গ্রাম। এক সন্ধ্যার কথা মনে আছে, উরখুলিয়ার গ্রামছাড়া জোতদার রেজেক মিয়ার পোড়োবাড়িটা দেখতে গেছিলাম। বিশাল বাড়ি, সারি সারি টিনের চৌচালা ঘর, সেসব ঘরে কেউ নাই তখন, জিনিসপত্র সব টুকরা টুকরা করে ভাঙ্গা, টিনের প্রতিটা ঢেউ-য়ে দায়ের নিপুণ কোপ। উঠানের মাঝখানে ছোটখাট একটা পাহাড়, ভাঙ্গা সিরামিকের জিনিসপত্রের ।

উরখুলিয়া একটা অদ্ভূত মাথাগরম জায়গা। তিতাসের পাড় ধরে লম্বালম্বি একটা গ্রাম, ঠিক চিলি দেশটার স্টাইলে। গ্রামের অর্ধেক লোক থাকে ইটালি। তারা টাকা পাঠায়, আর সেই টাকায় দুই গোষ্ঠীর শতবছরের পুরানো ঝগড়াটা ফি বছর ঝালাই হয়।

ঝগড়ার উপলক্ষ?

শুনলে হাসবে উরখুলিয়ার লোকেরা। উপলক্ষ নো প্রবলেম, জিয়াউর রহমান স্টাইলে। কোনো উপলক্ষ পাওয়া যাইতেছেনা, ঠিকাছে, ঐ যে জালাইল্যা আছে না, জ্ঞাতিগোষ্ঠী নাই, এতিম পোলা, ঘরে মা একলা, ওরে ফালায়া দাও! তারপর কেইস নিয়া সোজা নবীনগর থানায়।

জালাইল্যাকে আমি চিনতাম। এক পা খোঁড়া, কিন্তু কাইজ্যার আগে সবসময়। ভ্যানগার্ড।

জালাইল্যার খুনের এই পরিকল্পনা কিন্তু প্রতিপক্ষের নয়, তার স্বপক্ষেরই। আবার এই স্বপক্ষের কোনো উপদলীয় কোন্দলের ফসল নয় এই সিদ্ধান্ত। যারা এই নীলনকশা করেছে তারা সবাই জালাইল্যার সমঝদার। কিন্তু কি করা? দুইশ বছরের পুরনো 'বাইশাবাইশি', অনেক রক্ত খায়! তার তৃষ্ণা মিটাতে গেলে নিজের পরের বাছাবাছি করনের সুযোগ কমই থাকে।

যারা জালাইল্যারে ফালাইয়া দিল, তারাই গায়ের কাপড় বদলায়া নবীনগর থানায় গিয়া ফৌজদারি মামলা ঠুকল। তারপর বাজার করল, টর্চলাইটের জন্য দোকান ঘুইরা একনম্বর সানলাইট ব্যাটারি কিনল, জালাইল্যার মায়ের জন্য নতুন জায়নামাজ ও তসবি কিনল, তারপর বাড়ি ফিরবার আগে হাউজির মাঠেও দুইচক্কর দিল।

আর যারা ঘুম থেকে উঠে শুনল তারা খুনের মামলার আসামি, তাদের হৈয়া অবাক হৈলেন বিধাতা। তারাও ঘরের কালার টেলিভিশন, অষ্ট্রেলিয়ান গাভী, ডেকসেট ও ক্যামেরা পাশের গ্রামের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে পাঠায়া দিল, ঘরের মেয়েমানুষের হাতে দরকারি টাকাপয়সা গুঁজল, তারপর সোজা লঞ্চে হয় ভৈরব না হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

সেই উরখুলিয়ার পাশের গ্রামই বিদ্যাকূট। আমি উত্তপ্ত উরখুলিয়ায় বসে বসে বিদ্যাকূট নিয়া ঈর্ষায় জ্বলতাম। বিদ্যাকূটে কোনো পুলিশ ক্যাম্প লাগে না, সেই গ্রাম থেকে শরনার্থী আসে নাই কোনো দিন এই উরখুলিয়ায়। দূর থেকে দেখেছি, অদ্ভূত একটা গ্রাম, খড়ের গাদায় রোদের ঝিলিক লেগে এখান থেকেও আমার চোখ চিকচিক করে।

কবে যাবো বিদ্যাকূট, ভাবতাম পুরুষশূন্য উরখুলিয়া গ্রামে হাঁটতে হাঁটতে।

ফরহাদ মজহার-এর সাম্প্রতিক কবিতা প্রসঙ্গে


বয়স বিচারে ফরহাদ মজহার কবিতা সঞ্চালনে সবচে বয়োজ্যেষ্ঠ কবি। বাঙালি কবিদের বয়োজ্যেষ্ঠতাকে আমরা, উত্তরসূরী হিসেবে, একটুখানি কৃপাসহযোগে পাঠ করতে অভ্যস্ত। কিন্তু ফরহাদ মজহার সেই আয়েশটুকুর সুযোগ রাখেন নাই এই কবিতাসমূহে। এবং তার অপরাপর কবিতায়। তিনি সবসময় তরুণতর, নিজেকে সমসাময়িক দেখতে ভালবাসেন। আমরাও তাকে অনেক বছর এভাবে দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ফলে, এটা তাকেই মানায় যে তিনি ‘ফরিদার জন্য ক্যামেরাগিরি’ করবেন, 'সাড়ে সাতরকমভাবে' তাকাইবেন শালিখ পাখির দিকে।

নানারকমভাবে ফরহাদ মজহার-এর কবিতার বয়স বেড়েছে। ‘ভেজা কবিতা’য় বৃষ্টি তাকে তার দিদির জন্য উদ্বিগ্ন ও সজল করে তোলে। দিদির জন্য আকুল ফরহাদকে তখন আর প্রৌঢ় লাগে না, সেই কিশোরের মত লাগে যে চোখফুটে প্রথম বর্ষা দেখছে:

জলে জলে ভিজছে শহর, জলেতে ইস্পাত
একটি হলুদ মোটরগাড়ি জলেতে চিৎপাত।
দালানগুলো ভিজছে একা কারখানাতে পানি
জলের মধ্যে যুগল ভাসছে কবি ও বিজ্ঞানী।

বেড়েছে না বলে কমেছে বললেই মানায়। কেননা তিনি যখন বিছানা নিয়ে কবিতা রচনা করেন, যেখানে মানবশয্যার দীর্ঘ ইতিহাস নিয়ে জ্ঞান ফলানোর সুযোগও থাকে:

আমার ঘরের একপাশে আয়তত্রে হইয়া বিছানাটি কী সুন্দর অঙ্কিত হইয়া আছে
বিছানা অবধি পোঁছাইতে সভ্যতাকে কত পথ পাড়ি দিতে হইয়াছিল একবার ভাবিয়া দেখো


কিন্তু এরপর তিনি বিস্ময়কররকম ভাবে তার জ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করেন। হামলে পড়তে দেন নি বেচারা বিছানার (এবং কবিতার) ওপর। অত্যন্ত শিক্ষণীয় এবং অনুকরণীয় নিরাসক্তি। তরুণদের জন্য। আমরা যারা আমাদের যৎসামান্য র‌্যাশনালিটিকে কবিতার পেছনে লেলিয়ে দিই। আসুন দেখি ঐ দুই লাইনের পর কবি ফরহাদ মজহার, যিনি আবার একাধারে সমাজবিজ্ঞানী, রাজনীতি বিশ্লেষক, উন্নয়ন-চিন্তক এবং তত্ত্বালোচক, কোনদিকে গেলেন:

বিছানার ওপর বালিশটি পড়িয়া আছে, একটি মস্তকের জন্য তার নীরব নিঃশব্দ অপেক্ষা
একটি শরীর পাইবার আশায় বিছানাটি মৃতদেহের মতো গভীর গর্ত হইয়া আছে।

তত্ত্ব নাই, ইতিহাস নাই, সমাজবিজ্ঞান নাই। তাদের নির্যাস আছে হয়ত। কিন্তু আক্রান্ত করে না। কারণ, এখানে কবিতা আছে।

মনে পড়ে, ১৯৭৫ এ লেখা একটি প্রবন্ধ সংকলনে (বইয়ের নাম ছিল "প্রস্তাব") ফরহাদ মজহার তার চেতনাপ্রবাহে বিজ্ঞান, কবিতা, দর্শন, নৃতত্ত্ব সবকিছুকে একীভূত করে দেখতে প্রয়াসী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সময় কত বদলায়! এখন ফরহাদ যখন কবিতা রচনা করেন, তখন তিনি একান্তভাবেই কবি থাকতে চান।

আরেকটা বিষয়। ফরহাদ মজহারই সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে এখন একমাত্র কবি যিনি তরুণদের একটা ভাষাপ্রকরণচিন্তা, যার মেনিফেস্টেশনও পুরোপুরি হওয়া বাকি, সেটা দিয়ে নিজেকে আক্রান্ত করার সাহস দেখাতে পারেন। জয় হোক তাঁর।

২০০৫