শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০০৮

"সুমন রহমান নাকি সিঙ্গারের গল্প! কার আয়না কে?": রাহমান নাসির উদ্দিনের আলোচনা

[আমার অনুবাদে আইজাক সিঙ্গারের "আয়না" গল্পটি ২০০৬ সালে "কবিসভা"য় সঞ্চালিত হবার পর রাহমান নাসির উদ্দিন "কবিসভা"তে নিম্নোক্ত পাঠপ্রতিক্রিয়া পাঠান।]


জনাব সুমন রহমান,

অশেষ শুকরিয়া আপনার একটি অনুবাদ গল্প পাঠ করবার-অনুবাদ করবার জন্য সাধারণ বা অসাধারণ কোনো শুকরিয়াই এখানে যথার্থ নয়-মওকা দেবার জন্য। সনাতন ধন্যবাদের বহরে বাড়তি একটা ‘ধন্যবাদ’ যোগ কিংবা বিয়োগে খুব হেরফের হয় না। তাই, ‘ধন্যবাদ’ দিলাম না। কিন্তু আপনার লেখার তারিফ না করার কোনো কুলকিনারা নাই। আপনার অনুবাদ গল্পটি মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। এটা কি সিঙ্গারের নাকি সুমন রহমানের গল্প; পাঠের আগায় আমার মাথায় এটা থাকলেও পাঠকালে, মাঝখানে এবং গোড়ায় গিয়ে আগার চেতনা হারিয়ে ফেলি। আগা-গোড়া আমার ভাবনাগুলো আর এক থাকে না। মন্ত্রমুগ্ধ-পাঠ যাকে বলে। যদি শুরুতেই সিঙ্গারের একটা ছবি না ছাপানো থাকতো, তবে পাঠের অব্যাহত ভালোলাগার মধ্যে ‘এটি একটি অনুবাদ গল্প...অনুবাদ গল্প...’ জাতীয় আলগা খুঁতখুঁতানি এটা অস্বস্তিকর ভাব থাকতো না। কেননা, পাঠকালে মনেই হয় নাই এটি একটি অনুবাদ গল্প। চিত্রকল্পগুলো অসাধারণ, তবে সাধারণ অসাধারণ নয়। শব্দের যে প্রকৌশল আপনি সু(স্ব)কৌশলে এখানে নির্মিতি দিয়েছেন, তাকে ‘অসাধারণ’ নামক একটি শব্দ দিয়ে শেষ-সত্যিকার অশেষ বলে-করা যায় না। আরো অসাধারণ তার বিন্যাস এবং বিস্তার। কয়েক পশলা উদ্ধৃতি দিই...:



“...যা কিছু গোপন তার প্রকাশ্য হওয়া লাগবে, প্রতিটা গহীন ভাবনার ব্যক্ত হওয়া দরকার, প্রতিটা প্রেমেই আছে প্রতারণার আকাক্সা, যা কিছু পবিত্র তারই মর্যাদাহানি হওয়া প্রয়োজন। দুনিয়া ও পরকালের চক্করে যেকোনো সুন্দর শুরুর-ই খারাপ ধরনের সমাপ্তি হৈয়া যাইতে পারে...”

“জ্ঞান কখনই পয়লা বেহেশতের নিচে নামে নাই। আর পয়লা বেহেশতের পর জ্ঞান বৈলা যা আছে তার সবই হৈল লালসা... গেরাসিম ফেরেশতা বালুর মধ্যে খেলাধুলা করে পোলাপানের মত, চেরুবিমটা তো গোনাগুনতিই পারে না, আর আরালিমটা ফেলনা জিনিস চিবায় খালি। খোদা নিজে সময় কাটান হাঙ্গরের লেজ টাইন্যা টাইন্যা, আর জংলী ষাঁড়ে তার পা চাটে...”

“... লও যা সোনাদানা আছে, দেনমোহরের কাগজটা পুড়ায়া দাও, আর কাবিননামা ছিঁড়া ফালাও। সোনাদানা ফালায়া দাও কসাইটুলির জানলার নিচে, বাড়ি ছাড়ার আগে প্রার্থনার বই ডাস্টবিনে ফালায়া দাও, মেথুরা শরীফে থুথু ছিটাও, বিশেষত যেখানে যেখানে ‘শাদাই’ লেখা আছে সেই স্থানগুলায়...আমরা উড়ব ব্যাঙের বিষ্ঠাভরা মাঠের ওপর দিয়া, নেকড়েভরা জংলার ওপর দিয়া, সমকামীদের আখড়া ডিঙায়া-যেখানে সাপ হৈল পণ্ডিত, হায়েনা হৈল শিল্পী, কাক হৈল মৌলভী, চোরে দেখাশুনা করে খয়রাতির টাকা। সেইখানে সকল অসুন্দর হৈল সুন্দর, বাঁকা হৈল সোজা, নির্যাতন হৈল আরামদায়ক, ব্যঙ্গ হৈল অতি উচ্চ প্রশংসা...”

এই রকম অসংখ্য শব্দবন্ধ, বাক্যবিন্যাস, চিত্রকল্প এবং শব্দের যাদুকরি অভিব্যক্তি কি কেবল ‘অসাধারণ’ চেহারার একটি সাধারণ শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায়! ঠাহর করতে পারি না, এ গল্প কি সুমন রহমানের নাকি সিঙ্গার মশাইয়ের! যাদু-বাস্তবতা নামক এক কিসিমের গাল্পিকতার কথাবার্তা সাহিত্যে জারি আছে। এই গল্পে ওরফে ‘আয়না’য় আসলে কয় আনা যাদু আর কয় আনা বাস্তবতা সেটা অনুভবের সময় গল্পকার (নাকি অনুবাদ!) পাঠককে দেয় না। অন্তত আমাকে দেয় নাই। নাকি সেটাই যাদু! যা যাদুমন্ত্রের মতো কাজ করে। কিংবা সেটাই বাস্তবতা যা যাদুকরের শাব্দিক মায়াজালে লটকে থাকে। আলো-আধাঁরির খেলা। সকাল-সন্ধ্যা আধাবেলা! লিমিনালিটি! মারহাবা...

‘আয়না’ একটি পরদেশী গল্প হলেও, এই অনুবাদের আগা-গোড়া কোথায় যেন একটা চড়া স্বদেশী গন্ধ আছে। কৃতিত্ব সুমন রহমানের নিঃসন্দেহে। কয়েকটা খুচরা উদ্ধৃতি দেয়া যাক...

“...খোদা দুনিয়ার রমণীকূলে দিছেন অন্তঃসারশূন্যতা-বিশেষত যেসব রমণী ধনী, সুন্দরী, বাচ্চাকাচ্চাহীন, যুবতী এবং যাদের খরচ করার মত সময় বিস্তর আছে, অথচ সঙ্গীসাথী নাই...”

“...ওর চামড়া ছিল সাটিনের মত শাদা, দুধজোড়া ছিল ফোলা ফোলা, চুল ছিল কাঁধ-ছাড়ানো আর পা দুইটা ছিল মাদী হরিণের পায়ের মত চিকন লম্বা। আয়নার সামনে বৈসা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে নিজের রূপ উপভোগ করতে পারত। ছিটকিনি আর ভারি হুড়কো দিয়া আটকানো থাকত দরজা, আর সে ভাবত এই বুঝি খুইলা যাইতেছে দরজা, ঘরে ঢুকতেছে কোনো রাজকুমার, শিকারী বা কোনো কবি...”

“...মন দিয়া শোন, সবচে শাদা যে ময়দা তার কাঁই বানাও প্রথম। তাতে মিশাও মধু, ঋতুস্রাব, নষ্ট ডিম, শুয়োরের চর্বি, ষাঁড়ের অণ্ডকোষের চর্বি এক চামচ, এক কাপ মদ। সাবাথের দিন কয়লার আগুনে এইটা সিদ্ধ কর। তারপর স্বামীরে লৈয়া বিছানায় যাও এবং এইটা খাইতে দাও। মিছা কথা বৈলা বৈলা জাগায়া রাখ তারে, তারপর খোদা-না-খাস্তা কথা বৈলা ঘুম পাড়াও। যখন সে নাক ডাকতে শুরু করবে, তার অর্ধেক দাড়ি আর একটা কানের লতি কাইট্যা লও...”।

এরকম এন্তার উদ্ধৃতি দেয়া যায়। অর্থাৎ খুচরা নয় পাইকারি উদ্ধৃতি দেয়া যায়। ভীনদেশ আর নিজদেশ-র মধ্যকার ফারাক আর ফাঁক থাকে সুমন রহমানের (অনুবাদ!) গল্পে। গল্প কাকে বলে, কতো প্রকার ও কী কী? এ প্রশ্ন কেন মাথায় আসলো মালুম হয় না। গল্প নাকি অনুবাদ বেমালুম হয়ে ‘আয়না’-র শিথান-পৈথান ভ্রমণ করে? মননে ও মগজে বড় আরাম পেলাম। সুমন রহমান আরো গল্পপ্রবণ হোন...প্রত্যাশা করি নিরন্তর।

গল্পের পৈথানে এসে আমি ঠাসকি খাই। “...পিচ্চি শয়তানদের পদোন্নতি হয় না খুব একটা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসে যায়, এক জিরেলের পর আরেক জিরেল, অযুত অযুত প্রতিচ্ছবির উস্কানি, অযুত অযুত আয়নার ভিতর...”। তাজ্জব বনে যাই। “অশেষ হইয়াও হইলো শেষ” নাকি “শেষ হইয়াও হইলো না শেষ”। সার্থক রবীন্দ্রনাথ। নাকি সিঙ্গার! নাকি সুমন রহমান! অনুবাদ সাহিত্য দীর্ঘজীবী হোক। সুমন রহমান দীর্ঘজীবী হোন। আমিন।

রাহমান নাসির উদ্দিন
কিয়োতো, জাপান, ১৫ ফাল্গুন ১৪১২; ২৭/২/২০০৬



শুক্রবার, ২২ আগস্ট, ২০০৮

আয়না: আইজাক বাশেভিস সিঙ্গারের গল্প



১.
এক কিসিমের জাল আছে যেইটা মিথুসেলার মত আগিলা, মাকড়সার জালের মতন নরম ও ছ্যাঁদা-ছ্যাঁদা - কিন্তু শক্তিসামর্থে কমতি নাই। কোনো শয়তান যখন অতীতকালের পিছে বা বাতাসকলের চক্করে ঘুরতে ঘুরতে হয়রান হৈয়া পড়ে, তখন সে কোনো আয়নার ভিতর প্রবিষ্ট হৈয়া যায়। সেইখানে জাল বিছায়া সে মাকড়সার মতই বৈসা থাকে, মাছি ধরা পড়বেই। খোদা দুনিয়ার রমণীকূলে দিছেন অন্তঃসারশূন্যতা - বিশেষত যেসব রমণী ধনী, সুন্দরী, বাচ্চাকাচ্চাহীন, যুবতী এবং যাদের খরচ করার মত সময় বিস্তর আছে, অথচ সঙ্গীসাথী নাই।

ক্রাশনিক গ্রামে আমি সেইরকম এক রমণীর সাক্ষাৎ পাই। ওর পিতা ছিল কাঠব্যবসায়ী, স্বামী ডানজিগে খেয়ার কাজ করত। আর ওর মায়ের কবরে কেবল ঘাস গজাইতে শুরু করছে। মেয়েটা থাকত পুরনো ধাঁচের একটা বাড়িতে - ওককাঠের কাপবোর্ড, চামড়া-বাঁধান ক্যাশবাক্স আর সিল্ক দিয়ে মোড়ান নানান বইপত্রের মধ্যে। ওর চাকর ছিল দুইটা - এর মধ্যে বুড়াটা কানে শুনত কম আর জোয়ানটা ঘুরত এক বেহালাবাদকের পিছে-পিছে । ক্রাশনিকের অন্য গৃহবধুরা জুতা পরত পুরুষের, মেশিনের চোঙ্গার মধ্যে গম ঢালত সপাসপ, পাখপালক ছাড়াইত হাঁসমুরগির, রান্ধত স্যুপ, পালত বাচ্চাকাচ্চা আর যাইত জানাজায়। বলা বাহুল্য, সুন্দরী এবং শিক্ষিত জিরেল - যে বড় হৈছে ক্র্যাকো শহরে - এইসব গ্রাম্য প্রতিবেশীর সাথে কথা বলার মত বিষয়ই পাইত না। তারচে সে পছন্দ করত জার্মান গানের বই, বৈসা-বৈসা কাপড়ের মধ্যে এমব্রয়ডারি করত মুসা ও জিপোরা, আহসুইরাস ও রাণী এসথার, কিংবা দাউদ ও বাথশেবার ছবি। স্বামী ওর জন্য যেসব সুন্দর সুন্দর পোশাক আনত, সেগুলো কজেটেই ঝুলত, মুক্তা ও হীরার অলংকার বাক্সবন্দী হৈয়াই থাকত। কেউ কোনোদিন ওর সিল্কের অন্তর্বাস, লেস-লাগানো পেটিকোট বা লাল পরচুলা দেখে নাই - এমন কি ওর স্বামীও না। দেখবেই বা কখন? দিনের বেলায় তো প্রশ্নই ওঠে না, আর রাত্রে তো অন্ধকার।



জিরেলের ছিল একটা চিলেকোঠা, সেইখানে ছিল একখান আয়না যেটা ছিল ততটুকুই নীল - পানি বরফ হৈবার আগে যতটুকু নীল হৈয়া ওঠে। আয়নার মাঝবরাবর ফাটা ছিল একটা, আর তার চারপাশে যে সোনালি ফ্রেম ছিল তাতে সাপ, দরজার নব, গোলাপ এসবের বাহারি নকশাখোদাই ছিল। আয়নার সামনের মেঝেতে বিছানো ছিল ভালুকের চামড়া আর লাগোয়া পিছনেই ছিল একখান চেয়ার যার হাতল আইভরির আর গদী নরম মখমলের। নগ্নাবস্থায় সেই চেয়ারে বৈসা ভালুকের চামড়ায় পা রাইখা নিজেরে নিবিষ্টভাবে দেখার চাইতে আনন্দের আর কী হৈতে পারে? জিরেলের শরীরে তাকায়া থাকার মত ঐশ্বর্যও ছিল যথেষ্ট। ওর চামড়া ছিল সাটিনের মত শাদা, দুধজোড়া ছিল ফোলা ফোলা, চুল ছিল কাঁধ-ছাড়ানো আর পা দুইটা ছিল মাদী হরিণের পায়ের মত চিকন লম্বা। আয়নার সামনে বৈসা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে নিজের রূপ উপভোগ করতে পারত। ছিটকিনি আর ভারি হুড়কো দিয়া আটকানো থাকত দরজা, আর সে ভাবত এই বুঝি খুইলা যাইতেছে দরজা, ঘরে ঢুকতেছে কোনো রাজকুমার, শিকারী বা কোনো কবি। কারণ যা কিছু গোপন তার প্রকাশ্য হওয়া লাগবে, প্রতিটা গহীন ভাবনার ব্যক্ত হওয়া দরকার, প্রতিটা প্রেমেই আছে প্রতারণার আকাঙ্ক্ষা, যা কিছু পবিত্র তারই মর্যাদাহানি হওয়া প্রয়োজন। দুনিয়া ও পরকালের চক্করে যেকোনো সুন্দর শুরুর-ই খারাপ ধরনের সমাপ্তি হৈয়া যাইতে পারে। যখনি আমি এই স্বাদের কথা জানলাম, ঠিক করলাম এই রমণীটারেই ফুসলাইতে হবে। দরকার খালি একটু ধৈর্য। এক গরমের দিনে, আয়নার সামনে বৈসা সে ওর বাম স্তনের বোঁটা দেখতেছিল, তখনি আয়নার ওপর ওর চোখ আটকায়া গেল। হ্যাঁ, আমিই ছিলাম সেইখানে - আলকাৎরার মত কাল, বেলচার মত লম্বা, গাধার মত কান, ভেড়ার মত শিং, ব্যাঙের মত মুখ আর ছাগলের মত দাড়ি। আমার চোখ বলতে খালি দুইটা মনি। এত আশ্চর্য হৈছিল যে, ভয় পাওয়ার কথাই ভুইলা গেল। কান্নার বদলে সে ভাইঙ্গা পড়ল বাঁধভাঙা হাসির চ্ছটায়।

“ও আল্লা, কী বিশ্রী দেখতে তুমি!” বলল সে।
“ও আল্লা, কী সুন্দর দেখতে তুমি!” জবাব দিলাম আমি।

আমার প্রশংসায় ওকে খুশি মনে হৈল। “কে তুমি গো?” জিগাইল সে।

“ভয় পাইও না” বললাম, “আমি একটা পিচ্চি শয়তান, বড়সড় শক্তিশালী শয়তান আমি না। আমার আঙুলে নোউখ নাই, মুখে দাঁত নাই, আমার হাত গুড়ের মত, আর শিং মোমের মত। আমার যত শক্তি আমার জবানে। পেশাগত দিক থিকা আমি একটা ভোদাই, আসছি তোমারে আনন্দ দিতে কারণ তুমি একলা।”

“আগে ছিলা কৈ?”

“তোমার শোবার ঘরের স্টোভের পিছনে, যেইখানে ঝিঁঝি ডাক পাড়ে আর ইন্দুরে হল্লা করে। সেইখানে একটা শুকায়া যাওয়া ফুলতোড়া আর উইলোর মরা ডালের মাঝখানে ছিলাম গো।”

“কী করতা সেখানে তুমি?”
“দেখতাম তোমারে।”
“কবে থিকা?”
“তোমার বাসর রাইত থিকা।”
“খাওয়া দাওয়া?”
“তোমার শরীরের সুবাস, চুলের জ্বিলা, চোখের আলো আর মুখের বিষাদ।”
“শালা তেলবাজ” সে চিৎকার করল, “কে তুমি? কী কর এখানে? কৈ ত্থিকা আসছ? যাইবা কৈ?”

গল্প বানাইলাম একটা। বললাম, আমার বাপ ছিল স্বর্ণকার আর মা ছিল একটা মাদী ছাগল। তারা মিলিত হৈছিল এক গুদামের ভিতর বাতিল দড়ির স্তূপের ওপর, আমি ছিলাম তাদের জারজ সন্তান। কিছুদিনের জন্য উঠছিলাম মাউন্ট সিয়েরের শয়তানদের বস্তিতে, থাকতাম একটা খচ্চরের গুহায়। কিন্তু যখন জানাজানি হৈল যে, আমার বাপ একজন মানুষ - খেদায়া দিল আমারে। তখন থিকা আমি ঘরছাড়া। মাদী শয়তানগুলা আমারে এড়াইত কারণ, আমারে দেখলে নাকি ওদের আদমসন্তানের কথা মনে হৈত। আর মানবীরা আমারে দেইখ্যা ভাবত শয়তানের কথা। আমারে দেখলেই ঘেউ ঘেউ করত কুত্তাগুলান, মানুষের বাচ্চারা চেঁচাইত ভয়ে । কিন্তু কেন ভয় পাইত ওরা? আমি তো কারো ক্ষতি করি নাই। আমার একমাত্র শখ সুন্দরী নারী দেখা - দেখা আর ওদের সাথে আলাপ সালাপ করা।

“আলাপ সালাপ করা ক্যান? সুন্দরী হৈলেই কি জ্ঞানী হৈয়া যায় নাকি?”

“বেহেশতে জ্ঞানীরা সুন্দরীদের পায়ের নিচের পাওদানি।”

“আমার শিক্ষক তো অন্যকথা কয়।”

“তোমার শিক্ষক হালায় কি জানে? যারা বই লেখে তাদের বুদ্ধি ছারপোকার সমান। তারা একজন অন্যজনরে অনুকরণ করে। যখনি তুমি কিছু জানতে চাও, আমারে জিগাইও। জ্ঞান কখনই পয়লা বেহেশতের নিচে নামে নাই। আর পয়লা বেহেশতের পর জ্ঞান বৈলা যা আছে তার সবই হৈল লালসা। তুমি কি এও জান না যে, ফেরেশতারা সব মাথামোটা? গেরাসিম ফেরেশতা বালুর মধ্যে খেলাধুলা করে পোলাপানের মত, চেরুবিমটা তো গোনাগুনতিই পারে না, আর আরালিমটা ফেলনা জিনিস চিবায় খালি। খোদা নিজে সময় কাটান হাঙ্গরের লেজ টাইন্যা টাইন্যা, আর জংলী ষাঁড়ে তার পা চাটে। তিনি কাতুকুতু দেন শেখিনারে যাতে সে প্রতিদিন অনেক অনেক ডিম পাড়তে পারে; এই ডিমগুলারেই তোমরা আকাশের তারা কও।”

“বুঝলাম তুমি আমার সাথে মশকরা করতেছ।”

“এইগুলা মশকরা হৈলে আমার নাকের ওপরে হাড্ডি গজাক। আমার মিছাকথার কোটা আমি অনেক আগেই শেষ কৈরা ফালাইছি। এখন সত্য বলা ছাড়া আমার বিকল্প নাই।”

“আচ্ছা, তুমি কি বাচ্চা পয়দা করতে পার?”

“না গো আমার জান। খচ্চরের মতই অম আমি। কিন্তু তাতে আমার কামনা দমে নাই। শুধুমাত্র বিবাহিতাদের সাথে শুই আমি, দুর্দান্ত অ্যাকশনই আমার পাপ, আমার প্রার্থনা হৈল খোদা-কুৎসা, বিদ্বেষ আমার রুটি, ক্রোধ আমার মদ, ফুটানি আমার হাড্ডিমজ্জায়। বকবকানি ছাড়া এই একটা জিনিসেই ওস্তাদ আমি।”

আমার কথায় হাসি পাইল ওর। বলল, “শয়তানের বেশ্যা হৈতে জন্ম দেয় নাই আমারে আমার মা। যাঃ ফুট, নাইলে ওঝা ডাকুম কিন্তু।”

“উত্তেজিত হৈবার কিছু নাই”, বললাম আমি, “যাইতেছি। কারো ওপর জোর করি না আমি”।

তারপর মিলায়া গেলাম কুয়াশার মত।



২.
পরের সাতদিন জিরেল ওর আয়নাঘরে যাওয়া থিকা বিরত রাখল নিজেরে। আয়নার ভিতর আমি হালকা হালকা ঘুমাইলাম। জাল ছড়ান হৈছে; ভিকটিম রেডি। ওর মারাত্মক কৌতুহলের কথা জানতাম আমি। তাই এখন আমার কাজ হৈল খালি হাই তোলা। একজন খোদার বান্দারে এইরকম পটান কি উচিত আমার? উচিত কি নববধুরে তার পুরুষের সঙ্গ থিকা বঞ্চিত করা? সিনাগগের চিমনিতে আগুন দেয়া? সাবাথের মদকে ভিনেগার বানায়া দেয়া? কুমারীর জন্য বামনসোয়ামী উপহার দেয়া? বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে ভেড়ার শিং ঢুকায়া দেয়া? তেলাওয়াতের সুরের মধ্যে অসুর ঢুকায়া দেয়া? পিচ্চি শয়তানের এরকম কাজকামের অভাব তো নাই, বিশেষত আতংকদিবসগুলাতে, যখন পানির মধ্যে মাছগুলাও ভয়ে কাঁপতে থাকে। এমনি এক দিন আমি বৈসা বৈসা মুন জুস আর টার্কি সীডস-এর খোয়াব দেখতেছিলাম - তখনি ঢুকল সে। তাকাইল আমার দিকে, কিন্তু দেখতে পাইল না। আয়নার সামনেই বসল, আমি দেখা দিলাম না।

“নিশ্চয় আমি আগডুম বাগডুম ভাবতেছি”, ফিসফিস করতেছিল জিরেল, “ঐটা অবশ্যই গাঁজাখুরি স্বপ্ন ছিল আমার।”

নাইটগাউন খুইল্যা উদাম হৈয়া দাঁড়াইল সে ঐখানে। জানতাম ওর স্বামী শহরে গেছে এবং গতরাত্রে স্ত্রীর সঙ্গে শুইছে, যদিও জিরেল এখনও গোসল কৈরা পুতপবিত্র হয় নাই। অথচ তালমুদ শরীফে আছে, কোনো স্ত্রীলোকের পবিত্র হৈতে দশখান শর্ত পূরণ করা লাগে, আর বেলেল্লা হৈতে যে কোন একটা শর্তের অপমানই যথেষ্ট। রয়েজি গ্লাইনের কন্যা জিরেল আসলে আমাকেই খুঁজতেছিল এবং ওকে বিষণ্ন লাগতেছিল খুব। সে আমার, আমার, আমি ভাবলাম। আজরাইল তার বল্লমসহ তৈরি, হিংসুটে এক পিচ্চি শয়তান দোযখের মধ্যে মেয়েটার জন্য কড়াই বসাইতেছে, আরেক পাপী হতভাগির জন্য খড়িকাঠ টুকাইতেছে। সব তৈয়ার - বরফের চাঁই আর জীবন্ত কয়লা, ওর জিহ্বার জন্য আংটা, স্তনের জন্য প্লায়ার্স, ওর যকৃত খাওয়ার জন্য ইঁদুরের পাল, আর পাকস্থলিতে কামড় বসানোর জন্য কৃমি। কিন্তু আমার ছোট্ট শিকার এসবের কিছুই টের পাইল না। সে নিজের বাম স্তনে হাত বুলায়া নিল, তারপর ডান স্তনে। তলপেট দেখল, তারপর পায়ের পাতা। সে কি এখন বই পড়বে? নখে পালিশ লাগাবে? চুল আঁচড়াবে? স্বামীর আনা আতরের গন্ধ বাইর হচ্ছে ওর গা থিকা, ভুর ভুর গোলাপগন্ধ। স্বামী ওকে প্রবালের যে নেকলেসটা উপহার দিছিল, সেইটাই পরে আছে সে। কিন্তু সর্প না থাকলে হাওয়াবিবি কেমনে হয়? শয়তান না থাকলে খোদার মাহাত্ম্য কি? জিরেল ছিল কামনায় একেবারে কানায় কানায় পূর্ণ। বেশ্যার মত আতিপাতি কৈরা খুঁজতেছিল আমারে। কাঁপা-কাঁপা ঠোঁটে আবৃত্তি করল:

হাওয়ার মতন বেগে
গহীন পাতাল থেকে
কালো বিড়াল তুমি
নাগালে আসো, চুমি!
সিংহ বিক্রমে
মাছের বোবা প্রেমে
স্তব্ধ দেশের দেশী
নাও, তোমার ফুলরাশি!

শেষ শব্দটা আউড়ানমাত্র দেখা দিলাম আমি। আমারে দেখামাত্র ওর মুখ উজ্জ্বল হৈয়া উঠল।

“ও। তুমি এখানে?”

“চলে গেছিলাম”, বললাম, “কিন্তু ফিরে এলাম।”

“কৈ ছিলা এই কদিন?”

“ছিলাম, যেখানে কোনো স্থান নাই সেইখানে। ছিলাম আসমোদিউসের দুর্গের কাছে, যে জঙ্গলটায় সোনার পাখি থাকে তার কাছে একটা বেশ্যাদের প্রাসাদ আছে সেইখানে।”

“এত দূরে?”

“আমার কথা একিন না হৈলে আসো আমার সাথে। পিঠে চাইপ্যা বস, শিং চাইপ্যা ধর, তোমারে লৈয়া পতপত ডানা ছড়াই আকাশে। দুইজনায় পাহাড়পর্বত ডিঙায়া উইড়া যামু সেইখানে।”

“কিন্তু আমার পরনে তো কিছুই নাই।”

“সেইখানে কেউ কাপড় পরে না।”

“আমার স্বামী জানবে না কোথায় গেছি আমি?”

“যা জানার তাড়াতাড়িই জানবে সে।”

“লাগবে কতক্ষণ যাইতে?”

“সেকেন্ডেরও কম।”

“ফিরব কখন?”

“সেইখানে গেলে কেউই ফিরতে চায় না।”

“কি করব আমি সেইখানে?”

“আসমোদিউসের কোলে বৈসা উনার দাড়ি দিয়া বেনী বানাইবা। আলমন্ড আর পোর্টার খাইবা। সন্ধ্যা হৈলে উনার সামনে নাচবা। তোমার গোড়ালিতে ঘণ্টি বাঁধা থাকবে, আর সব শয়তান নাচবে তোমারে ঘিরা।”

“তারপর?”

“আমার প্রভু খুশি হৈলে তুমি তারই হৈবা। আর না হৈলে উনার সাঙ্গপাঙ্গদের কেউ তোমার দায়িত্ব নিবে।”

“সকাল হৈলে?”

“সেইখানে সকাল নাই।”
“তুমি কি থাকবা আমার সঙ্গে?”

“তোমাকে নিতে পারলে আমার পুরস্কার জুটবে চূষার জন্য একখান হাড্ডি।”

“হায় রে অভাগা শয়তান, মায়া লাগতেছে তোর জন্য, কিন্তু আমি যাব না। আমার সোয়ামি আছে, পিতা আছে। সোনারূপা আছে, পোশাক আছে, ওল আছে। আমার জুতার হিল ক্রাশনিকে সবচে উঁচা।”

“ঠিক আছে। তাইলে বিদায়।”

“দাঁড়াও দাঁড়াও। এত তাড়াহুড়া ক্যান গো? কী করা লাগবে কও।”

“এইত লক্ষ্মী মেয়ের মত কথা। মন দিয়া শোন, সবচে শাদা যে ময়দা তার কাঁই বানাও প্রথম। তাতে মিশাও মধু, ঋতুস্রাব, নষ্ট ডিম, শুয়োরের চর্বি, ষাঁড়ের অন্ডকোষের চর্বি এক চামচ, এক কাপ মদ। সাবাথের দিন কয়লার আগুনে এইটা সিদ্ধ কর। তারপর স্বামীরে লৈয়া বিছানায় যাও এবং এইটা খাইতে দাও। মিছা কথা বৈলা বৈলা জাগায়া রাখ তারে, তারপর খোদা-না-খাস্তা কথা বৈলা ঘুম পাড়াও। যখন সে নাক ডাকতে শুরু করবে, তার অর্ধেক দাড়ি আর একটা কানের লতি কাইট্যা লও। লও যা সোনাদানা আছে, দেনমোহরের কাগজটা পুড়ায়া দাও, আর কাবিননামা ছিঁড়া ফালাও। সোনাদানা ফালায়া দাও কসাইটুলির জানলার নিচে, বাড়ি ছাড়ার আগে প্রার্থনার বই ডাস্টবিনে ফালায়া দাও, মেথুরা শরীফে থুথু ছিটাও, বিশেষত যেখানে যেখানে ‘শাদাই’ লেখা আছে সেই স্থানগুলায়। তারপর সোজা আস আমার কাছে। আমি তোমারে পিঠে নিয়া উড়ব ক্র্যাশনিক থিকা মরুভূমিতে। আমরা উড়ব ব্যাঙের বিষ্ঠাভরা মাঠের ওপর দিয়া, নেকড়েভরা জংলার ওপর দিয়া, সমকামীদের আখড়া ডিঙায়া - যেখানে সাপ হৈল পন্ডিত, হায়েনা হৈল শিল্পী, কাক হৈল মৌলভী, চোরে দেখাশুনা করে খয়রাতির টাকা। সেইখানে সকল অসুন্দর হৈল সুন্দর, বাঁকা হৈল সোজা, নির্যাতন হৈল আরামদায়ক, ব্যঙ্গ হৈল অতি উচ্চ প্রশংসা। তাড়াতাড়ি কর, সময় খুব কম।”

“ভয় লাগতেছে পিচ্চি শয়তান, আমার খুউব ভয় লাগতেছে।”

“আমাদের সাথে গেলে প্রথম প্রথম সবারই লাগে।”

আরো কিছু জিগাইবার ইচ্ছা ছিল জিরেলের, হয়ত আমার বক্তব্যের স্ববিরোধ ধরার জন্য, কিন্তু পালাইলাম আমি। সে ওর ঠোঁট চাইপ্যা ধরল আয়নার মধ্যে, কিন্তু আমার লেজের একটুখানি নাগাল পাইল খালি।


৩.
ওর বাবা কাঁদল। স্বামী মাথার চুল ছিঁড়ল। চাকরবাকরেরা ওরে খুঁজল সেলারে আর বাড়ি-লাগোয়া উঠানে। ওর শাশুড়ি বেলচা দিয়া চিমনীর ভিতরটা পর্যন্ত খুঁচায়া দেখল। গরুর গাড়ির গাড়িয়াল আর কসাইরা ওরে তন্ন তন্ন কৈরা খুঁজল জঙ্গলে। রাতে টর্চ জ্বলল এখানে ওখানে আর তালাশকারীদের গলা ইকো হয়: “জিরেল, কোথায় তুমি? জিরেল! জিরেল!” সন্দেহ হৈল যে, সে কনভেন্টে পালায়া গিয়া থাকতে পারে। কিন্তু পুরোত মশায় ক্রুশ ধৈরা কসম কাটল, জিরেলরে সে দেখে নাই। খোঁজাখুঁজির জন্য পাঠানো হৈল এক হাতসাফাইকারীকে, তারপর পাঠানো হৈল এক জাদুকর মহিলাকে যে কারো আদলে অবিকল মোমের মূর্তি বানাইতে পারে, শেষে পাঠানো হৈল আরেকজনকে যে জাদুর আয়না দিয়া মৃত বা নিখোঁজ মানুষের সন্ধান করতে পারে। কিন্তু যখন আমি আমার শিকার হাতে পাইয়া যাই, তখন দুনিয়ার কারো সাধ্য থাকে না তাকে ফিরায়া নিবার। ডানা ছড়াইলাম ওকে পিঠে নিয়া। জিরেল আমারে অনেক প্রশ্ন করল, কিন্তু জবাব দিলাম না। সোডম-এ পৌঁছার পর লট শালার বৌ-এর কাছে থামলাম একপলক। তিনটা বলদে তখন ঐ বেটির নাক চুষতে ছিল। লট শালা শুইছিল গুহায় ওর মাইয়াগুলার সাথে, বরাবরের মতই মাতাল।

ছায়ার এই জগতে সবকিছুই পরিবর্তনশীল, কিন্তু আমাদের জগতে সময় একেবারে স্থির। এইখানে বাবা আদম এখনও ল্যাংটা, হাওয়াকে এখনও সাপে ফুসলাইতেছে। হাবিল মারতেছে কাবিলকে, রক্তচোষা নীলমাছি শুইতেছে হাতির সাথে, বেহেশত থিকা নামতেছে ঝর্ণাধারা, মিশর দেশে হাতে কাদা ঠেলতেছে ইহুদীরা, শরীর চুলকাইতেছে জব। যতক্ষণ সময় প্রবাহিত হয়, চুলকাইতেই থাকবে সে, কিন্তু আরাম পাইবে না সে কোনোদিন।

জিরেল কী যেন কথা কৈতে চাইছিল, কিন্তু পাখা ঝাপটায়া আমি লাপাত্তা হৈয়া গেলাম। আমার কাজ শেষ। গিয়া প্রাসাদের অনেক উঁচু কার্ণিশে বাদুড়ের মত ঝুলতে থাকলাম, চোখ খোলা কিন্তু দৃষ্টি নাই চোখে। দুনিয়া হৈল বাদামি আর বেহেশত হৈল হলুদ। বৃত্তাকারে দাঁড়ায়া শয়তানগুলা লেজ নাচাইতেছিল। দুইটা কাছিম ছিল টাইট জড়াজড়ি অবস্থায়, একটা পুরুষ পাথর উপগত একটা নারীপাথরের ওপর। শাব্রিরি আর বারিরি উপস্থিত হৈল। শাব্রিরির জন্ম হৈছে একটা বর্গেেত্রর আকার থিকা। তার মাথায় টুপি, হাতে বাঁকা তলোয়ার। তার পা-গুলা হাঁসের, কিন্তু ছাগলের মত দাড়ি আছে মুখে। নাকের ওপরে জোড়া চশমা আছে তার, কথা বলে জর্মন উচ্চারণে। আর বারিরি একইসঙ্গে বানর, টিয়া, ইঁদুর এবং বাদুড়। শাব্রিরি আর বারিরি মাথা নোয়াইল একটু, তারপর শুরু করল বিদূষক স্টাইলে:

আর্গিন মার্গিন
সস্তায় বেছে নিন
কিউট এক দোয়েল
নাম তার জিরেল
(তার) খোলা দরজা
(তাই) প্রেমে খুব মজা!

শাব্রিরি যখন জিরেলকে বাহু বাঁধনে ধরতে গেল, চেঁচাইল বারিরি, “ওরে তোর শরীরে হাত দিতে দিবি না মাগি! মাথায় খুঁজলি-প্যাঁচড়া আছে ওর, পায়ের মধ্যে ঘা, মেয়েমানুষরে মজা দিবার মতা নাই ওর। মুখে ফটফট, খাসি করা মোরগও ওর থেইকা ভাল। এরকম ওর বাপেও ছিল, দাদাও। তার চাইতে আয়, প্রেম করবি আমার সাথে, আমি মিথ্যারাজের নাতি। তাছাড়া আমার মেলা টাকাপয়সা আছে, ফ্যামিলিও ভাল। আমার দাদী ছিল নামা-র কন্যা ম্যাকলাথের সখী। আসমোদিউসের পা ধোয়াইয়া দিত আমার মা। আমার বাবা, চির দোযখনসীব হোক তার, বইত শয়তানের নস্যির বাক্স।”

এইভাবে শাব্রিরি আর বারিরি জিরেলের চুল ধৈরা টানাটানি করতে আরম্ভ করল, প্রতিবার টানের সাথে তারা জিরেলের গোছা গোছা চুল উপড়ায়া ফেলতে লাগল। তখনি জিরেল তার অবস্থাটা পুরাপুরি বুঝল এবং ‘ছাইড়া দেও ছাইড়া দেও’ বলে চিৎকার করতে লাগল।

“কী নিয়া লোফালুফি চলতেছে?” কেটেভ মারিরি জিগায়।
“ক্রাশনিকের একটা ছিনাল।”
“ভাল কিছু পাওয়া গেল না?”
“নাহ। ঐটাই ঐখানে ভাল।”
“আনল কে?”
“একটা পিচ্চি শয়তান।”
“ঠিক আছে। আবার শুরু কর।”
“বাঁচাও বাঁচাও।” জিরেল গোঙ্গাইতে থাকল।
“ঝুলায়া দাও ঐটারে”, ক্রোধের পুত্র র‌্যাথ চেঁচাইল, “কাইন্দা কোনো লাভ নাই মাগী। এইখানে সময় লড়েচড়ে না। যা বলা হৈছে কর, তুই এখানে জোয়ানও না, বুড়িও না।”

জিরেল কান্নায় ভাইঙ্গা পড়ল। ওর হিক্কা আর বিলাপের শব্দে লিলিথের ঘুম চটকায়া গেল। আসমোদিউসের দাড়ির ভিতর থিকা মুখ বাইর করল সে, ওর মাথার প্রতিটা চুল হৈতেছে একেকটা কিলবিল-করা সাপ।

“মাগিটার সমস্যা কি?” জিগাইল লিলিথ, “চেঁচাইতেছে ক্যান?”
“ওরা শুরু করছে ওর ওপর।”
“আরো একটু লবণ মিশায়া নিতে ক”
“আর আগে চর্বি ছাড়ায়া নিতে ক”

এই মশকরা চলল হাজার হাজার বছর ধৈরা, তারপরেও প্রেতচক্রের কান্তি নাই। প্রতিটা শয়তান তার তার করণীয় সারল, প্রতিটা পিচ্চি শয়তান তার তার মত মজা নিল। ওরা টানল, ছিঁড়ল, কামড়াইল আর চিমটাইল। পুরুষ শয়তানগুলা এত খারাপ না, মাদী শয়তানগুলা হৈতেছে ভয়ানক - আদেশ দিল: খালি হাতে স্যুপ বানাবি! আঙুল ছাড়া বিনুনী করবি! পানি ছাড়া ধোয়ামোছা করবি! গরম বালুর মধ্যে মাছ ধরবি! না ভিজ্যা গোসল করবি! বাড়িতে থাকবি এবং রাস্তায় হাঁটবি! পাথর দিয়া মাখন তৈয়ার করবি! বোতল ভাঙ্গবি কিন্তু মদ ফেলতে পারবি না!!

খোদা বৈলা কি কেউ আছেন? তিনি কি আসলেই দয়াশীল? জিরেল কি কোনোদিন মুক্তি পাবে? সৃষ্টির গোড়াতেই কি সাপের সাথে অশুভের যোগ ছিল? আমি কেমনে বলি? আমি তো ছোট্ট একটা শয়তানমাত্র। পিচ্চি শয়তানদের পদোন্নতি হয় না খুব একটা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসে যায়, এক জিরেলের পর আরেক জিরেল, অযুত অযুত প্রতিচ্ছবির উস্কানি, অযুত অযুত আয়নার ভিতর।


(নর্বার্ট গাটারম্যান-এর ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সুমন রহমান)



ফেব্রুয়ারি ২০০৬

অন্ধ সঙ্গীতকার: ভ্লাদিমির করলেংকো



সে দ্রুত তার মাকে চিনতে শিখে ফেলল - পায়ের আওয়াজ শুনে, কাপড়ের খসখসানি শুনে, এবং অন্যান্য নানান শব্দের মাধ্যমে যেগুলো সেই-ই কেবল আলাদা করে বুঝতে পারত। ঘরে যত লোকই থাকুক না কেন অথবা তারা যেভাবেই চলাচল করুক না কেন - সে কোন ভুল না করেই তার মায়ের কাছে চলে যেতে পারত। মা যখন তাকে কোলে নিত - সেটা সে আশা করুক আর নাই করুক - সে সবসময়ই বুঝতে পারত যে এটা তার মা। অন্যরা যখন তাকে কোলে নিত, সে আলতোভাবে তাদের মুখের উপর আঙুল বুলাত এবং এভাবে ধীরে ধীরে চিনে ফেলল কোনটা তার নার্স, কোনটা ম্যাক্সিম চাচা এবং কোনটা তার বাবা। এর বাইরে অচেনা কেউ যখন তাকে কোলে নিত, ঐ মানুষটার মুখের উপর বুলাতে থাকা তার আঙুলগুলো শ্লথ হয়ে যেত। আস্তে আস্তে, কিন্তু সুনিশ্চিতভাবে, অচেনা মুখটিকে তার আঙুলগুলো সনাক্ত করে ফেলত, তার মুখমণ্ডলকে খুব নিবিষ্ট লাগত তখন, যেন তার আঙুলগুলো তার হয়ে ‘দেখছে’।



প্রকৃতিগতভাবে সে ছিল প্রাণবন্ত ধরনের শিশু। কিন্তু যতই দিন যেতে থাকল ততই যেন তার অন্ধত্বের ছাপ তার স্বভাবের উপর বসে যেতে থাকল। তার চলাফেরা হয়ে উঠতে থাকল কম চটপটে। ঘরের নিরিবিলি কোনাগুলোতে লুকিয়ে বসে থাকার একটা অভ্যাস গড়ে উঠল তার, সেখানে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত অচঞ্চল ভঙ্গিতে, এবং তার মুখ দেখে মনে হত যেন কিছু শোনার চেষ্টা করছে। ঘরে যখন কেউ থাকত না, এবং অন্যদের কথাবার্তা বা চলাফেরার শব্দ যখন তার মনোযোগ আকর্ষণ করত না, তাকে দেখে তখন নে হত গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে এবং তখন তার সুন্দর মুখটাতে থাকত একটা বিপন্ন্ বিস্ময়ের আভা, সেটি মোটেও শিশুসুলভ ছিল না।

ম্যাক্সিম চাচা ঠিকই বলেছিলেন। অন্ধ শিশুটির প্রাণবন্ত ও অনুসন্ধানী চরিত্র তাকে অনেক সাহায্য করল। তার স্পর্শের বোধ হয়ে উঠল অসাধারণ। একটা সময়ে মনে হতে থাকল যেন, এমনকি, তার মধ্যে রঙ-এর অনুভব জেগে উঠছে: উজ্জ্বল রঙ-এর কোন জিনিসের উটর তার আঙুলগুলো বেশি সময় ধরে খেলা করত, এবং সেই সময়ে তার মুখে একটা অতিনিবিষ্ট মনোযোগের ভাব ফুটে উঠত। সবচেয়ে বিস্ময়কর উন্নতি, যেটি সময়ের সাথে সাথে পরিষ্কার হয়ে উঠল, সেটি হল তার শ্রবণশক্তি।

শিগগিরই সে বিভিন্ন শব্দের পার্থক্যের মাঝ দিয়ে এই বাড়ির প্রতিটি ঘরকে আলাদা করে চিনতে শিখল। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের পায়ের শব্দ আলাদা করে চিনল - তার পঙ্গু চাচার চেয়ারের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ, মায়ের সেলাই মেশিনের একটানা ছন্দ এবং ঘড়ির একঘেয়ে টিকটিক। খখনো কখনো মেঝেয় হামাগুড়ি দিতে দিতে সে এমন কোন শব্দে থমকে যেত এবং কানখাড়া করত যা স্বাভাবিকভাবে কারো শ্রুতিগোচর হওয়ারই কথা নয়। দেখা গেল তখন সে হাত বাড়াচ্ছে ঘরের দেয়ালে অলসভাবে ঘুরতেফিরতে থাকা একটা মাছির দিকে। মাছিটা উড়ে গেলে তার মুখে কিন্তু একটা বেদনার আভা ফুটে উঠে, যেহেতু সে বুঝতে পারে না কোন দিকে মাছিটা উড়ে গেল। অবশ্য বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই বেদনাবোধ ফিকে হয়ে গেল তার। বরং মাছিটা যে দিকে উড়ে যেত, সেদিকে সে তার মাথা চকিতে ঘুরিয়ে ফেলতে পারত তখন। তার শ্রবণমতা এতটাই পোক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, মাছিটার ত্রস্ত পাখা-ঝাপটানিকে সে খুব ভাল করে চিনে ফেলেছিল ইতিমধ্যে।

তার চারপাশের পৃথিবী - গতি, শব্দ ও রঙের পৃথিবী - এই অন্ধ বালকটির কাছে মুখ্যত পৌঁছাল শব্দের আকারে; আর তার চারপাশের ধারণাবলী হয়ে উঠল শব্দের ধারণা। তার মুখে সবসময় থাকত একটা ব্যতিক্রমী ধরনের শোনার ভঙ্গি, এজন্য তার থুতুনিটা সবসময় সামনের দিকে একটু বাড়ানো থাকত। আশ্চর্যজনক ভাবে চোখের ভুরু নড়ত তার, কিন্তু সুন্দর চোখজোড়া থাকত অচঞ্চল। ফলে তার মুখ বয়ে বেড়াত শিশুসুলভ নিবিষ্টতা এবং দুঃখবোধের একটা যুগপৎ মনোভাব।




৬.

অন্ধ বালকের জীবনের তৃতীয় শীতকালটাও ক্রমে শেষ হয়ে এল। দরজাগুলো আটকে-দেয়া বরফ গলতে শুরু করল, এবং শুরু হতে লাগল বসন্তের ব্যস্তমস্ত জীবন। সারা শীতকাল সে অসুস্থ হয়ে ছিল ঘরের মধ্যে, বাইরের বাতাসের ছোঁয়া লাগে নি বলতে গেলে; বসন্তের ছোঁয়ায় তার স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে লাগল।

জানালার খড়খড়িগুলো উঠিয়ে দেয়া হল, বসন্তের আনন্দ বিপুল উদ্যমে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। সূর্যের প্রফুল্লচ্ছটায় ঘরগুলোতে বয়ে যেতে লাগল আলোর বন্যা। সমুদ্র সৈকত, তখনও জনশূন্য, বরাবরের মতই জানালার বাইরে নিমন্ত্রণের মত দোলা দিতে লাগল। আর দূরে, ফসল কেটে-নেয়া কালো মাঠগুলো শুয়ে, স্থানে স্থানে বরফের আস্তর তখনও মিলায় নি। ঘাসগুলো অনেক জায়গাতেই বিবর্ণ ধরনের সবুজ রঙ পেতে আরম্ভ করছিল তখন। বাতাস ছিল নরম, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য যথার্থ। পুরো বাড়িটারই নবায়ন হল বসন্তের যাদুকরী শক্তির পরশে।

অন্ধ বালকের কাছে বসন্ত উপস্থিত হল ঘর ভরে-দেয়া উচ্ছল শব্দরাশির রূপে। বসন্তের বন্ধনহারা জলরাশির শব্দ শুনতে পেল সে, ঢেউয়ের পেছনে ঢেউ ভাঙ্গছে নিরন্তর, পাথরের মাঝ দিয়ে কলকল করে বইছে, পথ করে নিচ্ছে নরম ও ভেজা মাটির বুক চিরে। বাতাসের কানে কানে কথা বলা সমুদ্র তীরের গান শুনল সে। ঘরের চাতালে যে বরফ জমেছিল, এখন তা সূর্যের আলোয় গলে গলে পড়ছে, কান পেতে সে শুনতে লাগল অবিরত জলবিন্দু পতনের টুপটাপ শব্দ। নিখুঁত ও পরিষ্কারভাবে এই শব্দসমূহ ঘরে এসে আছড়ে পড়তে থাকল, যেন বা গোল গোল নুড়ি পড়ছে এমন মনে হল। কখনো কখনো, এই শব্দসমূহের মাঝে সারসের ডাকও এসে মিশে যেতে লাগল, বিশেষত যখন সে সুদূর আকাশ থেকে মাটির দিকে ডাইভ দিয়ে নেমে আসে এবং তারপর সেই ডাক আস্তে আস্তে বাতাসে মিলিয়ে যায়।

বসন্তের এই মহড়া বালকটির মুখে এক ধরনের বিপন্নতা ও দুঃখবোধের আভা তৈরি করল। সে মুখ বাড়িয়ে, ভুরু কুঁচকে অনেক আয়েশ করে শুনত, তারপর, যেন এইসব শব্দ তাকে ভীত করছে, এমন ভঙ্গিতে মায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিত এবং তার কোলের সঙ্গে লেপ্টে থাকত।

“ওর সমস্যা হচ্ছে কিসে?” মা ভাবল আর আশেপাশের সবাইকে জিজ্ঞেস করল।

ম্যাক্সিম চাচা অভিনিবেশ নিয়ে দীর্ঘসময় বালকটির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, তার সাম্প্রতিক আচরণের কোনো ব্যাখ্যা পাবার প্রত্যাশায়। কিন্তু ব্যাখ্যা মিলল না।

“সে আসলে....বুঝতে পারছে না” মা দ্বিধাজড়িত গলায় বলল, ছেলের মুখের বিপন্নতা খেয়াল করতে করতে।

সত্যিকার অর্থে, সে ভীত এবং অসহজ হয়ে পড়েছিল, আর এখন পুরোপুরি বিমূঢ় হয়ে পড়ল এইসমস্ত নতুন শব্দ ও ধ্বনির আগমনে, ভাবছিল পুরানো শব্দগুলো যেসব সে চিনত, সেগুলো মিলিয়ে গেল কোথায় ?


৭.

নতুন বসন্তের কলকাকলি ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল। যতই দিন যেতে লাগল, সূর্যের উত্তাপ ততই প্রকৃতিকে তার নিজস্ব ছন্দ ফিরিয়ে দিতে লাগল। জীবন আবার পুরনো গতি পেতে শুরু করল। পুরো থ্রটল ঠেলে দেয়া ইঞ্জিনের মতই সে সামনের দিকে ছুটতে আরম্ভ করল। তৃণভূমি সবুজ হয়ে উঠল, বাতাস ভারী হয়ে উঠল আমের বোলের গন্ধে।

ঠিক হল যে, বালকটিকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হবে, মাঠের মাঝ দিয়ে কাছের নদীতীরে।

মা তাকে কোলে নিল। ম্যাক্সিম চাচা ক্রাচে ভর দিয়ে তাদের পাশে পাশে হেঁটে চলল। তারা মাঠ পার হয়ে নদীপারের একটা সবুজ-ছাওয়া টিলার দিকে হাঁটল, সূর্যের আলো ও বাতাস একে একেবারে খটখটে শুকনো করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। টিলার উপর থেকে চারপাশের এলাকাটি আরো পরিষ্কার ও বিস্তৃতভাবে দেখা গেল।

মা হঠাৎ তার ধরে রাখা বালকের ছোট্ট মুঠির মধ্যে একটা চাপ অনুভব করল। বসন্তের প্রমত্ত যৌবন বালকটির মাকেও উতলা করে দিয়েছে আজ, ফলে বরাবরের মত ছেলের অস্বস্তিতে তাকে সংবেদনশীল দেখা গেল না। মা হেঁটেই চলল, মাথা উপরের দিকে তুলে, বসন্তের বাতাসে বুকভরা গভীর নিঃশ্বাস নিতে নিতে। নিচের দিকে যদি সে একমুহূর্তের জন্যও তাকাত, তাহলেও সে তার ছেলের বিপন্ন মুখভঙ্গি দেখতে পেত। বালকের অন্ধ চোখ সরাসরি সূর্যের দিকে ফেরানো, ঠোঁটদুটো ফাঁক হয়ে থাকা, পরিষ্কার বিস্ময়। সে খুব ছোট ছোট কিন্তু দ্রুত নিঃশ্বাস নিতে লাগল, ডাঙ্গায় তুললে মাছ যেমন করে। একসময়, তার বিপন্ন বিস্ময়ের আভা ভেদ করে মুখে ফুটে উঠল অনাবিল আনন্দের এক ভঙ্গি, বিপন্নতাকে এক লহমায় হটিয়ে দিয়ে ছোট্ট মুখটিকে আলোকিত করে তুলল সেই আভা। এর পরের মুহূর্তেই আবার সেই বোবা বিস্ময়, ভীত অনুসন্ধান। শুধু তার দেখার চোখজোড়া থাকল অচঞ্চল, দেখল না কিছুই, প্রকাশও করল না কিছু।

তারা ছোট্ট টিলাটির ওপরে উঠে ঘাসে ছাওয়া চূড়াটিতে বসল। অন্ধ শিশুটিকে তার মা তুলে নিয়ে এমনভাবে বসাল যেন তার আরাম হয় এবং তখনো সে তার মার হাত খামচি দিয়ে ধরে থাকল, যেন ভয় পাচ্ছে পড়ে যাবে, যেন তার পায়ের নিচে মাটি ঠিকমত খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু আবারও, বসন্তের সৌন্দর্যে বিমোহিত মা সেসব খেয়াল করল না।

সময়টা ছিল মধ্যদুপুর, ঘন নীল আকাশে সূর্যের অবিচল মূর্তি। আর নিচ দিয়ে চওড়া এবং গভীর নদীটি বসন্তের আশির্বাদে পূর্ণ হয়ে কলকল বয়ে যাচ্ছে। সবেমাত্র শীতের খোলস ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছে সে, এখানে ওখানে এখনও বরফের খণ্ড খণ্ড টুকরো ভাসছে - উজ্জ্বল আয়নার মধ্যে যেন সাদা সাদা ফোঁটা। তীরের জলঘাসগুলো প্লাবিত হওয়ায় গোটা এলাকাটিকে একটা বড়সড় বিলের মত দেখাচ্ছে; সেখানে মেঘের সাদা মিনার প্রতিফলিত হয়ে ফিরে ফিরে হারিয়ে যাচ্ছে, নদীর মধ্যে বরফের টুকরোর মতই। আর মাঝেমধ্যে বাতাস এসে জলের মধ্যে ঢেউয়ের দোলা তৈরি করে, সূর্যের আলোয় চকচক করে ওঠে নদী। নদী ছাড়িয়ে, দূরে, কালো, ভেজা ও আবাদযোগ্য সারিসারি মাঠ বিছিয়ে, আর কাঁপা কাঁপা কুয়াশার ঐ পাড়ে দেখা যায় কার যেন খড়ে-ছাওয়া গোয়াল, একেবারে বনের ঘন নীল কিনারায়। মনে হচ্ছে ধরিত্রী যেন শ্বাস ফেলছে, লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস, আকাশের উপাসনা করতে গিয়ে ধূপের সুগন্ধি জ্বালছে এখানে ওখানে।

সমগ্র প্রকৃতি আসলে একটা বিশাল মন্দির, যেখানে সে একটা ছুটির আয়োজনের মাঝে বিন্যস্ত হয়ে আছে। কিন্তু অন্ধ শিশুটির কাছে তা শুধুই অন্ধকার, বিশাল এবং সীমাহীন; একটা অন্ধকার যা অনভ্যস্ত ক্রোধের মত তাকে ঘিরে রাখে, যা প্রতিটি নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাকে নাড়ায়, ঝাঁকায়, বাজায় - এবং এত বিচিত্রভাবে যে তার হৃৎস্পন্দন বেদনাদায়কভাবে বাড়তেই থাকে।

যখন সে দরজার বাইরে প্রথম পা দিল, যখন সূর্যের আলো সরাসরি তার মুখে এসে পড়ল, তার চামড়ায় উত্তাপ ছড়াল, সে তখন সহজাত প্রবৃত্তির বশেই তার অন্ধ চোখজোড়া সূর্যের দিকে ফেরাল, যেন বুঝতে পেরেছে সে এটাই জগতের কেন্দ্র। চারপাশের দিগন্তবিস্তার, উপরের অসীম নীল - এসব সে কিছুই জানে নি তখন। সে শুধু বুঝতে পেরেছিল যে কিছু একটা জিনিস, হালকা, ছুঁয়ে যাওয়া, তার মুখ ছূঁয়েছে এবং মুখে উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়েছে। আর তারপর কিছু একটা, ঠাণ্ডা ও আলোময়, কিন্তু সৌর আলোর চেয়ে কম উত্তাপময় - তার মুখ থেকে ঐ উত্তাপকে ঝেঁটিয়ে দিয়ে ঠাণ্ডা এক আবেশে মুখখানি ভরিয়ে দিল। বাড়ির ভিতরে কিভাবে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে হয় সেটা শিশুটি শিখেছিল। সেখানে স্পেস ছিল শূন্য। কিন্তু এখানে - এখানে সে এমন কিছু দিয়ে বেষ্টিত যা ঢেউয়ের মত তার দিকে ছুটে-ছুটে আসছে, ব্যাখ্যার অতীত বৈচিত্র্য নিয়ে; এই বুলাচ্ছে নরম হাত, এই আবার পেশী জাগছে, জাগিয়ে দিচ্ছে। সূর্যের গরম ভাপ তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে হারিয়ে যাচ্ছে, বাতাস তার গালে গ্রীবায় খেলছে, থুতুনি থেকে কপাল পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে, যতক্ষণ না তার কানে বেজে ওঠে বাতাসের মধুর সঙ্গীত, যেন তারা চাইছে এই অন্ধ বালকটিকে তুলে এমন এক জায়গায় নিয়ে যেতে যে জায়গাটি তার অন্ধ চোখের অধিগম্য নয়। এই অনুভূতি তার চেতনাকে বেভুলো করছে, অবসন্ন করে দিচ্ছে। শিশুটি তার মায়ের হাত জোরে আঁকড়ে ধরে রাখল, দ্রিম দ্রিম কাঁপছে তার হৃদপিণ্ড, বন্ধ হবার উপক্রম।


তাকে ঘাসের ওপর বসিয়ে দেয়া হলে সে প্রথমে কিছুটা সহজ বোধ করল। বিপন্নতার অনুভূতি তখনও তার ছিল, তার হৃদয় পূর্ণ করে ছিল, তবে এখন সে তার চারপাশের শব্দগুলোকে আলাদা করতে পারছে। অন্ধকার ও তার ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া ঢেউগুলো তখনও আগের মতই তার কাছে আসতেছিল। মনে হচ্ছিল ঢেউগুলো যেন তার শরীরের ভিতর ঢুকে পড়ছে; তার রক্তধারা শিরার ভিতর যেন সেই ছন্দেই বইছে। এখন অবশ্য নানান ধ্বনিও ভেসে আসছে: ভরত পাখির কাঁপা কাঁপা ডাক, বার্চ গাছের নতুন পাতার মৃদু মর্মর, নদীর ছলছলাৎ। কাছাকাছি একটা সোয়ালো পাখি চক্কর খেয়ে গেল, ওর হালকা ডানায় শিস ধরিয়ে; ডাঁশমাছিগুলো ভনভন করছিল, এবং, দূরের মাঠে কোন কৃষক তার হালের বলদজোড়াকে টেনে নিতে গিয়ে হেট হেট বলছিল, একটু থেমে থেমে, সেই বিষণ্ন শব্দগুলোই ভেসে ভেসে আসছিল।

কিন্তু অন্ধ শিশুটির পক্ষে এই সবগুলো শব্দকে তাদের ঐকতানের মধ্যে অনুধাবন করে ফেলা সম্ভবপর ছিল না। সে তাদেরকে একত্র করে বুঝতে পারছিল না, তাদের স্ব স্ব প্রেক্ষাপটের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বুঝতে পারছিল না। এগুলো সবই ছিল আলাদা আলাদা; এই দৃষ্টিহীন বালকের ছোট্ট মাথার ভিতরে একটা একটা করে ঢুকছিল: কোনোটা নরম, কোনোটা অস্পষ্ট, কোনোটা চড়া, পরিষ্কার এবং কানে তালা লাগানোর মত। কখনো কখনো শব্দগুলো একসঙ্গে আসে, একটা বেসুরো সমাবেশের মধ্যে যেন একটা অপরটার ওপর হামলে পড়ে। তখনো মাঠের শিস ধরানো বাতাস তার কানে শিস ধরিয়েই চলছিল।


[ভ্লাদিমির করলেংকো-র "দ্য ব্লাইন্ড মিউজিশিয়ান" উপন্যাসের একটা অংশ, অনুবাদ করেছিলাম "দেখা না-দেখার চোখ" বইটির জন্য]


কবিসভার মডারেশন বিষয়ে

[কবিসভায় একবার মডারেশন প্রসেস নিয়া বেশ তর্ক হয়। সেলিম রেজা নিউটন ও সজল খালেদ এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেন। এই প্রেক্ষিতে আমার নিচের লেখাটি পোস্ট হয় ২০০৫ সালের ১৮ আগস্ট।]


ব্রাত্য রাইসুর মডারেশন-পদ্ধতি তথা পুরো মডারেশন প্রসেস নিয়াই কথা উঠছে।

সেলিম রেজা নিউটন অনেক কথা বলছেন। তিনি ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ। আজকাল অনেক পাবলিক ফোরামেই উনার ক্ষোভ, প্রশ্ন, অভিযোগ, ক্রোধ প্রকাশ পাইতে দেখতেছি। কবিসভার মডারেশন নিয়া উনি যে খুব ভাবিত সেইটা উনার পত্রে পরিষ্কার বোঝা যায়। শুধু উনার ভাবনা নয়, অন্যরা সে বিষয়ে ভাবিত না বৈলা তিনি (এবং সজল খালেদ) তাদের ওপরও নাখোশ। তার ওপর নিউটন আবার এই সাইলেন্ট শ্রেণীকে ‘রাইসুর পছন্দের মানুষ’ আখ্যা দিছেন। এখানে একটা কথা:


ভাই নিউটন/সজল, আপনের যেমন কোনো বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানানোর অধিকার আছে, তেমনি আরেকজনেরও তো সে বিষয়ে প্রতিক্রিয়া না-জানানোর অধিকার আছে। আবার আপনে যে বিষয়কে নিন্দাযোগ্য ধিক্কারযোগ্য মনে করতেছেন, সেইটা অন্যজনে নিন্দাযোগ্য/ধিক্কারযোগ্য মনে নাও করতে পারে। নয় কি? আগেভাগেই অন্যের নীরবতার ভাষ্য তৈয়ার কৈরা আপনে কি নিজের জ্যোতিষশাস্ত্রীয় দতা জাহির করলেন?

তাইলে? আপনের উত্তাপে আপনে উত্তপ্ত হন, মডারেটররে উত্তপ্ত করেন, উনার চৌদ্দগুষ্ঠিরে উদ্ধার করেন. কিন্তু আমাদের নীরব থাকনের অধিকার নষ্ট করতে চাইতেছেন ক্যান? আমরা যখন নানাবিষয় নিয়া কথা কৈবার চেষ্টা করছি, ঝগড়াবিবাদ করছি, তখন তো আপনেরে টাইনা হেঁচড়ায়া নামাইতে চেষ্টা করি নাই। করছি?

আপনি কৈবেন, এইটা একটা জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। মডারেশন। তাইলে? একটা বিষয়ের ওপর আপনের/আপনাদের ভ্যালু এডিশন এবং সেইমত আমাদের নীরবতার ওপর হামলা কি গণতন্ত্র এবং পরমত সহনশীলতার নর্মস মাইনা চলতেছে? ভাইবা দেখেন তো?

যাক, আমাদের অংশগ্রহণ না করার অধিকার ছিল, আপনেরা সেইটা জব্দ করলেন।

অংশগ্রহণ করি।

ইয়াহু গ্রুপের মডারেশন নিয়া অনেকেই মূল্যবান তথ্য জানাইছেন। কিন্তু আমি আরেকটু নন-টেকনিক্যালি ভাবতে চাইতেছি। কবিসভায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানাইছিলেন মডারেটর। উনার পজিশনটা মাইনা নিয়াই আমি এইখানে যোগ দিছিলাম। আমি (বা যে কেউ) যখন এইখানে যোগ দেই, সেইটা এইজন্যই দিছি যে, এইখানে যারা আছেন তাদের সাথে আমার যোগাযোগ খুব ফলদায়ক এবং প্রীতিকর হবে, এবং এর মডারেটর-সহ অন্য অনেক সদস্যের সাহিত্যবোধকে আমি অনুমোদন করি।

আরেকটা বিষয়। নিউটন বলছেন, কেউ যদি খারাপ চিঠি লেখে তাইলে জনমতের ভিত্তিতে তারে বহিষ্কার করলেই তো হয়। হয় নিউটন? ভাবেন তো, আপনেরে আমি একটা খারাপ চিঠি লেখলাম। সেইটা পাওয়ার পরে সভা আমারে বহিষ্কার করল। কিন্তু ঐ খারাপ চিঠি পইড়া আপনের যে মনমেজাজ বিলা হৈল, সেইটার এলাজ কেডা করব। সেইটার কমপেনসেশন কি? সেই চিঠি অবগত হওনের অপরাধ আপনে করছেন কি না?

উদাহরণ দিই: নিউটনের চিঠির প্রতিক্রিয়া জানাইতে গিয়া পূর্বা নিউটনের বিশ্ববিদ্যালয়-শিকতা এবং পেশাগত সময়পেণের ধরন লৈয়া যে মন্তব্য করলেন, সেইটাও কি খুব শোভন হৈছে? এণে পূর্বার অবগতির জন্য একটা তথ্য দিই: আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য সরকারি শিাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী বেতনভাতা রেভিনিউ বাজেট থিকা দেয়া হয়; অর্থাৎ দেশের জনগণ যে ট্যাক্স দেয় সেইটা। আপনের ট্যাক্সের পয়সা যেইটা আমেরিকা থিকা খয়রাত হিসাবে আসে সেইটা থিকা বিশ্ববিদ্যালয় শিকের বেতন দেয়া হয় না। আর কে জানে, আপনেও যে-বেতন থিকা ট্যাক্স দিতেছেন, সেইটা ইরাকের তেলবেচার পয়সা কিনা!

এইটা নিশ্চয়ই মডারেটরের হস্তক্ষেপের জায়গা ছিল। কিন্তু ভাই নিউটন, আপনেই তারে সেইটা করতে নিরুৎসাহিত করলেন।

এখন আপনে ঐ চিঠি পইড়া বিলা হৈয়া মুড-অফ কৈরা বইসা থাকবেন, আর কবিসভায় আমরা ভোটাভুটি করুম। বাহ!!!!!!!

এইজন্যই গণতন্ত্ররে মার্কস কৈছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বেচ্ছাচার !

মোটকথা হৈল, রাইসু এই সভার মডারেশন করতে গিয়া উনার ব্যক্তিগত রূচি দিয়াই চালিত হৈতেছেন। আমি সেইটার পক্ষে। কেবল রাষ্ট্রীয় প্রশ্নে আপনেরা নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান রাখেন, দয়া কৈরা একটা সাহিত্যিক ফোরামের ওপর এই গুরুভার চাপাইতে যায়েন না। মডারেটর যদি যুক্তিহীনভাবে চলেন, তবে উনারে তুলোধুনা করনের ব্যবস্থা এই ফোরামে আছে। আর সেই যুক্তির যথার্থতা সমষ্টি মাইনা করা লাগব এমনও না। কেউ ব্যক্তিগতভাবেও সেইটা হাজির করতে পারেন। অন্যরা সরবে বা নীরবে সেইটারে সমর্থন জানায়া যাইতে পারেন। আমার মনে হয়, এইভাবে আমরা সমষ্টিরে বাড়তি দায়িত্ব থিকা রেহাই এই ফোরামরে চলমান রাখতে পারি।

যন্ত্রশাস্ত্রে একটা নীতি মানা হয় : যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো জিনিস চলতে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেইটার ট্রাবলশুট না করা। (চমস্কির যে কথা নিউটন উদ্ধৃত করছিলেন, সেইটার প্রিমাইজ হিসাবে আমি এইটা উদ্ধৃত করলাম)।

কবিসভা চলতেছে। সভার মডারেটর সাহেবের ‘স্বৈরনীতি’ এবং ব্যক্তিগত পছন্দ/অপছন্দ আমাকে অন্তত আমার বক্তব্য প্রদানে কোনো হ্যাম্পার করতেছে না। কারো যদি করে, সেইটা তিনি ফোরামে শেয়ার করতেই পারেন (করতেছেনও), সেইটা নিয়া অন্যরা আলোচনাও করতে পারেন, সেই আলোচনা থিকা মডারেটর লেসনও নিতে পারেন, তবে সেই বিষয়ে আমি একটা পদ্ধতিগত সংবিধান প্রণয়নের বিপক্ষে।


বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০০৮

অভেদ ঘটায়া দেন

(১)


বাংলার ভাবান্দোলন নিয়া টুকরা-টাকরা কথাবার্তা হৈতেছিল কবিসভায়। ব্রাত্য রাইসু এক পর্যায়ে শ্রদ্ধেয় ফরহাদ মজহারকে আমন্ত্রণ জানাইছিলেন ভাবান্দোলন নিয়া কিছু কওনের জন্য। তখনই আমরা জানতে পারলাম যে, ফরহাদ ভাই কবিসভা ‘আনসাব’ করছেন। অর্থাৎ, ভাবান্দোলনের পরিভাষায় কৈতে হয়, ফরহাদ ভাইয়ের কবিসভা বিষয়ে ‘ভেদবুদ্ধি’ হৈছে। ক্যান হৈল? ক্যান অভেদবাদী ফরহাদ মজহার আমাদের নগণ্য কবিসভার সাথে ‘ভেদ’ ঘটাইলেন?

যা পাওয়া গেল, তা হৈল দুধ ও মধুসমেত কবি মাসুদ খানের সৌরভ। তিনি বেশ বিস্তারিত ভাবে ভাবান্দোলন-এর প্রোপট এবং এই সময়ে এর যাথার্থ্য আলোচনা করলেন। তাতে আমরা অনেক বিষয় জানতে ও বুঝতে পারলাম। আবার অনেক বুঝা-বিষয় ঝাপসা হয়াও গেল। যেমন:

মডার্নিজম/পোস্টমডার্নিজম প্রসঙ্গ

মাসুদ খান বেশ যথোচিতভাবে মডার্নিজমকে তুলোধুনা করলেন। তাতে আমরাও আরাম পাইলাম খুব। যে রীতিতে এবং যেসব প্রশ্নে তিনি মডার্নিজমকে তুলোধুনা করলেন সেইগুলা আমরা এর আগে পাইছি নানান পোস্টমডার্ন তাত্ত্বিকদের (যেমন তালাল আসাদ, সমীর আমিন প্রমুখ) রচনায়। অর্থাৎ মাসুদ ভাই মডার্নিজম বধ করলেন পোস্টমডার্নিজমের কান্ধে বন্দুক রাইখা। আবার এর পরপরই তিনি পোস্ট মডার্নিজম বধ করতে চাইলেন, না জানি কার কান্ধে বন্দুক রাইখা! বুঝলাম না। তিনি লিখলেন:

নতুন সে বাহানার নাম পোস্ট-মডার্নিজম, যা, আমরা মনে করি, মডার্নিজমেরই স¤পূরক এবং তারই এক বাড়িয়ে নেওয়া রূপ; যদিও অনেকেই মনে করেন, পোস্ট-মডার্নিজম মডার্নিজমের অনুগামী তো নয়ই বরং বিরুদ্ধ এক দর্শনের নাম। আমরা অবশ্য তা মনে করছি না। আমাদের বিবেচনায়, নয়া-উপনিবেশবাদী কালপর্বে পোস্ট-মডার্নিজম হচ্ছে সেই অভিনব মলম, যা উদ্ভাবিত হয়েছে মডার্নিজমেরই কারখানায়, মডার্ন সভ্যতারই জখমগুলোর জ্বালাপোড়ায় উপরি-প্রলেপ দেবার জন্য, নজর নানা দিকে ঘুরিয়ে দেবার জন্য।

মডার্নিজমের কারখানায় কিভাবে পোস্টমডার্নিজম পয়দা হৈল, এইটা মাসুদ ভাইয়ের কাছে বুঝতে চাই।


অভেদতত্ত্ব

প্রাক্সিস-এর দিক থিকা অভেদবাদ একটি বিপদজনক ইস্যু মনে হয় আমার কাছে, বিশেষত আমার মত সাধারণ মানুষের জন্য। এমনকি যারা অসাধারণ মানুষ, তারাও এর নানাবর্ণের ফাঁদ সবসময় এড়ায়া যাইতে পারেন বৈলা আমার মনে হয় না। এই কথা মনে রাইখাই শুরুতে আমি ফরহাদ ভাইয়ের কবিসভা আনসাব করার কথা কৈছিলাম। মাসুদভাই সকল ভেদ-এর অবসান দেখেন বাংলার ভাবান্দোলনে। এই ভাবান্দোলনের প্রণোদনা থিকা যখন তিনি নিজেদের জন্য রাজনৈতিক এজেন্ডা খোঁজেন, তখন কিন্তু আমরা নানারকমের ‘ভেদ’এর ঘোষণা দেখতে পাই। আসল ও নকলের ভেদ, দেশী ও পশ্চিমের ভেদ, ভারতচন্দ্র ও বোদলেয়ারের ভেদ, ইত্যাদি। মাসুদ খান যখন (খুব সঙ্গতভাবেই) একটি মতাময় পশ্চিমকে এই বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে দেখেন, সেইটা কি উনার দৃষ্টিতে ‘আদার’ হয়া থাকতেছে না? তাইলে কিভাবে সার্বজনীন ভেদবুদ্ধিবিনাশ সম্ভব ?

(জ্ঞানের কর্তা ও বিষয়ের অভেদ নিয়াও একইরকম আপত্তি করা যায়)



অনেক-এর দাসত্ব

মাসুদ খান লিখেছেন:

মডার্নিজমের অন্যতম আরাধ্য বিষয় ছিল ব্যক্তির মুক্তি। মডার্নিজম হন্যে হয়ে খুঁজেছে মুক্তির পথ। শুনিয়েছে মহা- মহা কেচ্ছাকাহিনী। কিন্তু খুঁজে খুঁজে না পেয়ে পোস্টমডার্ন কালপর্বে এসে বলা হচ্ছে যে, মুক্তি অসম্ভব। অথচ বাংলার ভাবুকতার ধারা অনেক আগে থেকেই ইঙ্গিত দিয়ে আসছে যে, স্বেচ্ছায় ‘অনেক’-য়ের দাসত্ব গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই সম্ভব হয় ‘এক’-য়ের মুক্তি, অর্থাৎ ব্যক্তির মুক্তি। অনেক-য়ের মুক্তির মধ্য দিয়েই সম্ভব হয় এক-য়ের মুক্তি।

এইখানে একটা প্যারাডক্স আছে। মাসুদ খান কৈলেন, ব্যক্তির মুক্তি সম্ভব যদি সে ‘স্বেচ্ছায়’ অনেক-এর দাসত্ব গ্রহণ করে। আবার ‘মুক্ত’ ব্যক্তিসত্তা ছাড়া কি কারো পে স্বেচ্ছায় অনেক-এর দাসত্ব গ্রহণ করা সম্ভব? তাইলে কোনটা আগে হৈবে? ব্যক্তির মুক্তি, নাকি অনেক-এর দাসত্ব? সেই বিখ্যাত ডিম-মুরগির সমস্যা!

আরেকটা বিষয়: এই লেখার শিরোনাম ‘দুধমধুর সৌরভ’ ক্যান হৈল? নামকরণের সার্থকতা কি? দুধ আর মধুর মত দামী খাওয়াখাদ্য’র সাথে দৈন্যভাবের কী সম্পর্ক? (এইগুলা নিয়মিত খাইলে কি দৈন্যভাব আসনের সম্ভাবনা আছে ?) ‘দৈন্যভাব’ নিয়া আমার আরো কিছু জিজ্ঞাস্য আছে। একসাথে আর সেইটা না করি। আশা করতেছি, এই প্রশ্নগুলো থিকা মুক্ত হয়া যাইতে পারলে আপনে-আপনেই আমার বাদবাকি জিজ্ঞাস্য তিরোহিত হয়া যাইব।

আসেন মাসুদ ভাই, অধমের সাথে বাংলার ভাবান্দোলনের অভেদ ঘটায়া দেন।


ঢাকা, ২৭ আগস্ট ০৫


(২)

ভেদ ঘুচল না অধমের।

জনাব রাদ আহমেদ দয়াপরবশ হয়া আমার একটা প্রশ্নের ‘ভেদ’ ঘুচাইতে চাইলেন। বা, বলা যায়, ঐ প্রশ্নের বৈধতা বা যাথার্থ্য নিয়া কিঞ্চিৎ আশ্চর্য হৈলেন। তিনিও মনে করেন পোস্টমডার্ণিজম মডার্ণিজমেরই একটু সম্প্রসারিত চেহারা। গোরি গোরি মুখরি মে কালে কালে চশমা! আর কিছু নয় ইহা, মডার্নিজমেরই কারিশমা!!

রাদ লিখলেন:
modernism er ak_adorshe sobaire Taina anar jei attitude bidyoman
cHilo - taar protikriya hisabe jeisob jinisgula jonmo nitesilo (ba
akhono nitese), accentuated hoitesilo (brindo-jounota korum, cu-clax-
clan korum, neo_natsi korum, gay-lesbian bibaho korum etc. )
seigulare swikriti diya nijer dole Taina ainar jonyei pomo-r
obotarona korse sei aki pokkho - ei rokom bhaba jae. mane 'talgaacHta
tomari thak - kintu tumi amar' jatiyo akTa byapar ....

aar ekhan thekei suman rahman jei "modernism er karkhanae kibhabe
postmodernism poyda hoilo - eiTa Masud bhaier kacHe bujhte chai" -
proshno korsen - seiTar uttar nihito acHena?


নিহিত নাই, রাদ। এইটা একটা রাজনৈতিক ভাষ্য। আমি প্রশ্ন করতেছিলাম, জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রোপটে দাঁড়ায়া। যে জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়া মডার্নিজম বিকশিত হৈছে, পোস্ট মডার্ণিজম সেই ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ জানাইছিল। যে বুদ্ধির চর্চা পশ্চিমের হাতে মতা তুইলা দিছে, পোস্ট মডার্নিজম সেই বুদ্ধির চর্চাকে উদলা কৈরা দিতে চেষ্টা করছে। মাসুদ খান যে ভাষায় মডার্নিজম-রে তুলাধুনা করলেন, ঐটা পোস্টমডার্নিজম/ পোস্ট কলোনিয়ালিজম-এরই ভাষা। আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন যে, পোস্টমডার্ণিজম বা পোস্ট কলোনিয়ালিজমের মূল চিন্তকদের অধিকাংশই জগতের পেরিফেরির বাসিন্দা। কু-কাক্স-কান বা গে-লেসবিয়ান বিবাহ কোরামকে (বা আরো যেসব কোরামের কথা কৈলেন আপনে) পোস্টমডার্ণিজম কিভাবে স্বীকৃতি দিছে? এইটা তথ্য হৈলে দয়া কৈরা রেফারেন্স দিয়েন, আর আপনের নিজের ভাষ্য হৈলে বিস্তারিত জানাইয়েন। আপনের এই ব্যাখ্যা হয়ত আমার দৃষ্টিভঙ্গির খোলনলচা আগাগোড়া ফাটায়া দিতেও পারে।

মাসুদ খান (এবং শ্রদ্ধেয় ফরহাদ মজহারও) যখন মডার্নিজমের বিপে যুক্তি দাঁড় করাইতে যান, তখন পোমো পাটাতন ব্যবহার করেন। কিন্তু পোমো-র পাটাতন বড় নড়বড়ে, বা উহার কোনো স্থায়ী পাটাতনই নাই। উহা সর্বদা নিজকে চ্যালেঞ্জ জানাইতে ভালবাসে। ফলে পাটাতনবাসী লোকজন যাহারা নিজেদের কোথাও না কোথাও স্থায়ী দেখিতে চাহেন তাহাদের বড় অসুবিধা! কী ঘর বানাইবেন তারা শূন্যের মাঝার?

ফলে পোমো-র বিরূদ্ধে একটা রাজনৈতিক অবস্থান। এইটা বৈলা স্বস্তি পাওয়া যে, পোমো মডার্নিজমের-ই সম্প্রসারিত রূপ। আমার এক শিক ছিলেন, তিনি খুব ভাল পোমো পড়াইতেন। উনারে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, স্যার, আপনে কি পোমো? তিনি হাইসা কৈলেন যে তিনি পোমো নন, তবে তিনি ক্রিটিক অব পোমো। অর্থাৎ তিনি আসলে মডার্নিস্ট, আউটডেটেড হয়া যাওনের ভয়ে একটু ঘুরায়া বলেন।

তাইলে পোমো’র ক্রিটিসিজম কি? প্রধান ক্রিটিসিজম হৈল, পোমো এনার্কি পয়দা করে। এনার্কি বুদ্ধিবাদের অপছন্দের জিনিস, যেহেতু বুদ্ধি ফাইন্যালি স্বত্ব-ই প্রতিষ্ঠা করে। পোমো হৈল ‘এনিমি প্রপার্টি’র মত, লিজ নেওন যায়, কিন্তু এর ওপর দালানকোঠা বান্ধা যায় না। ফলে, আমাদের মডার্নিস্ট মিস্ত্রী-রা বেকার হৈয়া যাইবেন! তাই, মাসুদ খানের পোমো-ভাষ্য এবং রাদ আহমেদ এর সমর্থন দুইটাই রাজনৈতিক প্রণোদনাজাত এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক থিকা সেই সাবেকী মডার্নিস্ট পাটাতনের ওপর খাড়ায়া আছে দেখতেছি।

যেসমস্ত কুঠুরিতে মতা কেন্দ্রীভূত হয়, বা হৈতে পারে, পোমো তার পদ্ধতিগত এনার্কি লৈয়া সেইসব কুঠুরিতে হানা দেয়। ফলে, ভাবান্দোলনের সাথে পোমো-র একটা গেহেরি শত্র“তা হৈবার সম্ভাবনা। বাংলার ভাবান্দোলন নিম্নবর্গীয় মানুষের ভাবকে যেভাবে সাহিত্যে একটা সার্বজনীন প্রাক্সিস-এর জায়গায় নিয়া যাইতে চাইতেছে, একটা মতাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বাসনা তার দৈন্যভাবের মধ্যেও কি নাই? যদি থাকে, তবে সেইটা বিদ্যমান মধ্যবিত্ত রূচি, সাহিত্যের বিচিত্র সম্ভাবনা এবং আরো আরো কেন্দ্রাতিগ প্রান্তিক ভাবনারাশির ওপর জবরদস্তি হয়া যাইতেছে কি না, সেই প্রশ্ন পোমো করতেই পারে।


ঢাকা, সেপ্টেম্বর ০৫




আরো কয়েকটি নিন্দাপ্রস্তাব

আবু লাহাব তার নিজের পাতা ফান্দে নিজেই পড়ছিলেন। এইবার ব্রাত্য রাইসু পড়লেন!

প্রথমত, রবীন্দ্র-তর্ক অংশে আমি পোস্ট কলোনিয়ালিজম-এর প্রসঙ্গ তোলাতে রাইসু আমার কাছে পোস্ট কলোনিয়ালিজম সম্পর্কে তলব করছিলেন। আমি আমার সাধ্যমত উত্তর করেছিলাম। উনি আমার কাছে একটা তালিকা চেয়েছিলেন। আমি সেই তালিকাটিও সরবরাহ করতে চেষ্টা করছি। তাতে, আমি বা পোস্ট কলোনিয়ালিজম কারো সম্মানহানি ঘটে নাই বৈলা আমার ধারণা। এই বেলা আমি সলিমুল্লাহ খানের সাহিত্যকীর্তির তালিকা চাওয়ায় (আমি উনার লেখা সত্যি সত্যিই পড়ি নাই, তবে তিনি প্লেটোর সংলাপের অনুবাদ করেছেন শুনেছি। সেই বই পড়ার আগ্রহ আমার হয় নাই), রাইসুর ভাষায়, তারে ‘অপদস্ত’ করা হৈল! আপনি চাইলে হয় জিজ্ঞাসা, আমি আমি চাইলে হয় অপমান!

আমি এই দ্বৈত আচরণনীতির নিন্দা করতে চাই।


দ্বিতীয়ত, কবিসভা ও সঞ্চালন নামক এই ইলেকট্রনিক যোগাযোগপ্রক্রিয়া চালু হৈবার প্রাক্কালে কিছু মৌলিক বিষয়ে আমাদের বোঝাপড়া হইছিল। এর একটা ছিল, এখানে কেউ আইকনত্ব নিয়া হাজির হৈবেন না, আবার কেউ কারো তল্পি বহনও করবেন না (সুব্রত দা এ বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন তার চিঠিতে)। এইরকম একটি প্রিমাইজের ওপর দাঁড়াইয়া ‘কবিসভা’ নামক একটি মডারেটর নিয়ন্ত্রিত সমাবেশে তুষার দাশ এবং টিপু সাহেবের ঐরকম আইকন-বানানো/আইকন-তোষণমার্কা চিঠি আসল কেমন কৈরা? কেউ একজন কেন ভিভিআইপি মর্যাদা পাইতেছেন না, সেইটার হাহুতাশ শুনবার জন্যই কি আমরা কবিসভা খুলছি? যদি তাইই হয় বলেন, আমি নিজেরে আনসাব কৈরা নিমু এখান থিকা। যদি তা না হয়, তবে সেই ফালতু জিনিস আমার পাঠতালিকায় উঠায়া দেওয়ার দায়দায়িত্ব জনাব মডারেটর-এর।

এই দায়দায়িত্ব মডারেটর স্বীকার না করলে আমি সেই আচরণেরও নিন্দা করতে চাই।

তৃতীয়ত, আপনার কথা শুইনা আমি অনুমান করতে পারি জনাব সলিমুল্লাহ খান একজন ভাল চিন্তক। কিন্তু এরকম একজন ভাল চিন্তকের প্রশংসা করতে গিয়া তুষার দাশ এবং টিপু যেসমস্ত চিন্তাহীন, উদ্ভট এবং হাস্যকর কথাবার্তা বলছেন (যেমন উনারে ভিভিআইপি মর্যাদা দেয়া উচিত, বাঙ্গালি জাতির উনারে বোঝা উচিত!!!!) সেইসব কথার মাধ্যমে ঐ ব্যক্তিত্বকে প্রকারান্তরে অপদস্তই করা হৈছে বৈলা আমি বিশ্বাস করি। কারো হয়ত মনে হৈতে পারে যে, এইগুলো উনাদের ভক্তি-উৎসারিত বাড়াবাড়ি, ফলত মার্জনীয়। আমি সেইটা মনে করি না, কবিসভায় আমরা ভক্তিমূলক গান শুনতে বসি নাই! তো, আপনি জনাব সলিমুল্লাহ খানকে ভক্তিবেশে ঐরকম অপদস্তকরনেরও নিন্দা করেন নাই। আমি আপনার এই ধরনের নিদ্রিত মনোভাবের তীব্র নিন্দা করতে চাই।

চতুর্থত, আমি প্রতিভা শব্দটিকে কীর্তি অর্থে ব্যবহার করছিলাম। আমার মনে হয়, কেউ যদি আমার সামনে কারো কীর্তির প্রশংসা করেন যে কীর্তির সাথে আমি পরিচিত নই, তাইলে সেই কীর্তি সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাওয়ার মধ্যে দোষের কিছু নাই।

ফলে, পঞ্চমত, আপনি যে বিষয়টিকে দেখতেছেন ‘প্রতিভার যাচাই’ শিরোনামে, সেই বিষয়টিকে আমি ‘দেখতেছি প্রতিভা অনুধাবনকারীর যাচাই’ শিরোনামে। সলিমুল্লাহ খান এইখানে একটা নাম মাত্র। আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে, উনার নামটি এই আলোচনায় ব্যবহৃত হইতেছে। উনারে খাটো বা অপদস্ত করার কোনো অভিপ্রায় আমার নাই, কারণ উনার কীর্তির সন্ধান আমি এখনও নিতে পারি নাই। একটা সত্য গল্প কই: কবি আল মাহমুদের এক ভক্ত একদা আপ্লুত হৈয়া কবিরে জিগাইলেন, মাহমুদ ভাই, আপনি এত লোকশব্দ লোকশব্দ লয়া আছেন, বইয়ের নাম ক্যান ‘কালের কলস’ রাখলেন, ‘কালের ঠিলা’ রাখেন নাই ক্যান?

আমি সেই ভক্তিদশার কথা বলতেছি, রাইসু!



ঢাকা, ২৭ মে ২০০৫

আসলে এইটা একটা লাঁকানিয়ান এনালিসিস হৈয়া উঠতে পারতো

জয় গুরু সুবিমল!! আসেন, শুরুতে দুইটা নির্ভেজাল কোটেশন খেয়াল করি:

১.
ঘটনা আর রটনায় পার্থক্য অনেক থাকে, জানি। একবার এক অধ্যাপকের সাথে সশরীর সাাতে তিনি জানাইলেন যে বৈদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়াইতেছেন। শিক। পরে অন্য সূত্র থিকা জানলাম সেইখানে তিনি ডক্টরাল/পোস্ট-ডক্টরাল রিসার্চ করতেছেন। অর্থাৎ, এক অর্থে, ছাত্র। এখন আমার কী করার আছে?
সুমন রহমানের পোস্ট, বাড়ির (এত) কাছে আরশীনগর!

২.
শুরু করছিলাম ব্যক্তিগত কটাক্ষ নিয়া। সেই কথাটারেই এইবার খুইলা কই। সুমন এই প্রসঙ্গটা দিয়াই তার আলোচনার ইতি টানছেন, আমি সেইখান থিকাই শুরু করতে চাই। ওইখানে কোনো এক অধ্যাপকের গল্প শোনাইলেন তিনি। আজিজ সুপার মার্কেটে নাকি তার লগে দেখা হইছিল। ভালো কথা। কিন্তু সোজা-সাপটা কথা কইবার সাহসটুকুও সুমন অর্জন করতে পারলেন না। তা না হইলে কোন অধ্যাপকের লগে দেখা হইছে তার নামটা কইতে বাধলো ক্যান? ঠিক আছে, মনে কইরা দেই। সুমনের লগে এক সন্ধায় এই অধম অধ্যাপকেরও দেখা হইছিল। সুমনের লগে তখন কবি ব্রাত্য রাইসু আর আমারই প্রিয় ছাত্র কবি রাদ আহমদও ছিলেন। আমিই আপনার লগে প্রথম সাক্ষাতে পরিচয় হওনের সময় কইছিলাম তাইওয়ানে পড়াই। এইবার নিশ্চয়ই সুমনের অধ্যাপকের নামটা মনে পড়বো?
মাসুদুজ্জামানের পোস্ট, খেলারাম খেলে যা!

এইবার চলেন একটু প্লানচ্যাট বাক্সটা খুলি। মহান জাক লাকাঁ আছেন লাইনে:


আমি: লাকাঁ জি, আপনের কাছে একটা নালিশ লৈয়া আসছি। ঐ যে, ড. মাসুদুজ্জামান, তাইওয়ানের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, উনি আমার সাইকো অ্যানালাইসিস কৈরা ফালাইছেন! এখন কী করি?

লাকাঁ: উনি তো সেইটা করতেই পারেন, কপিরাইট নাই এই কর্মের। তাতে সমস্যা কী হৈল?
আমি: উপরের কোটেশন দুইটা একটু খেয়াল করেন....
(খানিক নীরবতা। দীর্ঘশ্বাস)
লাকাঁ: হুম... খেয়াল করলাম। দাগাইছেন কী আপনে?
আমি: জ্বি।
লাকাঁ: হুম... আপনে আজিজ মার্কেটের নাম কন নাই, কিন্তু উনি পাইলেন কৈত্থিকা? আপনেগো ‘ব্যাংলাডেশে’ কি একজনই বৈদেশে অধ্যাপনা করেন নাকি? এক মাসুদুজ্জামানই সম্বল?
আমি: সেইটাই তো আমি আপনেরে জিগাইতে চাইতেছি... কম সে কম হাজার খানেক তো আছে, বৈধ অবৈধ মিলায়া।
লাকাঁ: আমারে জিগাইয়া ফায়দা নাই। এইবার আপনেই উনার সাইকো-অ্যানালাইসিস কৈরা ফালান। টেক্সট তো আপনের সামনেই হাজির আছে।
আমি: আপনে অভয় দিলে করি। একটু খেয়াল কৈরা দ্যাখেন, আমি একটা এক্সাম্পল দিছিলাম। তার সাথে আমার কৈ দেখা হৈছে আমি সেইটা বলি নাই। কিন্তু মাসুদুজ্জামান ঠিকই আজিজ সুপার মার্কেট খুঁইজ্যা পাইলেন আমার লেখার মধ্যে। সরিষার মধ্যে যেমনে কৈরা ভুত দ্যাখে কেউ কেউ। বা দৈ-এর মধ্যে চুন।
লাকাঁ: চালায়া যান....
আমি: দ্বিতীয় বোল্ড অংশটা খেয়াল করেন.... উনি বলতেছেন আমি-ই .... যেন উনি ছাড়া ত্রিভুবনে আর কোনো বঙ্গীয় প্রাণী নাই যে বৈদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে না, এবং যার সাথে ঢাকা শহরে আমার দেখা হৈতে পারে না। ....ই-প্রত্যয় বড় ভয়ানক!

লাকাঁ: কিছু একটা দাঁড়াইতেছে মনে লয়... আচ্ছা, সেকেন্ডারি ডাটা কি আছে, মানে উনার বিষয়ে, আপনের অভিজ্ঞতা ছাড়া....?

আমি: একটা কবিতা আবৃত্তি করতে পারি। ব্রাত্য রাইসু লিখিত...কবিতার নাম ড. (গলা খাকারি দিয়া আমি কবিতাটা পড়তে আরম্ভ করি)

এই নিখিল টেক্সটের সারি
যাহাকে মুগধ করে
তাকে দ্যাখো নিমীলিত নেত্রে ঐ
রয়েছে দাঁড়িয়ে। তাঁকে
বলো ন্যারেটিভ। বলো বাংলা কবিতার
তাবৎ সমস্যা -

তিনি এক বাক্যে - যাহা অতি দীর্ঘবাক্য - বুঝিয়ে বলবেন সব
তোমরা সব মন দিয়ে
শুনো। কোনো আলতুফালতু প্রশ্নট্রশ্ন
জিজ্ঞেস কোরো না। তিনি ডিসটার্বড হবেন। তাঁকে
বলো - হে ডক্টর তিনি মাসুদুজ্ঝামান

দুই বাংলা কবিতার।

লাকাঁ: দুইজনই কি একই ব্যক্তি?
আমি: জ্বি জ্বি। একই ব্যক্তি। বিলকুল এক।
লাকাঁ: হুম। টিপিক্যাল কেইস। আপনের কনকুশন কি?
আমি: কনকুশন, একটু রেটরেকলি কৈলে, এই নিখিল টেক্সটের মিছিলে উনি কেবল উনারেই দেখতে পান। ফলে অন্য আরেকজন অধ্যাপকের দৃষ্টান্ত হাজির কৈরা উনার ইগো-রে তিগ্রস্থ করা আমার উচিত হয় নাই। কবিতার সতর্ক বাণী আমি মানি নাই.... আমি তারে ডিসটার্ব করছি। নানান আলতু ফালতু প্রশ্ন ট্রশ্ন করছি....
লাকাঁ: সেই সব প্রশ্নের উত্তরে কী কৈলেন তিনি/?
আমি: প্রথমে ঐ দৃষ্টান্তকে ব্যক্তিগত কটা হিসাবে গায়ে মাখায়া নিলেন। এতে উনার পাল্টা কটা করবার অধিকার জায়েজ হৈল। তারপর বহুবিধ ভূষণে আমারে ভূষিত করলেন। যেমন: ১. আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞান জ্ঞান অতি (অ)প্রখর, ২. আমি উগ্র জাতীয়তাবাদী, ৩. আমার সোজাসাপটা কথা কৈবার সাহস নাই ৪. আমি হাটহাজারি মার্কা বাজারি গল্প বৈলা সিরিয়াস বিষয়কে নষ্ট কৈরা দেই, ৫. ব্যক্তিগত কটারে আগে নিজের দিকে একটু তাকাইতে হয়, ৬. আমি উনার মূলকথা না ধৈরা ছোবড়া ধৈরা টানাটানি করছি... ইত্যাদি ইত্যাদি।
লাকাঁ: অদ্ভূত বিষয়... উনি কি উনার বক্তব্যের মধ্যে ছোবড়াও রাখেন?
আমি: (স্বগত) আমি তো খালি ছোবড়াই দেখলাম!
লাকাঁ: কী কৈলেন?
আমি: না কিছু না। ভাবতেছি উনারে আমার ‘ডিসটার্ব’ করা একদমই উচিত হয় নাই। অধ্যাপক মানুষ। খালি খালি উনার গালি খাইলাম!
লাকাঁ: যাক...বড়দের গালাগালি খাওনের প্রথা তো আপনেগো দেশে আছেই।
আমি: তা আছে।
লাকাঁ: আর কোনো অগ্রগতি খেয়াল করলেন... ইতিবাচক কিছু?
আমি: কিছু কিছু। তবে সেইগুলারে এমন সুন্দর পলেমিকসের মোড়ক দিয়া মোড়াইছেন তিনি, যে পড়লে মনে হবে ঐটাই বুঝি উনার সবসময়ের পজিশন। দুয়েকটা বলি:
১. উনি এখন ভিসামুক্ত বিশ্ব আন্দোলনের পতাকা নামায়া ফেলছেন।
২. জাতিরাষ্ট্রহীনতার কথাও আর বলতেছেন না তিনি।
৩. মৌলবাদ আর মৌলবাদ বিরোধিতার চক্করে জাতি খাবি খাইতেছে বৈলা উনি যে আগের পোস্টে হাহুতাশ করতেছিলেন, এইবার ক্রুসেড আর জিহাদ-এর দিকে কবিসভার পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ কৈরা আগের পাপের প্রায়শ্চিত্ত কৈরা নিছেন।
লাকাঁ: তাইলে তো হৈলই। আর কিছু কৈবেন?
আমি: উনার এই অগ্রগতিতে আমি অনেক খুশি। তবে শেষ পোস্টের শেষ প্যারার প্রথম বাক্যটা একটু খেয়াল করেন।... তবে আমি এখনও অত্যন্ত জোর দিয়া বলি........... এইভাবে শুরু হৈছে বাক্যটা।
লাকাঁ: এর মাজেজা কি?
আমি: এই ‘এখনও’ শব্দের একটা গোপন ঢোঁক গিলা আছে, টের পাওয়া যায়। অর্থাৎ, যুক্তি না পাইলেও জেদ চালায়া যাইবেন তিনি। মিলুক আর না মিলুক, ছিল্যা ফেলবেন!
লাকাঁ: সমস্যা কি? উনারে চালায়া যাইতে দেন।
আমি: ফি আমানিল্লাহ!
লাকাঁ: আরেকটা কৌতুহল। আপনে এইসব কথা শোনাইতে আমারে ডাকছেন ক্যান?
আমি: আর কাউরে ফ্রি পাই নাই বৈলা। মার্ক্স-এঙ্গেলস থিকা ধৈরা এডওয়ার্ড সাঈদ পর্যন্ত বুক কৈরা ফালাইছেন উনি। সবার লাইন এনগেজড। আপনের নাম নিতে মনে হয় ভুইল্যা গেছিলেন। সেই চান্সে...... হ্যালো, হ্যালো!!!

(এইখানে প্ল্যানচেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হৈয়া যায়)

সিঙ্গাপুর ১৯/৮/৬



মুদ্রার দুইপিঠেই যখন মৌলবাদ!

আমার ‘জাতীয়তাবাদে’ উগ্রতা দেখছিলেন ড. মাসুদ ভাই, এইবার আরো এক কাঠি বাইড়া আমার পরম পূজনীয় প্রবাসী বড়ভাই সুব্রত সেইখানে আবিষ্কার করলেন সাদা পোশাকধারী মৌলবাদ। কারণ?

১. আমি আমার আরেক বড় ভাই কবি সাইফুল্লাহ দুলালের বিদেশগমনের পদ্ধতি নিয়া নীতিগত আপত্তি তুলছিলাম।
২. বড় ভাই মাসুদের ‘যুক্তি’র জবাবে রেটরিক হৈয়া উঠছিলাম যা প্রকারান্তরে বেয়াদবির সামিল!

উনার গলা ঘরোয়া। ‘মৃদু আপত্তি’র নামে তিনি যেভাবে আমারে কাফন দিয়া মোড়ায়া মৌলবাদী সাব্যস্ত করলেন, তাতে ভয়ে গলা শুকায়া আসছিল আমার। পানি খাইতে খাইতে ভাবলাম, বড়ভাইরা হঠাৎ কৈরা এইভাবে খেইপা উঠলেন ক্যান? আমার বুদ্ধি কম বৈলা, নাকি আমার বয়স কম বৈলা?



সুব্রত দা-র সাথে আমার তর্কের ইতিহাস বড় প্রাচীন। প্রায়-প্রতিবারই উনি (উনার সময়ের অভাবে বা আমার যুক্তিপ্রয়োগের নাদান ধরনের কারণে?) আলোচনা শেষ করেন না। এইবার তিনি অন্তত ফলোআপ করলেন। ধন্যবাদ তাঁকে।

এইবার ব্রাত্য রাইসু এবং সুব্রত গোমেজ আমার কথা বলার ধরন নিয়া আপত্তি জানাইলেন। উনাদের কনকুসিভ এবং জাজমেন্টাল হওয়ার ধরন নিয়া খোদ স্রষ্টাও আপত্তি করতে পারতেন, কিন্তু দুঃখের কথা হৈল, মডারেশনের দায়িত্ব আপাতত উনার হাতে নাই। এরকম অবস্থায় পড়লেই মন রেটরিক হৈয়া উঠতে চায়!

না। এইখানে বড়ভাইরা আছেন, উনারা ঠাট্টামশকরার মধ্যেও মৌলবাদের ভূত দেখতে শুরু করছেন।

আসেন তবে, রামগরুড়রীতিতেই কথা বলি। মাননীয় দাদা সুব্রত, আপনের এথিক্স সংক্রান্ত আলাপ (বা প্রলাপ) শুইন্যা আমার বিলাপ কৈরা কান্দতে ইচ্ছা হৈতেছে (কান্দলেও কি বেয়াদপ মৌলবাদী হৈয়া যামু?)। তর্কের খাতিরেই বলি আগে, এথিক্স বিদায় দিয়া আপনে আইন প্রণয়ন/বদল করবেন কিসের ভিত্তিতে? অর্থাৎ ফরাসীরা যে তাদের দেশে বোরখা-পড়া নিষেধ করার আইন করল, তারে আপনে রোধ করবেন কেমনে? মানবাধিকার দিয়া? তো এই মানবাধিকার তৈরি হয় কোন্ মূলনীতিতে? বুইঝেন কিন্তু বিষয়টা। আপনে কৈলেন, আপনে খুন করবেন না, কারণ খুন করলে আইন আপনেরে সাজা দিবে! যদি আইন আপনেরে সাজা না দিতে পারে? অর্থাৎ আপনের যদি আইনের উর্ধ্বে উঠার মতা থাকে, তাইলে খুন করবেন? যেমন বুশ-ব্লেয়াররা ইরাকে করতেছে? উনাদেরও উদ্দেশ্য কিন্তু আপনের মতই, মৌলবাদসংক্রান্ত ‘জটিলতা’ নিরসন। আপনের কথিত ‘জটিলতা’ নিরসনের ল্েযই কিন্তু উনারা আইন প্রণয়ন কৈরা ইরাকে আগ্রাসন জায়েজ করতেছেন।

আপনের আইন আর এথিক্স সংক্রান্ত ভাষ্য এক্কেবারে বুশ-ব্লেয়ারদের ভাষ্য হৈয়া গেল কেমনে?

তারপর ধরেন, এই যে আপনে কৈলেন এথিক্স একটা ব্যক্তিসাপে ব্যাপার, এইটা এত ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট বৈলা দিবার মত বিষয় না। এইটা নিয়া বহুত তর্কবিতর্ক আছে নীতিশাস্ত্রে। আপনের এবং আমার নীতিবোধ, তথা মুসলমান এবং খৃস্টানের নীতিবোধ এক না হৈলে সেইটা নিয়া একে অপরের সমালোচনা করতে পারবে না এইটা কেমন কথা! তাইলে তো পৃথিবীতে মোটামুটি কোনো আলাপই সম্পন্ন হৈবার কথা না! আমার তো মনে হয়, কেউ তার নিজের স্ট্যান্ডার্ডে দাঁড়ায়া অন্য কারো সমালোচনা করতেই পারে, তুলনা করতেই পারে। যেইটারে আমরা কই, কম্পারেটিভ স্টাডি। সমালোচনা করা মানে তো চাপায়া দেওয়া না!

একের মত গায়ের/চোপার জোরে অন্যে চাপায়া দেওয়ার নাম যদি মৌলবাদ হয়, তাইলে আন্ত-পাটাতন সমালোচনা শুনতে না-চাওয়ার ধামকি নিশ্চয়ই ফ্যাসিবাদ। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে এলিট ফ্যাসিবাদ।

পূর্বরাগপ্রণোদিত না হৈলে খেয়াল করার কথা যে, আমি অভিবাসনের বিরোধী তো না-ই, বরং এর পপাতী। কারণ আমি জাতিরাষ্ট্রের বর্তমান বিভেদ-রে উড়ায়া দেওয়ার মত অতিবিপ্লবী আজো হৈয়া উঠি নাই। জাতিরাষ্ট্র যেহেতু একটা বাস্তব সত্য, কাজেই অভিবাসন সত্য। কিন্তু দুলালের অভিবাসন প্রক্রিয়ার ব্যাপারে আমি (আইনি না) নীতিগত আপত্তি তুলছিলাম। ফলে আপনে যে ইমিগ্রেশন আইনের নানান ফিরিস্তি দিয়া সাত কাণ্ড রামায়ণ গাইলেন তা আমার কোনোই কাজে লাগল না। আইনি প্রক্রিয়ায় দুলালের কোনো গলদ নাই সেইটা আমার মত নাদানেরও না-জানবার কথা না। ফলে, বেয়াদবি না নিলে, আপনের মূল্যবান প্রশ্নোত্তর পর্বে আমি আর সামিল না হই!

আপনে কষ্ট কৈরা আমার লেখার মধ্যে ‘ভাবমূর্তি’র ভাবার্থক একটা প্যারাগ্রাফ বাইর করছেন বৈলা শুকরিয়া। কিন্তু আরেকটু অভিনিবেশ নিলে দেখতেন যে ঐ সময়েরই কোনো চিঠিতে আমি বিকল্প একটা শব্দ ব্যবহার করতে চেষ্টা করছি: আত্মসম্মান, বা নিজের কাছে নিজের অবস্থান। মাসরুর-এর শেষ মেইলটা আরেকবার পড়েন, সেখানে তিনি আমার বক্তব্যের একটা সারাংশ দাঁড় করাইতে চাইছেন। ইল-মোটিফ না থাকায় জিনিসটা ঠিকঠাক বাইর করতে পারছেন তিনি।

আর রেটরিক হওয়া, বা আপনের ভাষায়, তামাশা করাটা আপনের কাছে মৌলবাদী পন্থা মনে হৈছে। একটা দৃষ্টান্ত দেই: ধরেন, একজন মৌলবাদীর সাথে আদর্শ আর কর্মপন্থা নিয়া আপনের তর্ক হৈতেছে। তর্কশেষে দেখা গেল আপনের সব ভালো ভালো যুক্তিই তার কর্ণকুহরে হান্দাইতেছে না, সে তার জগতেই সতত বিরাজ করিতেছে। এখন আপনের থিওরি অনুযায়ী:

* গায়ের জোরে আপনের প্রগতিশীল মতাদর্শ তার উপর চাপায়া দিলে আপনে মৌলবাদী হৈয়া গেলেন।
* তার কুযুক্তি নিয়া রঙ্গরস করলেও আপনে সাদা-পোষাকধারী মৌলবাদী হৈলেন।
* আর চুপ থাকলে, যেহেতু আপনার নীরবতাও মৌলবাদ বিকাশে ভূমিকা রাখবে, সেইসূত্রেও আপনেরে মৌলবাদী কৈতে পারে কেউ কেউ!

তাইলে আপনের রাস্তা কোনটা? আসলে আপনে যে কয়েন দিয়া টস করতে কৈতেছেন, ঐটা হিন্দী শোলে সিনেমার অমিতাভের কয়েন দাদা, দুই পিঠেই ‘মৌলবাদী’ লেখা। একই কয়েন বুশ-ব্লেয়ারদের হাতেও আছে। ফলে আপনের/আপনাদের ফতোয়া নিয়া আমি ভাবিত না। ড. মাসুদ যখন আমার বমি আমারে খাওয়ান, ‘খালি মাঠ’ পাইয়া কবিসভায় আমি ডিসকোর্সের কচকচি করতেছি বৈলা কবিসভার সব সদস্যের বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে পাইকারি তামাশা করেন, ব্রাত্য রাইসু যখন দুলাল-বিষয়ে ‘কুত্তা’ শব্দ আপনের মুখে আবিষ্কার না-কৈরা আমার মুখে আবিষ্কার করেন, তার ভিত্তিতে আপনে আমারে সাদা পোষাকধারী মৌলবাদী-ই যে বলবেন, এ আর আশ্চর্য কি? নৈতিক সমস্যা যেহেতু আগে থেকেই নাই, তাই অন্যের জাজমেন্টের টুঁটি চাইপ্যা ধৈরা নিজের জাজমেন্ট গিলাইতে কোনো গণতান্ত্রিক সমস্যাও হয় না আপনাদের। আপনাদের এই মহতী কৃৎকৌশলকে সেলাম জানাই।



ভাবমূর্তির মামাশ্বশুর

১.
আনন্দ হৈল। সাথে বেদনাও হৈল।

আনন্দ হৈল মান্যবর সুব্রত দা-র আওয়াজ শুইন্যা। আহা! হে রাজহংস, কতকাল পর আপনে আইছেন এইসব কাদাখোঁচা পীদের হাস্যকটাকলকল মানস সরোবরে! যদিও মানস (চৌধুরী) নাই তার সরোবরে (‘তুমি কি আসবে আমাদের মধ্যবিত্ত রক্তে, দিগন্তে দূরন্ত মেঘের মত’)। আরও নাই রাশিদা সুলতানা, লুনা রূশদী। আমার থাকার ওজনের চেয়ে উনাদের না-থাকার ওজন অনেক বেশি। আপনে আসায় ভার লাঘব হৈল। অনেকটা।

আর বেদনা হৈল, কারণ, নিজে গন্ডা গন্ডা বাচ্চাকাচ্চা পৈদা করার পরও ‘ভাবমূর্তি’ নামের এই বাপে-তাড়ানো মায়ে-খেদানো বাচ্চার পিতৃত্ব আমার ঘাড়ে চাপায়া দিতেছেন কেউ কেউ। আমি বারবার যে এত কৈরা কৈতেছি, বিশ্বাস না-হৈলে আমার জিন পরীক্ষা কৈরা লন না ক্যান আপনেরা? এইটা কোন্ নাছোড়বান্দা জ্বিনের পাল্লায় পড়লাম রে, খোদা!

বৈদেশের মাটিতে বাঙালদেশের ভাবমূর্তির কথা আমি কহি নাই গো সুব্রত দা, এত ঘিলু আমার মাথায় এখনো জমে নাই। আমি কৈছিলাম এই ছোটখাট ডেল কার্নেগী-জাতীয় আত্মসম্মানবোধের কথা, সহজ সরল এথিকসের কথা। নিজেদের কাছে নিজেদের কমিটমেন্টের কথা। তবু আপনেরা কেন যে আমারেই ভাবমূর্তির বাপ বানাইতে চাইতেছেন জানি না? তারচেয়ে বরং আপনে যে একখান বিকল্প ভাবমূর্তির প্রস্তাব দিলেন, সেইটা আমার জব্বর পছন্দ: কুরবানির গরু না, হাড়-জিরজিরা গুতাইন্যা ষাঁড়ের ‘ভাবমূর্তি’। অতি চমেৎকার! আমি এই প্রস্তাবে রাজি। কিন্তু আপনের অগ্রজ বন্ধু আর আমার অগ্রজ ভাই দুলাল ভাই আমাগো আসন্ন ‘গুতাইন্যা’ ভাবমূর্তির গায়ে ঠাণ্ডা পানি যে ঢাইল্যা দিছে, সেইটা আপনেরও নজরে পড়ল না! যে কুত্তার কথা আপনে কৈলেন এই কুত্তা ‘মড়া’ কুত্তা যে না ঠিক আছে, কিন্তু এইটা তো ‘কামড়াইন্যা’ কুত্তাও না, এক্কেবারে ‘চাটা’ কুত্তা! এই কুত্তা তো কামড়াইতে আসে না, বৈদেশের অন্দর মহলে শুইয়া থাকতে চায়, আরাম কৈরা বৈদেশের হাড্ডি চুষতে চায়!

যাই হোক, ভাবমূর্তি লৈয়া আমার কোনো ভাবনা নাই, যার আছে সে জবাব দিক। ভাইবোনেরা, আমি হৈলাম ভাবমূর্তির মামাশ্বশুর, তাই বৈলা আবার কেউ আমার বেয়াই-য়ের নাম জিগায়েন না, কারণ ঐ হারামজাদার পোলায় আমার ভাগ্নি লৈয়া ভাইগ্যা গেছে, চিনতে পারলে আমিই আপনাদের আগে থানায় গিয়া জিডি করতাম!

২.
ফারুক ওয়াসিফ-এর উত্তেজনা দেইখ্যা আমি ডরাইছি। আমি এই সামান্য বিষয়টা নিয়া অল্পসল্প আলাপসালাপ করার মতলবে ছিলাম, উনি যেভাবে মক্কা-মদিনা দেখাইতে শুরু করলেন, তাতে আমার হার্টবিট বাইড়া গেছে।

উনার বক্তব্যের সাথে একমত-দ্বিমত হওনের সুযোগ খুঁজতেছিলাম, কিন্তু দেখলাম যেরকম রাগী রাগী বক্তব্য উনার..... তাতে এই আসরেও এফবিআই ডিজিডিএফআই-য়ের আনাগোনা শুরু হওনের সম্ভাবনা আছে। তার ওপর আমারে জিগাইছেন আমার লেখার মধ্যে যে ‘সরকারি’ সুর আছিল তার অর্থ কি....ব্যাপার কি ভাই? ক্রসফায়ার খাওয়াইতে চান নাকি?

আমি তো বাংলাভাইয়ের মত রাষ্ট্রবিরোধী না, বা মাসুদ ভাইয়ের মত ‘জাতিরাষ্ট্রহীনতার’ চিন্তায়ও মশগুল না, ফলে সরকার যখন রাষ্ট্রকে রিপ্রেজেন্ট একটু হৈলেও করে, কাজেই রাষ্ট্রকে বেষ্টন কৈরা থাকার সুবিধা পায় সে। বোঝা গেল?

আর বোঝা না গেলে, যেহেতু সরকারি চাকরি করি, কাজেই সরকারের দালাল বৈলা দুইটা গালি দিয়া ছাইড়া দেন আমারে। আপনের অনেক সাহস ভাই, আপনে বিএনপি-রেও গালি দেন, আওয়ামী লীগরেও। সাথে আমারেও দেন, আমি আপনের লগে নাই!


৩.

এণে ইগো/ব্যক্তিগত কটা/আক্রমণ প্রসঙ্গে দুইএকটা কথা বলতে ইচ্ছা করি। বিষয়টা তুলছিলেন মাসরুর। পরে ইমরুলকে লেখা চিঠিতে মাসুদ ভাইও এর উল্লেখ করলেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কবিসভায় আমরা অনেকেই পরস্পরের চাপার জোর প্রত্য করি। মাসরুরের ভাষায়, এভাবেই আমাদের বই-পড়া, ডিগ্রিধারী, শাহবাগ-গামী ইগো তার প্রাইড ডিসপোজ করে চামেচিকনে! মাসরুর যদিও সেইটা চান কি চান না সেই বিষয়ে মন্তব্যশূন্য ছিলেন, কিন্তু তার ভঙ্গি থেকে মনে হৈছে যে এইটা উনার কাম্য নয়। মাসুদ ভাইয়েরও কাম্য নয়। উনাদের আরাধ্য হৈল ইগোশূন্য পলেমিকস, বা যাকে বলা যায় বিশুদ্ধ তর্কচর্চা।

কেন জানি এসব নিয়া ভাবলেই সবকিছু শেষপর্যন্ত বস্তুবাদ-ভাববাদ/ দ্বৈতবাদ-অদ্বৈতবাদের ডাইকোটমিতে আইসা ঠেইকা যায়, অন্তত আমার চিন্তার মধ্যে! কতটুকু ইগো-নিরপে আমাদের পে হওয়া সম্ভব? ইগো যদি আলাদা একটা প্রাণভ্রমরা জাতীয় কিছু হৈত, তাইলে নাহয় কৌটার ভিতর ভৈরা রাইখ্যা ড্রয়িংরুমে বৈসা তত্ত্বচর্চায় সামিল হৈয়া যাইতাম! সেইটা যে হয় না, তা বোঝা ও মানার জন্য মার্ক্সের ‘জার্মান ইডিওলজি’ বইটাই যথেষ্ট। আমারি ইগোর রঙে পান্না হল সবুজ... আমি চোখ মেললুম আকাশে....জ্বলে ওঠল ইগো... পূবে পশ্চিমে!

আমার তো মনে হয়, আমরা যদি পলেমিকসের প্রণোদনার মনস্তাত্ত্বিক ইতিহাস তৈয়ার করতে পারি, তাইলে হয়ত দেখা যাবে সেখানে নিজের ইগো দাবায়া রাখা নয়, বরং ইগোকে নানান গার্মেন্টসে সাজায়া গুছায়া হাজির রাখাই হৈতেছে পলেমিকসের একটা রাজনীতি।





ডেঙ্গুচর্চার দিন

এই বর্ষাবিধৌত সন্ধ্যাগুলোতে আমার টবচর্চা, আমার উদার পানিসিঞ্চন, বারান্দায় টবের ফুলগাছগুলো হাঁসফাঁস করে ওঠে। তাদের দিকে না তাকিয়ে আমি অবিরাম পানি ঢেলে যাই। এভাবে বদনার নল ও ফুলগাছের শেকড়ের মধ্যে এক পানীয় রাস্তা স্থাপিত হয়, অব্যাহত পানির স্রোত প্রথমে তাদের বিস্ময়, পরে বিরক্তি, তারোপরে বিবমিষা, তস্যপরে খিস্তিখেউড়সমেত ডুবিয়ে একটা ছোট্ট কিন্তু তীব্র জলাবদ্ধতা তৈরি করে। সেখানে খেলতে আসে বর্ষাশেষের বাতাস, তাদের শিস খুব হালকা আর নরম উস্কানিতে ভরা, যেন সামনে, গাছপালা কেটেছেঁটে ঐ যে নাকবরাবর দূরে একটা নকল বনানীমত বানানো হয়েছে, তার আড়াল দিয়ে আমার মুক্তিদশার নদী কলকল করে বইছে।

তখন কেমন একটা দার্শনিকতাও পেয়ে বসে। প্রাচীন ঋষিরা বলেন পানিই নাকি জগতের মর্ম, আমার কাছে মনে হচ্ছে, পানি নয়, জগতের মর্ম হল পানিসিঞ্চন। মানুষ ও প্রকৃতি আসলে পানিসিঞ্চনই করে, পৃথিবীর ভূত-অভূত নানান শিকড়ে। এটাই জগতে একমাত্র কাজ। হে মনুষ্য! পরিণাম চিন্তা না করিয়া তোমার আরাধ্য শিকড়গুলাতে পানি ঢালিয়া যাও....পৃথিবীর কোনো একটা ধর্মগ্রন্থে এরকম একটা বাক্য থাকতেই পারে। ফলে বদনার নল দিয়ে পানি অবিরাম পড়ে, টব উপচিয়ে কখন যে বারান্দা টপকে নিচের ফাটের বারান্দায় পড়তে শুরু করে আমার খেয়াল থাকে না। বা থাকলেও কিছু করনীয় থাকে বলেও মনে হয় না। কানের পাশে অফিসফের্তা সাবরিনার নিচু গলার হিসহিস চাবুক আছড়াতে থাকে।

: তুহিনদের ফ্যাটে পানি পড়তেছে, শুনতে পাও না?

আমি হিসহিস শব্দ শুনি।

: ডেইলি সন্ধ্যায় একই কান্ড, এখন ন্যাকড়া-ত্যানা নিয়া যাও, ওদের বারান্দা মুইছা দিয়া আসো।

হিস হিস হিস।

: একদিন দেখা যাবে তুহিনের বাবা আইসা কান ধইরা বারান্দা মুছাইতে নিতেছে...

হিসহিসহিস। স্বীয় স্বামীর কর্ণযুগল অপর একজন স্বাস্থ্যবান পুরুষ কর্তৃক আকর্ষণের কল্পনা, যৌন উত্তেজক নিশ্চয়ই! ততণে আমার কাজ শেষ। ঘরে এসে শুয়ে পড়ি মশারি টাঙিয়ে।

শুয়ে শুয়ে ভাবি। কতকিছু! আমার শৈশব, সাইকেল শেখা, নদী সাঁতরানো। প্রথম চুম্বন, যৌন অসততার দগদগে স্মৃতিগুলো, বের করে করে চিবাই। টবের পানিতে আজ একটা লেয়ার পড়বে, ভোরের নরম আলোয় সেটা আকর্ষণ করবে কোনও পথহারা এডিসকে, এডিস তুমি কি পথ হারাইয়াছ, ডিম্বভারে তুমি কি স্লথগতি, আশ্রয় খুঁজিতেছ? দেখ আমার পরাগধানী, আর নিচে কী সুন্দর স্বচ্ছ টলমল জল, ঘণ্টাদুই তুমি আমার পরাগধানীতে বিশ্রাম কর বাপ, দেখবে তোমার ছেড়ে দেয়া ডিম থেকে লার্ভা বের হয়ে টলমল পানির ভেতর মৃদু মৃদু ঘুরছে.....! এরকম একটি মহৎ সম্ভাবনা আমার মশারির উপরে ঘুরপাক খায়। একটা ধারাবহির্ভূত অফৌজদারি মরণদশা বানায়। সেই দশার ভেতর আমি সাবরিনার মুখখানি বসিয়ে দিয়ে পরম আরামে ঘুমাই।

সাবরিনাকে আমি মনে মনে ডাকি, আমার র‌্যাডিক্যাল রজনীগন্ধা। রজনীগন্ধার মত ঋজুতা আছে ওর, ফলে আমি রজনীগন্ধাকেও ঘৃণা করি। শুয়ে শুয়ে ওর কথা ভাবি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই ওর ডিপার্টমেন্টাল কলিগের বোনের বিয়েতে যেতে না পারার বছরপূর্ব বেদনাটিকে শিক দিয়ে খোঁচাচ্ছে। এরকম দুয়েকটি বেদনা আছে ওর, সংবৎসর গণগণে থাকে, একটু টোকা পড়লেই কন্টেম্পরারি হয়ে যায়। এরাই আমার আমোদের উৎস, হৃদয়ে শান্তি আনে। শান্তি আসে আমার আলাদা ঘরে আলাদা বিছানায় টানানো মশারির বড় বড় দুটো ছিদ্র দিয়ে। এই ছিদ্রদুটো সেলাই করে দেয়ার কথা প্রতিদিনই বলে সাবরিনা, আর প্রতিদিনই ‘ভুলে’ যায়। সকালবেলা ওর অফিসের গাড়ি যখন নিচে ঘন ঘন হর্ণ বাজায়, ঘড়ি পরতে পরতে আমার ঘরে উঁকি দেয় সে।

: মশারিটা আনুমানিক কত বছর পরপর একবার খোলা যাইতে পারে বইলা তোমার ধারণা?
: বলা খুব মুশকিল। আপাতত এইটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।
: ওহহো...ছিদ্র দুইটা সেলাই করা হইল না। দেখি, আজকা আইসা কইরা দিমু।
দেয়া হবে না কোনদিন, জানি আমি, এরাই যে ওর মুক্তির দরজা। হাসি নিজের মনে। সে যদি প্রতিদিন মশারি সেলাইয়ের কথা নাও বলত, আমি কোনদিনই নতুন মশারি কিনে আনতাম না।

বস্তুত, এটা এমন একটা ডুয়েল যেখানে আমি সুঁইসূতা হাতে নিই না, যেমন সেও ফেলে দেয় না টবে জমে-থাকা বাড়তি পানিটুকু। এটা হচ্ছে এমন একটা নৈতিক পরিস্থিতি যাকে আমি অনেকদিন ধরে ভেবে ভেবে বানিয়েছি, এবং আমার অসহ্য লাগে যখন দেখি সাবরিনার চোখেও একই কৃতিত্বের আভা।

এভাবেই আমরা দুটি ডুবন্ত পিঁপড়ের মত জড়াজড়ি করে উপরনিচ করতে করতে আসন্ন ডেঙ্গু মহামারীর দিকে আগাই। আমাদের কোন যৌথতা নাই, কেবলমাত্র টেলিভিশনের সংবাদ দেখা ছাড়া। সংবাদ শুনতে শুনতে আমার চোখ চকচক করে ওঠে, ওরও মুড়ি-চিবানো বন্ধ হয়ে যায়। স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী স্বয়ং এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। অর্থাৎ মিন্টো রোড পর্যন্ত এসে গেছে? পরম বন্ধুর মত আমরা চকিত তাকাই একে অপরের দিকে। আহাহা...আর মাত্র পরীবাগের ঢাউস কয়টা এপার্টমেন্ট আর ইস্টার্ণ প্লাজা নামক জঙ্গলটা....তারপরই তো ভুতের গলি! এত খুশি লাগছিল, মনে হল তুণি একটা মেঘদূত লিখতে বসি। হঠাৎ ’কালিদাস’ ‘কালিদাস’ বলে আমি চিৎকার করে উঠি।

: কালিদাস মানে?
: কবি কালিদাস...স্বাস্থ্য উপমন্ত্রীর বাড়ির কেয়ারটেকার। চিলেকোঠায় থাকে।
: তারে ডাকতেছ ক্যান?
: কারণ অইই মশা নামাইছিল। উইড়া আসা এক দঙ্গল মশারে মেঘ মনে কইরা মেঘদূত লেইখা ফালাইছিল....আর যায় কই!
: এডিস ছিল ঐগুলা?
: নাহ্...এডিসের জ্ঞাতিগোষ্ঠী। আসল এডিস ভিতরেই ছিল।....

আমরা এই হেঁয়ালিটাকে টানতে টানতে অনেকদূর নিয়ে যাই। দু’জনেরই উদ্দেশ্য, অন্যজন যাতে মূল প্রসঙ্গটি এইসব ডালপালার মধ্যে খোয়ায়। কিন্তু নিখিল আলস্যস্রোতে ভবি ভুলবার নয়। ওর সোজা হয়ে-থাকা মেরুদন্ড খেয়াল করে আমি বেশ বুঝতে পারি, কী ভাবছে সে, যেমন সেও তাকিয়ে আছে আমার হঠাৎ লাফানো-শুরু-করা কপালের শিরার দিকে। পুরোপুরি পেশাদার প্রস্তুতি, যেন ইতালিয়ান ফুটবল লীগের ফাইনাল।

পরের দিন সকাল। ওয়ার্মআপ। আমি।

: নাহ...অফিসে যাব না আজ। কেমন জ্বর জ্বর লাগতেছে।
: সত্যি....যাঃ কিচ্ছু না, অফিস কামাই কৈর নাতো, যাও, ঠিক হৈয়া যাবে।

কয়েক ঘণ্টা পর। ওয়ার্মআপ ব্যাক। সাবরিনার ফোন।

: হ্যালো, গায়ে কেন জানি ব্যথা করতেছে খুব। মনে হয় জ্বর আসবে। রান্না করতে পারব না, তুমি বাইরে খায়া আইস। আমি অফিস থেকে ফেরার পথে ডাক্তার দেখায়া আসব।
: ডাক্তার দেখায়া লাভ কি। ঐগুলা তোমার পুরান বাতের ব্যথা। বাসায় আইসা গরম পানির সেঁক নাও, ভাল হৈয়া যাইব।

একদিন সন্ধ্যায় আমাদের ফ্যাটের নিচে এম্বুলেন্সের সাইরেন থামে। কিছু জটলা হয়। দু-একটা উঁচুগলার কথাবার্তা ভেসে আসে। সাবরিনার ভাষায়, নিষ্ঠুরতাহেতু আমি এসব দৃশ্যের দর্শক হই না, স্নায়বিক দুর্বলতার কথা বলে পাশ কাটাই। সাবরিনা কিন্তু দেখে, আমি জানি যে সে এই দৃশ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে, অম্লান একটুকরা সহমর্মিতা মুখে ঝুলিয়ে।

: শুনছ...তিনতলার ভাবী মনে হয়, ধরাধরি করে এম্বুলেন্সে উঠাইতেছে। কালকা শুনছিলাম ভাবীর জ্বর। তিনদিন ধৈরা।
: ডেঙ্গু নাকি?
: তাইতো বলাবলি করতেছে নিচে।

সাবরিনার গলায় স্পষ্ট ঠাট্টা। আমি বেদনায় বিমূঢ় হয়ে যাই। এটা কী রকম রসিকতা? এ যেন বত্রিশ নাম্বার পেয়ে ফেল করা, নিরানব্বই রানে আউট হয়ে যাওয়া, লটারিতে শেষ ডিজিট না মেলায় পাক্কা ত্রিশ লাখ টাকা হাতছাড়া হওয়া। উদভ্রান্তের মত বারান্দায় ছুটে যাই। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি ইঞ্জিনিয়ার শাহাবউদ্দিন সাহেবকে। লুঙ্গি পরা, উস্কোখুস্কো, বউয়ের স্ট্রেচার ঠেলে এম্বুলেন্সে উঠাচ্ছেন। অথচ ভেতরে ভেতরে কী নির্ভার আর সপ্রতিভ লাগছে তাকে। ওয়েলডান শাহাবউদ্দিন, বিড়বিড় করে বলি, আর ভেতরে ভেতরে ঈর্ষায় ছারখার হয়ে যাই।

তবে নিশ্চয়ই সময় এখনও শেষ হয়ে যায় নাই Ñ রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবি। দূর থেকে মিউনিসিপ্যালিটির মশানিধন যন্ত্রের বিকট আওয়াজ ঘর্ঘর ঘর্ঘর করে আমার স্নায়ু কাটে। খুব ত্রস্ত লাগে, জীবনকে সাংঘাতিক ছোট মনে হয়। ভেঙ্গে পড়া যাবে না, বিড়বিড় করে নিজেকে বলি, কে না জানে যে মিউনিসিপ্যালিটির ওষুধে মশার কিচ্ছু হয় না। হতে পারে, খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ডেঙ্গু হওয়ায় পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে গেছে, তাতে কিছু অন্তত খাঁটি ওষুধ মশাদের পেটে যাওয়ার সম্ভাবনা। এমন অবস্থায়, ধরা যাক, এমনওতো হতে পারে, ওষুধ ছিটানোর ফলে মিন্টো রোডের মশা সব আমাদের ভুতের গলির দিকে পালাচ্ছে। বাহ্ এই তো, চমৎকার একটা পরিস্থিতির কথা ভাবা যাচ্ছে! পানি ঢালার শিফট আরেকটা বাড়াব ঠিক করি, প্রয়োজনে কাল আরো কয়েকটা ফুলের টব কিনে নিয়ে আসব, কারণ, আমার মশারিতে আজ তৃতীয় যে ছিদ্রটি দেখছি ওটা নতুন, এবং ওটা দিয়ে শুধু মশাই নয়, আস্ত একটি মুরগিই ঢুকে পড়তে পারবে।


হালের ইসলামি চিন্তা: কতটুকু র‌্যাডিক্যাল, কোথায় লিবারাল

ইসলামী চিন্তার পুনর্পঠন: সমকালীন মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের সংগ্রাম। প্রথম খণ্ড। সংকলন ও অনুবাদ রেহনুমা আহমেদ। মে ২০০৬। একুশে পাবলিকেশন্স লিমিটেড, ঢাকা। প্রচ্ছদ অজ্ঞাত। ৪৬৪ পৃষ্ঠা। ৩৭৫ টাকা।


গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ইসলামী চিন্তার পুনর্পঠনের একটি প্রক্রিয়া দেখা যাচ্ছে বিশ্ব জুড়ে। অর্থনীতির বিশ্বায়ন এবং উত্তর-উপনিবেশ চিন্তাস্বাতন্ত্র্যের ফলশ্র“তি হিসাবেই এই প্রক্রিয়াটি বেগবান হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। একই সময়ে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি, পুঁজিবাদের নিঃস্বায়ন প্রক্রিয়া এবং আরো নানান প্ররোচনায় প্রথম ও তৃতীয় বিশ্বে ইসলামী জঙ্গিবাদেরও পুনরুত্থান ঘটেছে। ফলে, ইসলাম ধর্ম তথা মুসলিম জীবনব্যবস্থাকে গোটা পশ্চিমাশক্তির কোপানলে পড়তে হয়েছে নানাভাবে। ইসলামকে নিয়ে পশ্চিমের বুদ্ধিজীবীরা যে ধরনের সরলীকৃত এবং কনকুসিভ মন্তব্য করেছেন, তার বুদ্ধিবৃত্তিক জবাব আমরা পাই তালাল আসাদ, এডোয়ার্ড সাঈদ কিংবা একবাল আহমাদ-এর লেখায়। রেহনুমা আহমেদ সংকলিত এবং অনূদিত ‘ইসলামী চিন্তার পুনর্পঠন: সমকালীন মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের সংগ্রাম’ নামক গ্রন্থে ঐ ত্রয়ীর কোনো লেখা স্থান পায় নি। তাদের অব্যবহিত উত্তরসূরী এবং জীবিত (একজন বাদে) মুসলমান বুদ্ধিজীবী, অ্যাক্টিভিস্ট এবং ধর্মতাত্ত্বিকদের সাাৎকার, রচনা, এবং বাহাস নিয়ে এই বই। লেখক তালিকায় আছেন আমিনা ওয়াদুদ যিনি মুসলমান নারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম নামাজের ইমামতি করেন। আছেন টাইমস-এর বিচারে পৃথিবীর জীবিত চিন্তাবিদদের সেরা বিশজনের তালিকায় স্থান পাওয়া তারিক রামাদানসহ আরো অনেক খ্যাতনামা/অখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ। গ্রন্থভূক্ত লেখার বিষয়ও বহুবিধ: সাম্রাজ্যবাদ, ইসলামী রাষ্ট্র, নারীবাদ, কোরআন পঠনরীতি, শরীয়া ইত্যাদি। বিষয় বহুবিধ হলেও প্রণোদনা একটিই: যুক্তি ও প্রপঞ্চের নিরিখে পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতায় ইসলামকে পুনর্ব্যাখ্যা।


এসব সমকালীন মুসলমান চিন্তাবিদদের অনেকেই সরবে বা নীরবে দশম খৃস্টীয় শতকের মুসলিম চিন্তাগোষ্ঠী ‘মুতাযিলা’ সম্প্রদায়কে তাদের পূর্বসুরী মেনেছেন। একথা অনেকের অজানা নয় যে, যুক্তি এবং পদ্ধতিনির্ভর মুতাযিলা-চিন্তা সেসময়ের মেইনস্ট্রিম মুসলিম মানসে খুব একটা পাত্তা পায়নি। এই বই থেকে আরো জানা গেল যে, আব্দোলকরিম সোরোউশ-এর প্রকাশিতব্য একটি বইয়ের নাম ‘রিইনভেন্টিং দ্য মুতাযিলাইট এক্সপেরিয়েন্স’ বা মুতাযিলা-অভিজ্ঞতার পুনরুদ্ভাবন। এই নাম থেকেই ইসলামী চিন্তার পুনর্পঠনের একটি সূত্র পাওয়া যায়। এই তাত্ত্বিকেরা ইসলামী ঐতিহ্যের পরাজিত দার্শনিক আন্দোলনগুলোকে পুনর্নিরীা করতে চান। বিশ্বব্যাপী ইসলামী চিন্তার যখন পুনর্পঠন হচ্ছে, তখন এ ধরনের নিরীা নিশ্চয়ই অনেক জরুরি। কেন মুতাযিলা সম্প্রদায়ের যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যায় না-মজে ইসলাম ধর্ম আশআরীয় কাব্যে মজেছিল সেসময়ে?

যাক সে কথা। ইসলামী চিন্তার এই যে পুনর্পঠন, তা চরিত্রগত অর্থে সমরূপী (যড়সড়মবহড়ঁং) মনে হয় নি। এই মিছিলে সামিল আছেন এমন চিন্তক (আমিনা ওয়াদুদ) যিনি নিজেকে পোস্টমডার্ণ এবং ইসলামী চিন্তার পুনর্পঠনকে একটি ‘পোস্টমডার্ণ’ চেষ্টা মনে করেন। আবার অনেকেই আছেন, যথা: আব্দোলকরিম সোরোউশ, যার মূল সমস্যা ইসলামের সাথে ‘আধুনিকতা’ তথা গণতন্ত্রের মেলবন্ধন ঘটানো। এটি বেশ চিত্তাকর্ষক বৈচিত্র্য এই গ্রন্থের। বোঝা যাচ্ছে, পশ্চিমা চিন্তার লিগ্যাসীর দিক থেকে যে যেই পাটাতনেই থাকেন না কেন, প্রত্যেকেই সামিল হচ্ছেন ইসলামের পুনর্পঠনে। কেন?

জবাব পাওয়া যায় রাদওয়ান আল সাইয়িদ-এর লেখায়। তিনি লেখেন, “নৃশংস খুনী, ধর্মীয় উন্মাদ, শয়তান, আত্মঘাতী হামলাকারী, গলা জবাই করে Ñ আর অবশ্যই খুব-সাধারণ ‘স’[ন্ত্রাস] শব্দটি: গত এক দশকে ইসলাম সম্বন্ধে এই ইমেজ পশ্চিমে পাবলিক আলাপচারিতাকে আকার-আকৃতিদান করেছে” [পৃষ্ঠা ৩৭৩]। অর্থাৎ ইসলামের নামে জঙ্গীবাদের এই উত্থান-ই প্রকারান্তরে লিবারাল মুসলিম চিন্তাবিদদের ইসলামী চিন্তার পুনর্পঠনে উদ্যোগী করেছে। গ্রন্থভূক্ত অনেক লেখক আবার পশ্চিমের নানান দেশের অভিবাসী হওয়ায় তাদের ওপর বাড়তি একটা চাপ আছে যেটি সহজে বোধগম্য। কিন্তু তারপরও তাদের লেখায় জঙ্গীবাদ নিয়ে সমাজতাত্ত্বিক আলাপের জায়গা খুবই অপ্রতুল মনে হয়েছে। দার্শনিক ও যৌক্তিকভাবে জঙ্গীবাদকে প্রত্যাখ্যান করলেই যেন দায়িত্ব ফুরাবে, এমন মনে হয় তাদের লেখা পাঠ করলে। কেউ কেউ অবশ্য প্রথম বিশ্বে গজিয়ে-ওঠা জঙ্গীবাদের সামাজিক শেকড় খুঁজেছেন। কিন্তু যে আর্থসামাজিক বাস্তবতায় তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলোতে জঙ্গীবাদ গড়ে ওঠে, তার ব্যাপারে মুখ খোলেন নি এদের প্রায়-কেউই। অথচ এই লেখকদের অনেকেই তৃতীয় বিশ্বের বাসিন্দা।

সামান্য ব্যতিক্রম ছিলেন গুটিকয় চিন্তক: যেমন ফাহমী হাওয়েদী। তিনি বলছেন, “উগ্রপন্থী দলগুলোর জঙ্গীপনার কথা যখন বলা হয়, তখন একইসাথে এই দলগুলোর প্রতি রাষ্ট্রের সহিংসতার কথা বলা হয় না কেন, সহিংসতার যে চক্রে এগুলো সৃষ্টি হচ্ছে তার কথা বলা হয় না কেন?” [পৃষ্ঠা ৩১৭] অর্থাৎ সেটা বলা কিংবা উদঘাটন করার দায়িত্ব তিনি অন্য কাউকে ন্যস্ত করতে চান। রাদওয়ান আল সাইয়িদও এেেত্র রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দোষী মনে করেন। তার মতে, একটি প্রাণবন্ত রাজনৈতিক আবহ না-থাকার কারণে জঙ্গীবাদের রাজনৈতিক আকাক্সা প্রকাশ্য হওয়ার আশায় শেষমেষ সহিংস হয়ে উঠতে বাধ্য হয়। [ পৃষ্ঠা ৩৭৯]

এ প্রসঙ্গে এই গ্রন্থের সংকলক এবং অনুবাদক রেহনুমা-র একটি মন্তব্যকেও বিপদজনক সরলীকরণ মনে হয়েছে। প্রাককথন অংশে তিনি বাংলাদেশের জঙ্গী সম্পর্কে মন্তব্য করছেন, “ইসলামী/জঙ্গী ইসলামী শক্তি রাষ্ট্র-বিপীয় শক্তি না। ....বরং, তারা আম-জনতার প্রতিপ শক্তি।” [পৃষ্ঠা ২২] নানান পাবলিক স্থানে বোমা হামলার কারণে তিনি এই ‘জনপ্রিয়’ অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। আমল দেন নাই ধরা-পড়া জঙ্গীরা আমাদের বিচারব্যবস্থা নিয়ে কী কী কথা বলছে তার ওপর, এই বই যখন তিনি (রেহনুমা) লিখছেন তখন জঙ্গী শায়খ রহমান কিংবা বাংলা ভাই আদালতে দাঁড়িয়েই আদালত ব্যবস্থাকে প্রকাশ্যে বিদ্রুপ করছে। সেটি কি কেবলি নাটকীয়তা? সেটি কি তাদের রাষ্ট্রবিরোধী পজিশন নয়?

ইসলামী চিন্তার পুনর্পঠনের এই কালে চিন্তকদের নিজেদের মতের ভিন্নতা এবং বিষম অবস্থানের কথা আলোচনা হচ্ছিল। একটা ভাইব্র্যান্ট চিন্তাপ্রক্রিয়া চলমান আছে, এ ধরনের প্রপঞ্চ থেকে এটিই প্রমাণিত হয়। যেমন, রাশেদ ঘান্নুশী তালিবান প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আফগানিস্তানকে একটা অশিতি, ট্রাইবাল ও ভাঙ্গাচোরা সমাজ বলে অভিহিত করেন [পৃষ্ঠা ৫৪], অথচ হেবা এজ্জাত-এর কাছে পূর্ব এশিয়া, ইরান, আফগানিস্তান হচ্ছে বহু ফিকহ্ শাস্ত্রের উৎসস্থল [পৃষ্ঠা ৫৮]। এ কারণে চিন্তার েেত্র হেবা এজ্জাত ভৌগোলিক উৎকৃষ্টতা বা সিনিয়রিটির ধারণার সাথে একমত হন না। আবার আমিনা ওয়াদুদ-এর মতে, শরীয়া সম্পূর্ণরূপে পিতৃতান্ত্রিক [পৃষ্ঠা ৩৫]। কিন্তু তারিক রামাদান শরীয়ার পালম্বন করতে গিয়ে বলেন যে, শরীয়া কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা নয়, এটি মূল্যবোধের ব্যবস্থা। স্যাটেলাইট ধর্মযাজক শেখ ইউসুফ আল-কারাদাউয়ি-র মতে শরীয়ার ভিতর পাঁচটি বিষয় আছে: ধর্ম, আত্মা, মন. উত্তরাধিকার এবং ধনসম্পদ [পৃষ্ঠা ১৯০]। এটি পরিষ্কার যে, শেষোক্ত দুইজন শরীয়াকে একটা কোজড পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে মানছেন না।

মিসরের সেক্যুলার নারীবাদীদের বিষয়ে হেবা এজ্জাতের মন্তব্যটি খুব গুরুত্বপূর্ণ লেগেছে। তিনি বলছেন, আইনের পরিবর্তন করে রাষ্ট্রকে মতায়িত করার মাধ্যমে মিসরের নারীবাদীরা রাষ্ট্রমতা দ্বারা আত্মসাৎকৃত হয়ে গেছেন। [পৃষ্ঠা ৬৪] কারণ চূড়ান্ত বিচারে রাষ্ট্রই যখন জয়ী হয়, তখন সেই নারীবাদীরা কার্যত রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ হয়ে পড়েন। এই পর্যবেণ বাংলাদেশের নারীবাদের েেত্রও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে।

‘সহনশীলতা’ প্রসঙ্গে তারিক রামাদানের অবস্থানটি বেশ চিন্তা উদ্রেককারী। তিনি বলছেন, “আমি সহনশীলতার ধারণার ঘোর বিরোধী। বেশির ভাগ সময়ে এর অর্থ হচ্ছে: ‘আমি গ্রহণ করি যে আপনি এখানে আছেন, যেহেতু আপনার এখানে থাকার ব্যাপারে আমার কোনো চয়েস নাই। কিন্তু আপনার এখানে থাকায় আমার কিছু যায়-আসে না, আমি [শুধু] আপনাকে বরদাশত করি।” [পৃষ্ঠা ১৪৩] একইভাবে, ‘বিশ্বাস’কে একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক বৃত্তি হিসাবে দেখার উস্কানি পাওয়া যায় শাবেস্তারির প্রসঙ্গ আলোচনায়। এই চিন্তকের মতে, বিশ্বাস কখনোই অন্ধ অনুকরণ নয়। [পৃষ্ঠা ৪০৭] বিশ্বাস হচ্ছে যাচাই করতে পারা। ফলে তার জন্য চিন্তার স্বাধীনতা একান্ত দরকার। আবার, রাষ্ট্রগঠন আর উম্মাহগঠন যে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস সেটি শেখ তাহা-র জবানিতে পাওয়া যায়। তার মতে, ইসলাম রাষ্ট্রগঠন নয়, বরং উম্মাহগঠন নিয়ে ভাবিত। এসব-ই চিন্তার ঐতিহ্যে সমকালীন মুসলিম দার্শনিকদের মৌলিক অবদান বলে মনে হয়েছে।

খুবই চমৎকার লেগেছে আব্দোলকরিম সোরোউশ-এর কথাবার্তা। মুসলমানদের নীতিনৈতিকতার ঐতিহাসিক পতন বিষয়ে সুন্দর একটি ভাষ্য দাঁড় করান তিনি। তার মতে, ঐতিহাসিক কালে ইসলামে ফিকহ্ শাস্ত্রের চর্চা যতটুকু হয়েছে, এথিক্সের চর্চা/বিকাশ তত পরিমাণে হয়নি। তিনি মনে করেন, ফিকহ্ শাস্ত্রের বিধানকে এথিক্সের বিধানের চেয়ে শ্রেয়তর ভাবার কারণ নেই। এমনটা ভাবা হয়েছে বলেই ইসলামে মানবাধিকার-বিষয়টি দুর্বলভাবে এসেছে। কিন্তু, তার নৈতিক ভাষ্য দাঁড়িয়ে থাকে ‘আমাদের নৈতিক হতে হবে’ জাতীয় একটি পূর্বানুমানের ওপর। এরকম একটি পূর্বানুমান নীতিশাস্ত্রের ঐতিহাসিক বিকাশকে পাশ কাটিয়ে যায় বলে মনে হয়। কেন নৈতিক হতে হবে, এটি কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ কোনো অনুসন্ধান নয়, বিশেষত এই উত্তরাধুনিক যুগে। আরেকটি লেখায় আব্দোলকরিম সোরোউশ অধিকার বনাম কর্তব্যের তর্ক হাজির করেছেন ইমানুয়েল কান্ট তথা আধুনিক পাশ্চাত্যচিন্তার চোখরাঙানির সামনে। তার মতে, কী ইসলাম কী ক্রিশ্চিয়ান ধর্মের ভাষা হল দায়িত্বপালনের ভাষা। আপনি ঠিকমত দায়িত্ব পালন করছেন কিনা সেটা দেখা ঈশ্বরের কাজ। কিন্তু আজকের আধুনিক মানুষ ঈশ্বরের এবাদত করাকে ‘দায়িত্ব’ ভাবতে রাজি নন, ঈশ্বরের এবাদত তার ‘অধিকার’। আর এই ধ্যানধারণাই হল লিবারাল পশ্চিমের লিগ্যাসী। এই লিগ্যাসী নিয়েই ইসলামের পুনর্পঠন করতে চান সমকালীন এই মুসলমান চিন্তাবিদেরা।

রেহনুমা আহমেদ-এর অনুবাদ ঝরঝরে Ñ এমনটা বলা যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও তার ভাষা আড়ষ্ট, আর হাইফেন-ব্যবহারে যথেচ্ছাচার ল্য করা যায়। বাংলা পরিভাষা প্রণয়নে তিনি বহু জায়গাতেই কনভিন্সিং হয়ে উঠতে পারেন নি, হয়ত বাংলা শব্দের ইটিওমোলজিক্যাল দিকটা বিবেচনায় না-আনার কারণে। যেমন ঊীঃবৎহধষরঃু শব্দের বাংলা করেছেন তিনি ‘বহিরাগততা’, আবার জবষধঃরারংধঃরড়হ শব্দটিকে বাংলায় লিখছেন ‘আপেকিতা-করা’ শব্দবন্ধে, যার অর্থ কী হয় সেটা নিয়ে ধন্দ জাগে। বাক্য গঠনেও তাকে নানা জায়গায় অমনোযোগী লাগে, যেমন ৪০২ পৃষ্ঠায় লিখছেন ‘বিতর্ক তার পিছু অনুসরণ করেছে’। কিংবা ৫০ পৃষ্ঠায়, ‘ঘান্নুশীর চিন্তা প্রকাশ করে পশ্চিমা এবং ইসলামী দর্শন, দুটোরই ওস্তাদী বোধগম্যতা’। এসব বাক্যের অর্থ অস্পষ্ট, দূরান্বয়ী এবং ফলত কখনো কখনো পীড়াদায়ক।

তবে, সমকালীন ইসলামী চিন্তকদের লেখা বাংলায় প্রকাশ করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় (এবং শ্রমসাধ্য) অনুমতিটুকু নিতে কার্পণ্য করেননি অনুবাদক। এটি প্রশংসার দাবিদার, কারণ এই দেশে গ্রন্থস্বত্ব কিংবা লেখাস্বত্ব স্বীকারের সংস্কৃতি এখনও গড়ে ওঠেনি। গ্রন্থটির একটি ভূমিকাও লিখেছেন তিনি (ভাগ্যিস সাঈদ ফেরদৌস এবং নাদিম মণ্ডল অনুরোধ করেছিলেন!)। তাতে, স্বল্প পরিসরে ইসলাম, জঙ্গীবাদ এবং বর্তমান দুনিয়ার হালঅবস্থা নিয়ে রেহনুমা আহমেদ একটি আলাপ পেশ করেছেন। ভূমিকাটি আরো বিস্তৃত হতে পারত।

সব মিলিয়ে, রেহনুমা আহমেদ-এর এই সংকলনে স্থান পাওয়া অধিকাংশ লেখকই ইসলামী সিভিল সোসাইটির লোক। দেখা যাচ্ছে, তারা কোরআনের পঠনপাঠন বিষয়ে যতখানি র‌্যাডিক্যাল, পশ্চিমের চিন্তা অ্যাকোমোডেট করার ব্যাপারে ঠিক ততখানিই লিবারাল। ইসলামের শুরুর দিকে গ্রিকচিন্তা-প্রভাবিত মুতাযিলা আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল, তার একটা পুনর্নিরীা করতে চান এই সমকালীন মুসলমান দার্শনিকেরা। এখন মনে হচ্ছে, সেই নিরীার ফল হাতে পেলেই কেবল এই পুস্তকের শিা সম্পূর্ণ হতে পারে। অপোয় থাকলাম, রেহনুমা আহমেদ বা অন্য কেউ হয়ত ‘রিইনভেন্টিং দ্য মুতাযিলাইট এক্সপেরিয়েন্স’ নামক বইটি বাংলাভাষার পাঠকদের পড়ার সুযোগ করে দেবেন।

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ-এর গল্প বিষয়ে

মাতৃমূর্তি ক্যাথিড্রাল। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ। পেঁচা/প্রতিরূদ্ধ ২০০৪। মূল্য ১২৫ টাকা।


বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাস যুক্তি, বুদ্ধি, শুদ্ধি ও দৃশ্যবর্ণনার দাপটের ইতিহাস। এই মহান রাজপথে অনেক সৈনিক অকাতরে তাদের মূল্যবান মেধার খরচ করেছেন, তারপরও একে ছোটগল্পের একমাত্র ডাইস ধরে নিয়ে এর উপরে মালমশলা চাপানোর অন্ত নেই। ব্যতিক্রম চেষ্টা যে কিছু হয় নি তা নয়, তবে তাদের জন্য (কিঞ্চিৎ ভ্রুকুটি/প্রশ্রয়সহ) ‘কাব্যিক’ বা অন্য কোন বাতাবরণে মূলধারার বাইরে অন্য একটি লঘু প্রকরণের দোকান খোলার বাজে অভ্যাসও রপ্ত করেছি আমরা। সব কারখানাতেই ডাইস বদলানোর রেওয়াজ আছে, বছরে একবার, আর মালিক খুব কাইস্টা হলে দু’বছরে-তিনবছরে। বাংলা ছোটগল্পের বর্তমান ডাইসের মালিক শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ কাইস্টা ছিলেন না, নানারকম ডাইসের সন্ধান তিনি নিজেও যে করেন নাই এমনও নয়, তবু পৌত্রপৌত্রাদিক্রমে তারই চালু করে দেয়া ডাইস আমরাও চালু রাখতেছি। ফলে, বাংলা ছোটগল্প শতায়ু হতে না হতেই জটায়ু হয়ে উঠেছে, কেমন যেন প্রবীণ-প্রবীণ ভাব তার হাবভাবে। এখনকার অধিকাংশ ছোটগল্পের সর্বাঙ্গে প্রসববেদনা প্রকাশ্য, পড়ার পর মনে হয়, ফিরিয়া যাই, লইয়া আসি এর পয়দাকারীকে, আগলাইয়া রাখি পরবর্তী রিলিজের মর্মযাতনা থেকে।


সৌভাগ্যবশত, ফিরিবার প্রাক্কালেই কেবল নদীকূলের শ্মশান দৃষ্টিগোচর হয়, পালে জোর হাওয়া লাগে, কর্তব্যবোধ-সংক্রান্ত দার্শনিকভাব জ্রাগ্রত হয়, এবং এক অপেশাদার প্রকাশক কর্তৃক ‘মাতৃমূর্তি ক্যাথিড্রাল’ নামক একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’র পর এটি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ’র দ্বিতীয় গদ্যকীর্তি। আয়তনের দিক থেকে মাতৃমূর্তি বেশ স্বাস্থ্যবান একটি সংগ্রহ, আমার মতে অন্তত তিনটি পুস্তকের সম্ভাবনাকে এখানে একত্রে পুরে দেয়া হয়েছে। সম্ভাব্য প্রথম পুস্তকটির (মাতৃমূর্তি ক্যাথিড্রাল, কালিদহ, খুনেরা, রীতিমত পর্ণোগ্রাফি, মিরাজ, ঘাতক, নোবডি ইত্যাদি) উদ্দেশ্য তার পাঠক/সমালোচককে চমৎকৃত করা, স্বস্তির মধ্যে রাখা, কোনোভাবেই অপ্রস্তুত করা নয়। এসব গল্প নিয়ে প্রগলভ হয়ে উঠার সুযোগ অনেক, কালিদহএর ইংরেজি শিক বা নোবডি’র ডেডবডিকে ধরে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ পর্যন্ত তরতর করে উঠে যাওয়া যায়। এই পর্বে পাওয়া যায় একজন গল্পকার সুব্রত অগাস্টিন গোমেজকে, যিনি বঙ্গগল্পসাহিত্যে তার অপ্রতিষ্ঠার যাবতীয় সম্ভাবনা নির্মূলের ব্যাপারে একটুও ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নন।
তবু একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলা দরকার: নোবডি একটি অসাধারণ রচনা, কথিত রাজপথের মার্চপাস্টের প্রোডাক্ট হলেও, এমনকি হ্রস্ব দৈর্ঘের বৃষ্টিও, যার আত্মায় কান পাতলে করলেংকোর নৈশঝড়ের (বনগর্জন-ভ­াদিমির করলেংকো) আভাস মিলবে হয়তো। আভাসেই ভালোবাসা মেলে, বইয়ে যাইই থাকুক, নাম নির্বাচনের জন্য হুমায়ুন আহমেদ যে খনিতে নামেন তার নাম রবীন্দ্রনাথ, সেটি তিনি আভাসের বাজারমূল্য বোঝেন বলেই। আসন পেয়ে যাওয়ার এটিও একটি তরিকা, কিন্তু সুব্রত’র মন মজে নি সেদিকে। তিনি সুদূরের পিয়াসী।

ফলত, তিনি অন্য এক ধরনের সুষমাসন্ধান করেছেন, এটাকে আমি ফেলছি দ্বিতীয় ক্যাটেগরিতে (ওমেগা, যৌবরাজ্য, বদলা, সেনবংশ ইত্যাদি)। এটি ছিল আশি দশকের আড্ডাগুলোর একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ফর্ম। দেখতে (বা শুনতে) তাদের উপকথার মত সাজানোগুছানো লাগলেও ভেতরে ভেতরে এরা ছিল অযুক্তির নৈরাজ্য-ভরা, যুক্তির নিরংকুশ আধিপত্যকে তারই অস্ত্রে পাল্টা আঘাত করার একটা স্বতঃস্ফূর্ত চর্চা । এই মৌখিক ঘরানার আধিকারিক ছিলেন জনাব শামসুল কবীর বা ইচক দুয়েন্দে (দ্রষ্টব্য: মাওলানা নাভাসি- কচিসমগ্র, পেঁচা/প্রতিরূদ্ধ ২০০৪)। যারা বঙ্গসাহিত্যে আশি দশকের ইম্প্যাক্ট নিয়ে নানান কটুকথা বলেন ও কটাসন্দেহ করেন, তাদের আমি এই বিষয়টি বিবেচনার আমন্ত্রণ জানাই। শামসুল কবীর চিন্তার যুক্তিশৃঙ্খলাকে পুরোপুরি পরাজিত করতে পেরেছিলেন তার ঐসব অনুগল্পে (দৃর্ভাগ্য, এদের অনেক গল্পই লিখিত নয়!)। সুব্রত কিন্তু পরাজিত করেন নি, পোষ মানিয়ে নিয়েছেন। ভাষার অলংকার কীভাবে উল্টো যুক্তিপরম্পরাকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করে Ñ ‘সেনবংশ’ এর উদাহরণ। ‘বদলা’ বা ‘আপেল পেকে এসো ক্রমে’ এই প্রবণতাটিকে আরও বড় প্রেেিত ফেলবার প্রচেষ্টা, যদিও খুব সফল হয়েছে এমনটা মনে হয় নাই।

তৃতীয় সম্ভাব্য পুস্তকটি (অফিস, প্রলয়পয়োধিজলে, যান, চরৈবেতি, রাইসুর বিচিত্র কান্ডকারখানা) বঙ্গসাহিত্যের পাঠ অভিজ্ঞতার বিচারে বিব্রতকর ব্যতিক্রম লাগতে পারে। সুব্রত তার অমরত্বের আকাক্সা রোপন করেছেন এই পর্বে এসে। এসব গল্পে তিনি উদ্দাম, অ-শাসিত, পূর্বাপর-অমনস্ক, চরিত্রচিত্রণে বায়াজড, নিজ জীবনাচরণে কমিটেড, এবং গতিধারায় প্রায়ই ইনটুইটিভ। প্রথম স্তরের গল্পগুলোতে তিনি যুক্তিপ্রক্রিয়ার গভীর বশ ছিলেন, দ্বিতীয় স্তরে উল্টো তাকেই পোষ মানিয়েছেন, আর এই স্তরে এসে ঐ পোষ-মানা জন্তুটির শেকল খুলে দিয়েছেন যাতে সে পালাতে পারে। আর শেকল-খোলা ঐ জন্তুটির আচরণ আরো বিস্ময়কর: কখনও সে পালায় দূরে, কখনও আবার পায়ে এসে মুখ ঘষে। এই টানাপোড়েনসমতে সুব্রত যে গদ্য তৈরি করেছেন সেটি তার সময়ের ভাষা, যদিও সেই সময়ের অনেক সাহিত্যকে আমরা ঐ ভাষায় কথা বলতে শুনি নি। এখানেই সুব্রত তার দশকের সাচ্চা প্রতিনিধিদের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন হয়ে উঠেছেন, যা তিনি কবি হিসেবে আগে থেকেই ছিলেন (কাব্যগ্রন্থ- তনুমধ্যা, পুলিপোলাও) , যদিও কবিতায় তিনি এতখানি স্বাধীনতা উপভোগ করেন নি বলেই আমার মনে হয়েছে।

এর আগে বাংলা গদ্যসাহিত্যের সম্ভাব্য যে গতিপথটিকে ধ্র“ব ধরে নেয়া হচ্ছিল কয়েক দশক ধরে Ñ সম্ভবত মার্কসবাদী এবং নিও-মার্কসিস্ট নন্দনতত্ত্বের প্রভাবে Ñ মেদহীন ঝরঝরে শাণিত ভাষা, নির্লোভ লেখকত্ব, নির্মম কাহিনীবিন্যাস, মনোদৈহিক জটাজাল Ñ সুব্রত’র এই পর্বের গল্পগুলো তার ধ্র“বত্বকে চ্যালেঞ্জ করে। সুব্রত আক্রমণ করেছেন ‘শাণিত’ ভাষাভঙ্গি-সম্পর্কিত আমাদের ধ্যানধারণাকে (প্রলয়পয়োধিজলে), লেখকসুলভ ‘নির্লোভ’ দূরত্বের মহিমা তিনি গ্রহণ করেন নি অনেক গল্পেই (অফিস, চরৈবেতি ইত্যাদি), তার বিবৃত কাহিনীর মধ্যে তিনি খুব ‘লিপ্ত’ থাকেন প্রায়ই (রাইসুর বিচিত্র কান্ডকারখানা। আরো দ্রষ্টব্য: ওমেগা এবং তৃতীয় প্রচ্ছদের উপসংহারগত সাযুজ্য)। সবচেয়ে বড় ব্যতিক্রম হল, যেসব প্রেতি লেখকের সাইকোঅ্যানালিসিস দাবি করে সেসব জায়গায় সুব্রত ফিজিক্যাল মুভমেন্ট ও সংলাপের দ্বারস্থ হয়েছেন (যান-এর শেষাংশ, নিশি, ঘাতক ইত্যাদি)। এসবই নতুন (বাংলা) ধরনের গল্পের আলামত, তাদের মধ্যে নৈরাজ্য থাকতে পারে, কিন্তু কেরাণিসুলভ কিষ্টতা নাই। এভাবেই সুব্রত’র গল্প আমাদের কাহিনীহীনতার দিকে আমন্ত্রণ জানায়, গদ্যকে যুক্তির শেকল থেকে মুক্ত করে এবং অযুক্তির বিনোদন পুরে দেয়। ‘মাতৃমূর্তি ক্যাথিড্রাল’ পাঠের বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে বাংলা গদ্যরীতি বা ছোটগল্পের ভবিষ্যত চেহারা ইত্যাদি ভাবনায় ফুর্তি আসে খুব, এটা উপরি পাওনা এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই।

বইটির প্রকাশক মানস চৌধুরী একজন অপেশাদার প্রকাশক, যদিও অপেশাদরিত্বের ছাপ তিনি গ্রন্থে রাখতে পারেন নি, দুয়েকটা বানানভুল ছাড়া। প্রচ্ছদ ভাল লাগে, তবে দূর থেকে। তৃতীয় প্রচ্ছদে লেখক সম্পর্কে একটি অতিনিরীহ বয়ান আছে যেটি গ্রন্থপ্রবেশে উদ্যোগী পাঠককে আরো ক্যাজুয়েল করে, আসন্ন রূদ্ধশ্বাস ভ্রমণের পূর্বাভাস দেয় না কোনমতেই। বিপদজনক ফাঁদ! ইচ্ছাকৃত?

ব্যর্থ গল্প লেখার সাহস ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

অদিতি ফাল্গুনীর গল্প এবং গল্পগ্রন্থের প্রকাশ নানা কারণে বিশিষ্ট। প্রথমত, তিনি বিচিত্র সব বিষয়ের গল্প বলতে চান। দ্বিতীয়ত, তিনি সাদামাটা গল্প বলেন না। তৃতীয়ত, নিজের প্রকাশকে (হয়ত বিকাশকেও) তিনি যাচাই করেন মার্কেজ, দস্তয়েভস্কি, সারামাগো বা আবুল বাশারদের সাথে। চতুর্থত, এই পোড়া দেশে শিতি পাঠক-লেখক-সমালোচকের অভাব আছে জেনেও ‘বাণিজ্যিক প্লাবনে’ গা ভাসান না। পঞ্চমত, গল্পকে তিনি উপন্যাস বানাতে চান না, মালমশলা যতই হাতে থাকুক। ষষ্ঠত, অন্তত পাঁচশ’ পৃষ্ঠার নিচে কোনো উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা তার নাই। ঐতিহ্য কর্তৃক প্রকাশিত এই গল্পকারের ‘বানিয়ালুকা ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থের শুরুতেই এতসব বিশিষ্ট তথ্যের সন্ধান মেলে।

বইয়ের প্রথম গল্প ‘বানিয়ালুকা’র বৈচিত্র্য স্পাশিয়াল বা ভৌগোলিক। জাতিসংঘ মিশনের দায়িত্ব পাওয়া এক বাংলাদেশী বৈমানিকের বসনিয়া-অভিজ্ঞতা। বানিয়ালুকা এক বসনিয়ান মুসলিম মহিলা যার সার্বিয় স্বামীকে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মেরে ফেলে এবং তাকে নজরবন্দী করে। চিঠির মাধ্যমে সেই মহিলা শরণ নেয় একদা পরিচয় হওয়া ঐ বাংলাদেশী বৈমানিকের, যে চিঠি তার হাতে পৌঁছায় অনেকদিন পর। সময়মত পৌঁছালে ঐ বাংলাদেশী বৈমানিক কী করতেন সেটা জানা যায় না, কিন্তু পরে পৌঁছানোর কারণে ঐ বৈমানিকের পে নিজের কন্যাসন্তানের নামের সমস্যাটির সমাধান হয়। গল্পের বসনিয়া-প্রেতি বাদ দিলে এটি বিমল মিত্র ঘরানার গল্প, তবে ঐ প্রেতিটিই গল্পটিকে বিশিষ্ট করার চেষ্টা করে। বসনিয়া-পরিস্থিতিকে ক্রিটিক্যালি দেখার চেষ্টা আছে এই গল্পে, সেটি অবশ্য সার্বদের প্রতি মমত্ব জাগায়।

দ্বিতীয় গল্প ‘হেরূকের বীণা’র বৈচিত্র্য কালিক বা ঐতিহাসিক। ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুত্থানের মুখে দাঁড়িয়ে বৌদ্ধদের আত্মোপলব্ধি আর দ্রোহপ্রস্তুতির গল্প। গল্পবুনন রীতি মনে করিয়ে দেয় ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ এর শওকত আলীকে এবং ‘পোড়ামাটির কাজ’এর আবদুল মান্নান সৈয়দকে। পাদটীকায় কিন্তু উনাদের নাম নেই, কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়েছে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কাছে।

‘সৌভাগ্যের রজনী’ গল্পে তেমন কোনো দৃশ্যমান বৈচিত্র্য নেই। বুঝি বা সে কারণেই এটিকে এই বইয়ের সেরা গল্প মনে হয়েছে। বিষয় খুব সাদামাটা, পতিতাপল্লীতে পতিতাদের শবেবরাত পালন। চাঁদ ও রুটির মধ্যে সংবেদন-বিপর্যয় ঘটিয়ে এই অসাধারণ গল্পটি শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত পাঠককে এক গভীর মমতায় জড়িয়ে রাখে। এই গল্পের উৎকর্ষ অদিতির বিষয়বৈচিত্র্যস্পৃহাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে। সেই প্রশ্ন আরো পোক্ত হয় পরবর্তী গল্পগুলো পড়ার পর।

‘আক্কাস নিবাড়ন...’ এই বইয়ের আরেকটি ভাল গল্প যার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ‘মিস বাংলাদেশ’ জাতীয় সেরা সুন্দরী ইভেন্টকে ব্যঙ্গ করা। কিন্তু লেখক উদোর পিন্ডি চাপান বুধোর ঘাড়ে, উদ্দেশ্যের অসহায় বলী হয় বামন সম্প্রদায়। অবাক লাগে, যিনি বসনিয়া-পরিস্থিতিতে সার্বদের ওপর মমত্বজাগানিয়া গল্প দাঁড় করান, তিনি কি না বেঁটেবামনদের দেখতে গিয়ে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গেলেন না!

এরপরের গল্পগুলোর ইতিহাস অদিতি’র নানারকম অসফল পরীানিরীার ইতিহাস। ‘জাফর, চিনিজাতক’ আর ‘জয়নালউদ্দিনস ট্রাভেলস’ ভালো লাগে নি তাদের মেটাফিজিক্যাল ট্রিটমেন্টের কারণে। চিনিজাতক-এ রিপোর্টিং আর জাতকগ্রন্থের কোলাজ করা হয়েছে, এক গ্লাসের মধ্যে পানি আর সর্ষে তেলের কোলাজের মত। পানিটুকু খেয়ে তেলটুকু মাথায় মাখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না পাঠকের। একই অবস্থা ঘটেছে পরের গল্পে জয়নালউদ্দিন আর গালিভর-এর কোলাজ প্রচেষ্টার মাঝে। মেটাফিজিক্স আরো মূর্ত হয় জয়নাল-গল্পের উপসংহারে, যেখানে লেখক বলেন, ‘ফিরে ফিরে আসবে সেই অনন্ত কালচক্র’। এই লাইনটিই উক্ত দুটি গল্পের সারাংশ।

বাকি থাকে দুটো গল্প: ‘আর্থ-সামাজিক সমীা’ আর পুনর্মুদ্রিত ‘ব্রিংনি বিবাল’। এই দুই গল্পে (আগের জয়নালউদ্দীনস-এও) গল্পকার উপস্থিত হন একজন মাঠগবেষকের স্ট্যাটাসে, কিন্তু তার মন পড়ে থাকে ঢাকাই সাহিত্যের দেশে। অর্থাৎ তিনি সাহিত্যিক, মাঠগবেষণাকে তিনি সাহিত্যিক অভিজ্ঞতা জোগাড়ের একটা উপায় হিসেবে নিয়েছেন। এরকম একটা সৎ বয়ান আছে ‘আর্থ-সামাজিক সমীা’ গল্পে, যে সততার খপ্পরে-পড়া ডকুমেন্টারি ধাঁচের বৃহদায়তন গল্পটির পাঠ শেষপর্যন্ত একটি নির্ভেজাল পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়।

পুনর্মুদ্রিত ‘ব্রিংনি বিবাল’ পড়ে শেষ করার পর প্রথমেই স্বস্তি আসে এটা ভেবে যে, ভাগ্যিস এটাকে পাঁচশ পৃষ্ঠার উপন্যাস বানান নাই লেখক! আঠার পৃষ্ঠাতেই নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়! লেখকের পরিশ্রম হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায় গল্পটি পড়লে। মান্দি জাতির নানান বিষয় এসেছে এই গল্পে: তাদের ইতিহাস-পূরাণ, খৃস্টীয়করন এবং মান্দিদের ভূমিতে স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্টের নামে বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন ফর্মূলার অন্যায় আরোপ, ইত্যাদি। প্রত্যেকটি বিষয়ের ওপরই লেখকের পর্যবেণ ভাল, এমন কি মূল কাহিনী অর্থাৎ পার্লারে কাজ করা মান্দি কিশোরীর কাহিনীটাও ভাল। কিন্তু গল্পে এদের পারস্পরিক ল্যাপ্টালেপ্টির ধরনটা যুতসই লাগে নি। খুব বানিয়ে তোলা মনে হয়েছে। ‘ব্রিংনি বিবাল’ এ লেখক দুইটা জায়গা থেকে মান্দিজাতিকে দেখেছেন: পৌরাণিক আর সমাজতাত্ত্বিক। এদের মেলামেশা কখনো কখনো বিপজ্জনক হয়ে গেছে, বিশেষত যেখানে তিনি মান্দিদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চালুর পৌরাণিক ব্যাখ্যা হাজির করেন, যেটা সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থেকে অনেক দূরের, একটি পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যা।

‘বানিয়ালুকা’র অদিতি ফাল্গুনীর মাঝে অন্তত তিনটা ইতিবাচক লণ দেখা যায়। এক, ব্যর্থ গল্প লেখার সাহস আছে তার, দুই, গ্রামবাংলার কথাসাহিত্যবটিকা বিক্রি করেন না তিনি, এবং তিন, নিজের প্রায় গল্পেই হাজির থাকার চেষ্টা আছে তার। তার গল্পের বিষয় বিচিত্র, কিন্তু উন্মোচনের ধরন খুব হাতে গোণা। সেখানে তিনি প্রায়ই প্রি-অকুপাইড। এটা তার সীমাবদ্ধতা। ‘বানিয়ালুকা’ আর ‘সৌভাগ্যের রজনী’ ছাড়া এই বইয়ের বাদবাকি গল্প সুখপাঠ্য নয়, পাঠকের স্বস্তির ওপর সরাসরি আঘাত করে। এটা ঠিক সীমাবদ্ধতা নয়, এটা অদিতির সুচিন্তিত অবস্থান, ফলে এখানে সীমাবদ্ধতা যদি কিছু থাকে সেটা লেখকের বোঝাপড়ার এবং দৃষ্টিভঙ্গির। এই সবকিছু নিয়েই অদিতি ফাল্গুনী। বানিয়ালুকা-র গল্পগুলো অদিতি’র পরবর্তী গল্পপাঠের আগ্রহ জিইয়ে রাখে।

ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত এই বইয়ের ছাপা বাঁধাই ভাল। প্রচ্ছদ রিলিফ দেয়, ফলে ভাল। শেষ ফ্যাপে অদিতি’র ছবিটিও ভাল। কিন্তু টেক্সট ডিজাইন খুব ভাল লাগে না, সম্ভবত প্রতি পৃষ্ঠায় একটা করে আন্ডারলাইন রেখে পৃষ্ঠাসংখ্যা বসানোর কারণে।






ঝিঁঝিট

একদিন সত্যি তোমাকে বিদ্যাকুট বেড়াতে নিয়ে যাবো
চোখ কপালে তুলে দেবো অচেনা অনেক গাছের নাম করে
সিগারেট একদম খাবো না, জোড়া ঘড়িয়াল হয়ে ভেসে
ছুটোছুটি বাঁধিয়ে দেবো জেলেপাড়ায়, নিশ্চুপ হয়ে শুনবো
কেদোবাঘের লেজে আগুন দিল কারা, শুনবো আর হাসবো
ভরসন্ধ্যায় যতরাজ্যির ভুতের গল্প বানিয়ে বানিয়ে
তোমার বাহাদুরির বারোটা বাজিয়ে দেবো

চৌচালার উপর খুব ধীরে চেপে বসবে রাত
তোমাকেও হতে হবে নম্র শান্ত নিরুপায়, আমার-ঘোড়া

কী যে ভালো লাগবে আমার, দূরে, ভাঙ্গা ব্রীজে
চাঁদপুরগামী নৈশ লোকালের প্ররোচনা
কী যে আনন্দ হবে, কখনোই তুমি বুঝবে না
যা বলেছি মিথ্যে ছিল কি না


অমরতার চেয়ে সত্য

তোমার অন্তর্ধান সকাল দশটার যাদুকরী রোদের ভেতর
অতএব মেনে নিই এই বিরহ মাত্র কয়েক ঘণ্টার

এটুকু সময়ের মধ্যে ঘুরে আসতে হবে অনেকগুলো উপদ্বীপ
অনেকগুলো পাহাড়ি খাড়ির তলদেশের মাটির নমুনা পাঠে
জেনে নিতে হবে কেন মহাদেশগুলো পরস্পরের কাছে ক্রমশই
অসহনীয় হয়ে উঠছে
জানতে হবে ঝাউয়ের একটিমাত্র প্রজাতিই কেন ক্রন্দনশীল!

এসব প্রশ্নের তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের অনেক নিচে, ফলত বাতাসমাত্রই শৈত্যপ্রবাহ, আমরা নৈকট্য বোধ করতাম। অর্থাৎ আমার মহিষের চামড়া-টানানো-আকাশের নিচে তোমার চকিত লাবণ্য! আমাকে জানতে হত যা কিছু ঘটেছে এবং যা কিছু ঘটে নি, তাই আমি জানতাম কার্যকারণ হচ্ছে যাবতীয় অভিজ্ঞতার প্রধান মুদ্রাদোষ। তবু যখন:

দেশান্তরী তুতসীদের দেখে তোমার কান্না পেত, আমি আশ্বাস দিতে গিয়ে
বলেছিলাম, দশ হাজার বছর আগে মহাসমুদ্রে ভেসে-বেড়ানো এক ছন্নছাড়া
মহাদেশের নাম আফ্রিকা।

বিচ্ছিন্নতাবাদ তোমার পছন্দ নয়, কিন্তু চাঁদের বিচ্ছেদ কি তোমাকে উপহার
দেয় নি একটি অতলান্তিক সমুদ্র!

তাছাড়া, অনেকবার বলেছি, তালব্য-শ’ লিখতে গিয়ে তুমি কতটা যতœশীল,
এ থেকে বোঝা যায় তোমার যৌবন ঠিক কতখানি ফুটেছে!

আমি ভয় পাই সেসব কথা যা তোমাকে বলা হয় নি, এরা আমাকে দিয়েছে
অনিদ্রা আর আনন্দ, খুব সপ্রতিভ কোন আড্ডার মর্মমূলে এরা থেকে গেছে
পিত্তথলির পাথরের মত নীরব ও বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে...


যেমন, ধরা যাক, ভেড়াদের আমি ভালবাসি তাদের পর্যটকসুলভ পেশাদারি
নির্লিপ্তির জন্যে, এবং জেনেছি হস্তীছানার জলক্রীড়া নিজ-প্রতিবিম্ব-দর্শনে
অনীহা ছাড়া আর কিছু নয়।

এসব বিষয়ে নিশ্চিত হতে গেছি। সেখানে দেখেছি
গোলকধাঁধা তৈরি করেছে তোমার চুজোড়া
আহ্লাদী হয়ে উঠেছে তোমার স্তনবৃন্ত
তোমার কুন্তলরাশি ঝপাৎ বৃষ্টিপাতের মত
আমাকে লুকিয়ে ফেলেছে
যাবতীয় চিন্তাশীলতার কাছ থেকে


ভাবলাম, আমি বোধহয় সূর্যকলসের ফাঁদে-পড়া দার্শনিক পতঙ্গমাত্র
জানা নেই ভূবনচিলের পা কেন খুঁজে ফিরে গগনশিরীষ শাখা
মফস্বলী কাকের কেন চাই এলুমিনিয়ামের এণ্টেনা

অনিবার্য এবং অবোধ্য, স্বাভাবিক কিন্তু গাণিতিক নয়

বরং জরুরি বেলা একটায় তোমার ফিরে আসা
মিনিট-স্থায়ী পুনর্মিলন, সমগ্র জীবনের
যৌথতার চেয়ে সত্য
অমরতার চেয়ে সত্য অমরতার দিকে যাওয়া