শুক্রবার, ৩ এপ্রিল, ২০০৯

মুমুর্ষূ চটিবই আর তার বিপন্ন নারীরা

লেখার উদ্দেশ্য

চটিবই হচ্ছে একটি এক ফর্মার (বইয়ের সাইজে ১৬ পৃষ্ঠা) কিংবা আধা ফর্মার প্রকাশনা, যেখানে পয়ার ছন্দে অন্তমিল রেখে একটা কাহিনি বর্ণনা করা হয়। ফর্মাটি ভাঁজ করা থাকে, ভাঁজ খুলে পৃষ্ঠা নম্বর দেখে-দেখে পড়ে যেতে হয়। সাধারণত কোনো চালু কাহিনি, ঘটে-যাওয়া ঘটনা, অলৌকিক কোনো বিবৃতি, কিংবা কোনো স্ক্যান্ডালকে উপজীব্য করে এসব প্রকাশনা বের হয়। এর কাগজ নিউজপ্রিন্টের, ছাপা অত্যন্ত নিম্নমানের এবং ঘিঞ্জি, লেখক অচেনা, এবং পাঠক বোধগম্যভাবেই নিম্নবর্গের। কোনো বইয়ের দোকানে পাওয়া যায় না এসব বই, কখনো হকার ফেরি করে শহরের পথে-পথে, কখনো বা ফুটপাতের পসরায় মেলে। ‘পথকবিতা’ বলি, কিংবা বটতলার বই বলি, বা চটিবইই বলি, এসব বইকে নিম্নবর্গের চিন্তাচেতনার দ্যোতক মনে করার যৌক্তিক কারণ আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর পাঠক ও লেখকের মধ্যে তেমন কোনো শ্রেণিভেদ নেই। একান্তভাবেই বিনোদনের জন্য রচিত এসব বইয়ের কাহিনিতে সঙ্গত কারণেই নারীচরিত্র বেশ জায়গা জুড়ে থাকে। বর্তমান নিবন্ধটি প্রথমত চটিবইশিল্প নিয়ে সাধারণভাবে কিছু আলোকপাত করবে, দ্বিতীয়ত, সমাজে আলোচিত ঘটনা বা কেলেঙ্কারি এসবে অন্তর্ভুক্ত নারীচরিত্রের বরাতে কীভাবে চটিবইতে উঠে আসে এবং চটিবই কীভাবে ওই ঘটনাপ্রবাহের ওপর ছায়া ফেলতে চেষ্টা করেছে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবে এবং তৃতীয়ত, বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত চটিবইয়ের নারীচরিত্র বিশ্লেষণ করে তাদের বিপন্নতাকে মাধ্যম হিসেবে চটিবইয়ের বিপন্নতার সাথে সম্পর্কিত করে দেখার চেষ্টা করবে।

বটতলার পুঁথি থেকে চকবাজারের চটি : আড়াই শতকের জীবনচক্কর

চটিবই বা বটতলার বইয়ের ইতিহাস কিন্তু বাংলাভাষার ভদ্রলোকী বই থেকে বেশি অর্বাচীন নয়। ভারতবর্ষে পর্তুগীজরা প্রথম প্রেস বসায় ষোড়শ শতাব্দীতে, মূলত বাইবেল ছাপানোর জন্য। চটিবইয়ের রমরমা হাল আরম্ভ হয় ঊনবিংশ শতকে। ১৮৫৭ সালে অর্থাৎ সিপাহী বিপ্লবের বছরে বাংলা ভাষায় চটিবই বেরিয়েছিল ৩২২টি, এবং রেভারেন্ড জেমস লঙ-এর হিসেব অনুযায়ী শুধু কলকাতাতেই এসব বই ছাপা হয়েছিল ছয় লাখের মতো। ঢাকা কিংবা রাজশাহীও কলকাতা থেকে খুব বেশি পিছিয়ে ছিল না, অনিন্দিতা ঘোষ সাক্ষ্য দেন। বটতলার বইয়ের রমরমা ব্যবসার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে ভারতচন্দ্র কিংবা বঙ্কিমের বই বের করা অভিজাত তত্ত্ববোধিনী প্রেসের জিভ বেরিয়ে যাওয়ার দশা হয়েছিল সেই ঊনবিংশ শতকেই। শিক্ষামূলক গল্প, পুরাণকথা, আদিরস ও স্যাটায়ার এগুলোই মোটাদাগে সেই আমলের চটিবইয়ের বিষয়বস্তু ছিল।
এই যে বটতলার পুঁথি কিংবা চকবাজারের চটি যাই হোক, নিম্নবর্গের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের দ্যোতক হিসেবেই এরা ঐতিহাসিকভাবে আবির্ভূত হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। মহাভারত কিংবা অন্নদামঙ্গলের মতো বইয়েরও বটতলা সংস্করণের ইলাস্ট্রেশনে আমরা দেখি হিন্দু দেবতা কার্তিকের মাথায় ইউরোপীয় হ্যাট, কিংবা মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করছে কোনো ইউরোপীয় সাহেব। এমন অনেক দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। সিপাহী বিদ্রোহের কালে বের হওয়া বটতলার বইয়ে ইংরেজ- বিদ্বেষ প্রচার একটা মুখ্য বিষয় ছিল, সেটা সত্য ঘটনার বয়ান করেই হোক, পুরাণ কাহিনির নতুন তফসির হাজির করেই হোক কিংবা স্ক্যান্ডাল ছড়িয়েই হোক। বই তখনো এত ব্যক্তিগত পঠনের বিষয় হয়ে ওঠে নি, অন্তত নিম্নবর্গের কাছে। একজন গলা ছেড়ে পড়েছে তো দল বেঁধে অন্যরা শুনেছে। ফলে, বটতলার বইয়ের পাঠকশ্রোতার সংখ্যা কোনো অর্থেই কম ছিল না সেসময়।

গত আড়াইশ বছরে এই শিল্পমাধ্যমটি নানাভাবে বিবর্তিত হয়েছে, নানাবিধ বিষয়ের ওপর বই বের হয়েছে, এবং কলকাতায় বিচ্ছিন্ন কিছু চোখে পড়লেও বাংলাদেশের চটি বইয়ের ইতিহাস নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি গবেষণা আজ পর্যন্ত হয় নি। মুনতাসীর মামুন বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কাজ করেছেন, যেখানে জানা যায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঢাকায় ‘চারপেজি, আটপেজি বা ষোলোপেজি ডাবল ডিমাই আকারের নিউজপ্রিন্টে নিম্নমানের প্রেসে ছাপা’ চটিবই বিক্রি হতো। তাঁর বিবেচনায় ওই শতকে রচিত বেশিরভাগ পথকবিতারই বিষয়বস্তু ছিল ১৮৯৭ সালের ঢাকার ভূমিকম্প এবং ১৮৮৮ সালের টর্নেডো। কিছু কিছু পথকবিতা রচিত হয়েছে ‘অশ্লীল’ বিষয় নিয়ে, কিছু কিছু হিন্দুদের উৎসব নিয়ে। মুনতাসীর মামুনের মতে, ওই সমস্ত পথকবিতা সমসাময়িক ঘটনা ও বিষয়ের ‘বিশ্বস্ত দলিল’ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমোন্নতির কারণে ওগুলো স্তিমিত হয়ে আসে।

হালের মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকে একথা মানতে কোনো আপত্তি নেই যে এই চটিবই শিল্পটি মার খেয়ে গেছে, কিন্তু সেটি যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসারের কারণেই মার খেয়ে গেছে এই বক্তব্যে কিঞ্চিৎ দ্বিমত আছে। এই কথার অর্থ দাঁড়ায়, চটিবইয়ের যারা ক্রেতা তারা স্রেফ তাদের সংবাদতৃষ্ণা মেটানোর জন্যই এর দ্বারস্থ হতেন। মুনতাসীর মামুন যে কালের কথা বলছেন সে কালে সংবাদপত্র দুর্লভ জিনিস ছিল না। আর ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্প কিংবা ১৮৮৮ সালের টর্নেডোর মতো সর্বজনজ্ঞাত বিষয় নিয়ে রচিত পথকবিতা স্রেফ এর সংবাদমূল্যের জন্যই পাঠক কিনছে এটিও যৌক্তিক ঠেকে না। মুনতাসীর মামুন তাঁর প্রবন্ধের পরিশিষ্টে “ঝড়ের গান” বলে একটি পথকবিতার উদ্ধৃতি দিয়েছেন সেটি এখানে আবার উদ্ধৃত করে দেখা যাক
ঈশ্বরের অপার নিলা বুজা ভার২ আছে সাধ্য কার।
বুজি বাউরূপে এলেন হরি নিবারিতে ধরাভার।
১২৯৪ সনে, চৈত্র মাসের ২৬ দিনে
শনিবার সন্ধ্যার পরে খণ্ড প্রলয় হল সঞ্চয়।
ঘুর্ন বায়ু এইসে বেগে ঘুইরে উঠে উদ্ধ ভাগে
বিপরীত এক শব্দ ডাকে শুইনলো লোকের চমৎকার।
পশ্চিম হইতে তুফান ছুইটে, হাজারীবাগ দিয়া উঠে,
খেরী ঘর আর মেইটে কোঠে
কত বেইঙ্গেছে অপার।
বাড্ডানগর বাগলপুরে নবাবগঞ্জ চন্দ্রি বাজারে
জত ঘর গিয়াছে পইরে
সংখ্যা করা নাজায় তার।
সিকসেন ভেঙে আমলিগোলা, প্রবেশ করে লালবাগের কিল্লা,
সিপাই জখম করে কতগুলা
মরে একজন হাওলাদার।
সেখান হইতে তুফান ছুইটে পরে এসে চান্নিঘাটে
রমৎগঞ্জ এক চাপটে
ভেঙে এইল চকবাজার
ভেঙে জেলখানা নরিত কোনা, বেগম বাজার দিচ্ছে হানা
মোগটুলী কয়েকখানা
দোকানঘর ভেঙে আর।
কুমারটুলী যে অবস্থা কিছু না রেখেছে আস্থা
নাস্থা খাস্থা তিন অবস্থা
দালান কোঠা একাকার।
বংশীবাজার সজিব রাখি, বাবুর বাজার দিয়ে বাঁকী
বেগে চলে দক্ষিণমুখী
বুড়িগঙ্গা হইলে পার।
পার হইতে ঝরের মুখে পইরে ছিল যত নৌকা
আছারিয়া ঘূর্ণাপাকে
কইরে গেছে চুরমার।
যতলোক গিয়াছে মারা, জন্মসূত্রে ছিল ধরা
দগ্ধাকার কইরে জিঞ্জিরা
ঢাকা হইল পুনর্ব্বার।

উপর্যুক্ত উদ্ধৃতি খেয়াল করলে বোঝা যায়, শুধুমাত্র ঘটনার বিবরণ দিয়েই ওই পথকবিতার লেখক দায় শেষ করেন নি, নিজের জানলা থেকে ঘটনাকে দেখার চেষ্টা করেছেন। ভয়াল টর্নেডোটি বংশীবাজার না ছুঁয়ে, বাবুর বাজারের পাশ দিয়ে গিয়ে দক্ষিণের বুড়িগঙ্গায় হামলে পড়েছে... এই বর্ণনা যত না সাংবাদিকের, তার চেয়ে বেশি কবির। আবার একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতিকে পাপপুণ্যের জায়গা থেকে ফয়সালা করতে গিয়ে লেখক যেখানে নিয়তিবাদী ইঙ্গিত দেন, সেখানে তিনি যত না সাংবাদিক তার চেয়ে বেশি দার্শনিক। পথকবিতার যারা পাঠক, তারা একটা জানা ঘটনার ভেতর এই সমস্ত চোরাগোপ্তা ভাষ্যগুলোকে সাংবাদিকতাসুলভ বিবরণের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন বলেই এসব প্রকাশনা সর্বজনজ্ঞাত বিষয়ের ওপর গড়ে উঠেও পাঠককে টানতে পেরেছে।

তাহলে চটিবই শিল্পটি মার খাওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ কী ? মুনতাসীর মামুন জিনিসটা ধরতে চেষ্টা করেছেন এই বলে যে এসব চটি “সমসাময়িক ঘটনার বিশ্বস্ত দলিল” এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসারে এই সমস্ত প্রকাশনা
স্তিমিত হয়ে এসেছে। আদতে বিষয়টা একটু অন্যরকম বলে আমার মনে হয়েছে। প্রথমত, বর্তমানের চটিবইগুলো খেয়াল করলে দেখা যায়, এরা আর নিম্নবর্গের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রতিনিধিত্ব করছে না। সংবাদপত্র কিংবা অভিজাত পুস্তকের জবানিটাই যেন চটিবই পুনরুৎপাদন করছে। কালেক্রমে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের দৃষ্টিভঙ্গির আছর পড়েছে এসব প্রকাশনায়, যার ফলে এরা ধীরে ধীরে এদের নিজস্বতা হারিয়ে ফেলেছে। এটিকেই হয়ত মুনতাসীর মামুন “সমসাময়িক ঘটনার বিশ্বস্ত দলিল” বলে মনে করেছেন। পরের অংশে সালমান শাহ এবং খুকু-মনিরের চটিবই দুটোর আলোচনা থেকে বিষয়টি বোঝা যাবে।

দ্বিতীয়ত, চটিবইশিল্প মার খাওয়ার পেছনে অন্য শিল্পের উত্থান এবং এর সহজলভ্যতাও অনেকাংশে দায়ী। সিনেমাশিল্প এবং হালে অডিওশিল্প নিম্নবর্গের বিনোদনের জায়গাটি অনেকটাই দখল করে নিয়েছে। এসব প্রযুক্তি যত সস্তা হচ্ছে, ততই সহজলভ্য হয়ে উঠেছে এবং নিম্নবর্গের কাছে গ্রাহ্য হচ্ছে। আরেকটা বিষয় হলো, চটিবই একটা পঠনসাপেক্ষ বিনোদন এবং নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে পঠন পাঠনের অভ্যাস স্বাভাবিকভাবেই কম। ফলে চটিবইয়ের বিনোদনটি হয়ে দাঁড়াত একটা যৌথ বিনোদনের মতো : একজন পড়তেন এবং অন্যরা শুনতেন। নগর যতই বিকশিত হচ্ছে, জীবন ততই জটিলতর হচ্ছে এবং ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে শহরবাসী সংঘহীন হয়ে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে একটা চটিবই পঠনকে ঘিরে জমায়েত হওয়ার চেয়ে মোটামুটি সস্তায় একটা অডিওপ্লেয়ার কিনে ঘরে বসে বিনোদন করাটাই যুক্তিসঙ্গত। নিরক্ষরেরও এক্ষেত্রে কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় না।

চটিবইয়ের অভিজাত নারী এবং ছদ্মবেশী মধ্যবিত্ত রুচি

ঢাকা শহরে গত শতকের আশির দশক পর্যন্ত চটিবইয়ের একটা রমরমা পসার ছিল। যেকোনো বড়োসড়ো সামাজিক অভিঘাতের ঢেউ এখানে এসে পড়ত এবং তা থেকে নিম্নবর্গের এতদসম্পর্কিত মনোভাব বোঝার চেষ্টা করা যেত। বর্তমানেও চটিবই আছে, তবে অনেকটাই প্রাণহীন। কিছু গানের বই, দরকারি কিছু ম্যানুয়ালজাতীয় বই আর কিছু পর্নো। কাহিনিনির্ভর পথকবিতাশিল্পটি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলা যায়। তবে এখনো কোনো বড়োসড়ো কেলেঙ্কারি হলে এবং এর সাথে নারীচরিত্র যুক্ত থাকলে কালেভদ্রে চটি বেরোতে দেখা যায়। কেলেঙ্কারির ডামাডোলে উচ্চবর্গীয় সমাজের কোনো নারীসদস্য থাকলে চটিবই সে বিষয়ে বেশ প্রগলভ হয়। তবে এই প্রগলভতা থেকে নির্বিচারে এটা ধরে নেয়া যাবে না যে, নিম্নবর্গীয় সমাজ নারীবিষয়ে হরেদরে একরকমের ধারণা পোষণ করে। বিগত শতকের আশির দশকের দুটি চটিবই থেকে দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। একটি সালমান শাহ নামক জনপ্রিয় নায়কের আত্মহত্যা নিয়ে, অন্যটি মনির নামক ব্যক্তি কর্তৃক তার স্ত্রীকে খুন করা বিষয়ে। এগুলোও রচিত হয়েছে কবিতার ফর্মেটে, অন্তমিলসমেত। সালমান শাহর আত্মহত্যা নিয়ে নানান জল্পনা-কল্পনা তখন ছিল, এমনকি সংবাদপত্রগুলোও আন্দাজনির্ভর অনেক কাহিনি ফেঁদেছে। এই বিবাহিত নায়কের আত্মহত্যার সাথে অন্য একটি জনপ্রিয় নায়িকার সাথে তাঁর প্রেমের গুঞ্জনকে একটা কার্যকারণ সম্পর্কে দেখানোর ইঙ্গিত যেখানে সংবাদপত্রগুলোই নির্বিচারে দিয়ে চলেছিল, চটিবই একে অনুসরণ করেছে মাত্র। তবে সংবাদপত্রের ইঙ্গিতময়তা চটিবইয়ে এসে শুধু ইঙ্গিত হিসেবেই থাকে নি, বরং নায়িকার নামধাম, নায়কের সাথে বিভিন্ন সময়ে তার অভিসারের বিবরণ, নায়কের স্ত্রীর সাথে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ইত্যাদি নানান কল্পনা মিশেছে সেই বর্ণনায়। এই প্রসঙ্গে জনমত ও সংবাদপত্রকে মোটামুটি একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে দেখা যায়। সংবাদপত্র এক্ষেত্রে জনমত গঠন করেছে নাকি অনুসরণ করেছে বলা মুশকিল। তবে মোটামুটিভাবে সালমান শাহ-র আত্মহত্যাকে অভিজাত শ্রেণির ভিতরকার উদ্দাম জীবনধারার একটি অনিবার্য ফলশ্র“তি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা আছে ওই বইতে। পুরো দৃশ্যপটে সালমান শাহ হলেন ট্রাজিক হিরো, অভিজাত টেক্সটে একটা অফটপিক। চটিবইয়ের সালমান শাহ হচ্ছেন এমন এক আত্মহন্তারক যাকে অভিজাত সমাজ চুষে ছিঁবড়ে বানিয়ে মরতে বাধ্য করেছে। ফলে, সংবাদপত্র-পড়া শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে সালমান শাহর আত্মহত্যা একটি বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা হিসেবে প্রতিভাত হলেও চটিবইয়ের পাঠকের কাছে এই মৃত্যু অনিবার্য ও ঐতিহাসিক। এটুকুই যা পার্থক্য। এটা প্রমাণ করতে সংবাদপত্রের তথ্যগুলোকেই বিভিন্নভাবে সাজানো হয়েছে চটিবইতে, ফাঁকগুলো ভরাট করা হয়েছে কল্পনা ও ছদ্মবেশী শ্রেণিবিদ্বেষ দিয়ে।

সালমান শাহ-র ঘটনাটির একটা সমস্যা ছিল। তার আত্মহত্যা, আত্মহত্যার পেছনের স্ক্যান্ডাল এবং সালমান শাহ-র পত্নীর হাল মিলিয়ে ঘটনাটি কোনো ক্লাসিক ট্রায়োর আকার নিতে পারে নি। পারে নি এ কারণে যে, সালমান শাহ-র পত্নী ছিলেন অভিজাত সমাজের সদস্য, এবং সালমান শাহ-র প্রেমিকা ছিলেন আরেকজন জননন্দিত নায়িকা। ফলে ঘটনা দাঁড়ায় উলটো : নায়িকার নীরবতা ও অন্যরকম ভাবমূর্তির কারণে একদিকে যেমন তাকে ভিলেনের জায়গায় কল্পনা করতে সমস্যা হয়েছে, আবার পত্নীর অভিজাত প্রেক্ষাপটের কারণে তাকেও বিপন্ন ভাবা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। তুলনায় খুকু-মনিরের কেসটি অনেক লাগসই ছিল। আশির দশকের শেষদিকে খুকু নাম্নী এক নারীর সাথে পরকীয়া সম্পর্কের জের ধরে জনৈক মনির তার স্ত্রীকে খুন করেন। দারুণভাবে খেটে যায় এই কাহিনি চটিবইয়ের কাঠামোর মধ্যে। এখানে নিহত স্ত্রী শারমিন একটি ট্র্যাজিক চরিত্র, চিরন্তন বাঙালি নারীর প্রতিমূর্তি, অন্যদিকে খুকু হয়ে দাঁড়ান একটি উপযুক্ত ভ্যাম্প যে কিনা ‘মাথাগরম’ মনিরকে প্ররোচিত করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটান। চটিবইয়ের মনিরকে শাস্তিবিধানের ব্যাপারে কোনো গ্রেস দেয়া না হলেও ঘটনার পুরো নৈতিক দায়দায়িত্বসহ হুকুমের আসামি হিসেবে দাঁড় করানো হয় খুকুকে। চটিবইয়ে খুকুর এই ভ্যাম্পদশাটি এমনি সর্বব্যাপী প্রভাব ফেলে যে অনেক পূর্বাপর বিবেচনা ছাড়াই এই মামলায় মনিরের সাথে খুকুরও ফাঁসি হয়ে যায়। পরবর্তীকালে, জনমতের তোড় কমে এলে মামলার রায়টি রিভিউ হয়, খুকুর মৃত্যুদণ্ড রদ হয়ে কারাবাস হয়, কেননা দেখা যায় যে চটির খুকুর অপরাধের চেয়ে বাস্তবের খুকুর অপরাধ কিছু কম ছিল। ওই চটিটিও সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে রচিত। ঘটনাটি জানার জন্য লোকের চটিবই পড়বার দরকার ছিল না, চটি বইটি আসলে দৃষ্টিভঙ্গিটুকু ছড়িয়ে দিয়েছিল বা মধ্যবিত্ত গড়রুচির প্রভাবেই খুকু-মনির কেসের চটিভাষ্য ওইরকম দাঁড়িয়েছিল।

সালমান শাহ ও খুকু-মনিরের কাহিনি মোটামুটিভাবে ত্রিভূজ প্রেমের পরিণতি, অন্তত সংবাদপত্রগুলো এই ধারণাটিই হাজির করে। সেখানে খুকুর ওপর চটিবইয়ের নৈতিকতা যে তীব্রতা নিয়ে হামলে পড়ল, তার চেয়ে অনেক কম তীব্রতা ও ঘৃণা অনুভূত হলো সালমান শাহর প্রেমিকার ব্যাপারে। খুকুর ফাঁসির আদেশ রদ হওয়াটা পর্যন্ত খুশি মনে মেনে নেয় নি পত্রিকা-পড়া মধ্যবিত্ত। এর কারণ হতে পারে এটি যে, খুকুকে পত্রিকায় যেভাবে পরিবেশন করা হয়েছিল তাতে উস্কানি ছিল। পক্ষান্তরে সালমান শাহর প্রেমিকা পত্রিকার এই প্রচারণার ব্যাপারে অনেক সতর্ক ছিলেন। তিনি নিজের কিংবা অন্যের প্রভাব খাটিয়ে পত্রিকাগুলোকে সেভাবে নিজের ওপর হামলে পড়তে দেন নি। মফস্বলবাসী খুকুর পক্ষে সেটি নিশ্চিত করার উপায় ছিল না।

আলোচ্য ঘটনা দুটোয় নিহত ব্যক্তি দুজনের একজন পুরুষ (সালমান শাহ) এবং অন্যজন নারী (শারমীন- মনিরের স্ত্রী)। চটিবই দুটোও মূলত নিহতদের পক্ষাবলম্বন করেই কাহিনিগুলো লিখেছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে দু’জায়গাতেই আক্রান্ত হয়েছেন নারী। সালমানের ঘটনাটি আত্মহত্যা এবং এখানে সরাসরি অভিযোগ করার সুযোগ কম ছিল বলে তাঁর প্রেমিকা জনরোষ থেকে রেহাই পেয়েছে, যদিও অভিযোগের তর্জনী তাঁর দিকে উঠেছিল অনেক দিন। পক্ষান্তরে শারমীন হত্যা মামলায় মনিরের পরকীয়া প্রেমের সাথী খুকুকে জড়িত করার ব্যাপারে রীতিমতো একটা উন্মাদনা লক্ষ করা গেছে। চটিবইতেও দেখা যায়, খুকুকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে আসল খুনী মনিরের অপরাধই হালকা হয়ে যায়!

চটিবইয়ের ‘দুঃখী’ নারীরা

রোকেয়াবিবি এবং আনারকলি চটিবইয়ের দুটো নারীচরিত্র। ট্রাডিশনালি ‘পথকবিতা’ বলতে মুনতাসীর মামুন যা বুঝিয়েছিলেন, এ দুটো সেই ধরনের বই। নিউজপ্রিন্টে ছাপা, আধা ফর্মার একটা ভাঁজ করা জিনিস। প্রকাশকাল নেই, কিন্তু প্রকাশকের মোবাইল নম্বর দেয়া আছে। সেই নম্বরের ডিজিট গুণে গুণে আন্দাজ করা যায় এই
পুস্তকগুলো ২০০২ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে ছাপা। দুটো বই একই প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছে, আবার একটির লেখক প্রকাশক নিজেই। অন্যটির লেখক, ভনিতাসূত্রে জানা যায়, বর্তমান প্রকাশকের পিতা। দুটো বইয়েরই প্রচ্ছদ আছে। আনারকলিতে কাহিনির সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটা ছবি আঁকা হলেও রোকেয়াবিবি-র প্রচ্ছদে কারিনা কাপুরের একটি উদাস ছবি। দুটি বইয়েই শেষপৃষ্ঠার অর্ধেক জুড়ে নবীন লেখকদের কাছে বিভিন্ন ধরনের লেখা পাঠানোর আহবান। নবীন লেখকদের সশরীরে হাজির হতে কিংবা ফেরত খামসহ আবেদন করতে বলা হয়েছে সেখানে। পথকবিতা যতই বিলুপ্তপ্রায় জিনিস হোক, এখনো যেন প্রকাশকের চেয়ে লেখকের আকাক্সক্ষাটাই বেশি উদগ্র! অবশ্য প্রকাশক যেখানে উত্তরাধিকারসূত্রে নিজেই লেখক, সেখানে লেখকের জন্য গরজ কিছু কম হওয়ারই কথা।

রোকেয়াবিবির কাহিনিটি করুণ। বিবাহসূত্রে স্বামীর নাবালক ভাইটিকে লালনপালনের দায়িত্ব পড়ে তার। এর মধ্যে একদিন লঞ্চডুবিতে স্বামী মারা যায়। জগতসংসারে একা হয়ে পড়ে রোকেয়া, শিশু দেবরটিসমেত। নিজ পরিবারের ভ্র“কূটির মুখে দ্বিতীয় বিয়ে না-করার ব্যাপারে অনমনীয় থেকে ঘর ছাড়ে সে, এক ধনী লোকের ঘরে গৃহপরিচারিকার কাজ নেয়। সন্তানস্নেহে বড়ো করে তোলে দেবরকে, লেখাপড়া শেখায়। তারপর একদিন দেবর উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকা যাওয়ার আবদার করে। ততদিনে রোকেয়া তার তরুণ দেবরের প্রেমে পড়ে গিয়ে তাকে নিয়ে আবার ঘর বাঁধবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। দেবরের আবদার নিয়ে সে ছুটে যায় ধনী গৃহকর্তার কাছে। গৃহকর্তা রাজি হন, তবে সাথে শর্ত জুড়ে দেন যে তার একমাত্র কন্যাকে বিয়ে করলেই তিনি তাকে আমেরিকা যাওয়ার খর্চাপাতি দেবেন। বিনাবাক্যব্যয়ে রাজি হয় রোকেয়া, ভেতরে ভেতরে খান খান হয়ে যায় তার দেবরকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন। গৃহকর্তার কন্যাকে বিয়ে করে আমেরিকা পাড়ি জমায় রোকেয়ার দেবর। তরুণীটি তার স্বামীর ফিরে আসার দিন গোণে। একদিন রোকেয়ার দেবর ফিরে আসে তার তরুণী বধূর বাহুডোরে। রাত ভোর হলে তারা দুজনেই উঠে দেখে অন্য ঘরে আত্মহত্যা করেছে রোকেয়া।

লক্ষণীয় যে, কাহিনির প্রথম ভাগে রোকেয়া সন্তানস্নেহে দেবরকে মানুষ করতে গিয়ে আমাদের যেমন সীতাকে মনে করিয়ে দেয়, পরের অংশে দেবরকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন যখন দেখতে শুরু করে তখন তাকে রূপবানের মতো লাগে। অর্থাৎ এই বইয়ের রোকেয়াবিবি সীতা ও রূপবানের একটি ইন্টারেস্টিং শংকর। রোকেয়াবিবি যেন সীতার অনমনীয় চরিত্রের একটি উজ্জ্বল সমালোচনা। সে দেখায়, সীমাহীন বিপন্নতার মাঝে সম্পর্কের নানান অলিতেগলিতে মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ হয়, সম্পর্কের রকম বদলে যায় মানবিক প্রয়োজনে। সেসব বিপন্নতার ঘেরাটোপের মাঝে সম্পর্কের ট্যাবু মেনে-চলা সীতা বিদ্যমান মূল্যবোধের বাইরে পা দেয় নি। আবার রূপবানকে যতই র‌্যাডিক্যাল লাগুক, সেও কিন্তু একটা সমাজ-চাপানো সম্পর্ককে বহন করে গেছে। চরিত্র হিসেবে রূপবান সাবমিসিভ হলেও এই চরিত্রের সাথে আমাদের চিন্তাভাবনার আদানপ্রদান কিন্তু আদতে পুরুষতন্ত্রের সমালোচনা হিসেবেই হাজির হয়। এই পৌরাণিক সমর্পণ পুরুষতন্ত্রকে আক্রমণ করে না, কিন্তু কিছুমাত্রায় হলেও বিপন্ন করে। এক্ষেত্রে রোকেয়া যুগান্তকারী, একই সাথে চিরদুঃখিনী এবং ট্যাবু-নাশিনী। স্বামীপ্রেমে তার বিন্দুমাত্র ঘাটতি নেই, আবার শিশু দেবরকে সে আগলে রেখেছে মায়ের মতো। এই জায়গায় সীতা আর লক্ষণের তুলনা এসেছে টেক্সটে। আবার স্বামীর মৃত্যুর পর যুবক দেবরকে নিয়ে ঘর বাঁধবার স্বপ্ন দেখতেও বাঁধে নি তার। সেই স্বপ্ন কিন্তু রূপবানের মতো নিয়তিনির্দিষ্ট নয়, বরং রোকেয়ার সিদ্ধান্তপ্রসূত। জীবন তো এমনি সব অভাবনীয় বিস্ময়ে ভরা।

মজার বিষয় হলো, এই রোকেয়া কিন্তু প্রাচীন পুরাকথার কোনো চরিত্র নয়। সে শিশু দেবরসমেত শহরের বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ নেয়, পরিণত দেবরের বিরহে ‘“ফোমের বিছানায়’ শুয়ে রাত জাগে, স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে গেলে অর্থাৎ গৃহকর্তার কন্যাটির সঙ্গে নিজেই দেবরের বিয়ের আয়োজন করে দিয়ে ‘মোনালিসার মতো রোকেয়ায় কান্দে এবং হাসে’, আবার বিদেশ-প্রত্যাগত দেবরটি বাংলাদেশ বিমান থেকে নেমে একটি ট্যাক্সি নিয়ে বাসায় পৌঁছায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সবই সমসাময়িক কালের সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু যে কালটিকে ধরার চেষ্টা আছে, তাতে আমেরিকা-প্রবাসী দেবরের বিরহে তার বধূ ও ভাবী উভয়েরই বিরহব্যথার সংগীত বেশ সময় নিয়ে বাজে বৈকি। এক-আধবার ফোনাফুনি না-হওয়াটা বেশ বিস্ময়ের। বোঝা যায়, কাহিনিতে ফোনালাপ আমদানি হলে বিরহের বারোমাসি পয়ারটির বারোটা বেজে যেত। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় এভাবে মাঘ-ফাল্গুন এলে রোকেয়ার দেবরের বধূটি, যে কিনা রোকেয়ার পাশে শুয়ে শুয়েই সশব্দে বিরহযাপন করছে, তার ভাবনা :
মাঘের শেষে ফাগুন আইল কুকিল করে রাও
ডাকিস নারে প্রাণের কোকিল আমার মাথা খাও

আনারকলির কাহিনিটি এর চেয়ে পুরানো এবং বেশ খানিকটাই রূপকথার ছাঁচের ভেতর ঢোকানো। কলকাতার জমিদার মনিরউদ্দি পাহাড়ে শিকার করতে গিয়ে এক কুটিরে গরিবের মেয়ে আনারকলির দেখা পায়। ফুসলিয়ে বিয়ে করে তাকে এবং বাড়িতে তুলে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে কলকাতায় ফিরে আসে। তারপর আর সে পথ মাড়ায় না। যথারীতি আনারকলির গর্ভে মনিরউদ্দির এক পুত্রসন্তান জন্মে এবং তার নাম রাখা হয় সোলেমান। পিতৃপরিচয় ছাড়া বড়ো হতে থাকে মেধাবী ছাত্র সোলেমান এবং একসময়, সতীর্থদের কানাঘুষার কারণে, পিতৃপরিচয় জানার জন্য সোলেমান মরিয়া হয়ে মায়ের কাছে যায়। জানতে পারে কলকাতার জমিদার মনিরউদ্দি তার পিতা। পিতৃ-সন্দর্শনে সোলেমান কলকাতায় যায় এবং পিতার সামনাসামনি দাঁড়ালে মনিরউদ্দি তাকে গুণ্ডা দিয়ে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেয়। ফিরে এসে সোলেমান আইনশাস্ত্রে অধ্যয়ন শুরু করে। টিউশনির সুবাদে ব্যারিস্টার ছমিরউদ্দির একমাত্র কন্যা মায়াবতীর সাথে মন দেয়ানেয়া হলে একসময় কন্যার পিতা সোলেমানকে ব্যারিস্টারি পড়ানোর জন্য ইংল্যান্ডে পাঠায়। সোলেমান ব্যারিস্টার হয়ে ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসে এবং মায়াবতীর সাথে সুখের জীবন কাটাতে থাকে। এদিকে তার পিতা মনিরউদ্দির সপ্তম স্ত্রী ঘরের চাকরের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে ধরা পড়লে মনিরউদ্দি ওই চাকরকে খুন করে এবং বিচারে তার ফাঁসি হয়। ব্যারিস্টার সোলেমান পিতার কেস হাতে নেয় কিন্তু ফাঁসি রদ করার চেষ্টা সফল হয় না তার। তখন সে পিতাকে শিখিয়ে দেয় যে, যখন জজ তাকে তার অন্তিম ইচ্ছার কথা জিজ্ঞেস করবে তখন যেন সে বলে যে, মরার আগে জজ সাহেবের বৌ-এর সাথে এক রজনী কাটাতে চায়। যেই বলা সেই কাজ। শুনে জজসাহেব তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে পিস্তল বের করে ফেললেন। তখন ব্যারিস্টার সোলেমান জজ সাহেবকে বোঝায় যে, ঠিক একই কারণেই চাকরকে খুন করেছেন জমিদার সাহেব। এই চালাকির কারণে মনিরউদ্দির ফাঁসির আদেশ রদ হয় এবং পিতাপুত্রের মিলন হয়।

প্রথম কাহিনিতে রোকেয়াকে আমরা যতটা কেন্দ্রীয় ভূমিকায় দেখি, আনারকলির কাহিনিতে আনারকলির সেরকম অবস্থা নেই। সে বরং কাহিনিতেও অন্তঃপুরবাসিনী। তার দুঃখ ও জীবনসংগ্রামের কথা আমরা ভাসাভাসা শুনি সোলেমানের কোনো প্রসঙ্গের খেই ধরে। অবশ্য এই কাব্যের মূল উদ্দেশ্য লেখাপড়ার মাহাত্ম্য বর্ণনা। একমাত্র লেখাপড়া জানার কারণেই সোলেমান তার পিতাকে নিশ্চিত ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচাল, এটিই এখানে বক্তব্য। লেখাপড়া করতে থাকা সোলেমানের মনে অদ্ভুতভাবে কোনো পিতৃবিদ্বেষ তৈরি হয় না, এমনকি তার পিতা যখন পিটিয়ে তার হাড় ভেঙে দেয় তখনো সে পিতাকেই ভজনা করে। পুত্রত্বের স্বীকৃতির আকাক্সক্ষা তাকে এমনি মরিয়া করে তোলে। ফলে পিতা যখন ফাঁসির আসামি তখন স্বীকৃতি-না-পাওয়া পুত্র সোলেমান তার পিতাকে দয়া দেখিয়ে সাহায্য করছে এমনটা নয়, বরং পিতার কাজে আসার একটা সুযোগ পেয়ে নিজেকেই যেন সে ধন্য মনে করছে এমনটাই মনে হয়। কাহিনির শিরোনামে আনারকলির করুণ কাহিনি বয়ানের প্রতিশ্র“তি থাকলেও পুরো কাহিনিতে পিতৃত্বের এমনি জয়জয়কার। আনারকলির দুঃখের চেয়ে তার পুত্র সোলেমানের পিতৃস্বীকৃতি পাবার তৃষ্ণাই এই কাহিনির নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মনে রাখতে হবে আনারকলির কাহিনিটি যিনি লিখেছেন তারই পুত্র লিখেছেন রোকেয়ার কাহিনিটি। ফলে এই দুটো কাব্যের তুলনা থেকে আমাদের পক্ষে পথকবিতার অন্তত দুই প্রজন্মের লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যটুকু বোঝা সম্ভব হবে। এর আগে কিছু কাঠামোগত মিলের কথা না-বললেই নয়। দুটি কাহিনিতেই দেখা যায় বিদ্যাশিক্ষা করতে সন্তানটি বিদেশে যায় এবং উভয়ক্ষেত্রেই ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে আসে। তাদের উভয়েরই ভাগ্যবদলের সংগ্রামে কোনো সহৃদয় ধনী ব্যক্তিকে সহায় হতে দেখা যায়, যদিও এই সহায়তা নিঃশর্ত নয়। শর্তটি আরো মনোরম : উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর বিয়ে করতে হবে ওই ধনী ব্যক্তির পরমাসুন্দরী কন্যাটিকে। উভয়ক্ষেত্রেই এই পরমাসুন্দরী কন্যাটি তার পিতামাতার একমাত্র সন্তান অর্থাৎ বিষয়আশয়ের একমাত্র উত্তরাধিকারী।

পার্থক্যের কথা কিছু বলি : আনারকলির কাহিনিতে আনারকলি কিংবা সোলেমানের স্ত্রী মায়াবতী রীতিমতো বোবা। তাদের কোথাও কথা বলতে বা প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যায় না। রোকেয়ার কাহিনিতে রোকেয়া কিন্তু রীতিমতো প্রধান চরিত্র এবং তার দেবরের বধূটিও পার্শ্বচরিত্র হিসেবে যথেষ্ট ভালো মনোযোগ পেয়েছে। তার জবানিতে একটা বারোমাসি পর্যন্ত আছে। আনারকলির কাহিনিতে সোলেমানের পাষণ্ড পিতা পুরো কাহিনির ভিলেন হলেও কাহিনিকারের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল, রোকেয়াবিবির কাহিনিতে সেই জায়গাটি রোকেয়ারই। আগের প্রজন্মের রচিত আনারকলি যেখানে কিচ্ছা বা লোককথার গহ্বর থেকে আধাআধি বেরোতে পেরেছে, সেখানে রোকেয়া কিন্তু একেবারেই সমসাময়িক। আগেই বলেছি, তার চরিত্রের প্রণোদনাটি তৈরি হয়েছে সীতা ও রূপবানের একটা শংকর অনুভব থেকে। এই রোকেয়ার চরিত্র সীতা ও রূপবানের কাঠামো মিলিয়ে হলেও দেখতে সে কারিনা কাপুরের মতো। আনারকলির কাহিনিতে আনারকলি কিংবা সোলেমানের পিতার চরিত্রগুলো সেভাবে হালনাগাদ হয় নি। তবে সেখানে দেখা যায় যে সোলেমান ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডন যাচ্ছে। এখানে তথ্য হিসেবে এটা মনে রাখা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, এই কাহিনি দুটোর রচয়িতাদ্বয় সিলেটের অধিবাসী এবং সিলেট-লন্ডন যোগাযোগ বেশ পুরানো এক ঘটনা। এভাবে এ দুটো বই পুরাকথা এবং সমকালের মধ্যে যাওয়া-আসা করেছে।

মুমূর্ষু চটি ও বিপন্ন নারী

উল্লিখিত দুই শ্রেণির চটিবইতে নারীচরিত্রের দুরকম বিপন্নতা লক্ষণীয়। প্রথম শ্রেণির চটিবইগুলো লিখিত হয়েছে সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে, ফলত নারীচরিত্রগুলো প্রতিবেদনভাষ্যের অতিরিক্ত কিছু দিতে পারে নি। সেই অর্থে এই শ্রেণির চটিবই মূলত মধ্যবিত্ত মানসিকতার নারীকেই ফুটিয়ে তুলেছে। সালমান শাহ কিংবা খুকু-মনিরের ঘটনায় মধ্যবিত্ত যেমন করে সালমান শাহ-র প্রেমিকা এবং খুকুর ওপর হামলে পড়েছিল, চটিবইতেও সেরকমই দেখা যায়। পার্থক্য এটুকু যে, যে স্ক্যান্ডালটা সংবাদপত্রের প্রতিবেদন রেখে-ঢেকে ইঙ্গিতে প্রচার করেছে, চটিবই সেটার অনেকদূর বিস্তার করে দেখিয়েছে। কল্পনার রং চড়িয়েছে বেশ খানিকটা। এহেন চটিবইয়ের বাজার পাওয়ার পেছনে নিম্নবর্গের মানুষের শ্রেণিবিদ্বেষকে পুঁজি করা হয়েছে সন্দেহ নেই। ফলে একে নিম্নবর্গের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ হিসেবে ভাবা দুরূহ, বরং এখানে নিম্নবর্গের চিন্তা একান্ত বাধ্যগতের মতো উচ্চবর্গের চিন্তার ছক অনুসরণ করেছে।

পরের দৃষ্টান্ত দুটোতে অবস্থা কিছুটা ভিন্ন। এই দুটো চটি গড়ে ওঠেছে মূলত কিচ্ছাকাহিনির আদলে। ফলে এদের নারীদের বিপন্নতাও রূপকথার নারীচরিত্রের বিপন্নতার মতোই। নারী যেখানে অন্তঃপুরবাসিনী (আনারকলি) সেখানে তাকে এভাবেই দেখানো হয়েছে। আবার যেখানে সে ট্যাবুনাশিনী, সেখানে চটি তার স্বভাবসিদ্ধ দুর্ধর্ষভঙ্গিতে সেটাই বিবৃত করেছে। এক্ষেত্রে তাকে সহায়তা দিয়েছে উপকথার শক্তিমান নারীরা। উচ্চবর্গীয় ভ্র“কূটির ভয় থেকে এখানে সে অনেকটাই মুক্ত। এমনকি স্ক্যান্ডালের লোভও তাকে টলাতে পারে নি একবিন্দু। লক্ষণীয় যে, কাহিনিতে বর্ণিত রোকেয়া কিংবা আনারকলি যে খুব নিম্নবর্গীয় চরিত্র এমনটা নয়। তবু তাদের ওপর শ্রেণিবিদ্বেষের আছর পড়ে নি, সম্ভবত রূপকথার বর্মসমূহ তাদের রক্ষাব্যূহ হয়ে ছিল বলেই।

চটিবই কিংবা বটতলার পুস্তক তার অভিষেকে যে ধরনের প্রতিশ্রুতিসমেত হাজির হয়েছিল, কালেক্রমে আজ তার অনেককিছুই বদলে গেছে। আজও চটিবই মূলত নিম্নবর্গের বিনোদনের জন্যই প্রকাশিত হয়, তবে তার কতটা নিম্নবর্গের চিন্তাভাবনাকে অনুসরণ করে লেখা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বরং একটা সমরূপীকরণের প্রবণতা দেখা যায় এসব পুস্তকে, যা মূলত নিম্নবর্গের মনোভাবকে উচ্চবর্গীয় মূল্যবোধের শাসনে বেঁধে রাখবার স্পৃহা থেকে উৎসারিত। সংবাদপত্র এক্ষেত্রে এই ধরনের নিয়ন্ত্রণের এজেন্সি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রূপকথা এবং কিচ্ছাকাহিনি একে টানে উলটোদিক থেকে। চটিবইয়ের ক্ষেত্রে এই টানাপড়েনের খেলায় সংবাদপত্র যতই নির্ণায়ক হয়ে উঠছে, ততই এই শিল্পটি দূরে সরে যাচ্ছে নিম্নবর্গের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রতিনিধিত্বশীলতা থেকে। এসব কারণে, চটিবইয়ের নারী যত বিপন্ন হয়েছে, মাধ্যম হিসেবে চটিবই ততই মুমূর্ষু হয়েছে।

গ্রন্থপঞ্জি

 Anindita Ghosh, 2003, An Uncertain "Coming of the Book": Early Print Cultures in Colonial India, Book History Vol 6 (23-55).
 -----, 1998, Literature, Language and Print in Bengal: c 1780 – 1905, unpublished PhD thesis, Cambridge: University of Cambridge.
 Debjani Sengupta, 2002, Mechanicalcutta: Industrialization, New Media in the 19th Century, Sarai Reader: The Cities of Everyday Life, pp 149-58.
 Sanjay Sircar, 2006, Mou-rani, a lost 1940s Bengali Pornographic Street-text and a context for it, South Asian Popular Culture, 4:1 (87-91).

 এমডি কামরুল হাসান বিএ, প্রকাশসাল অজ্ঞাত, সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল সালমান শাহ, ঢাকা: সালমা বুক ডিপো।
 কবি জালাল খান ইউসুফী, প্রকাশসাল অজ্ঞাত, রোকেয়া বিবি করুণ কাহিনী কবিতা, ঢাকা : হেলেনা প্রকাশনী।
 পল্লীকবি ইউসুফ খান, প্রকাশসাল অজ্ঞাত, বিদ্যার বাহাদুরী বা আনারকলির করুণ কাহিনী, ঢাকা : হেলেনা প্রকাশনী।
 মশিউর রহমান চৌধুরী, প্রকাশসাল অজ্ঞাত, খুকু-মনির এর ফাঁসি, ঢাকা : স্বরলিপি প্রকাশনী।
 মোহাম্মদ আবদুল কাইউম, ১৯৯০, চকবাজারের কেতাবপট্টি : উনিশ শতকে ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সাধনা, ঢাকা : ঢাকা নগর জাদুঘর।
 মুনতাসীর মামুন, ২০০৭, কোথায় গেল সেই পথকবিতা, মুদ্রণের সংস্কৃতি ও বাংলা বই, স্বপন চক্রবর্তী সম্পাদিত, কলকাতা : অবভাস।
 -----, ২০০৬, ঢাকার হারিয়ে যাওয়া বইয়ের খোঁজে, ঢাকা : অনন্যা।
 শ্রী পান্থ, ১৯৯৭, বটতলা, কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।
 সুকুমার সেন, ২০০৮, বটতলার ছাপা ও ছবি, কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।


মঙ্গলবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

বহুদিন পর নিজের ঘরে এসে...

বিদ্যাকুটে এলাম অনেক দিন পর। অনেক ধুলো জমেছে দেখি! পাসওয়ার্ড পর্যন্ত ভুলে গেছিলাম!!
বিদ্যাকুটকে পোড়োবাড়ি লাগছে একদমই।
আমাকে যারা এখানে ভিজিট করেছেন, তারা কি মনে রেখেছেন এই সাইটটিকে?
মনে রাখলে দয়া করে একটা করে মন্তব্য রেখে যাবেন।
হিল্লি-দিল্লি করছি, কিন্তু নিজের ব্লগেই থিতু হতে চাই।