বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০০৮

মান্দার, সুমন প্রবাহন, আর সব নিখোঁজ মুখেরা

২০০৩ সাল। দীর্ঘদিনের হাইবারনেশন কাটিয়ে ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছি। ঢাকায় এসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুরানো বন্ধুদের একসাথ করলাম। তাদের কেউ কেউ নেই, কেউ কেউ মুমূর্ষু, কারো কারো জীবনের পথই পাল্টে গেছে। আমাদের জং ধরা সব তলোয়ার, ঠিক করলাম পত্রিকা করবো একটা। জীবন থেকে জং ছাড়াতে হবে।

পত্রিকার নাম ঠিক হল "মান্দার"। একে ঘিরে রিফাত চৌধুরী, কাজল শাহনেওয়াজ, কফিল আহমেদ, শামসেত তাবরেজী, মাহবুব পিয়াল, আয়শা ঝর্ণা এবং আমি একত্র হলাম। কখনো শাহবাগ, কখনো কাজল শাহনেওয়াজের বাসায়, কখনো ধানমন্ডির কোনো রেস্তোরাঁয় বসে বসে পরিকল্পনা আগায় আমাদের।


এর মধ্যেই কফিল আহমেদ বললেন, কাগজ করতে হলে এখনকার যারা তরুণ তাদের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে তো জানতে হবে। আকাশ থেকে পড়লাম। তাইতো? আমরা তো আর তরুণ নই! আমাদের পর আরো দুটি প্রজন্ম চলে এসেছে এতদিনে। কী করছে তারা? কী লিখছে? তারা কি আমাদের নন্দনতত্ত্বের উত্তরাধিকার বহন করছে?

চোখে পড়ল "কালনেত্র" নামে একটা পত্রিকা। কী ঝকঝকে! শাহবাগের অন্যসব জটায়ুমার্কা লিটলম্যাগ নয়, কী প্রকরণে, কী লেখায়। একে একে আরো কয়েকটি কাগজ চোখে পড়ল। ভাবলাম "মান্দার" এসব তারুণ্যের সাথে আমাদের যোগাযোগের একটা পাটাতন হোক।

এমনি এক সময়ে সুমন প্রবাহনকে প্রথম দেখি। কফিল আহমেদ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। অন্তর্মুখী এক তরুণ। এমন নিচুস্বরে কথা বলেন যে কান খাড়া করে শুনতে হয়। বিভিন্ন জায়গায় ওর দুয়েকটা কবিতা পড়েছিলাম, ঠিক করলাম ওকে "মান্দার"এ লিখতে বলবো। বলাতে রাজি হয়ে গেলেন।

এভাবেই আমার সম্পাদিত একমাত্র সাহিত্য পত্রিকার একমাত্র ইস্যুতে সুমন প্রবাহনের নামটি আমাদের সাথে গেঁথে রইল। "মান্দার" প্রশংসা কুড়িয়েছিল, অঘটনও কম ঘটে নি এর প্রকাশনা ঘিরে। সেসব অন্য কোনো সময়ে বলা যাবে। কাগজ নাম কুড়ালেও এর হ্যাপা সামলাতে গিয়ে আমার দম শেষ হয়ে গেছিল। ফলে, আর সব প্রকৃত লিটলম্যাগের মত "মান্দার"ও প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় আটকে থাকল।

বলা বাহুল্য, সুমন প্রবাহনের সাথে আমাদের যোগাযোগটিও "মান্দার" দ্বিতীয় সংখ্যার মত পেন্ডিং হয়ে থাকল। দেখা হত শাহবাগে, মাঝে মাঝে একসাথে চা-সিগ্রেটও হত। আস্তে আস্তে খেয়াল করছিলাম আমাদের তরুণ কবিবন্ধুটি একটু একটু করে ছন্নছাড়া জীবনের দিকে যেন ঝুঁকছেন। দেখি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আশির দশকে এরকম বদলে যাওয়ার চিত্র অনেক দেখেছি। নতুন কিছু তো নয়। সুমন প্রবাহনকে দেখি, মনে পড়ে শাহেদ শাফায়েত এর কথা, বিষ্ণু বিশ্বাসের কথা, এমন কি শোয়েব শাদাব এর কথাও। কী সব অমিত প্রতিভাবানদের সেই সময়। কিন্তু কখনো মনে পড়ে নি শামীম কবির এর কথা। কখনো ভাবি নি আমাদের তরুণ এই কমরেড শামীম কবির এর পরিণতি নিজের জন্য নির্বাচন করবেন।

মাঝে মাঝে ভাবি, সেই আশির শুরু থেকে আমাদের প্রিয় প্রতিভাগুলোর ঘাড় মটকিয়ে বাঙলা কবিতা বেশ রক্তপায়ী হয়ে উঠেছে। রক্তের নেশা ওকে পেয়ে বসেছে। ইতোমধ্যে ঝরে যাওয়ার তালিকাটি কিন্তু ফুলে ফেঁপে উঠছে ক্রমশ: সুনীল সাইফুল্লাহ, সাবদার সিদ্দিকী, বিষ্ণু বিশ্বাস, শোয়েব শাদাব, শাহেদ শাফায়েত, শামীম কবির, সঞ্চয় প্রথম এবং সুমন প্রবাহন। এদের মধ্য সুনীল, শামীম আর সুমন বেছে নিয়েছেন স্বেচ্ছামৃত্যু। বাকিদের কেউ মৃত, কেউ বা নিখোঁজ, কেউ শেকলবন্দী, কেউ বা স্রেফ ভবঘুরে।

সুমন প্রবাহনের ৩৩তম জন্মদিবসের এই দিনে একে একে অন্য সবার মুখ মনে পড়ছে আমার। যেন একটা ছোটখাট মিছিল, বাঙলা কবিতার বলয় থেকে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাওয়া আমার ভাইদের।

কবিতা এসব অসম্পূর্ণ চেষ্টাগুলোকে, এই উল্কাপিন্ডের মত জীবনগুলোকে, এইসব তীব্র ভালোবাসাগুলোকে কিভাবে মনে রাখবে? তারা কি তাদের নিজ নিজ পরিবার আর বন্ধুদের স্মৃতির উপলক্ষই হয়ে থাকবেন?

শুক্রবার, ৭ নভেম্বর, ২০০৮

প্রথম আলো-র ১০ বছরের ১০ বই: কিছু পর্যবেক্ষণ

প্রথম আলো বছরে বেশ কয়েকবার বই নির্বাচন করে থাকে। সেরা ১০ মননশীল বই, সেরা ১০ সৃজনশীল বই, তরুণদের সেরা ১০ বই, প্রথম আলো বছরের সেরা মননশীল ও সৃজনশীল বই, ইত্যাদি। বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট। ফলে এসব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনারও শেষ নেই। সব মিলিয়ে এই উদ্যোগ খুবই উৎসাহব্যঞ্জক।

এবার, পত্রিকার ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকী আরেকটি বাছাই উপহার দিয়েছে। ১০ বছরের ১০ বই। লেখক তালিকায় আছেন সর্বজনাব হাসান আজিজুল হক, গোলাম মুরশিদ, হুমায়ুন আহমেদ, আবদুশ শাকুর, আনিসুজ্জামান, আনিসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, আলতাফ হোসেন, শহীদুল জহির এবং অদিতি ফাল্গুনী। বলাবাহুল্য ১০ বছরে ১০টি বই নির্বাচন করা খুবই দুঃসাধ্য কাজ এবং এরকম নির্বাচনকে সর্বতোভাবে প্রতিনিধিত্বশীল ভাবা মুশকিল। তালিকায় যাঁরা আছেন এঁদের অনেকেই ভাল লেখক। কিন্তু যারা প্রথম আলো-র এই স্বীকৃতি প্রদানের প্রক্রিয়াটি দীর্ঘদিন ধরে খেয়াল করছেন তাদের মনে এই তালিকা কিছু পর্যবেক্ষণের জন্ম দেবে। যেমন:


১. তালিকায় হুমায়ুন আহমেদ এর "জ্যোছনা ও জননীর গল্প" আছে, কিন্তু এই বইটিকে হারিয়ে দিয়ে যে বইটি প্রথম আলো পুরষ্কার জিতে নিয়েছিল ("প্রেম ও প্রার্থনার গল্প" - সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম) সেটি নেই।

২. তালিকায় শহীদুল জহির আছেন, কিন্তু শাহীন আখতার নেই। স্মর্তব্য, শাহীন আখতার-এর "তালাশ" প্রথম আলো পুরষ্কার পেয়েছিল শহীদুল জহিরকে বইকে পেছনে ফেলে।

আরো আরো প্রশ্ন হয়ত করা যায়। তবে এই ইস্যুতে প্রশ্ন জাগে: কেন প্রথম আলো পুরষ্কার পাওয়া শাহীন আখতার এবং সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জায়গা নিয়ে নিলেন তাদের রানার-আপবৃন্দ? এটা কি কোনো কনপেনসেশন প্যাকেজের আওতায় ঘটল? নাকি প্রথম আলো এখন ভাবছে হুমায়ুন আহমেদ কিংবা শহীদুল জহিরকে রেখে শাহীন আখতার কিংবা সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে সেরা লেখক নির্বাচন করা যথাযথ বিবেচনা ছিল না তাদের?

বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০০৮

মধ্যবিত্তের কানসাট ও আন্তঃবিত্তীয় যোগাযোগ

কবিসভায় তর্ক হৈতেছিল কানসাট, মধ্যবিত্ত এবং আন্তঃবিত্তীয় যোগাযোগ লৈয়া। কানসাটের বিক্ষোভের সাথে সংহতি প্রকাশ করার জন্য কয়েকজন সংবেদনশীল কবি-সাহিত্যিক-রাজনীতিক একটা সভা আহ্বান করছিলেন টিএসসি-তে, সেইখানে উনারা উনাদের উদ্দিষ্ট শ্রোতৃমন্ডলীর ভিতর দুইচাইরজন ‘শ্রমিক শ্রেণীর’ লোক দেখতে চাইছিলেন। সেইটা ছিল জনাব ব্রাত্য রাইসুর আপত্তির বিষয়। ১. রাইসু মধ্যবিত্তের আয়োজন-করা সমাবেশে শ্রমিক শ্রেণীসদস্যদের এইরকম প্যাসিভ অংশগ্রহণের মধ্যে কোনোই মাহাত্ম্য পান নাই। তার কাছে একটা বহুচর্চিত ফর্মাটের মতই লাগতেছিল এই ধরনের আমন্ত্রণ। এবং ২. এই ধরনের সভাকে নিম্নবিত্তের তরফে মধ্যবিত্তের মতা কুক্ষিগত করা বা জাতির বিবেক হৈয়া উঠার প্রচেষ্টা লাগে রাইসুর।

রাইসুর প্রথম যুক্তি না-মানার কোনো কারণ দেখি না। প্রতিবাদ সংহতির উদ্দেশ্য যদি হয় ‘কানসাটের ঘটনাকে মধ্যবিত্ত সমাজে চাউর করা’ (ফারুক ওয়াসিফের চিঠি) তাইলে সেখানে শ্রমিক শ্রেণীর ‘স্যাম্পল’ রাখার কী ফায়দা? সেটা কি এজন্য যে, এতে কৈরা কানসাট লৈয়া মধ্যবিত্ত সমাজে আরো যা যা আলোড়ন-বিলোড়ন চলতেছে, তাদের সবার থিকা এই সংহতিসভার আয়োজকবৃন্দ যে বেশি ‘মূলানুগ’, কিংবা প্রতিনিধিত্বশীল -- সেই দাবি করতে পারেন? (বাক্যটা জটিল হৈয়া গেল! একটু ভাইঙ্গা ভাইঙ্গা বুইঝা লৈয়েন সবাই।)

অরূপ রাহী, ফারুক ওয়াসিফ কিংবা ইফতেখার মাহমুদ (আরো যারা যারা যুক্ত ছিলেন এই সংহতিসভায়) প্রমুখের নিম্নবিত্ত-দরদে আমার ব্যক্তিগতভাবে কোনো সন্দেহ নাই। এমনকি, গোটা মধ্যবিত্তসমাজে দলিত-সমব্যথী যারা যারা আছেন এবং নানাভাবে সেইটা প্রকাশ কৈরা যাইতেছেন, তাদের সবার মধ্যে এই ভাইদের (রাহী-ওয়াসিফ-লিপু)অগ্রগণ্য বিবেচনা করতেও আমি পিছপা নই। কিন্তু উনাদের সংহতিসভায় শ্রোতাশ্রেণীর যে সাম্যবাদ, বা ক্রস-শ্রেণী-অভিসার, সেইটা উদ্দেশ্যের দিক থিকা মহৎ মনে হৈলেও যোগাযোগের জ্ঞানগত বিবেচনায় কিছুটা অবাস্তব, তাতে সন্দেহ নাই আমার।

কিন্তু, মধ্যবিত্ত যদি নিম্নবিত্তের (তথা জাতির) কণ্ঠস্বর হৈবার চায়, তাইলে কী ক্ষতি (রাইসু এবং ভাস্করকে প্রশ্ন)? ইতিহাসে দেখা গেছে, নিম্নবিত্ত তাদের প্রয়োজনে সমব্যথী মধ্যবিত্ত সমাজের কাউকে নেতা বানায় (স্পার্টাকাস, লেনিন, মাও, হালে রব্বানী)। হয়ত এজন্য যে, একক কণ্ঠস্বর হৈয়া উঠার যে মধ্যবিত্তীয় সংস্কৃতি, সেইটা নিম্নবিত্ত আয়ত্ব করতে চায় না। কিংবা এজন্য যে, অভিজাতের সাথে লড়াইটা কয়েকধাপ ওপর থিকা আরম্ভ করবার যোগাযোগগত সুবিধা। নিম্নবিত্ত যদি মধ্যবিত্তরে তাদের প্রয়োজনে নেতা বানায়া ‘ইউজ’ করবার পারে, তাইলে মধ্যবিত্তও শ্রেণীগত নেতৃত্বলাভের বাসনা থিকা নিম্নবিত্তের আন্দোলনের পুরোভাগে (সমব্যথাসহ) দাঁড়ায়া যাইতে পারে। পারে না? এখানে বিষয়টাকে স্ট্র্যাটেজি অর্থে বিবেচনা করা ভাল, নীতিশাস্ত্রের দিকে না গিয়া। কারণ, নীতিশাস্ত্র প্রথমেই এই তর্কের প্রিমাইজটাকে চ্যালেঞ্জ করে: যা কিছু মহত্ত্ব সবই নিম্নবিত্তের আর যা কিছু ‘খাউজানি’ সবই মধ্যবিত্তের? এই ধরনের মূল্যারোপ নীতিশাস্ত্রসম্মত নয়।

কানসাট বিষয়ে প্রশ্নজাগর হওয়ায় রাইসুরে উছিলা কৈরা ‘কবিসভা’ তথা কবি সাহিত্যিকদের রাজনৈতিক ‘নিষ্ক্রিয়তা'কে বেশ একচোট নিলেন কেউ কেউ (উনারা নিজেরাও কবিসভার মেম্বার!)। এইটা দৃষ্টিকটু ও শ্রুতিকটু শোনাইছে। কে কখন কোন্ উদ্দীপনায় গরম হৈয়া উঠবে, সেইটা আন্দোলনের মাহাত্ম্য দিয়া ডিকটেট করা যায় না (তাইলে আমবাগানের জনগণ পলাশীর যুদ্ধের দর্শক হৈয়া থাকতেন না!) বাংলা সাহিত্য কার পানে ‘ভেটকাইয়া’ পৈড়া আছে সেইটা বাংলা সাহিত্যের অন্তর্যামী জানেন, আর বাংলা রাজনীতি কার পানে ভেটকাইতেছেন সেইটাও আগাম বৈলা দেওনের ব্যবস্থা নাই। থাকলে যে সংহতিসভার দাওয়াত আমরা পাইছি, সেইটা আরো আগে আয়োজিত হৈতে পারত। হয় নাই, কারণ আমাদের উদ্দীপ্ত হওনের নিজ নিজ ধরন আছে, ব্যক্তিভেদে, গোত্রভেদে, সংগঠনভেদে।

‘মহান’ কোনো মিশন নাই এমন সাহিত্যের দিকে অতীতের বামরাজনীতি একটু চোখ গরম কৈরাই তাকাইছে। যেন সাহিত্যের পুলিপিঠা একমাত্র তারই ভাপে সিদ্ধ হওয়া উচিত। মহাত্মা সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি, মায়াকভস্কি প্রমুখ এই কর্মকাণ্ডে বিস্তর ইন্ধন (অজ্ঞাতসারে) জোগাইছেন। উনাদের কর্মকান্ডের ওপর ভর কৈরা বামপন্থা ‘ঈমানপাতলা’ সাহিত্যিকের জন্য একটা ম্যানুয়াল বানাইবার চাইছে সেই সোভিয়েতকাল থিকা। সেই ম্যানুয়াল যুগে যুগে চাপান হৈছে পাস্তরনাক কিংবা সোলঝেনিৎসিন প্রমুখের কলমের আগায়। উনারা পলায়া পলায়া বাঁইচা ছিলেন, অনেকে পলায়াও বাঁচবার পারেন নাই। সেই আমলে স্ট্যালিনের হাত নাকি খোদার হাত থিকাও লম্বা আছিল!

সেই রামও নাই, অযোধ্যাও নাই। তবু মাঝে মাঝে ফোঁসফাঁস ফোঁসফাঁস শোনা যায়।

আরেকটা বিষয়: মানি আর নাই মানি, মধ্যবিত্ত মূলত প্রদর্শনের রাজনীতির-ই ভোক্তা। কানসাটের বিক্ষোভ নাগরিক মধ্যবিত্তের কাছে একটা টেলিভিজুয়াল রিয়েলিটি। অর্থাৎ, যারে ‘কর্পোরেট’ বৈলা গালি দেই, সেই মিডিয়াই কানসাট-কে আমাদের মত ‘বিবেকবান’ মধ্যবিত্তের সামনে হাজির করছে। আমাদের দিলে সহমর্ম তৈয়ার করছে। এইসবের কিউমিলিটিভ পরিণামেই সরকার তার মারদাঙ্গানীতি বদলাইতে বাধ্য হৈছে। কানসাটের বিজয় উদযাপনে টিএসসি-র সংহতিসভার যে ভূমিকা, তার চেয়ে সেই বিজয় অর্জনে মিডিয়ার গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। বেশি কি না, সেইটা হিসাব করলেই বোঝা যায়। যদি না বোঝা যায়, ‘কর্পোরেট’ মিডিয়ার এই রোল প্লে-কে যেসমস্ত রাজনৈতিক তত্ত্বকাঠামোর মধ্যে প্রশংসা করা না যায়, সেসমস্ত রাজনীতির খোলনলচা পাল্টাইবার সময় আসছে।




২০০৬




পরিশিষ্ট (কানসাট তর্কের নির্বাচিত অংশ)




`jeishob KLSB-sramik-peshajibi-rajnoitik-shangskritk kormi'- punjibad, purushtantra-shoshon-nipiron-nirjaton er biruddhe kaj korte chai, tader moddhe amar nam thakle amar bhaloi lagbo. ei lobh amar ase.ami ei lobher charcha kori. porishkar. porichoy to shamajik-rajnoitik nirman.

shobhar shobbho ra ki bolen?
[অরূপ রাহীর চিঠি]

টিএসসিতে আয়োজিত প্রতিবাদ সংহতির একটা লক্ষ্য ছিল, কানসাটের ঘটনার তাৎপর্যকে মধ্যবিত্ত সমাজে চাউর করা। আরেকটি লক্ষ্য ছিল, কানসাট যেভাবে পল্লীবিদ্যুতের শোষণ এবং রাষ্ট্রের খুনী চরিত্রকে তুলে ধরেছে, মধ্যবিত্ত মহলে তার জের টেনে লড়াইয়ের
ধ্বনিকে প্রতিধ্বনিত করা।
[ফারুক ওয়াসিফের চিঠি]

আমরা সুশীল লেখকেরা পরিচিত সম্ভাবনাময় সুশীল শ্রমিককূলেরে নিয়া একটি সংহতি সমাবেশ আসলে কী কারণে করুম! আর তাও আমাগো এলাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা সংলগ্ন! কারণ সেই প্রচার! আমি এই উদ্দেশ্যরে নেতিবাচক দেখি না অবশ্যই! কিন্তু এই অভিপ্সারে আমার মধ্যবিত্তের কুরকুরানীবৎ-ই লাগে!
[ভাস্কর আবেদীন-এর চিঠি]

shobkisui rajniti hoite pare hoito, tobe rajnitir ekta kaj hoilo shatru-mitra bhed, pokkho-bipokho-niropekkho khela chinte para.apne kar pokkhe ba niropokkhe? na ki gorib, borolok, moddhobitto shobar bibhinno bishoy e nijer pokkhe kotha bolen?


somaj shongshar nia apner kono nirdisto bekkha ase naki? ja dia amra 'shathik' upaye cholte firte bolte ebong na bolte pari? na ki , `tui cholte lag, ami tor pison thika shoja-dan-bam komu' ei line-e asen?


[অরূপ রাহীর প্রশ্ন, ব্রাত্য রাইসুকে]

gorib-er andolon luth koira nia buddhijibira je jatir konthoshor hoiya othar cheshtai roto kintu hoite partese na eita sthitabostha? sramik-ra je lekhok kabi buddhijibigo loge ek pongktite boshtei partese na eita sthitabostha?

[ব্রাত্য রাইসুর প্রশ্ন, অরূপ রাহীকে]


এক সাক্ষাৎকারে চমস্কিরে জিজ্ঞেস করা হইছিলো, বুদ্ধিজীবীর দায় কী। উত্তরে চমস্কি কইলো, কাজ হইলো সহজ জিনিসরে জটিল কইর‌্যা তুইল্যা ধরা।...... রব্বানী কানসাটের মানুষগরে আকাঙ্ক্ষারে ধারণ করতে পারছিলো বইল্যাই হেরে নেতা বানাইছে মানুষ। যখন আর ধারণ করতে পারবো না, তখন লাথ মাইর‌্যা সরাইয়া দিবো। আমার স্বল্পজ্ঞানে এতটুকুই বুঝতাছি।
[বাঁধন অধিকারী]


lekhok, kabi, buddhiji-go loge jokhon sromikgo kotha tola hoi tokhon shurutei sromik je lekhok, kabi ba buddhijibi hoite pare na ba parbo na ei shiddhanto deoya
hoiya jai. tokhon oi shobhai alongkarer adhik kono kam thake na sromik shahebgo.

[ব্রাত্য রাইসু]


এই শহরে সভা করিয়া ‘কলা’ করা হয়। কলার (আর্ট) নানান ছাল-বাকলা ছিড়িয়া রসাস্বাদন চলে। বাংলা সাহিত্য আপনাদের পথপানে ভেটকাইয়া পইড়া আছে, আপনারা তাকে উদ্ধার করবেন এই ভরসায় আছিলাম, আর দেখছিলাম সেইখানে কত কত বিষয়, কত মহার্ঘ আলোচনা উঠিতেছে আর পড়িতেছে, কত আগডুম বাগগুডুম ধ্বনিতে কান জারবার হইতেছে-তারপরও ভালই ছিল। খামাখা রাজনীতির কথা আনা রাহীর ঠিক হয় নাই। আপনারা তো ওইসব ভাবেন না।

[ফারুক ওয়াসিফের চিঠি]







শনিবার, ১১ অক্টোবর, ২০০৮

মিজান মল্লিক-এর কবিতা: পাঠপ্রতিক্রিয়া

যারা সময়াভাবে মিজান মল্লিকের কবিতা পড়বার সুযোগ পান নাই, তাদের জন্য আমার এই বাড়তি বদান্যতা। দয়া কৈরা মিজান মল্লিকের কবিতার দুইটা স্যাম্পল একবার পড়েন আপনেরা ...


মনোরঞ্জন


দেখলাম, বরই বিষয়ে লোকেদের উৎসাহ অনেক।
বাচ্চাদের কৌতূহল বিস্ময়কর! বড়রা অভিজ্ঞ থাকায় ছল-চাতুরী করে।
দেখলাম, গাছে চড়ে অনেকেই বরই পাড়ে আর যারা গাছে উঠতে পারে না তারা
দূর থেকে ঢিল ছোঁড়ে-আঁকশি ব্যবহার করে। অবশ্য বরই বিকি-কিনি হয় বাজারে।
ঠিক কবে থেকে? সেই ইতিহাস আমার ম্মরণে নাই।

যারা ইকনোমিক্স ভালো বোঝে-তারা গাছেরটাও খায় তলারটাও।
এমন কিছু মুখ আমার চেনা, যারা কদাচিৎ চেখে দেখেছে, আর কিছু-
(আমার জানামতে অন্তত এক জন) জীবনে একবারও বরই না খেয়ে পটোল তুলেছে।
তারা নিতান্তই হত-দরিদ্র আর সংস্কারাচ্ছন্ন কিনা ভেবে দেখছি।
এ কথা নিশ্চিত যে লোকেরা বরই খায়। কেউ কেউ আচার তৈরি করে-
রোদে শুকায়, সময় বুঝে আয়েশ করে খায়।

ভেবে দেখলাম। লোকেরা পরনারী আর পরদেশি ভাষা চর্চা করে।

২৪/৬/৪


কালচারের সন তারিখ

শাওন মাসের তৃতীয় দিবস। রোজ বৃহস্পতিবার ভোরবেলা আমার জন্ম।
সাল জানা নাই। তবে সংগ্রামের চেয়ে বয়সে আমি ছোট। আমার আম্মা
নিরর না। আরবিতে কোরান পড়তে সম। আর জনক নিরীহ ইশকুল
মাস্টার। রিটায়ার্ড। সৎ। কর্মঠ। সকাল-সন্ধ্যা ননস্টপ কাজ করেন। কথা বলেন কম।
বিষয় আশ্চর্যের তবে বিবরণ সত্য। আমার বাপের বাপও ছিলেন মাস্টার। উপরন্তু পাঠান।
ঘোড়ায় চড়ে তিনি মক্কা-মদিনায় যান। তাঁরে আমি শুনেছি বটে নয়নে দেখি নাই।

দাদার ইন্তেকালের সময় আমার বাপের বয়স ছিল নিতান্তই কম। মাত্র সেভেন কাসের ছাত্র।

বাপেরে দেখি। তার লগে আমার দারুণ সখ্য। যদিও আমার জন্মবিত্তান্ত তিনি লিখে রাখেন নাই।
অবশ্য তাঁর বাপেও তাঁর জন্মতারিখ লিখে রাখে নাই। আমরা কালচারের নিচে সন তারিখ দিই।

.......
পাঠক, আপনি কি স্বীয় স্মৃতিবিভ্রাট বা লেখকের নামের বিভ্রাটের আশংকা করতেছেন। আসেন আপনেরে আশংকামুক্ত করি। এর কোনোটাই ঘটে নাই। কবিতাগুলো নিশ্চিতভাবেই মিজান মল্লিকের লেখা, তবে, সম্ভবত আগে জন্মানোর সুযোগে পশ্চিমবঙ্গের করি বিনয় মজুমদার উনার ‘পূর্বকরণ’ (অনুকরণের সম্ভাব্য উল্টাশব্দ) করনের মওকা পাইয়া গেছিলেন! তবে মিজান কিন্তু এতকিছুর পরও নিজেরে আলাদা কৈরা চিনাইতে সমর্থ। বিনয়ের ঐসমস্ত বিবৃতিধর্মী কবিতার সাবটেক্সটে ভাবনার অনেক বুদবুদ উড়াউড়ি করে। মিজান তার কবিতায় এইসব ‘অহেতুক’ উড়াউড়ির রাস্তা সিলগালা কৈরা দিছেন। উনার কবিতার সারফেস ইটের মত শক্ত। ঐটাই উনারে চিননের রাস্তা।

বিনয় মজুমদার বছরে ছয়মাস হাসপাতালে থাকেন শুনেছি। হয়ত ধরাধামেও বেশিদিন থাকবেন না। উনার বন্ধুরা অনেকেই গত হৈয়া গেছেন। বিনয়ের সম্ভাব্য প্রয়াণে যারা ব্যথিত হৈবার প্রস্তুতি মনে মনে লৈতেছিলেন, উনাদেরও বাড়াভাতে ছাই দিলেন মিজান মল্লিক। মনে হৈতেছে এখন থিকা উনিই এই ট্রাডিশন চালায়া লয়া যাইবেন। সাথে আরো থাকতেছে পূর্ববাংলার কনটেক্সট, একদম ফ্রি! বিনয়-ভক্তরা এখন থিকাই চাইলে ক্যাবলা ঘুরায়া বসতে পারেন। আর বিদেশ নয়...এখন থেকে বাংলাদেশেই...! অবশ্য, এই দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে কবি বিনয় মজুমদার এবং কবি মিজান মল্লিকের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চুক্তিস্বাক্ষর হৈছে কিনা আমার জানা নাই।

2005

বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর, ২০০৮

রূপক কর্মকারের শাহরিয়ার-প্রজেক্ট!

ঘটনাটি ঘটেছে সচলায়তনে। কদিন আগে রূপক কর্মকার নামে এক "অতিথি ব্লগার" সেখানে নাযিল হলেন। তাঁর লক্ষ্য ব্লগের খাতায় কবি আবু হাসান শাহরিয়ারকে প্রমোট করা। সচলায়তনের কেউ কেউ শাহরিয়ার-ভক্ত, ফলে কাজটি তেমন কঠিন নয়। তিনি নাযিল হলেন আবু হাসান শাহরিয়ার-এর একটি সাক্ষাৎকারসহ। সেখানে আ হা শা সচলায়তনের ব্লগারদের "বিশ্ব নাগরিক" জাতীয় বিশেষণে বিশেষায়িত করেছেন। আর যায় কই? সচলায়তনের ব্লগাররা ঝাঁপিখোলা কৃতজ্ঞতা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেন ঐ পোস্টে, শাহরিয়ার-বন্দনায় এবং আত্মতুষ্টিতে সচলায়তন বরাবরের মত মুখর হয়ে উঠল। অভিষিক্ত হলেন রূপক কর্মকার নিজেও, তবে সেটি শাহরিয়ার-এর বার্তা পৌঁছে দেয়ার কারণেই। নিজেও তিনি কোনোভাবেই নিজেকে বিশিষ্ট করে তুললেন না, নির্লোভ বার্তাবাহকের মতই দায়িত্ব পালন করলেন। অবাক লাগল! কে এই শাহরিয়ারময় রূপক কর্মকার, শাহরিয়ারের সিগনেচার ছাড়া ত্রিভূবনে যার অস্তিত্ব কিছু নাই। ভাবলাম হতে পারে, কতরকম ভক্তই না জগতে থাকে, প্রভুর পায়ে জীবন সঁপে দেয়া ভক্তেরই কাজ বটে।

কিছুপরই বুঝলাম, যত নখদন্তহীন নির্লোভ ভাবা হচ্ছিল তিনি ততটা নন। সচলায়তনের ব্লগার পলাশ দত্ত ও মুজিব মেহদীর সাথে রীতিমত পায়ে পা দিয়ে গ্যাঞ্জাম বাঁধানোর ধরন দেখে সেটা আঁচ করা গেল। পলাশ দত্তের কবিতার সমালোচনা করতে গিয়ে যেরকম কৃপাণহস্ত এবং কনফিডেন্ট লাগল রূপককে, মনে হল তাঁর ওপর আবু হাসান শাহরিয়ারের আত্মা যেন ভর করেছে! মুজিব মেহদীর সাথে তর্ক করতে গিয়ে তিনি সেই স্বর অব্যাহত রাখলেন, এবং তাঁর সমর্থনে আরো আরো শাহরিয়ার-ভক্তের আবির্ভাব হতে থাকল সচলায়তনে। মজার বিষয় হল, নতুন এই ভক্তরা কেউ সচলায়তনের নিয়মিত ব্লগার নন, "অতিথি" মন্তব্যকারী। শেষ বোমাটা ফাটালেন সচলায়তন কর্তৃপক্ষ। তারা জানালেন যে রূপক কর্মকার এবং তার সমর্থক-মন্তব্যকারীদের আইপি একই। অর্থাৎ একই ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন নামে কাজ চালিয়েছেন! ভাগ্যিস আবু হাসান শাহরিয়ার-এর আইপি জানেন না তারা! অবশেষে এই ধরনের প্রতারণার অভিযোগে ব্যান খাইলেন রূপক বাবু!

আবু হাসান শাহরিয়ার-এর ইন্টারভিউ পড়ার পর মনে হচ্ছিল যে, তিনি সচলায়তনে প্রবেশ করতে চান। কিন্তু সচলায়তনের প্রবেশপথ তার আকৃতির তুলনায় বেশ ছোট, ততটুকু মাথা নুইয়ে ঢোকার ব্যাপারে শাহরিয়ারের মন হয়ত সায় দিচ্ছিল না। তাই সচলায়তনে রূপকবাবুর আগমন, দরজা বড় করার জন্য, "স্বাগতম" লেখা আলাদা গেট বানানোর জন্য। আইকন হয়ে প্রবেশ করতে চান তিনি, আইকন হয়েই বিহার করতে চান। আবার "প্রিয় কবি"কে এই ব্লগে দেখতে পাবার জন্য আকূল হয়ে উঠেছিলেন অনেকেই। তাতে রূপক বাবু হয়তো একটু বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন! গুরুর স্টাইলে ছড়ি ঘোরানোর মকশো করতে গিয়েই তীরে এসে তরী ডুবলো তার! তরী ডুবলো কার?

আবু হাসান শাহরিয়ার-এর সাংগঠনিক প্রতিভা আছে, আবার অনেকেই তাঁকে কবি মনে করেন। আমি অবশ্য খুব পড়ে দেখি নি, বিচ্ছিন্ন দুচার লাইন এখানে ওখানে দেখেছি, তাতে পড়বার আগ্রহ তৈরি হয় নি। কিন্তু তারেক রহিমের কী হবে? তার মুখটা মনে করে আমার কষ্টই লাগছে, ডাই-হার্ড শাহরিয়ার-ফ্যান সে, রূপক-কর্মকার কেলেংকারির মূল প্রণোদনা কোত্থেকে এল, এটা বোঝার মত যথেষ্ট বুদ্ধি ওর আছে আমি জানি।

রবিবার, ৫ অক্টোবর, ২০০৮

হয়তো জীবন এদের কাছে এতো ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট নয়!

প্রবাসের মাটিতে বসে যেসব "শিক্ষিত" বাঙ্গালছানা "আস্তিক-নাস্তিক" জাতীয় সৌখিন, বস্তাপচা ও এলিটিস্ট তর্কে কম্যুনিটি ব্লগের তাওয়া গরম রাখেন তাদের বিদেহী বিবেচনাবোধের জন্য এই ভিডিওটি। এটি আল-জাজিরা টেলিভিশনের একটি প্রতিবেদন, সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশী শ্রমিকদের মানবেতর জীবন নিয়ে। এ নিয়ে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ আছে কিছু, পরবর্তীতে লিখবো। আমার মতো বৃত্তির নিরাপত্তা নিয়ে নয়, জমিবেচা টাকায় হাড়ভাঙ্গা শ্রম দিতে এরা বিদেশ গেছেন। মেয়াদ শেষে আমার মতো পারমানেন্ট রেসিডেন্টশিপের দরজায় দাঁড়াবেন না, ফিরে আসবেন পরিবারের মাঝে। তবু ক্রীতদাসের জীবন তাদের। তারা জানে ঈশ্বর তাদের পক্ষে নয়, তারা এও দেখেছে দেশের হাইকমিশন আরেক রক্তচোষা, তবু তারা উপাসনা করে, তবু তারা দেশের বাসি পত্রিকার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আমি ভাবি কেন এই অস্তি, কেন অস্বীকার নয়? কেন নিখিল নাস্তির স্রোতে ভেসে যাওয়া নয়?

হয়তো জীবন এদের কাছে এত ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট নয়!

শনিবার, ৪ অক্টোবর, ২০০৮

নিকনবীর অন্তর্ধান ও আমারব্লগের ভবিষ্যত

আগের পোস্টে হযরত মুহম্মদ নিকধারী এক ব্লগারের কথা লিখেছিলাম। আমার ধারণা ছিল আমারব্লগ কর্তৃপক্ষ তাকে ব্যান করেছেন। পরে জানা গেল তাকে ব্যান করা হয় নাই, নিজেই তিনি "প্রাইভেট" বলয়ে চলে গেছেন। আজকে সকালে উঠে দেখলাম ইনি আর নাই। শূন্য ভিটায় চোরছ্যাচ্চড়দের বিড়ির পাছা পড়ে আছে।

এই অন্তর্ধানের রহস্য কি? মনে রাখতে হবে গতকাল প্রতিবাদী ব্লগাররা যখন দলে দলে আমারব্লগ ছাড়ছিলেন, তখনো নিকনবী বুক ফুলিয়ে বহাল তবিয়তে তার ভিটাবাড়িতেই ছিলেন। অর্থাৎ তাদের প্রস্থানে নিকনবী এবং তার উম্মতরা ভয়ের কিছু দেখেন নি। হয়ত আরামই পেয়েছিলেন। হয়ত এটাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল।

কিন্তু মডারেশনহীন আমারব্লগের কারিগরদের জন্য এটা কাম্য ছিল না। বিশেষত যারা চলে যাচ্ছিলেন তারা মোটামুটি আমারব্লগেই ব্লগিং করতেন। রিলিজিয়াসলি। এদের তৎপরতার দ্বারা আমারব্লগের একটা চেহারা দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। আমারব্লগ নিজের পাটাতন খুঁজে পাচ্ছিল। কিন্তু সেটা অনেকেরই কাম্য নয়, অনুমান করি। তারা মুক্তচিন্তা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে আমারব্লগকে ডাম্পিং জোন বানিয়ে মজা দেখতে চান। এসব ধান্দাবাজ হিপোক্রেটদের কথা আমি আমার পোস্টে লিখেছিলাম। বলেছিলাম যে এইসব নিকেরা এখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে বড় বড় ভাষণ দেয়, কিন্তু সচলায়তনের পর্দায় ডান্ডাবেড়িসহ অনাবিল অভিনয় করে চলে। প্রশ্ন করেছিলাম এরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার এত ডাইহার্ড সমর্থক হওয়া সত্বেও সচলায়তনে পড়ে আছে কেন? যেখানে আমারব্লগ তাদের মতপ্রকাশের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য "নো মডারেশন" পলিসি দিয়ে আপ্যায়ন করছে? বলেছিলাম, "একই লোক এক জায়গায় মডারেটেড হয়ে লিখছে, আবার এখানে এসে মডারেশন ছাড়া লিখছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে তার ব্যক্তিগত কোনো অবস্থান নেই। এরা আসলে ভীষণরকম পজেসিভ, ওয়েবে যতরকম ঠাঁই আছে সবখানেই একটা ফাৎনা ফেলে রাখতে চায়। এদের আমি হিপোক্রেট মনে করি।

এখন দেখা যাচ্ছে, আমার ব্লগের “নো মডারেশন” নীতির সুযোগে এইসব হিপোক্রেসি পার পেয়ে যাচ্ছে। একদিকে আমার ব্লগ মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে উচ্চাসন দিচ্ছে, আবার অন্যদিকে এইসমস্ত হিপোক্রেসিকেও প্রমোট করছে নিজের অজান্তে।"

সম্ভবত এগুলো আমারব্লগ কারিগরদেরও মনের কথা ছিল। আমি "মিনিমাম সেন্সিবল মডারেশন"এর প্রস্তাব দিয়েছিলাম আর সুশান্ত সেটার যৌক্তিকতা যেই খুঁজে পেলেন, আর অমনি নিকনবী হাওয়া! এ যেন ভুতের মুখে রসুন পড়ল! বুঝতে বাকি থাকে না যে, এই নিকনবীর নাটক আমারব্লগে কারা শুরু করেছিল। আমি জানতাম তারা যে কোন মূল্যেই হোক আমারব্লগে মডারেশন চায় না, কারণ মডারেশন চালু হলে তাদের আন্তব্লগীয় রাজনীতি এবং বিকৃত মানসিকতার প্রদর্শন আর কোথায় করবে? ফলে পিশাচ আপাতত দরজার ওপাশে গেল, কিন্তু রসুনের মালা খসে পড়লেই আবার সে ঘাড়ে কামড় দিতে হাজির হবে ঠিক ঠিক।

আমারব্লগ "নো মডারেশন" নীতিতে চললে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি এই ব্লগে লিখিও না তেমন। বরং "নো মডারেশন" নিয়ে ব্লগটি কতদূর যায় সেটা একটা ইন্টারেস্টিং অবজার্ভেশন আমার। কেউ কেউ দেখলাম ব্লগারদের "বিবেকের মডারেশন"কেই সমাধান ভাবছেন। আমি একমত। তবে থিওরেটিক্যালি। যারা ভাবছেন এই ব্লগে সবাই একইরকম খোলা মনোভাব নিয়ে ব্লগিং করতে আসছে তারা ভুল ভাবছেন আমার ধারণা। এখানে নানারকমের আদম আছে, নানান উদ্দেশ্য তাদের। কারো কারো বিবেক আগে থেকেই মডারেটেড, বা প্রিকন্ডিশনড। বিবেকের থিওরি দিয়ে এদের জাগ্রত করা যাবে না।

আমারব্লগ আমি মাঝে মাঝে পড়ি। আমার বিবেচনায়, এই ব্লগে একমাত্র গালাগালি ছাড়া এমন কিছু দেখি নাই যা কোনো মডারেটেড ব্লগে করা সম্ভব নয়। গালাগালিগুলো বাদ দিলে বাদবাকি লেখাগুলো তো প্রথম আলো-র মত সুশীল পত্রিকাতেও ছাপা সম্ভব বলে আমার ধারণা! ফলে আমার ধারণা যারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ধুয়া তুলছেন তারা ইচ্ছামত গালাগালি করাকেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে ভাবছেন। ফলে, এই প্রেক্ষিতে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এক শ্রেণীর সাইকোপ্যাথদের যত্রতত্র মাস্টারবেশনের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের মোল্লামার্কা আস্ফালনের তোপে আমারব্লগ তার মডারেশনভাবনা নিয়ে হয়ত ম্রিয়মান হয়ে গেছে। কী আর করা। বিষ্ঠাবহনের দায় থেকে আমারব্লগ নিজেকে মুক্ত করুক, একটা স্বতন্ত্র ব্লগ হয়ে টিকে থাকুক, আপাতত সেটাই চাওয়া।








শুক্রবার, ৩ অক্টোবর, ২০০৮

নবীর নামে নিক নিয়ে "আমার ব্লগ"এ তোলপাড়!

এবার সুনামি "আমার ব্লগ"এ। সেখানে এক ব্লগার নবী হযরত মুহম্মদ এর নিক নিয়ে ব্লগ লিখেছেন। আর তা নিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন অন্য ব্লগাররা। ঐ নিকধারীর চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে ছেড়েছেন। কেউ কেউ "আমার ব্লগ" থেকে নিজেদের (সাময়িক ভাবে) প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ঐ নিকটির অ্যাকাউন্ট ডিলিট করার জোর দাবি উঠেছে। ফলশ্রুতিতে, আমার ব্লগ কর্তৃপক্ষ যারা "নো মডারেশন" নীতিকে আশ্রয় করে এই ব্লগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারা অবশেষে হযরত মুহম্মদ নামক নিকটির অ্যাকাউন্ট আমার ব্লগ-এর পাতা থেকে ডিলিট করে দিয়েছেন।

কম্যুনিটি ব্লগিং প্লাটফর্ম হিসেবে "আমার ব্লগ"এর জন্মই হয়েছে মডারেশনের ধারণার বিপরীত প্রণোদনা থেকে। সম্ভবত সচলায়তনের স্বৈরাচারী মডারেশন পদ্ধতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে এইরকম একটি প্লাটফর্মের কথা ভাবেন তারা। যতদূর দেখেছি, এই ব্লগে মডারেটরের কোনো পদই সৃষ্টি করা হয় নি। কোনো মডারেশন নাই, ব্যান নাই, সদস্যপদের জন্য লম্বা কিউ নাই, তেল মারতে হয় না কাউকে, সব মিলিয়ে আমার ব্লগ যেন সেই মজারু দ্বীপ যেখানে সবই আছে, কিন্তু পুলিশ নাই!

ঠিক সেই মজার আহবানে নয়, একটা কম্যুনিটি ব্লগে লেখালেখি অব্যাহত রাখার ইচ্ছা থেকে আমার ব্লগ-এ আমিও অ্যাকাউন্ট খুলেছিলাম। ব্লগ লিখতেই দেখি... ওমা... সচলায়তনের সব ভ্যাম্পায়াররা এখানে হানা দিতে শুরু করলেন। আসলে গোড়া থেকেই এরা এখানে ছিলেন, নতুন কোনো কম্যুনিটি হলেই সেখানে তারা এজেন্সি নিয়ে রাখেন। তো, তাদের গায়ের গন্ধে আর পাখার ঝাপটে আমার ত্রাহি ত্রাহি দশা! গালাগালির চূড়ান্ত করে ছাড়লেন এরা। এই এরাই আবার সচলায়তনে যখন লেখেন, তখন কত নোক্ষী ছেলে! কী বোর্ড দিয়ে সব সোনা যেন বের হয়! বুঝলাম এরা সচলায়তনে সোনার ডিম পাড়েন আর আমার ব্লগ-এ লিজার্ড রিলিজ করতে আসেন। একই অভিযোগ সামহোয়ারইন-এর ব্লগাররাও করেছিলেন এদের বিরূদ্ধে, বেশ আগে। কিন্তু সামহোয়ার বড় কম্যুনিটি, এইসব হাগাহাগির থোড়াই কেয়ার করে। কিন্তু আমার ব্লগ একটা নতুন কম্যুনিটি, এখনো তার নিজস্ব কম্যুনিটি ঠিকমত গড়ে ওঠে নাই।

এখন কথা হচ্ছে, "আমার ব্লগ"এর কৌশল অনুযায়ী সেখানে হযরত মুহম্মদ নামে নিক থাকতেই পারে। কারণ এই ব্লগে কোনো নীতিমালাই নেই, মত প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ মানে না এরা। যারা এখানে লিখছেন তারা এই পজিশন মেনে নিয়েই লিখছেন, বা এই পজিশন থাকার কারণেই এখানে কন্টিনিউ করছেন। তাহলে কোন্ কারণে এরা হযরত মুহম্মদ নিককে ডিলিট করতে বলেন?

কারণ খুবই মানবিক। মুসলমানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করা যাবে না। হযরত মুহম্মদ নিকটি আদতে তাইই করতে এসেছিল বলে আমারো মনে হয়েছে। এতে ব্লগের মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে এটা স্বাভাবিক। আবার, আপনি যদি মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানেন, তাহলে এইরকম নিক নিয়ে কোনো ব্লগার তার অনুভূতির কথা বলার স্বাধীনতা রাখেন এটাও মানেন। এখন সংক্ষুব্ধ ব্লগার মুকুল এবং আরো কেউ কেউ বলছেন, স্বাধীনতা মানেই যথেচ্ছাচার নয়। যা খুশি তাই করা মানেই স্বাধীনতা নয়। একটা সীমা থাকতে হবে। তাদের সীমাসন্ধানের নৈতিক চাপপ্রয়োগের ফলে আমার ব্লগ-এর মূল দর্শনের সীমানাপ্রাচীর ভেঙ্গে চুরমার। দেখলাম হযরত মুহম্মদ এর অ্যাকাউন্টটা অবশেষে ডিলিট করে দেয়া হয়েছে।

এটা বাংলা কম্যুনিটি ব্লগের ইতিহাসে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। "আমার ব্লগ" একটা অত্যন্ত সাহসী চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল যে তারা কিছুই মডারেশন করবে না। ওয়েব হবে অবারিত, স্বাধীন। এটি প্রমাণ করার মাধ্যমে তারা আসলে প্রমাণ করতে শুরু করেছিল যে সচলায়তনজাতীয় ওয়েব ব্লগিং মূলত প্রিন্টমিডিয়ার ভাবাদর্শকেই ওয়েবে ইমপোজ করার ব্যাপার। সেই একই বিধিনিষেধ, একই মানবিচার, একইরকম কাহিনী। "আমার ব্লগ"এর এই প্রজেক্ট এখন কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ল। মডারেটরের অফিস খুলল তারাও।

তাহলে কি আমি বলতে চাইছি হযরত মুহম্মদ এর নিক ব্যান করা অযৌক্তিক হয়েছে? না, সেটা বলতে চাইছি না। কিন্তু এই প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর "আমার ব্লগ"এর প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে আমার পক্ষে দেয়াও সম্ভব নয়। নবীর নামে নিক যিনি নিয়েছেন তিনি তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জায়গা থেকে নিয়েছেন, আবার যারা এর প্রতিবাদ করেছেন তারাও খুব অযৌক্তিক ছিলেন না। টেক্সটের শক্তি অসীম। হযরত মুহম্মদ-এর নামের সাথে দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অপরপক্ষ একটু অসুবিধার মধ্যেই থাকবেন। আবার, এই নিক নিয়ে নিকধারী যা করতে শুরু করেছিলেন তাকে ম্যানিপুলেশন তো বলাই যায়। আমার মতে, একটা কম্যুনিটি ব্লগে সেটা তিনি করতে পারেন না। সেখানে নানারকম লোক আছে, তাদের নানা ধরনের বিশ্বাস বা অবস্থান আছে। কিন্তু তাই বলে তিনি অন্যায় করেছেন সেটাই বা বলি কী করে? তিনি তো এই ব্লগের চরম লিবারাল চরিত্রের সুযোগ নিয়েছেন মাত্র।

ঘুরে ঘুরে সেই পুরনো প্যাঁচাল: নৈরাজ্য না নিয়ন্ত্রণ? আমি সবসময় যেটা বলতে চেয়েছি, নৈরাজ্য যেমন নয়, তেমনি সচলায়তন-মার্কা নিয়ন্ত্রণও নয়, বরং নৈরাজ্য থেকে নিয়ন্ত্রণ বরাবর একটা স্কেলে টেনে সেই স্কেলের কোন্ বিন্দুতে আপনি অবস্থান করছেন সেটা কম্যুনিটি ব্লগকে ঠিক করে নিতেই হবে। "আমার ব্লগ" ধীরেসুস্থে হয়ত সেই পথেরই পথিক হয়ে ওঠবে।


পোস্ট স্ক্রিপ্টাম: অলৌকিক হাসান তার পোস্টে জানিয়েছেন যে নিকনবীকে ব্যান করা হয় নাই, নিজেই তিনি "প্রাইভেটাইজড" হৈয়া গেছেন। সেই অর্থে আমার ব্লগের "নো মডারেশন" নীতি এখনো বহাল আছে। বিস্তারিত দেখুন http://amarblog.com/aloukik/13474 এই লিংকে।

০৩.১০.০৮


বুধবার, ১ অক্টোবর, ২০০৮

আমি দুঃখিত, অভিজিৎ!!

(আমার লেখা "ব্লগারের মৃত্যু ও ভার্চুয়াল শোকের চেহারা"কে উপলক্ষ করে মাননীয় অভিজিৎ রায় সচলায়তনের পাতায় আমার চরিত্রহননে কিঞ্চিৎ বাক্যব্যয় করেছেন। এই উপলক্ষে আমারো মনে পড়ল আমাদের পুরনো মোলাকাতের কথা। "পুরনো ক্ষতের দাগ আলো আবছায় হাসে"... বন্ধু মাহবুব পিয়ালের কবিতার লাইন। আবার "ক্ষতস্থান সেরে গেলে পুনর্বার তাতে রোম গজায় না" সেটি জানিয়েছিলেন বিনয় মজুমদার। রোম যে গজায় নাই তা আজ এতোদিন পরে টের পাইলাম। সেই অবকাশে ওয়েব খুঁজে কবিসভা থেকে পুরনো একটি লেখা পাওয়া গেল।)

অভিজিৎ রায়ের আলোচনা ও রেফারেন্স পড়লাম।

এক নম্বর পয়েন্টে তিনি আমার সাথে ঐকমত্য পোষণ করলেন দেইখা আরাম পাইলাম। অর্থাৎ তিনিও মনে করেন বুদ্ধিবৃত্তিক তর্কের মধ্যে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ গুলায়া না ফেলাই উচিৎ।

দুই নম্বর পয়েন্টে তিনি আমার লেখার মধ্যে একটা ‘ভুল তুলনা’ খুঁইজা পাইছেন। অর্থাৎ, তার মতে, ধর্মগ্রন্থনির্ভর ধর্মীয় শাসনের সাথে গ্রন্থহীন সেক্যুলার শাসনের তুলনা হৈতে পারে না। মোটা হরফে লিখছেন, সাদ্দামের এট্রোসিটিকে জাস্টিফাই করে...এমন কোনো নীতি সেক্যুলারিজমে নাই।

এইখানে আইসা মানসের মত আমারও সন্দেহ হৈল। তিনি কি এই অধমের লেখাটি পড়েছেন ঠিকমত?

অভিজিৎ, আপনে খেয়াল করলে দেখবেন যে, আমি মূলত সেক্যুলারিজমের প্রাক্সিস-এর দিকটাই আলোচনা করতেছিলাম, যেহেতু, আমার জানা মতে, সেক্যুলারিজমের কোনো সর্বজনীন মূলনীতি কেউ লিখ্যা যান নাই। সেক্যুলারিজম শেষপর্যন্ত কিছু প্রাক্সিসেরই সমষ্টি। মডার্নিজমের একটা কম্পোনেন্ট হিসাবে এই বিষয়টা পশ্চিমে বিকশিত হৈছে রাষ্ট্রকে ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিকতা থিকা উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু, আমি বলতেছিলাম বাস্তবে কী হৈছে সেই কথা। বলতেছিলাম, সেক্যুলার রাষ্ট্রের বাতাবরণে থাইকাও রাষ্ট্রনায়কেরা যেভাবে বিধর্মী নিধন করছেন সেই কথা। তখন কিন্তু, মহান পশ্চিম, সেক্যুলার রাষ্ট্রের এইসব আচরণকে নন-সেক্যুলার আখ্যা দেয় নাই।

তারপরে, অনেকটা উপযাচক হৈয়া, জনাব অভিজিৎ একটা লিংক দিলেন, যাতে এই কবিসভার নাদান সদস্যরা বিশ্বাস, দর্শন ও ডগমার পার্থক্য ‘ভালমত বুঝতে’ পারে। আমি সেই লিংকে কিক করলাম। পাইলাম জনৈক অপার্থিব জামানের কিছু সংজ্ঞা। পইড়া বুঝতে বুঝতে আমারতো সংজ্ঞাহীন হৈবার দশা!

সংক্ষেপে বলি:

অপার্থিব ‘বিশ্বাস’ কে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়া লিখছেন 'ফেইথ' হৈল 'পারসনাল বিলিফ'.....। বাদবাকি পড়ার ধৈর্য আমার আর হয় নাই। ভাই অভিজিৎ, এইটারে টটলজি কয়, বাংলায় বলা যায়, পুনরুক্তিদোষ। ফেইথ হৈল বিলিফ! বাহ্! তারপরে আবার ‘পারসনাল’!! অর্থাৎ কোনো জনগোষ্ঠী, যেমন ধরেন ধীবর, যখন নদীর দেবতায় বিশ্বাস করে, তখন সেইটারে কিন্তু ‘ফেইথ’ কওয়া যাইব না! যেহেতু ‘পারসনাল’ না! চমেৎকার!!

অতঃপর ফিলসফির সংজ্ঞা। এইখানেও ‘পারসনাল’ আছে, সেই আলোচনা বাদ দেই, নাইলে আমার হালায় আবার টটলজি হৈয়া যাইব! ঐখানে বলা হৈছে, ফিলসফি হৈল অ্যা পারসনাল ভিউ অ্যাবাউট রিয়েলিটি....! আবার ধৈর্যহারা হৈয়া গেলাম। রিয়েলিটি কি জিনিস? যেসব বিষয় নন-রিয়াল (যেমন ঈশ্বর) সেসবের পারসনাল ভিউ তাইলে ফিলসফি হয় না? আমার রীতিমত মূহ্যমান অবস্থা!

শেষ চেষ্টা করার আর সাহস হৈল না। মাফ কৈরেন ভাই!

সাজ্জাদ শরিফ প্রায়ই বলেন, আমাদের দেশের ফিলসফিচর্চার দূরবস্থার কথা। এক্ষণে প্রমাণ পাইলাম।

..........................

বাকি থাকল, অভিজিৎ, আপনের লেখা, সেইটাও পড়লাম। আপনের লেখায় ফরহাদ মজহারের বিরূদ্ধে আপনের উত্তেজনাটাই শুধু ঠাহর করতে পারলাম। আপনের দর্শন অপার্থিব জামানের চেয়েও ভীতিকর। আপনে লিখছেন, প্লেটোর ‘অতীন্দ্রীয় রহস্যবাদী ভাববাদ’! কী জিনিস সেইটা?

এখন আমি বুঝতে পারতেছি না, কেন আপনে আমার সাথে একমত হৈলেন? আমি কৈছিলাম, ফরহাদ মজহারকে মোকাবেলা করা দরকার বুদ্ধিবৃত্তির জায়গা থিকা। আপনেও সায় দিলেন। কিন্তু আপনের লেখা পইড়া আমার মনে হৈল, ঠিক এই ধরনের চিন্তাহীন বিরোধিতার বাইরে থেকে আমি বিষয়টা দেখতে চাইছিলাম। আমার বক্তব্য রূঢ় শোনাইলে আমি দুঃখিত অভিজিৎ।


শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

ব্লগারের মৃত্যু ও ভার্চুয়াল শোকের চেহারা


মুহম্মদ জুবায়ের মারা গেছেন। ইনি প্রথম যৌবনে লেখক হওয়ার জন্য ঘর ছেড়েছিলেন এবং শেষ জীবনে লেখালেখি করবার জন্য বেছে নিয়েছিলেন ব্লগকে। সেই অর্থে ব্লগার ছিলেন তিনি, লিখতেন সচলায়তনে। আমি যখন সচলায়তনে প্রবেশ করেছিলাম, তিনি রীতিমত ছেলেমানুষের মত খুশি হয়েছিলেন। আমার দ্রুত সদস্যভূক্তির ব্যাপারে সচলায়তন কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানিয়েছিলেন। তারপর একদিন কথাচ্ছলে জানিয়েছিলেন যে, তিনি সচলায়তন অঙ্গনে আর লিখবেন না। সেটি সম্ভবত ডুয়াল পোস্টিং নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপের জবাবে তাঁর অভিমানী সিদ্ধান্ত ছিল। আমরা যথারীতি তাঁকে তাঁর সিদ্ধান্ত পাল্টাতে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি তা করেছিলেন। তারপর আমি যখন সচলায়তন ছেড়ে আসি, তিনি আমার ছেড়ে আসার সিদ্ধান্তের সাথে একমত ছিলেন না। তাঁর মনে হয়েছিল আমি না ছেড়ে আসলেও পারতাম। এমনকি সচলায়তন বিষয়ে প্রথম আলো-তে লেখা আমার নিবন্ধের গীবতেও সামিল হয়েছিলেন তিনি।

মুহম্মদ জুবায়ের বিষয়ে এইটুকু লেখার পর আমি নিজে পরিষ্কার যে সচলায়তনের ব্যাপারে তাঁর শর্তহীন পক্ষপাত ছিল। খুবই ভালোবাসতেন এই ফোরামটিকে। কিছু খিটিমিটি হলেও সেখানেই লিখে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। এতই টান ছিল এই ফোরামের প্রতি যে, এই ফোরাম ত্যাগ করবার পর অন্য অনেকের মত তিনিও আমার সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রদ করে দিয়েছিলেন।

মুহম্মদ জুবায়ের-এর সাথে আমার প্রথম দেখা কবিসভায়। কবিসভা উত্তপ্ত তর্কবিতর্কের জায়গা, মনে পড়ে কোনো একটা বিষয়ে তাঁর সাথেও আমার তর্ক হয়েছিল। পরে অনিয়মিত হয়ে গিয়েছিলেন কবিসভায়। মেইল করতেন মাঝে মাঝে, আমার একটি গল্পের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন, শহীদ কাদরীর সাথে আমার গল্প নিয়ে তাঁর বিস্তর কথাবার্তা হওয়ার কথা। ফলে, মুহম্মদ জুবায়ের, যাঁকে আমি চর্মচক্ষে দেখি নি কোনোদিন, তাঁর ব্যাপারে একটা স্নিগ্ধ অনুভূতি আমার ছিল সবসময়।

সচলায়তনে ব্লগ লিখতেন তিনি, সত্তর দশকের জীবনযাপন ও স্বপ্ন নিয়ে তাঁর চিন্তাজাগানিয়া পর্যবেক্ষণ ছিল। একটা ধারাবাহিক উপন্যাসও লিখেছিলেন। বন্ধু ও প্রবাসী লেখক লুৎফর রহমান রিটনকে সচলায়তনে নিয়ে এসেছিলেন। এই ব্লগের মডারেটরদের সাথে তাঁর দহরম মহরমও ছিল। ব্লগাতিরিক্ত যোগাযোগ ছিল। ব্লগারদের কারো কারো সাথেও। একবার তাঁর অসুস্থতা এবং ধূমপান করা নিয়ে তাঁর কন্যাটি একটি মর্মভেদী চিঠি লিখেছিলেন তাঁকে, সেই চিঠি সচলায়তনে অনেক প্রশংসাও পেয়েছিল।

এহেন মানুষটি, যিনি তাঁর যাবতীয় পক্ষপাত ও সমালোচনাসহ আমার কাছে আদ্যোপান্ত ভার্চুয়াল একটি চরিত্র, তাঁর মৃত্যুসংবাদ ঘিরে আমার ভেতর জমতে থাকা শোকের চেহারাটি আঁচ করতে চেষ্টা করি। আঁচ করতে চেষ্টা করি, মুহম্মদ জুবায়ের তাঁর ভার্চুয়াল অস্তিত্বের বাইরে কে ছিলেন, কী ছিলেন। তাঁর স্মৃতিকথা থেকে টের পাই তিনি এক স্বাপ্নিক মানুষ ছিলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন, সেই ধারাবাহিকতায় সমাজতন্ত্রের স্বপ্নও দেখেছিলেন। তাঁর লেখক হয়ে-উঠার স্বপ্নের সাথে সেইসব স্বপ্নকে তিনি মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিলেন। এভাবে অনেক খুইয়ে, একসময় জীবনকে গুছিয়ে নেয়ার তাড়না অনুভব করেছিলেন, বেছে নিয়েছিলেন প্রবাস জীবন। কিন্তু স্বপ্ন আর স্বপ্নকে বাস্তবে দেখতে না-পাবার বেদনা তাঁর পিছু নিয়েছিল। নিপুণ আততায়ীর মত। প্রথম প্রজন্মের প্রবাসীর মত তিনিও তাঁর স্বদেশকে বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলেন। এর জন্য বেদনা পাবার দায় থেকে কখনো ছুটি নেন নি। ফলে, কর্মস্থলে, ভিন্ন সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা স্বজনবেষ্টনীর মাঝেও তিনি ছিলেন একা। একেলা।

কিন্তু এ তো মুখস্ত গল্প। এই গল্পের উপসংহার আমরা জানি। কিন্তু আশ্চর্য হই ভেবে যে মুহম্মদ জুবায়ের সেই উপসংহারটি বেছে নেন নি। প্রৌঢ়ত্বকে জয় করে নেমে এসেছিলেন তরুণদের ব্লগে। তরুণদের চোখভরা স্বপ্নের জগতে হয়ে জুবায়ের যেন বুড়ো বাতিওলা! এ এক জয়ের নেশাই বটে! মনে পড়ে, এমনিতর নেশার টানেই সরকারি চাকুরি থেকে অবসর নেয়া কবি মুস্তাফা আনোয়ার আমাদের উদ্দাম জীবনের সাথে সমানে সমানে পাল্লা দিতেন। গ্রেস নিতেন না একদমই। মুহম্মদ জুবায়েরও তাই। জরাগ্রস্ততার অমোঘ খপ্পরে পড়বার আগে মানুষের শেষ রোমান্টিক দ্রোহ!

কিন্তু আজ যখন মুহম্মদ জুবায়ের মারা গেলেন, আমি বিষণ্ণ হয়ে থাকলাম এই ভেবে যে এই নামটিকে ঘিরে আমাদের অন্তহীন ভার্চুয়াল জগতে আর কোনো গালগল্প তৈরি হবে না। মুহম্মদ জুবায়ের এর নামে আর কোনো ব্লগ বা উপন্যাস আপলোড হবে না, যেগুলো পাঠ করে করে আমরা তাঁকে চিনতে থাকবো, তাঁর ব্যক্তিত্ব তৈরি হতে থাকবে আমাদের পারসেপশনের আঁকাবাঁকা গলির ভেতর। শোকের অক্ষর উপচে পড়ছে সচলায়তনে, অন্যান্য ব্লগেও। ভাবি, এই শোকটি কেমন? কিছু টেক্সটের জন্য কিছু টেক্সটের শোক, নাকি টেক্সট-উত্তর অচেনা যোগাযোগহীন ব্যবহারিক জীবনে এর কোনো অভিঘাত তৈরি হয়? মুহম্মদ জুবায়েরকে আমরা তো চিনেছি তাঁর টেক্সট দিয়েই, অর্থাৎ তাঁর লেখাকে তাঁর ব্যক্তিত্বের উপরে আরোপ করে নিয়েছি আমরা। রলা বার্থ যেমন বলেন, লেখকের অস্তিত্ব বা বিদ্যমানতা তাঁর লেখার স্বাতন্ত্র্যকে বাধাগ্রস্ত করে। সেই অর্থে, ব্লগার মুহম্মদ জুবায়ের-এর মৃত্যু যেন প্রতীকী! যেন তিনি তাঁর মরণ দিয়ে মুক্ত করে গেলেন তাঁর রচনারাশিকে, আমাদের মননে তাঁর ব্যক্তিত্বের সংগঠন প্রক্রিয়া থেকে। টেক্সটের বাইরে সত্যিকারের যিনি জুবায়ের, যার একটা ফুসফুস অকেজো ছিল অনেকদিন, যিনি অনেকের বন্ধু, ভাই বা পিতা, তার শরীরী মৃত্যুতে আমাদের ভার্চুয়াল-পেরোনো ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীজীবন কতখানি শোকতপ্ত হবে? সেই অর্থে এটি অথরের মৃত্যু, একটি টেক্সচুয়াল মরণ। এই টেক্সচুয়াল মরণের স্মরণে আমরা যে শোকগ্রস্ত হচ্ছি সেটিও টেক্সচুয়াল, এবং টেক্সটের বাইরেও যদি এর সন্তাপ আমরা অনুভব করি, তবে সেও টেক্সটেরই সামর্থে।

আরেকটা বিষয়: মার্কেজ একটি উপন্যাসে যেমন লিখেছেন, কেবলমাত্র মৃত্যুই মাটির সঙ্গে মানুষের নাড়ির যোগ ঘটাতে সক্ষম। অর্থাৎ যে মাটিতে আমার অধিষ্ঠান সেখানে আমার পূর্বপুরুষের কবর থাকলেই সেটা অনেক দৃঢ় হয়ে ওঠে। মুহম্মদ জুবায়ের-এর মৃত্যুশোক তাঁর ব্লগিং ফোরাম সচলায়তনে সেইরকম ইতিবাচক একটি প্রভাব ফেলবে মনে হয়।

বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

কখনো যাই নাই বিদ্যাকূট

চোখের সামনে পুড়ছে আমার মনসুন্দর গ্রাম
আমি যাই নাই রে, আমি যাই নাই

- কফিল আহমেদের গান

১.
কখনো যাই নাই বিদ্যাকূট!

উরখুলিয়া গেছি, বিদ্যাকূটের পাশের গ্রাম। এক সন্ধ্যার কথা মনে আছে, উরখুলিয়ার গ্রামছাড়া জোতদার রেজেক মিয়ার পোড়োবাড়িটা দেখতে গেছিলাম। বিশাল বাড়ি, সারি সারি টিনের চৌচালা ঘর, সেসব ঘরে কেউ নাই তখন, জিনিসপত্র সব টুকরা টুকরা করে ভাঙ্গা, টিনের প্রতিটা ঢেউ-য়ে দায়ের নিপুণ কোপ। উঠানের মাঝখানে ছোটখাট একটা পাহাড়, ভাঙ্গা সিরামিকের জিনিসপত্রের ।

উরখুলিয়া একটা অদ্ভূত মাথাগরম জায়গা। তিতাসের পাড় ধরে লম্বালম্বি একটা গ্রাম, ঠিক চিলি দেশটার স্টাইলে। গ্রামের অর্ধেক লোক থাকে ইটালি। তারা টাকা পাঠায়, আর সেই টাকায় দুই গোষ্ঠীর শতবছরের পুরানো ঝগড়াটা ফি বছর ঝালাই হয়।

ঝগড়ার উপলক্ষ?

শুনলে হাসবে উরখুলিয়ার লোকেরা। উপলক্ষ নো প্রবলেম, জিয়াউর রহমান স্টাইলে। কোনো উপলক্ষ পাওয়া যাইতেছেনা, ঠিকাছে, ঐ যে জালাইল্যা আছে না, জ্ঞাতিগোষ্ঠী নাই, এতিম পোলা, ঘরে মা একলা, ওরে ফালায়া দাও! তারপর কেইস নিয়া সোজা নবীনগর থানায়।

জালাইল্যাকে আমি চিনতাম। এক পা খোঁড়া, কিন্তু কাইজ্যার আগে সবসময়। ভ্যানগার্ড।

জালাইল্যার খুনের এই পরিকল্পনা কিন্তু প্রতিপক্ষের নয়, তার স্বপক্ষেরই। আবার এই স্বপক্ষের কোনো উপদলীয় কোন্দলের ফসল নয় এই সিদ্ধান্ত। যারা এই নীলনকশা করেছে তারা সবাই জালাইল্যার সমঝদার। কিন্তু কি করা? দুইশ বছরের পুরনো 'বাইশাবাইশি', অনেক রক্ত খায়! তার তৃষ্ণা মিটাতে গেলে নিজের পরের বাছাবাছি করনের সুযোগ কমই থাকে।

যারা জালাইল্যারে ফালাইয়া দিল, তারাই গায়ের কাপড় বদলায়া নবীনগর থানায় গিয়া ফৌজদারি মামলা ঠুকল। তারপর বাজার করল, টর্চলাইটের জন্য দোকান ঘুইরা একনম্বর সানলাইট ব্যাটারি কিনল, জালাইল্যার মায়ের জন্য নতুন জায়নামাজ ও তসবি কিনল, তারপর বাড়ি ফিরবার আগে হাউজির মাঠেও দুইচক্কর দিল।

আর যারা ঘুম থেকে উঠে শুনল তারা খুনের মামলার আসামি, তাদের হৈয়া অবাক হৈলেন বিধাতা। তারাও ঘরের কালার টেলিভিশন, অষ্ট্রেলিয়ান গাভী, ডেকসেট ও ক্যামেরা পাশের গ্রামের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে পাঠায়া দিল, ঘরের মেয়েমানুষের হাতে দরকারি টাকাপয়সা গুঁজল, তারপর সোজা লঞ্চে হয় ভৈরব না হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

সেই উরখুলিয়ার পাশের গ্রামই বিদ্যাকূট। আমি উত্তপ্ত উরখুলিয়ায় বসে বসে বিদ্যাকূট নিয়া ঈর্ষায় জ্বলতাম। বিদ্যাকূটে কোনো পুলিশ ক্যাম্প লাগে না, সেই গ্রাম থেকে শরনার্থী আসে নাই কোনো দিন এই উরখুলিয়ায়। দূর থেকে দেখেছি, অদ্ভূত একটা গ্রাম, খড়ের গাদায় রোদের ঝিলিক লেগে এখান থেকেও আমার চোখ চিকচিক করে।

কবে যাবো বিদ্যাকূট, ভাবতাম পুরুষশূন্য উরখুলিয়া গ্রামে হাঁটতে হাঁটতে।

ফরহাদ মজহার-এর সাম্প্রতিক কবিতা প্রসঙ্গে


বয়স বিচারে ফরহাদ মজহার কবিতা সঞ্চালনে সবচে বয়োজ্যেষ্ঠ কবি। বাঙালি কবিদের বয়োজ্যেষ্ঠতাকে আমরা, উত্তরসূরী হিসেবে, একটুখানি কৃপাসহযোগে পাঠ করতে অভ্যস্ত। কিন্তু ফরহাদ মজহার সেই আয়েশটুকুর সুযোগ রাখেন নাই এই কবিতাসমূহে। এবং তার অপরাপর কবিতায়। তিনি সবসময় তরুণতর, নিজেকে সমসাময়িক দেখতে ভালবাসেন। আমরাও তাকে অনেক বছর এভাবে দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ফলে, এটা তাকেই মানায় যে তিনি ‘ফরিদার জন্য ক্যামেরাগিরি’ করবেন, 'সাড়ে সাতরকমভাবে' তাকাইবেন শালিখ পাখির দিকে।

নানারকমভাবে ফরহাদ মজহার-এর কবিতার বয়স বেড়েছে। ‘ভেজা কবিতা’য় বৃষ্টি তাকে তার দিদির জন্য উদ্বিগ্ন ও সজল করে তোলে। দিদির জন্য আকুল ফরহাদকে তখন আর প্রৌঢ় লাগে না, সেই কিশোরের মত লাগে যে চোখফুটে প্রথম বর্ষা দেখছে:

জলে জলে ভিজছে শহর, জলেতে ইস্পাত
একটি হলুদ মোটরগাড়ি জলেতে চিৎপাত।
দালানগুলো ভিজছে একা কারখানাতে পানি
জলের মধ্যে যুগল ভাসছে কবি ও বিজ্ঞানী।

বেড়েছে না বলে কমেছে বললেই মানায়। কেননা তিনি যখন বিছানা নিয়ে কবিতা রচনা করেন, যেখানে মানবশয্যার দীর্ঘ ইতিহাস নিয়ে জ্ঞান ফলানোর সুযোগও থাকে:

আমার ঘরের একপাশে আয়তত্রে হইয়া বিছানাটি কী সুন্দর অঙ্কিত হইয়া আছে
বিছানা অবধি পোঁছাইতে সভ্যতাকে কত পথ পাড়ি দিতে হইয়াছিল একবার ভাবিয়া দেখো


কিন্তু এরপর তিনি বিস্ময়কররকম ভাবে তার জ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করেন। হামলে পড়তে দেন নি বেচারা বিছানার (এবং কবিতার) ওপর। অত্যন্ত শিক্ষণীয় এবং অনুকরণীয় নিরাসক্তি। তরুণদের জন্য। আমরা যারা আমাদের যৎসামান্য র‌্যাশনালিটিকে কবিতার পেছনে লেলিয়ে দিই। আসুন দেখি ঐ দুই লাইনের পর কবি ফরহাদ মজহার, যিনি আবার একাধারে সমাজবিজ্ঞানী, রাজনীতি বিশ্লেষক, উন্নয়ন-চিন্তক এবং তত্ত্বালোচক, কোনদিকে গেলেন:

বিছানার ওপর বালিশটি পড়িয়া আছে, একটি মস্তকের জন্য তার নীরব নিঃশব্দ অপেক্ষা
একটি শরীর পাইবার আশায় বিছানাটি মৃতদেহের মতো গভীর গর্ত হইয়া আছে।

তত্ত্ব নাই, ইতিহাস নাই, সমাজবিজ্ঞান নাই। তাদের নির্যাস আছে হয়ত। কিন্তু আক্রান্ত করে না। কারণ, এখানে কবিতা আছে।

মনে পড়ে, ১৯৭৫ এ লেখা একটি প্রবন্ধ সংকলনে (বইয়ের নাম ছিল "প্রস্তাব") ফরহাদ মজহার তার চেতনাপ্রবাহে বিজ্ঞান, কবিতা, দর্শন, নৃতত্ত্ব সবকিছুকে একীভূত করে দেখতে প্রয়াসী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সময় কত বদলায়! এখন ফরহাদ যখন কবিতা রচনা করেন, তখন তিনি একান্তভাবেই কবি থাকতে চান।

আরেকটা বিষয়। ফরহাদ মজহারই সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে এখন একমাত্র কবি যিনি তরুণদের একটা ভাষাপ্রকরণচিন্তা, যার মেনিফেস্টেশনও পুরোপুরি হওয়া বাকি, সেটা দিয়ে নিজেকে আক্রান্ত করার সাহস দেখাতে পারেন। জয় হোক তাঁর।

২০০৫


শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

অতিগরিবের ক্ষুধা-ব্যবস্থাপনার ভেতরে কোনো এক দিপালীর আত্মহত্যা



ভৈরবের দিপালীদের পরিবারে এখন অন্য অবস্থা। চাল আসছে, ডাল আসছে, এনজিও আসছে, ভিজিএফ কার্ড আসছে, ওয়ার্ড কমিশনার এসে সকালসন্ধ্যা খোঁজ নিচ্ছে। মেঘ না চাইতেই ঝড়!

ঝড়-ই তো। দিপালী যখন গলায় দড়ি দিয়ে ক্ষুধার জ্বালা চিরতরে মিটাল, তখন দিপালীর পঙ্গু বাবা ভাবছিলেন মেয়ের অন্তিম সৎকারের অর্থ জোগান দেবেন কিভাবে? কিন্তু কোত্থেকে কী যেন ম্যাজিক হয়ে গেল, মেয়েটা মরে গেল, আর সঙ্গে-সঙ্গেই রূপকথার মত অদ্ভূত সব ঘটনা। যে সমস্ত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের স্বপ্নও তিনি দেখেন নি, তারা এসে হাজির: সমবেদনাসহ, খাদ্যসহ, চাকরিসহ। একের পর এক রিকশা আর মোটরসাইকেল এসে থামছে তার ছাপড়ার সামনে, হতভাগা মেয়েটার জন্য মনের মধ্যে এক পশলা শোকও জমতে দিচ্ছে না।

পালা করে খেত দিপালীর পরিবার। আটজনের এই পরিবারে নিয়ম ছিল, যে-চারজন দুপুরে খাবে, রাতে তারা উপোস করবে। রাতে খাবে অন্য-চারজন। এভাবেই চলছিল তাদের ক্ষুধা ব্যবস্থাপনা। ভালই চলছিল। গোলমালটা লাগল, যখন দিপালীর প্রতিবন্ধী এক ভাই নিয়ম ভেঙ্গে পরপর দুইবার খেয়ে বসল। তাতে দিপালীর কপাল পুড়ল, ক্ষুধার যন্ত্রণার চেয়ে তার কাছে মৃত্যুকেই বেশি শান্তির মনে হল।

এরকম হয়েই থাকে। ‘ক্ষুধা-ব্যবস্থাপনা’র যে দেশব্যাপী নীরব দযজ্ঞ চলে, তার খোঁজ সরকার নেয় না, এনজিও-র ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পে তাদের জায়গা নাই, সংবাদপত্রের পাতায় তার সংকুলান হয় না ঘটনাহীনতার কারণে। এরমধ্যে হঠাৎ কোনো এক দিপালী মাঝখান থেকে দুম করে মরে বসে, বিব্রত হয় মধ্যবিত্তের সিভিল বিবেকব্যবস্থা। কিন্তু না হলেও চলত! কারণ পরিসংখ্যানে ‘স্ট্যান্ডার্ড এরর’ বলে একটা বিষয় আছে না? ক্ষুধা ব্যবস্থাপনার এই যে সর্বব্যাপী আয়োজন, তাতে দুয়েকটা দিপালী তো পরিসংখ্যানের নিয়মেও ঝরে যেতে পারে! পারে না?

এই হল শাস্ত্রের আসল নাম: নিখাদ নিপাট ক্ষুধা ব্যবস্থাপনা। এসেটহারা গরিবের ক্ষুধা ব্যবস্থাপনা। এসেট নাই বলে সে ক্ষুদ্রঋণ পায় না, এনজিওর খাতা তার সামনে খোলে না। সরকারের তো দুইশ টাকার ভিজিএফ মশকরা, ক্ষুধার পেটে বয়স্কভাতার চুলকানি, তার দরজাতেও কত পেট-ভর্তি মানুষের ভিড়! আর বিত্তবান সমাজ? দিপালীর বাবা চেয়ে চেয়ে দেখেন ওদের। বুঝতেই পারেন না, জীবিত দিপালীর চেয়ে মৃত দিপালীর কদর এত বাড়ল কোন্ নিয়মে?


দিপালীদের পরিবারে যেভাবে ক্ষুধার ‘ব্যবস্থাপনা’ চলছিল, দিপালী আত্মহত্যা না করলে তা হয়ত সংবাদপত্রবাসী জানতই না। এভাবে নীরবে নিভৃতে ভয়ংকর ক্ষুধার সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে তাদের জীবন গড়িয়ে চলত। ষাট বছরের আয়ু তিরিশ বছরে ঠেকে যেত, অমর্ত্য সেন যাকে বলেছিলেন ‘নীরব দুর্ভিক্ষ’। সেই অবসরে জিনি ইনডেক্স লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ত, ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল-এর বাৎসরিক প্রতিবেদনের মুখে মন্ত্রী বাহাদুরদের আস্ফালন দেখে খোদ দুর্নীতির দেবতাই বিব্রতমুখ হয়ে থাকত, আর পলিথিনের ছাউনি-দেয়া ছাপড়ার ঘরে বসে বসে সর্বগ্রাসী ক্ষুধার সাথে দিপালীদের এই কুটনীতি চলতেই থাকত!

এখনও তো চলবে সব-ই। প্রকল্প পরিচালকের পাজেরো চলবে, মাইক্রোক্রেডিট সামিট চলবে, দারিদ্র গবেষণায় দেশ সয়লাব হয়ে যাবে। চলবে না খালি দিপালীদের সাবেক ‘ক্ষুধা-ব্যবস্থাপনা’। কিছু বিবেকবান মানুষের তৎপরতায় এখন তাদের খাওয়া হচ্ছে তিন বেলা (কিন্তু কতদিন?)। আবার গরিবের জন্য তিন বেলা খাওয়াও কম বিপত্তির নয়! কোষ্ঠ তরল হয়ে যায়, ঘন ঘন ল্যাট্রিনে যেতে হয়, একথা বেগুনটিলা বস্তির বৃদ্ধা গুলবানু বলেছিল।

দিপালীর পরিবার তাদের এই গরিবি জানান দিতে চায় নি। তাই নিজেরা নিজেদের ‘ব্যবস্থাপনা’ তৈরি করেছিলেন। দিপালী আত্মহত্যা করায় সিভিল সমাজের জ্ঞানপাপ হয়ে গেল! আমরা জেনে ফেললাম, গরিব কিভাবে তার সবচেয়ে মৌলিক চাহিদার সাথে খেলে। ফলে, দিপালীর পরিবারের মত আরো অতিগরিব যারা আছে, যাদের ধারণা গরিবি জানান দেয়ার বিষয় নয়, তারা আরো সতর্ক হয়ে যাবে। এমনিতেই তারা সমাজে অস্পৃশ্য হয়ে থাকে, এরপর থেকে অদৃশ্য হয়ে থাকবে। ক্ষুধার আরো নিবিড় ‘ব্যবস্থাপনা’ বের করবে তারা। যেখানে আত্মহত্যাজাতীয় কোনো স্ট্যান্ডার্ড এরর থাকবে না, ফলে সিভিল বিবেক আসন্ন ঈদের প্রাক্কালে রং ঝলমল প্লাজার সামনে কোনোরকম দংশনে পড়বে না।

‘অতিগরিব’ নামে সমাজের একটা অংশের কথা অনেকেই স্বীকার করেন শুনি, কিন্তু তাদের কাছে পৌঁছাবার কোনো ফর্মূলা এখনও বাজারে আসে নি। শোনা যায়, অতিগরিবের উন্নয়ন অনেক দুরূহ, কারণ তাদের এসেট নাই (ফলে বন্ধকী নেয়া যায় না!), তাদের ভয়েস নাই (ফলে ইন-ডেপথ ইন্টারভিউ দেয় না তারা!), তাদের এমনকি কোনো আকাঙ্ক্ষাও নাই (ফলে অ্যাডভোকেসী মাঠে মারা যায়!)। আপামর প্ররোচনাহীন এক জনগোষ্ঠী! তারা এমনিতেই তিলে তিলে মরে, তাদের মধ্যে দিপালীর মত কারো কারো হয়ত মৃত্যুর এই শম্বুক গতি পছন্দ হয় না। তখন অতিগরিবেরা শিরোনাম হয়।

দিপালীদের বাড়িতে আজ দেশের বিবেকবান মানুষের সাহায্য পৌঁছেছে, কিন্তু দরকার সুনির্দিষ্ট পলিসি, আর তার যথাযথ বাস্তবায়ন, এইসব অতিগরিব এবং বিপদাপন্ন মানুষের কার্যকরভাবে বেঁচে থাকার জন্য। নাহলে, ভেবে দেখুন, মাস ছয় পরে, দিপালীদের সাহায্যের টাকাই ফুরিয়ে যাবে না, এর সাথে তাদের এতদিনকার ‘ক্ষুধা ব্যবস্থাপনা’র অভ্যাসটিও হারাবে তারা। সেইসাথে, আরেকবার সংবাদ শিরোনাম হবার ভয়ে সমাজে তারা আরো ইনভিজিবল হয়ে যাবে। ফলে, দিপালীর পরিবার তথ্যপ্রবাহ হয়ে আমাদের বিবেকে আর হয়ত কামড় বসাবে না, কিন্তু ক্ষুধার কামড় থেকে তারা কি মুক্তি পাবে?

২০০৫
সংবাদের লিংক:
http://www.thedailystar.net/2005/10/16/d51016110280.htm

বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

"চন্দ্রবিন্দু" যেভাবে তৈরি হল




বিপুলা এই টেলিভিশন মিডিয়ার সম্ভাবনার কতটুকু জেনেছি আমরা? সর্বসাকুল্যে টেলিভিশন অনুষ্ঠান বলতে খালি দেখছি বিভিন্ন দৈর্ঘের নাটক, বিভিন্ন প্রস্থের টকশো, আর নানাবর্ণের আইডল প্রতিযোগিতা। এর বাইরে বিস্তীর্ণ অভিজ্ঞতার যে দেশ, সেখানে এই বাক্সটির সম্ভাবনা কীরকম? গতানুগতিক এই সমস্ত ফর্মাটের বাইরে নতুন কোনো বিনোদনের সুযোগ আছে কিনা টেলিভিশনে?

এরকম একটি জায়গা থেকেই চন্দ্রবিন্দুর কথা ভাবা। ২০০৫ সাল সেটি, আমি শিল্পসাহিত্যে দৃষ্টিসংবেদন নিয়ে গবেষণা করছি, একই বছরে এটি দেখা না-দেখার চোখ নামক বই হয়ে বেরোয়। ব্যতিক্রমধর্মী ঐ সংকলনের কাজ করতে করতে কথাশিল্পী শাহাদুজ্জামানের সাথে চন্দ্রবিন্দু নিয়ে অনেক আলাপ, কবি সাজ্জাদ শরিফের সাথেও। চিন্তার জট খুলতে থাকে, বন্ধু এবং মেধাবী নির্মাতা নূরুল আলম আতিক প্রবল উৎসাহে এগিয়ে আসেন। তারপর অনেকদিন ধরে চন্দ্রবিন্দু এগিয়ে চলছিল এই চতুষ্টয়ের চিন্তার মিথষ্ক্রিয়ায়। এই পর্যায়ে একটা ছন্দোপতন: আমাকে চলে যেতে হয় দেশের বাইরে। কিন্তু থেমে থাকে নি চন্দ্রবিন্দু, বরং আতিকের সুযোগ্য চিন্তায় ও সৃজনী দক্ষতায় তরতর করে বেড়ে উঠতে থাকে। আমি দূরদেশে বসে খবর পাই। পরম আনন্দ হয়।


চন্দ্রবিন্দু বানানোর মূল প্রণোদনা কি? এক কথায় এর উত্তর দিতে গেলে বলতে হয়, শ্রেণীনির্বিশেষে মানুষে মানুষে যোগাযোগের একটা পাটাতন তৈরি হয় কিনা সেটা খতিয়ে দেখা। ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের এই কালে মানুষ তার ধর্মের কিংবা শ্রেণীর ঘেরাটোপে যেভাবে বন্দী হয়ে পড়ছে, তার ফলে কবুতরের খোপের ভেতর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে আটকা পড়েছে চিরকালের কথকতা। কিন্তু ধনীর বারান্দায় যেমন বৃষ্টি পড়ে, গরিবের ঘরেও। তাদের প্রত্যেকেরই শৈশব আছে, আছে ভুতের ভয় কিংবা মায়ের কাছে যাবার আকূলতা। একই আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ছে বিভক্ত সমাজে, ফলে তার অর্থ ও অনর্থ স্থানবিশেষে ভিন্ন হয়ে যায়। আমরা ভিন্নবিভক্ত হয়েই একে মোকাবেলা করি, ভুলে যাই এর অভিন্ন উৎসের কথা। চন্দ্রবিন্দু আমাদের এই প্রতিদিনের খন্ডিত অনুভবগুলোকে আশ্রয় করেই চিরকালের বাঁশিটি বাজাতে চেয়েছে।

চিরকালের বাঁশি চিন্তায় বাজানো যত সহজ, পর্দায় বাজানো ততই কঠিন। বিশেষ করে যে পর্দায় স্টেরিওটাইপ ইমেজ আর বাণিজ্যের জংলীজটিল রাজনীতি দিয়ে মধ্যবিত্তের বিনোদন তৈরি হয়, সেখানে ভিন্নধারার একটি অনুষ্ঠানের জন্য জায়গা পাওয়া খুবই মুশকিল। কিন্তু নুরুল আলম আতিক দমে যাবার পাত্র নন, তাই তো নানান বৈরী অবস্থা পার হয়ে চন্দ্রবিন্দু আজ চ্যানেলআই-এর পর্দায়। এর মধ্যেই দর্শক এর প্রথম পর্বটি দেখে ফেলেছেন। চন্দ্রবিন্দু কতটা সফল কিংবা কতটা ব্যর্থ সে বিচারের ভার তাঁদের ওপর। কিন্তু আমি খুশি আমার একটি ভাঙাচোরা স্বপ্নকে এত নিপুণভাবে বাস্তবের পর্দায় হাজির হতে দেখে। আতিক সেটি করেছেন, তিনি এই স্বপ্নের যেমন সারথী ছিলেন তেমনি বাস্তবেরও রূপকার হয়ে দেখালেন। চমৎকার একটি সেটে অনবদ্য লাগছে শারমিন লাকী-র নাটকীয় উপস্থাপনা। চন্দ্রবিন্দু জয়যুক্ত হোক।


শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

দ্য ম্যাট্রিক্স মুভি নিয়ে জ্যাঁ বদ্রিয়াঁর সাথে আলাপ






দ্য ম্যাট্রিক্স (১৯৯৯) হলিউডের একটি ব্লকবাস্টার সাইন্স ফিকশন মুভি। ওয়াচোস্কি ভাইদের বানানো সেই মুভিতে নিও নামের এক কম্পিউটার হ্যাকারের সাথে মরফিউস নামে আরেক প্রবাদতুল্য হ্যাকারের দেখা হয় এবং সে তাকে ২০০ বছর পরের পৃথিবীতে নিয়ে যায় যেখানে সাইবার ইন্টেলিজেন্স দুনিয়াকে শাসন করছে। সেখানে এক যন্ত্রগোষ্ঠী মানুষের মধ্যে প্রভূত প্রভাব বিস্তার করে তাদের হৃদয়কে “ম্যাট্রিক্স” নামক একটি গাণিতিক বাস্তবতার মধ্যে বন্দী করে রাখছে। নিও, মরফিউস এবং ট্রিনিটি ম্যাট্রিক্সকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়।

জ্যাঁ বদ্রিঁয়া (১৯২৯-২০০৭) বর্তমান বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দার্শনিকদের একজন যার হাত ধরে উত্তরাধুনিকতাবাদের বিকাশ হয়েছে। জনপ্রিয় ও স্মরণীয় ইভেন্ট, সেলিব্রিটি এবং সংস্কৃতি নিয়ে তার অনেক চিন্তাজাগানিয়া রচনা আছে। “সিমুলেশন ও সিমুলাক্রা” তাঁর অসংখ্য রচনার একটি, যার উদ্ধৃতি এই সাক্ষাৎকারে আছে। ”সিমুলেশন” বলতে তিনি বোঝান সেই বানিয়ে তোলা বাস্তবতা বা ভার্চুয়াল-এর বর্ণন যা “সত্যিকারের” বাস্তবতা থেকেও সত্য ও শ্রেয়তর হতে আরম্ভ করে।

অদে ল্যান্সেলিন: ভার্চুয়াল ও বাস্তব নিয়ে তোমার ধারণাগুলোকে দ্য ম্যাট্রিক্স মুভির মূল ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। ম্যাট্রিক্সের প্রথম পর্বটি তো একেবারে সরাসরি সেরকম ইঙ্গিত দিয়েছে। মনে হয়েছে “সিমুলাক্রা ও সিমুলেশন” এর প্রচ্ছদ যেন রূপালি পর্দায়! অবাক হয়েছো?

জ্যাঁ বদ্রিয়াঁ: এখানে নিশ্চিতভাবেই একটা ভুল বোঝাবুঝি আছে, যে কারণে আমি এখনও দ্য ম্যাট্রিক্স নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। দ্য ম্যাট্রিক্স-এর প্রথম পর্ব মুক্তি পাবার পর ওয়াচোস্কি ভাইদের তরফ থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তাদের প্রত্যাশা ছিল পরের পর্বগুলোয় তারা আমার সঙ্গে কাজ করবেন। কিন্তু এরকম হবার প্রশ্নই ওঠে না (হাসি)। ১৯৮০ সালেও এরকম একবার হয়েছিল যখন ন্যু-ইয়র্কের সিমুলেশনবাদী চিত্রশিল্পীরা আমার সাথে দেখা করলেন। ভার্চুয়াল যে একটা অবধারিত বিষয়, আমার এই প্রকল্পকে তারা গ্রহণ করলেন এবং সেটাকে একটা পরিষ্কার ফ্যান্টাসির চেহারা দিয়ে দিলেন। কিন্তু আসলে এটা এমন এক জগত যেখানে বাস্তব জগতের ক্যাটাগরিগুলো খাটে না।

অদে ল্যান্সেলিন: কিন্তু ধরো, দ্য পারফেক্ট ক্রাইম-এ তুমি যে দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলছো, তার সাথে এই ফিল্ম অবিশ্বাস্যভাবে মিলে যায়। এই ফিল্ম যথার্থই “বাস্তবের পোড়োবাড়ি”র দিকে ধাবমান, যেখানে পুরোপুরি ভার্চুয়াল এবং কল্পনার মানুষেরা চিন্তাশীলতার সক্ষম বিষয়বস্তু থেকে খুব বেশি ভিন্ন কিছু না।

জ্যাঁ বদ্রিয়াঁ: ঠিক, তবে বাস্তব ও ভার্চুয়ালের মুছে যেতে-থাকা সীমানা নিয়ে আরো অনেক ফিল্ম হয়েছে: দ্য টুম্যান শো, মাইনরিটি রিপোর্ট, বা এমনকি মালহল্যান্ড ড্রাইভ, যেটি ডেভিড লিঞ্চ-এর মাস্টারপিস। দ্য ম্যাট্রিক্স-এর মূল কৃতিত্ব হল যে সে এই বিষয়টাকে মারখাপ্পা আক্রমণ করেছে। যদিও সেটা করেছে অনেক সরলভাবে। তার ম্যাসেজ হল, হয় চরিত্রগুলো ম্যাট্রিক্স বা ডিজিটাল জগতের বাসিন্দা, না হয় তারা র‌্যাডিক্যালভাবে এর বাইরে, যেটা দেখা যায় দ্য ম্যাট্রিক্স-এ জিয়ন শহরের অধিবাসীদের মাঝে। এই দুই জগতের দেখা যখন হয় তখন কী ঘটতে পারে এটা দেখানো খুব ইন্টারেস্টিং হতে পারে। কিন্তু এই ফিল্মের সবচেয়ে বিব্রতকর অংশ হল, যে-সমস্যাটির উদয় হয়েছে সিমুলেশন থেকে, সেটিকে সে মোকাবেলা করতে চেয়েছে প্লাতোনিক ট্রিটমেন্ট দিয়ে। এটি একটি মারাত্মক ত্রুটি। জগত যে একটি বড়সড় বিভ্রম ছাড়া আর কিছু নয় - এই ধারণাটি প্রায় সব বড়-বড় সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং শিল্পচর্চা ও প্রতীকায়নের মাধ্যমে এর সুরাহা হয়েছে। আর একই ধরনের ভোগান্তি ঠেকাতে আমরা যা বানিয়েছি, সেটা হল একটা গাণিতিক বাস্তব যেটি সাবেকি বাস্তবকে প্রতিস্থাপন করতে সম। আর এভাবে একটা চূড়ান্ত সমাধানের দিকে যাওয়া: এমন একটি ভার্চুয়াল জগত যেখানে যাবতীয় বিপজ্জনক ও নেতিবাচক বিষয় আশয়ের জায়গা নেই। এটাই দ্য ম্যাট্রিক্স মুভি-র পদ্ধতি। যা কিছু স্বপ্নে, ইউটোপিয়ায় বা ফ্যান্টাসিতে করবার কথা, সেগুলোকে একটা চেহারা দেয়া হয়েছে, “বাস্তবায়িত” করা হয়েছে। এটা একটি নিটোল স্বচ্ছতার জগত। এই মুভিটি সেই ধরনের একটা ম্যাট্রিক্স নিয়ে এবং সেখানে এরকম একটি ম্যাট্রিক্স গড়ে তোলা যেতে পারতো।

অদে ল্যান্সেলিন: কিন্তু এটা তো সেই মুভিও যেখানে প্রকাশ্যে মানুষের প্রযুক্তিজাত বিচ্ছিন্নতার বিরোধিতা করা হয়েছে। আবার একইসঙ্গে এটা সেই মুভি যেটা ডিজিটাল জগতের উন্মাদনা ও কম্পিউটারে-বানানো দৃশ্যের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করেছে।

জ্যাঁ বদ্রিয়াঁ: ম্যাটিক্স রিলোডেড মুভির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এটাতে সেই পরিহাসের সামান্যতম কণাও আর অবশিষ্ট নেই, এমন কিছুই নেই যা দর্শককে মুভির এই বিপুল স্পেশাল ইফেক্ট-এর বাইরে কিছু ভাবাবে। এমন একটাও সিকোয়েন্স নেই ঐ মুভিতে যেখানে কোনো অবিশ্বাস্য ডিটেইল তোমাকে একটা সত্য ইমেজের সামনা সামনি দাঁড় করিয়ে দেবে। আসলে, প্র্রযুক্তি নিয়ে রূপালি পর্দার মানুষদের যে মোহগ্রস্থতা আছে, সেটাই এই মুভিটাকে স্রেফ একটা তথ্যের আকর বানিয়ে ছেড়েছে। বাস্তব আর কল্পনাকে আলাদা করার কোনো রাস্তাই আর ঐ ছবিতে নেই। কিন্তু দ্য ম্যাট্রিক্স আদতে একটি অনিঃশেষ বিষয়বস্তুর কথা বলেছিল, যা একইসঙ্গে সরাসরি ও বিরোধী, কারণ এটা বাস্তব জগতের কোনোখানেই নেই। মুভিটার শেষে যে ছদ্ম-ফ্রয়েডীয় ভাষণটি আছে, সেখানে এটা সুন্দরভাবে বলা হয়েছে: যা কিছু গতানুগতিক নয় তাকে সমীকরণের ছাঁদে ফেলে দিতে হলে ম্যাট্রিক্স-কে আবার ঢেলে সাজাতে (গাণিতিক ভাষায়, রিপ্রোগ্রামিং করা) হবে। আর তুমি, প্রতিরোধকারী, তুমিও সমীকরণের অংশ। মনে হচ্ছে, এরকম একটি ভার্চুয়াল সার্কিটে আমরা যেন চিরকালের জন্য আটকা পড়ে গেছি, যা থেকে বাইরে বেরুনোর কোনো রাস্তাই নেই। এই জায়গাটায় আবার আমি তাত্ত্বিকভাবে দ্বিমত পোষণ করি (হাসি)। দ্য ম্যাট্রিক্স এমন একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তির চেহারা তুলে ধরেছে এবং তার বদলে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে, যার জুড়ি আজকাল বাস্তবে দেখা যায়। এটাকে একটা বৈশ্বিক মাপে দেখানো এই ছবির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। এখানে বরং মার্শাল ম্যাকলুহানের শরণ নেয়া ভাল: দ্য মিডিয়াম ইজ দ্য মেসেজ, বা, বলবার মাধ্যমটিই হল বক্তব্য। যে উদ্দাম ও দুর্দমনীয় সংক্রমণের মাধ্যমে দ্য ম্যাট্রিক্স নিজেকে দর্শকের মাঝে সঞ্চার করছে, সেটিই হল তার বক্তব্য।

অদে ল্যান্সেলিন: এটা খুব মজার যে বাণিজ্যিক বিচারে প্রায়-সব আমেরিকার ব্লকবাস্টারগুলো, হোক সেটা দ্য ম্যাট্রিক্স কিংবা ম্যাডোনা-র সর্বশেষ অ্যালবাম, সবাই দাবি করছে যে এরা এমন একটি সিস্টেমের সমালোচনা করছে, যে সিস্টেমটি আবার ব্যাপকভাবে ওদের প্রমোট করে।

জ্যাঁ বদ্রিয়াঁ: ঠিক এটাই আমাদের সময়টাকে এরকম নিপীড়নমূলক বানিয়েছে। বর্তমান সিস্টেমটা যে বিনোদন সামগ্রীগুলো উৎপাদন করছে তার মধ্যে কোথায় যেন একটা নেতিবাচক বিভ্রম গেঁথে দিচ্ছে সে। যেন কারখানা নিজেই মেয়াদোত্তীর্ণ জিনিস উৎপাদন করছে। সব ভাল ভাল বিকল্পগুলোকে ঠেকিয়ে রাখার এটাই হল কার্যকর পন্থা। জগত সম্পর্কে কারো প্রত্যক্ষণকে এক জায়গায় আটকে রাখবে, এমন কোনো ওমেগা পয়েন্ট নেই, এর বিপরীত ক্রিয়াটিও নেই; শুধু উদ্দীপনা নিয়ে লেগে-থাকা। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, একটা সিস্টেম যতই পূর্ণতার দিকে যায়, ততই সে একটা সার্বিক দুর্ঘটের দিকেও যায়। এই বস্তুগত পরিহাসটি সেই সত্যই প্রতিপাদন করে যে, কোনো কিছুই চূড়ান্ত নয়। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনাও সেটি প্রমাণ করে। সন্ত্রাসবাদ বিকল্প কোনো মতার আধার নয়। পশ্চিমের ক্ষমতা যে রীতিমত আত্মহন্তারক হয়ে উঠছে নিজেকে বদলাতে গিয়ে, সন্ত্রাসবাদ একটু বড় করে সেটাকেই প্রতীকায়িত করেছে। সেই সময়েই এটা আমি সরাসরি বলেছিলাম, কেউ আমল দেয় নি। তবে এসব মোকাবেলা করতে গিয়ে আমাদের দুঃখবাদী বা নৈরাজ্যবাদী হওয়ার দরকার নেই। এই সিস্টেম, এই ভার্চুয়াল কিংবা এই ম্যাট্রিক্স ― সবই সম্ভবত ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ফিরে যাবে। কিন্তু এই যে বদলানোর প্রক্রিয়া, এই যে প্রতিরোধ এবং মোহময়তা ― এর কোনো বিনাশ নেই।


বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

হারিয়ে যাওয়া একটি কবিতা

তুমুল বিভ্রমে হঠাৎ তাকে পাই
তুমুল সচেতনে হেরে
তমাল তার পণ বেঁধেছে নিজ ডালে
সে আসে মৃতদেহ ছেড়ে

প্রবল বাকরোধ আমায় পেয়ে বসে
প্রবল বমনের ঘাতে
প্রাচীন অনীহার ত্রিশির তাড়া খেয়ে
শুয়েছি এই নদীখাতে

সে আসে পোড়াদেহ খোলস পালটিয়ে
কুমারী নবভাষা পেয়ে
নিকোনো ঘর থেকে পালিয়ে যাদুঘরে
বলেছি ফিরে যাও মেয়ে

তোমার ফলভার যেখানে উপগত
একদা আদিবাস জেনে
দেখেছি নদীটির শাসন দুরকম
ঋতু ও বিবাহের গানে

(১৯৯০?)


[বহুদিন আগে লেখা, ছন্দ শিখছি কেবল তখন। তারপর ছন্দ বিস্মরণ। কোথায় লুকিয়েছিল এই লেখাটি? আজ বহুদিন পর, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে নিশ্চয়। এরই মধ্যে দু-দুটো কবিতার বই, একে বাইরে রেখেই। তাই কাগজ নয়, ওয়েবই সমাধি হোক তার।]




মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

মানলে তালগাছ, না মানলে বালগাছ!!

বিনয় মজুমদারের একটা কবিতার উদ্ধৃতি আমি দিয়েছিলাম। ব্রাত্য রাইসু সেইটাকে ‘নর প্রাকৃতিক জৈব কবিতা’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। এই ধরনের অভিধার কথাও মনে হয় আর কেউ বলেন নাই। ফলে স্বত্ব রাইসুর, সন্দেহ নাই। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, সেই কবিতার শিরায় শিরায় রবীন্দ্রনাথের মনুমেন্টপ্রমাণ অবস্থান নিয়ে একটা পরিষ্কার বিদ্রুপ বহমান, যেটা রবীন্দ্রনাথের অবদানকে পাশ কাটায় না, সহমর্মী থাকে। বিনয়ের সময় হয়ত রবীন্দ্রনাথকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার স্পর্ধা অর্জন করে নাই, যেটা অর্জন করেছে ব্রাত্য রাইসুর সময়, বা তিনি হয়ত তার সময় থেকেও অনেকখানি এগিয়ে (এগিয়ে বলছি, যেহেতু তেমন কাউকেই পাচ্ছি না, যে, উইদ ফুল থ্রটল, রাইসুর সাথে একমত হইতে পারতেছে)।

আমি (ভুলক্রমে!) একটা পাটাতনের ইঙ্গিত করেছিলাম। যেহেতু আমি বিশ্বাস করি কোনোকিছুই রাতারাতি ডিম ফুইটা বাইর হয় না। আমার ধারণা ছিল, রবীন্দ্র প্রসঙ্গে ব্রাত্য রাইসুর র‌্যাডিক্যাল অবস্থান ঐতিহাসিকভাবেই বিকশিত হয়েছে। বিনয়কে একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে মানছিলাম। কিন্তু রাইসু’র মনে হয়েছে, এইটা উনার বক্তব্যের মেরিট যাবতীয় গরুগাধাকে বণ্টন করে দেয়ার একটি সুমন রহমানীয় চক্রান্ত। রাইসুর বক্তব্যের স্বত্ব তার কাছ থেকে ছিনায়া লইয়া যাওয়ার একটা স্নিগ্ধ চেষ্টা। সেই কোপ থেকে পাটাতনকে তিনি ‘পাঠাতন’ লিখলেন, তার মানে বিনয় বা অন্যান্য ‘পাঠা’দের সাথে একমঞ্চে উচ্চারিত হওয়ার কোনো খায়েশ উনার নাই।

ভাই রাইসু, আপনার বক্তব্যের মেরিট আপনারই। আমার বিবর্তনবাদ (বা ঐতিহাসিক বিকাশবাদ) আমারই থাক, ধইরা নিই যে আপনার রবীন্দ্র-অবধারণ মোটামুটি নবুয়তের ফর্মেই আপনের ওপর নাযিল হইছে। কিন্তু তাতেও একটা সমস্যা পাকাইতেছে আপনারই লেখা একটা কবিতা।

বিরহে পরাণ থরোথরো
ঘুরে মরিব একেলা
গাবো ঠাকুরের গান

এমন দিনেই তারে বলা যায়
যা বলিনি এতদিন
প্রথমত বৃষ্টির অভাবে

আর আমার জন্যই এল এই গান জলের ওপরে ভেসে ভেসে

(ব্রাত্য রাইসু, বর্ষামঙ্গল, আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি)

বিরহাক্রান্ত রাইসু একা একা ঘুরে ঘুরে ঠাকুরের গান গাইতেছে, এই কবিতার চিত্র যদি মোটামুটি এইরকমই হয়, তাইলে উহারে দয়া কইরা একটা অভিধা দিয়া দিবেন কি? আমাদের একটু বইলা দিবেন কি, এই কবিতার সাথে আপনের বর্তমান রবীন্দ্র-অবস্থানের কোনো ধারাবাহিকতা আছে কি না? জানতে ইচ্ছা করতেছে।

কবিসভা বড় অদ্ভূত জায়গা। এইখানে কোনো তর্কেরই মিমাংসা হয় না, এমন কি অনেক মিমাংসিত তর্কও এইখানে টগবগ কইরা ফোটে (এটা মন্দ না)। এইখানে প্রতিপক্ষ হইয়া যারা কোনো তর্ক আরম্ভ করেন, প্রতিপক্ষ থাইকাই তারা আলোচনা ক্ষান্ত দেন, বুঝি বা ক্লান্ত হৈয়া পড়ার কারণে। এইরকম অনেক ঈমানদারের সাক্ষাৎ এইখানে মিলে।

মানভাষা-ঊনভাষা তর্ক একটি পোস্ট কলনিয়াল চিন্তাদশা, এইটা বুঝতে আমার দুইটাকাও লাগে না। এই তর্কের পরিবেশ তৈরি হইছে ক্ষমতা-সম্পর্কের নানান ইতিহাস, নানান তত্ত্ব ও ঘটনার পাটাতনের (পাটাতনই লিখলাম, কী আর করা!) ওপর দাঁড়িয়ে। জাস্ট অ্যা মেয়ার পোস্ট-কলোনিয়াল ইমপ্লিকেশন! এইটা একটা ভাল এজেন্ডা বইলা আমার ধারণা, আমি এই এজেন্ডার খুব ভক্ত। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন এইটা কোনো ইতিহাস-নিরপেক্ষ দশা থেইকা তার ওপর হঠাৎ কইরা নাযিল হইছে, সেইটা তার ভাবনা, তার সুখ।

আরো স্পেসিফিক হইয়া বলি: ধরা যাক, বাংলা সাহিত্যে যত রবীন্দ্র বিরোধিতা আছে সব একজাতের, শুধু রাইসুরটা আলাদা জাতের। এক্ষণে আমি জানতে চাই, ব্রাত্য রাইসু তার রবীন্দ্র বিরোধিতায় এ পর্যন্ত যত বাক্য লিখেছেন, তাত্ত্বিকভাবে তার মধ্যে এমন কোনো বক্তব্য কি আছে, যেটি পোস্ট-কলোনিয়াল চিন্তার ধারাবাহিকতা ছাড়া এসেছে?

আমাদের গ্রামে লোকজন কয়, মানলে তালগাছ না মানলে বালগাছ। যারা এইটা কয়, বা যে অবস্থায় কয়, সেইটা হইল কাউরে তালগাছও না বানানো, বালগাছও না বানানো। কারণ, কাউরে তালগাছ বানানো সহজ, এর চেয়ে সহজ বালগাছ বানানো।


ঢাকা, ১৬ মে ২০০৫


শনিবার, ৩০ আগস্ট, ২০০৮

কবিতার পাঠ: ইমরুল হাসানের একটি কবিতা

ইমরুল হাসানের কবিতাটি এল ইমেইলে:


পাগল

কেউ কি আর চেষ্টা করে যাচ্ছে না, তোমার কি মনে হয়?
আড়ালে আড়ালে কতই না শ্রেণীভেদ, শাসিয়ে যাচ্ছে
রাস্তার পাশে তোমাকে দাঁড় করিয়ে যাচ্ছে একা!

ইচ্ছা হয়, উবু হয়ে বসে থাকি, রাস্তার কোণায়
ড্রেনের পাশে, মাথানিচু; আগে, অনেক অনেক আগে যেমন
বসে থাকতো, পাগল! কিছুটা সুশ্রী আর যার সুস্থ হওয়ার আশা
মরে যাই নাই তখনো, তাকে দেখলে মনে হতো যে, সে আর
পাগল হতে চায় নাই, কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে বসে পড়েছে
যা আর স্বাভাবিক নয়, যাকে কিনা বলা হচ্ছে, ভাবা হচ্ছে
সে আর যা নয়, যা সে হতে চায় নাই, যা আসলে আর কিছুই না ...

এমনই একটা র্নিবিকল্প সময়, সন্ধ্যাবেলায়
কতকিছুই না ভাবছে মানুষ-জন, চলে যাচ্ছে, ফুসফাস করে
হাঁপাতে হাঁপাতে পার হয়ে যাচ্ছে, কতকিছুই তো করছে ...
কেউ কি আর ড্রেনের ভিতর থেকে টাকা খোঁজার মতো করে
অন্যকিছু বের করে আনার চেষ্টাটা করে যাচ্ছে না?
তোমার কি মনে হয়?

২৯.০৮.০৮


একঝলক পাঠ, তারপর আবার প্রতিদিনের জীবনে। কিন্তু সেই যে পাগল, যে কিছুটা সুশ্রী, এবং সুস্থ হবার আশা এখনো শেষ হয়ে যায় নাই যার, তাকে তাড়ানো গেল না। আশাহীন যে পাগলামি তাকে ভুলে যাওয়া সহজ, হয়ত জরুরিও, আবার পাগলামিহীনতায়ও কোনো গল্প নেই, মনে রাখাও নেই। প্রতিদিনের এই যে জীবন, পথে-পাওয়া জীবন, এই যে সব মৃদু অস্বস্তি বাড়ি ফিরবার পথে, এই যে একটুকরা বিষাদ... এগুলোই ইমরুলকে কবিতায় উবু করে। মনে হবে যেন মাখনে ছুরি চালাচ্ছে সে, কিন্তু আলাদা যে ইমেজটা হাজির থাকে মনে, কবিতাটি পড়বার বহুদিন পরেও, আমি খেয়াল করি ক্রমে সেটা গ্রানাইটের মত শক্ত হয়ে যায়!

একেকটা ইমেজের এত শক্তি! ভাবি।

ইমরুলের এই কবিতায় (অন্য অনেক কবিতায়ও বোধ করি) কবি কথা বলছে যার সাথে, বা যাকে আসলে কবিতাটি শোনানো হচ্ছে, তার ব্যক্তিত্ব অন্যরকম। সে যেন সব কিছু ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট বোঝে, তাই ইমরুল তাকে নানান ইমেজ দিয়ে, ইমেজের ভেতর গুপ্তির মত প্রশ্ন গুঁজে দিয়ে সংশয়ী করে তুলতে চায়। কবিতা পাড়ার জন্য এমন একজন সঙ্গী পেয়ে যাওয়া বেশ আরামের, কবির জন্য। জরুরিও বটে।

ইমরুলের কবিতা কানের কাছে ফিসফিস করে বলার মত, এবং বলার পর, যিনি বললেন এবং যিনি শুনলেন তারা ভুলে যাওয়ার ভান করবেন সত্যি, কিন্তু ঐ একটা-দুটা ইমেজ থাকবে যা আপনার সংবেদনার নরম মাটিতে গ্রানাইটের মত অনড় হয়ে পড়ে থাকবে। আপনি ভাববেন, ঠিক আছে পরে সরিয়ে দেবেন 'খন, কিন্তু... হাহাহা.... পারছেন কি?

পাগলা ভক্তের ধাওয়া!!


কবিসভায় ব্রাত্য রাইসু এবং আমি (ইমরুল এবং ভাস্করও) দুয়েকটি বিষয় নিয়া তর্ক করিতেছিলাম। আমরা পরস্পরের কিছু কিছু বিষয়ে একমত আর কিছু কিছু বিষয়ে দুইমত হইতেছিলাম। তাতে অনেক বিষয় আমার নাদান-চক্ষে পরিষ্কার হইবার সুযোগ পাইতেছিল, মান্যবর রাইসু-ও তর্কটিকে উপভোগ্য বইলা সায় দিতেছিলেন।

কিন্তু পাগলা ভক্তের মন ইহাতে মানিবে কেন?

ভক্তের মন তাই নানান মোক্ষম কৌশলের আশ্রয় খুঁজিল। একজন বেনামে সুমন রহমানের ভক্ত সাজিলেন। বিপরীত লিঙ্গের এই চরিত্রটি আমার কাছে সুমন রহমানের অনেক লেখা বিষয়ে আপ্লূত প্রশংসা করিলেন, যাতে আমার মহিলাবাঞ্ছা আর ভক্তবাঞ্ছা দুইটাই পুরা হয়। অনেক ইনায়া বিনায়া শেষে তিনি আমার ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর চাহিলেন। কিন্তু ততক্ষণে আমি আমার জানের ওপর খতরা টের পাইয়া গিয়াছি। তাই দরজায় রসুনের মালা ঝোলাইয়া হাতে ক্রুশ লইয়া বইসা রহিলাম। কোনো সাড়া দিলাম না। ফোন নম্বর দিলাম না। এরপর সেই ভক্তের প্রশংসা ক্রমে নিন্দায় পর্যবসিত হইতে থাকিল। স্বস্তি পাইলাম। মনে হইল এই যাত্রা ফাঁড়া কাটিয়া গেছে। বন্ধ দরজার ওপারের মোহনীয় হাসিখানি অবশেষে গগনবিদারী প্রেতচিৎকারিণীরূপে পাহাড়েপর্বতে প্রতিধ্বনি তুলিয়া বিদায় নিলেন।


স্ত্রীজাতীয় আরেকজন নিজনামে কবিসভার যৌথ ডাকবাক্স থিকা আমার ব্যক্তিগত মেইলবাক্সে আছর করিলেন। তিনি আসিলেন এক ‘ভয়ংকর’ ভালবাসার পয়গাম লইয়া। আমাকে নানান বিষয়াদি জিজ্ঞাস করিলেন, যথা: আমি বিবাহিত কি না, আমি দেখিতে ‘উত্তেজক’ কি না, ইত্যাদি। তিনি আমাকে লম্বা লম্বা চিঠি লিখিতে লাগিলেন এবং আমাকেও সেইমত আদেশ করিলেন। কিন্তু আমি একজন ভীতুবিবাহিত মানুষ বিধায় উনার উদাত্ত ডাকে সাড়া দিবার পারি নাই। শেষে আমার ‘অক্ষম’ পুরুষত্বে কুপিত হইয়া তিনি নিজ অভিসন্ধি সরাসরি প্রকাশ করিলেন: আর কোনোদিন যদি আপনি রাইসুরে.......

ইমেইল বাক্স খুলিলেই এইসব ভয়ংকর ভয়ংকর সব হুমকিতে ভরা চিঠি দেখিতে পাই, শেষে মনের দুঃখে ইমেইল ছাইড়া এমএসএন চ্যাটবাক্সে গিয়া ঢুকিলাম। সেইখানে ঘাপটি মাইরা ছিলেন আরেকজন, আমাকে দেখিবামাত্র একখানি জল্লাদের ইমোটিকন দেখায়া ভাগায়া দিলেন। আমি খাবি খায়া পলায়া যাইবার প্রাক্কালে তিনি আবার পেছন পেছন দুইখান ভাইরাস লেলাইয়া দিলেন। ইহার একটি লাগিল আমার কম্পিউটারের উইন্ডোজে। কম্পিউটার ক্র্যাশ করিল। আরেকটি লাগিল আমার ইমিউন সিস্টেমে। আমিও ক্র্যাশ করিলাম।

ভাবিলাম, ভালই হইল একদিকে, পাগলা ভক্তের মন শান্ত হইবেক। আমি ও আমার কম্পিউটার চুপচাপ পইড়া থাকি, মুক ও বধির ইস্কুলে যাওয়া-আসা করি বরং!!

কিন্তু টেলিফোন নামক আরেকটি যন্ত্র যে আছে এই জগতে! সেইখানে হানা দিলেন আরেকজন। বলিলেন, দেখছেন নাকি, আপনেরে নিয়া চিঠি লিখছে আইজগা....

তখনও দেখি নাই। পরে ল্যাচড়াইতে ল্যাচড়াইতে এক সাইবার ক্যাফেতে গিয়া দেখিলাম আরেক ভক্ত। টিপু সাহেব লেখছেন। ভালই লেখছেন। আমার বলিবার কিছু নাই। কারণ উনার স্কুলবিতর্কমার্কা বক্তব্যের উত্তরে আমার যা বলার তা আগের চিঠিতেই বলা আছে। সাশ্রয় করি বরঞ্চ!

একটা প্রস্তাব নিয়া ভাবিতেছি। রাইসু একদা নিন্দাসভার ডাক দিয়াছিলেন। তখন আমি অন্যরকম তর্কে মজিয়াছিলাম। এখন মনে হইতেছে নিন্দাসভা না হইলেও একখানি ভক্তসভা তৈয়ার করা অত্যন্ত জরুরি। যাবতীয় ভক্তকুলের একটা জন্য অভয়ারণ্য খুলিয়া দিলে উনারা যেমন নিজ নিজ আইকনদের ধামা ধরিয়া স্বচ্ছন্দে বিহার করিতে পারিবেন, তেমনি আমাদেরও অনেক তর্কসাশ্রয় হইয়া যাইবে।




ঢাকা, ৩১ মে ২০০৫


বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০০৮

"মধ্যরাতের নদী" নিয়ে মুজিব মেহদীর আলোচনা


পড়েছিলাম 'ময়মনসিংহ জং' নামক একটি লিটল ম্যাগাজিনে। কবি মুজিব মেহদী এই কাগজের সাথে সাক্ষাৎকারে সমসাময়িককালে তাঁর পছন্দের একটি কবিতার কথা বলতে গিয়ে "মধ্যরাতের নদী" কবিতাটির কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিছু আলোচনাও করেছিলেন। সাক্ষাৎকারের সেই অংশটি এখানে ব্লগস্থ হল:

......................
ময়মনসিংহ জং : একটি প্রিয় (অন্যের) কবিতার কথা বলুন। ভালো লাগার কার্যকারণসহ।

মুজিব মেহদী : একজন নিয়মিত পাঠক তাঁর পাঠেতিহাসে অনেক প্রিয় কবিতার সংস্পর্শে আসেন। এই প্রিয়তা আবার সময়ে বদলে বদলে যায়। সময়ে কোনো-কোনোটার প্রতি ভালো লাগা আরো প্রগাঢ় হয়, কোনোটা আর ভালো লাগে না। আবার নতুন নতুন ভালো লাগার কবিতা প্রিয়তালিকায় যুক্তও হয়। আমারও এমন হয়েছে। আমার ভালো লাগা কবিতার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তার ভিতর থেকে একটি কবিতা বেছে নিতে গিয়ে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের মোকাবেলা করতে হলো। কোনটি রেখে কোনটির কথা বলব। যেটির কথা বলব সেটি কি প্রিয়দের সেরা ? তা না হলে তো অবশ্যই অন্য কোনো বিবেচনা দরকার। সেটা কী হতে পারে ? ঠিক করে নিলাম নির্বাচিত কবিতাটিকে হতে হবে বাংলাদেশের কোনো কবির কবিতা এবং আমার সমসাময়িক কোনো কবির। এখানেও দেখলাম অনেক কবিতাই নির্বাচনপ্রার্থী। শেষাবধি আরেকটি বিবেচনা সামনে আনতে হলো। সেটা এই যে, জন্মে না হোক অন্তত কাব্যচর্চায় হলেও কবিকে হতে হবে আমার চেয়ে জ্যেষ্ঠ। এবার বেছে নেয়া গেল সুমন রহমান (১৯৭০) এর ‘মধ্যরাতের নদী’।
সুমন রহমান কবি হিসেবে আমাদের সমসাময়িক, তবে তাঁর কাব্যঅভিযাত্রার সূচনা অন্তিমআশিতে। ঈশান জয়দ্রথ লেখকনামে ১৯৯৪-এ বোরোয় তাঁর ‘ঝিঁঝিট’ নামক প্রথম কাব্যগ্রন্থ। দীর্ঘ প্রায় দেড় দশক পর সুমন রহমান লেখকনামে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সিরামিকের নিজস্ব ঝগড়া’ বেরিয়েছে ২০০৮-এ। কবিতাটি সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সিরামিকের নিজস্ব ঝগড়া’য় অন্তর্ভুক্ত হবারও আগে একাধিকবার পঠিত ওয়েবব্লগ ‘সচলায়তন’ এবং সম্ভবত লিটলম্যাগ ‘মান্দার’-এ।

কোনো শিল্পকর্মের প্রতি ভালো লাগা ব্যাপারটা সবসময় ব্যাখ্যাযোগ্য হয় না। ব্যাখ্যা যাও-বা কোনোরূপে সম্পন্ন করা যায় তা কখনো সর্বজনীন হয় না, ফলত হয় খণ্ডিত ও একপেশে। তবু খণ্ডিতকরণেরই কিছু চেষ্টা হোক।

নদীবহুল বাংলাদেশের কবিতা ও গানে নদীকে নিজের দুঃখের কথা শোনানোর রীতিটি আমাদের ঐতিহ্যসম্পৃক্তই। তবু কবিতাটি অন্যান্য নদীবচন থেকে আলাদা। সাধারণত নদী নিয়ে যেরকম কবিতা লিখিত হয়, কবিতাটিতে সেসব উপাদানের কোনো-কোনোটি হাজির থাকলেও এটি মোটেই সেরকম নয়। নদীসংক্রান্ত লেখায় নদীর চপলতা, নিষ্কলূষতা, সুদূরগমন ক্ষমতা ইত্যাদির প্রশস্তি গান থাকে, কিংবা রাতের নদী হলে তাতে পড়া চাঁদের ছায়ায় প্রিয়তমার মুখাবয়ব দেখাজনিত অধ্যাসের বর্ণনাও থাকে। এখানে সেসব নেই। এই কবিতাটি মহিমান্বিত নদীকে সাক্ষী মেনে একজন কবির নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার শিল্পসৌকর্যে। কবিতাটি পড়তে পড়তে নদীর মতো দীর্ঘ একটি হাহাকার হাতকয় দূর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়, দূরাগত কৃত্রিম আলোকসজ্জাকে ছাপিয়েও একটা নৈশ অন্ধকার সমাসীন বলে যা বস্তুত দেখা যায় না, কিন্তু জেলেনৌকার মৃদুআলোয় বোঝা যায় যে কথকের চোখজোড়া ভিজে উঠছে কবিতার সাথে সম্পর্কের টানাপড়েনে। অন্তত আমার অনুভবে ব্যাপারটি এরকমভাবেই ধরা দেয়। মৃদু অথচ বৃহদায়তন এ বিষাদ আমাকে ছুঁয়ে যায়, কেননা এরকম সংশয় আমার ঝোলায়ও আছে যে, কবিতা আমাকে বুঝতে পারছে কি না বা আমি কবিতাকে। এ বিবেচনায় আমি ভাবি যে, কবিতাকর্মী মাত্রকেই হয়ত কবিতাটি স্পর্শ করবে।

কালের ভারে কাবু শীর্ণতোয়া নদীর পাঁচমিশালী ক্যাজুয়াল গতিভঙ্গির মতো এ কবিতাটিরও কোথাও কোনো দ্রুততা নেই, এখানেও এসে মিশেছে অনেকস্রোত: জলদূষণ কারণে মাছের শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে কবিতা উসকে দেয়া খেয়ালী বালিকা, উঠতি শহরের অকার্যকর ও অপ্রতুল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, কারখানা শ্রমিকের দলবদ্ধ স্নান এবং সবিশেষ কবিতাদাম্পত্যের সাফল্যব্যর্থতা। পরিপার্শ্বকে দেখার বিরল দক্ষতা এবং সেসবকে রঙঢংতাৎপর্যসমেত মূর্ত করে তুলবার যে স্ফূর্তিময় সাফল্য কবি কবিতাটিতে দেখিয়েছেন, তা অনবদ্য। কবিতাটিতে একটি বাড়তি পাওনাও জুটে গেছে উপজাত হয়ে। সেটি এর পরিবেশ চিন্তন। ফলত এটি একটি পরিবেশবান্ধব কবিতারও উদাহরণ হয়ে গেছে।

সুমন রহমান এই কবিতায় কবিতাশিল্পের ক্লিশে অলংকার উপমা ব্যবহারে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। ধরা যাক, শুরুর দিকের ধীরে চলা নীরব নদীর বর্ণনার ব্যাপারটা। কেমন নীরব ও শ্লথ ওই চলন? কবি বলছেন, ‘যেন কারো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাচ্ছে মধ্যরাতের নদী’। কিংবা তৃতীয় অনুচ্ছেদে বর্ণিত ইউরিয়া ফ্যাক্টরির বর্জ্য-জঞ্জালে কাতর ইলিশের পরিণতি বর্ণনা: ‘তবু গুনগুনিয়ে যাচ্ছে নদী, যেন ওর গানের ভেতর ইলিশের/ বোকা-বোকা শ্বাসকষ্ট আছে। সহজ মরণ আছে।’ কিংবা শেষাংশে নিজেদের কবিতাপ্রয়াসকে ছোট শহরের অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সাথে করা তুলনাটা: ‘যেন আমার সম্ভাব্য কবিতা/ঐ উঠতি শহরের পয়ঃনিষ্কাশনের মতোই/একপেশে একটি বধির ব্যবস্থামাত্র!’

আমি কবিতাটির শব্দ নির্বাচন ও সজ্জার শৈল্পিক কারিগরিতে বিশেষভাবে মুগ্ধ। মুগ্ধ এর কেন্দ্রকে পরিপাটি রেখেও পরিপার্শ্বকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারার বিরল ক্ষমতাদৃষ্টে। সুমন রহমানের এ ভ্রমণ কাজেই যুক্ত হয়ে যায় আমার প্রিয় তালিকায়।


মধ্যরাতের নদী

খুব ক্যাজুয়েল, কোন জলদি নাই, যেন নিরবধি -
যেন কারো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাচ্ছে মধ্যরাতের নদী
পাঁচমিশালী ধারাস্রোতের দোটানা-সহ।

আলোকসজ্জার নৈশ অনুরোধ ঠেলে যেতে মন কি তার একদম সরছে না?
নাকি ভুলে গেছে,পাহাড়ের বেণী খুলবার দিনে সেও ক্রন্দনশীলা পথ -

আর জয়দ্রথ
কিংবা আমি
এসে বসলাম পা ডুবিয়ে - ইউরিয়া ফ্যাক্টরির সবুজ বিষ্ঠা মিশছে
ঘুমন্ত ইলিশের ফুলকায়
তবু গুনগুনিয়ে যাচ্ছে নদী, যেন ওর গানের ভেতর ইলিশের
বোকা বোকা শ্বাসকষ্ট আছে। সহজ মরণ আছে।

নদীকে বললাম আমার নানাবিধ পদ্যসম্ভাবনার কথা
এক বালিকার খেয়ালখুশির ভেতর তীব্র বেদনারাশিসমেত
লতিয়ে উঠত ওরা –
যাকে আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম ওর সহচরীদের কাছ থেকে
আগলে রেখেছিলাম পৃথিবীর সবাইকে তস্কর ভেবে

বলতে ইচ্ছা করছে: তাকে হারিয়ে ফেলেছি, অথবা তাকে
কোনদিনই পাই নি
তাকে আমি একদম বুঝি নি, সেও আমাকে নয়
আমি হয়ত তাকে একদিন বুঝে উঠতে পারবো, কিন্তু সে আমাকে
কোনদিনও বুঝবে না

একটি নিঃসঙ্গ জেলেনৌকার আলোয় আমার চোখ
ঝাপসা হয়ে আসছে

নদী বইছে ধীরে, সপ্রতিভ উপেক্ষার অল্প অল্প ঘূর্ণি ওর গায়ে
যেন আমি যে গল্পটি বলছি সেটি বহুবার তার বহুজন থেকে শোনা
যেন তার তীরে তীরে পুনরাবৃত্তি বোনা

যেন কোন উচ্চাভিলাষী শহরের পাশ দিয়ে
একবারও বয়ে না-গিয়ে
আমার বুঝবারই কথা নয় দাম্পত্য কাকে বলে
যেন আমার সম্ভাব্য কবিতা
ঐ উঠতি শহরের পয়ঃনিষ্কাশনের মতই
একপেশে একটি বধির ব্যবস্থামাত্র!

সমবেত স্নান শেষে শ্রমিকদের হল্লা মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে
ছুটি চেয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলছে ঘাটগুলো, যেন আমি উঠে গেলেই
একযোগে নাইতে নামবে –
সারাদিনের কান্তি আর লোহার অ্যাংকরের খামচিগুলোতে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে
ঘুমাতে যাবে তারা।

মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০০৮

সাহিত্য কি আমাদের বিপক্ষে? : অন্ধত্ব ও সাহিত্য নিয়ে কেনেথ জার্নিগান-এর রচনা



সাহিত্যের উপাদান হিসেবে অন্ধত্বকে খোদ অন্ধরা কিভাবে মূল্যায়ন করে? আমেরিকার ন্যাশনাল ফেডারেশন অব দ্য ব্লাইন্ড এর ড. কেনেথ জার্নিগান-এর এই লেখাটি সাহিত্যের সেই চেহারা তুলে ধরেছে যেখানে চক্ষুষ্মান সাহিত্যিকগণ চক্ষুহীন মানুষকে সাহিত্যের উপাদান করতে গিয়ে তাদের স্বাভাবিক জগতের বাইরে ছুঁড়ে দিয়েছেন। এমন কি জন মিল্টনের মত খ্যাতিমান অন্ধ সাহিত্যিকেরাও, কেনেথ বলছেন, এইসব জনপ্রিয় ধারণার ফাঁদে পড়ে গিয়ে অন্ধত্ব নিয়ে দৃষ্টিবান মানুষ যা ভাবতে পছন্দ করে তারই প্রতিধ্বনি করেছেন।

কেনেথ-এর মতে, অতীতকালের সাহিত্য যেখানে অন্ধত্ব বিষয় হিসেবে এসেছে তা মোটেও অন্ধদের বাস্তবতাকে সমর্থন করে না, ফলত অন্ধদের জীবনে সেসব মোটেও কোনো উৎসাহ জোগায় না। বর্তমানের সাহিত্যে বেশ কিছু ইতিবাচক মোড়বদলের কথা তিনি বলেছেন, যদিও রেফারেন্স দেন নি। অবশ্য কেনেথ-এর বক্তব্য তৈরি হয়েছে প্রধানত তার চিরায়ত ইংরেজি ও ফরাসী সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা থেকে। আর সাহিত্যের কাছে তার প্রত্যাশার ধরনটিও বিতর্কের বিষয় হতে পারে।

["দেখা না-দেখার চোখ" এ এই অনুবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল]



ইতিহাস যেমন মানুষের কৃতকর্মের সন্নিবেশ তেমনি সাহিত্য হল তার চিন্তার সমাবেশ। আমি এখন বলতে চেষ্টা করব সাহিত্যে অন্ধদের উপস্থাপনার ধরন নিয়ে। কীভাবে দেখা হয়েছে আমাদের সেখানে? আমাদের ভূমিকা কী? কবি, উপন্যাসিক, প্রবন্ধকার ও নাট্যকারগণ কী ভেবেছেন আমাদের নিয়ে? অন্ধত্ব জিনিসটা আসলে যেরকম তারা কি সেইরকমই দেখেছেন, নাকি তারা যেরকম দেখতে চেয়েছেন, অন্ধত্বকে সেইরকম করেই তুলে ধরেছেন?

সাহিত্যে অন্ধজীবন নিয়ে কোনো একক বা একটি সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি নেই। বরং দেখা যায় সাহিত্য অনেকগুলো বিচিত্র এবং পরস্পরবিরোধী অন্ধত্বের ইমেজ হাজির করছে, সেটি শুধু যুগ বা সংস্কৃতিভেদে নয়, শুধু লেখকভেদে নয়, এমন কি একই বইয়ের বিভিন্ন পৃষ্ঠায়ও এই বৈপরীত্য বিদ্যমান।


বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাহিত্যে অন্ধত্বের বিষয়টি মোটামুটি নয় ধরনের বিষয়াশ্রিত হয়ে এসেছে: অলৌকিক ক্ষমতারূপে, নিরুদ্ধার ট্রাজেডী হিসেবে, নির্বুদ্ধিতা ও অসহায়ত্বের পূর্বগামী হয়ে, ধূর্ততা আর শয়তানি সহযোগে, নিখাদ পূণ্যের সহগামী হিসেবে, পাপের শাস্তিরূপে, অস্বাভাবিকতা এবং বিমানবিকীকরণের সূত্রপাত হিসেবে, শুদ্ধতার প্রতীকরূপে, অন্য কিছুর প্রতীক বা রূপক হিসেবে।

অলৌকিক বা আল্লাপ্রদত্ত ক্ষমতা হিসেবে অন্ধত্ব সাহিত্যে কিভাবে চিত্রিত? ধরা যাক আপনাদের কেউ আমায় জিজ্ঞেস করলেন, অন্ধ হওয়ার কি কি সুবিধা আছে বলে আমি মনে করি? এবং ধরা যাক আমি উত্তর দিলাম: কোনোই সুবিধা নেই, তবে এমন কিছু দিক আছে যা হয়ত আমরা ভেবে দেখি না। আবিষ্কারের জন্য একটা নতুন জগত, নতুন এবং অভিনব প্রত্যণ, নতুন জেগে উঠা মতা; অন্ধ জীবন চতুর্থ মাত্রার জীবন। এরকম শুনলে একজন অন্ধ হিসেবে আপনি কী বলবেন? অনুমান করি, হাসতে হাসতে বিষম খাবেন। আমার মনে হয় না এইসব বস্তাপচা বোকাভাষণ কাউকে আকৃষ্ট করবে। আপনারা এবং আমি নিজের মুখে ঝাল খাওয়া অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, অন্ধত্বের কোনো চতুর্থ মাত্রা নেই, অন্ধ হলে কোনো অলৌকিক ক্ষমতা জাগ্রত হয় না, কোনো অদ্ভূত অনুভূতি হয় না, উন্মোচিত হবার জন্য নতুন কোনো জগত এসে হাজির হয় না। কিন্তু আমি যে উদ্ধৃতি দিয়েছি সেটি কিছুকাল আগের এক জনপ্রিয় উপন্যাস থেকে নেয়া।

অলৌকিক বা প্রকৃতিপ্রদত্ত মতার সাথে অন্ধত্বের এই যে মেলবন্ধন, এটি সাহিত্যে একটি সর্বজনমান্য ঐতিহ্য, চিরায়ত পূরাণকাহিনীগুলোতেও এর শেকড় আছে। প্রাচীন গ্রিসের দেবতাদের মধ্যে মানুষকে শাস্তি দেয়ার একটা পছন্দনীয় প্রথা ছিল অন্ধ করে দেয়া। একে সাধারণভাবে মৃত্যুর চেয়েও খারাপ মনে করা হলেও, কখনো কখনো, দেবতার কৃপায় সেই অন্ধ হয়ে যাওয়া শাস্তিগ্রহীতা ব্যতিক্রমী কিছু ক্ষতিপূরণও পেয়ে যেতেন: যেমন ভবিষ্যকথন ক্ষমতা। মনে করা হয়, হোমার তার অন্ধত্বের ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেয়েছেন কবিত্বশক্তি। একইভাবে, সফোকিসের নাটকে যে টাইরেসিয়াসকে পাওয়া যায়, অন্ধ হবার বদলে নবুয়তপ্রাপ্তি ঘটেছিল তার।

উনবিংশ শতাব্দীর মহান উপন্যাসিক ভিক্টর হুগো’র ‘দ্য ম্যান হু লাফস’ উপন্যাসে অন্ধত্ব নিয়ে আধুনিক লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গি মেলে। সেখানে অন্ধত্ব শুদ্ধতা ও আনন্দের সহযোগী হয়েছে, যা কোনোভাবে দৃষ্টিহীনতাকে পুষিয়ে দিচ্ছে। তার উপন্যাসের অন্ধ নায়িকা দিয়াকে দেখা যায় এক পরমানন্দে বিভোর হয়ে থাকতে, যেটা অন্ধের পক্ষে বেমানান ঠেকে। এই পরমানন্দ কখনো কখনো আত্মার গহীনে অনুধাবনের জন্য অন্ধদের এক সঙ্গীত উপহার দেয় এবং তার মাধ্যমে তাদের অন্ধকার জীবনকে আলোকিত করে তোলে। হুগো’র মতে অন্ধত্ব হল সেই অন্তহীন গুহা যার মধ্যে অসীমের ঐকতান ধরা দেয়।

সম্ভবত, জনপ্রিয় কল্পকাহিনীর অন্ধ গোয়েন্দাদের কীর্তিকলাপের মাধ্যমেই অন্ধত্বের সাথে ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের যোগাযোগ পরিস্ফুট হয়। ম্যাক্স ক্যারেডস নামের ফোর্থ ডাইমেনশনাল চরিত্রটি আবির্ভূত হয়েছিল ১৯১৪ সালে এবং গোটা বিশের দশক ধরে নানান অতিমানবীয় ঘটনার নায়ক হয়ে থেকেছে সে। ১৯১৫ সালে আমরা পাই ডেমন গন্ট নামক আরেকজন অন্ধ গোয়েন্দাকে, যিনি একটা কেসও হারেন নি। এই তালিকায় থর্নলে কল্টন, ডানকান ম্যাক্সেইনসহ আরো অনেক চরিত্রের নাম যোগ করা যায়। যেমন হয়েছে গোয়েন্দা ডানকানের চরিত্রের বেলায়। এখানে ডানকানের নৈপুণ্যের ছটায় তার স্রষ্টাই ঢাকা পড়ে গেছেন। তবু এমন কিছু মুহূর্ত আসে, ডানকানের স্রষ্টা লিখেছেন, যখন সাধারণ মরণশীল মানুষের ক্ষমতার অতিরিক্ত কিছু মতা ডানকানের অধিগত হতে দেখা যায়। এসব মুহূর্ত তাকে উদ্বিগ্ন করে।

তারা সেইসঙ্গে আমাদেরও উদ্বিগ্ন করেন। অন্ধত্বের সাথে এসব অস্বাভাবিক এবং অতিমানবিক ক্ষমতারোপ নিঃসঙ্গ ও আলাদা, অসহজ এবং উদ্ভট একটি বস্তাপচা চরিত্রের আদলে ভাবা থেকে অন্ধকে একটুও রেহাই দেয় না। বরং পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটায়।

এটি শুধু অসত্যই নয়, অন্ধদের জন্য নেতিবাচকও। কারণ এতে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, কোনো অন্ধ মানুষ যা অর্জন করল তা নিজের যোগ্যতায় নয়, বরং অন্ধত্বে নিহিত কোনো ম্যাজিকের বদৌলতে। অন্ধত্বের ওপর এহেন অতিমানবীয় ক্ষমতারোপ এক লহমায় সাধারণ বাস্তবতা থেকে উঠিয়ে নিয়ে অন্ধকে দাঁড় করায় অস্বাভাবিকতার উদ্ভট এক মঞ্চের ওপর। অথচ অতিমানবীয় বা অস্বাভাবিক যাই হোক, এটিই ধ্রুবসত্য যে, অন্ধের কোন দায় নেই, অধিকার নেই, সমাজ নেই এই পৃথিবীতে।

কৃতকর্মের পুরষ্কার হিসেবে প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতা অর্জনের ধারণা অন্ধের জন্য কোনোভাবেই প্রশংসাসূচক নয়, বরং অপমানকর। এই ধারণা আমাদের যাবতীয় অর্জনকে ছিনিয়ে নেয়, এমন কি আমাদের ব্যর্থতার দায়ও আমাদের বহন করতে দেয় না। এই ধারণা অন্ধের জন্য একটা সুষম সমাজ গঠনের দায় থেকে বিদ্যমান সমাজকে মুক্তি দিয়ে দেয়। চারপাশের জীবনে উদ্দাম ও সমান অংশগ্রহণের সামর্থ অর্জনে আমাদের মোটেও উদ্দীপ্ত করে না। সংক্ষেপে এই ধারণা অনুযায়ী, অন্ধ অসাধারণ হতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই সাধারণ হতে পারে না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমরা অতি সাধারণ অন্ধলোক, আশির্বাদপুষ্টও নই, অভিশপ্তও নই।

অন্ধত্বের ওপর প্রকৃতিদত্ত মতারোপের ধারণা নেতিবাচক হলেও অনেক কম ক্ষতিকর, সাহিত্যে অন্ধত্বের সাথে এর চেয়েও ক্ষতিকর অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে। সবচেয়ে তিকর ধারণাটি আবার সবচেয়ে প্রাচীনও: সেটি হল অন্ধত্বকে একটি সম্পূর্ণ ট্রাজেডী হিসেবে দেখা। একটি হিব্রু প্রবাদ আছে, অন্ধলোক হল মৃত মানুষের মত। অন্ধকে জীবন্মৃত করে উপস্থাপনের চরম নিদর্শন পাওয়া যায় ইদিপাসকে নিয়ে লেখা গ্রিক নাটকগুলোতে। ইদিপাস রেক্সে রাজা নিজেই যখন নিজের চোখ তুলে ফেললেন তখন নাট্যকার বলছেন: অন্ধ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই ভাল ছিল। এই ঐতিহ্যের বিস্তার ঘটে ইংরেজি সাহিত্যেও। সেখানে একজন কবি, নিজেও যিনি অন্ধ, অন্ধত্বকে মহাদুর্যোগ আখ্যা দিয়ে শেষকথা বলছেন। স্যামসন অ্যাগনেষ্টিজ-এ জন মিল্টন:
শত্রুবেষ্টিত অন্ধের চেয়ে অনেক ভাল ছিল বন্দী হওয়া, পাতালে নিক্ষিপ্ত হওয়া, ভিক্ষা করা, বা ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া। তুচ্ছাতিতুচ্ছ পতঙ্গজীবনও আমার চেয়ে ভাল। তারা হামাগুড়ি দিয়ে চলে, তবুও তো দেখতে পায়। আমি, আলোর মধ্যে অন্ধকার, প্রতিদিনের প্রতারণা, প্ররোচনা, ঠগবাজি বা ভুলভালের কাছে প্রতিদিন ধরা খাই। দরজা খোলা থাকা না থাকা আমার জন্যে সমান, সেটা অন্যের বিষয়, আমার নয়। অর্ধেকের কম আমি জীবিত, অর্ধেকের বেশি আমি মৃত, একটা চলমান কবর।

এই মহাকাব্যিক কবিতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় এর মহাদুর্যোগ পরিস্থিতি নয়, উল্লেখযোগ্য হল আমাদের মহাকবি মিল্টন এর রচয়িতা। তার সব মহৎ রচনা (প্যারাডাইজ লস্ট সহ) লিখিত হয়েছে তিনি অন্ধ হয়ে যাবার পরে। তাহলে তিনি কেন অন্ধত্বকে এমনভাবে দেখতে গেলেন? উত্তরটা সহজ: আমরা অন্ধরা নিজেদের অবস্থাকে সেভাবে দেখতে চেষ্টা করি, যেভাবে চক্ষুষ্মান মানুষ আমাদের দেখতে চায়। এমন কি, যখন আমরা বুঝি ঐ দৃষ্টিভঙ্গি একদম ভুল, তারপরও সেই মতামতটিকেই আমরা নিজেদের ওপর চাপাতে দিই বা চাপিয়ে নিই। এভাবে অনেক সীমিত ও খণ্ডিত অনুধাবন আমাদেরই সহায়তায় আমাদের বাস্তবতা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে থাকে। সাহিত্যের গতানুগতিক ঐতিহ্য দ্বারা চালিত হয়ে মিল্টন নিজের এবং তাবৎ অন্ধদের জন্য একটি ভুল দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দিলেন। সত্যি বলতে কি, মিল্টন বরং অন্ধত্ব নিয়ে সাবেকী বস্তাপচা মতামতগুলোর পালেই হাওয়া দিলেন, এবং সেটি তিনি করলেন তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিপক্ষে গিয়ে। সাহিত্যের ক্ষমতা সত্যিই অনেক!

এক শতাব্দী পর অন্ধত্বের দুর্যোগের ধারণাটি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠে। কিপলিং-এর ‘দ্য লাইট দ্যাট ফেইলড’ পুস্তকে বলা হয়, অন্ধত্ব মৃত্যুর চেয়েও খারাপ। এই বইয়ের নায়ক যখন জানতে পারে যে, সে অন্ধ হতে চলেছে, তখন বলে: এটা হল চলমান মৃত্যু। অন্ধকারে আমাদের নিশ্চুপ হয়ে থাকতে হবে এবং আমরা কাউকেই দেখব না, যা চাই তা কোনোদিনই পাব না, শতবছরও যদি বাঁচি। পুস্তকটির পরবর্তী অংশে নায়ককে দেখা যায় সমগ্র পৃথিবীর বিরূদ্ধে আক্রোশে ফেটে পড়তে, যেহেতু সেই পৃথিবী দেখতে পায়, যেখানে সেই নায়ক অন্ধের মৃত্যুর মাঝে মৃত হয়ে আছে, সহযোগীদের কাঁধে দুর্বহ বোঝা হয়ে। যখন এই আত্ম-অনুকম্পায় ভরা চরিত্রটি আত্মহত্যা করতে সমর্থ হয় (কী যে স্বস্তির খবর!) কিপলিং বলে ওঠেন যে, এই অন্ধ নায়কের ভাগ্য শেষপর্যন্ত ওর সাথে প্রতারণা করে নাই, কারণ সে একটা দয়ালূ বুলেট অন্তত নিজের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে।

‘দ্য এন্ড অব দ্য টিদার’ উপন্যাসে জোসেফ কনরাড তার চরিত্র ক্যাপ্টেন হুয়েলীকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করেন, কারণ সেটি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে অনেক ভাল। ডি এইচ লরেন্সের উপন্যাস ‘দ্য ব্লাইন্ডম্যান’ এ মরিস যুদ্ধে অন্ধ হয়ে যায়, ভবিষ্যতের কোন সোনালি ইঙ্গিতই তার দুর্দশা লাঘব করে না। ‘ইনভাইটেশন টু দ্য ওয়াল্টজ’ উপন্যাসে লেখক রোজামন্ড লেম্যান আরো এককাঠি সরেস। তার উপন্যাসের যুদ্ধে-অন্ধ-হওয়া চরিত্রটি সমাজে সম্মানজনক জীবন যাপন করলেও, কোনো কাজে লাগে না, যেন একটা চলতে ফিরতে থাকা লাশ। যখন সে তার প্রাক্তন প্রেমিকার সাথে নাচে তখন পরিস্থিতি খুব বেদনাদায়ক হয়ে উঠে। অন্ধলোকটি তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে নিবিড় করে ধরে রাখলেও প্রকৃত প্রস্তাবে সে তখন অনেক দূরে, সঙ্গীত থেকে, জীবন থেকে, সমাহিত এবং পছন্দশূন্য। আর প্রেমিকা আসলে ঐ অন্ধলোকটির চক্ষুষ্মান যুবক বয়স আর বর্তমানের মৃত্যুর সাথে নাচে।

এই লেখকেরা মনে করেন, অন্ধত্বের তথাকথিত ট্রাজেডী এতটাই দুর্বহ যে, খোলা আছে দুইটি রাস্তা: হয় চোখ ফিরে পাওয়া, নয় মরে যাওয়া।

দেখা যাক অন্ধত্বের সাথে নির্বুদ্ধিতা আর অসহায়ত্বের প্রসঙ্গকে কিভাবে মেলানো হয়েছে। প্রাচীন কাল থেকেই অন্ধরা রগড় নাটক ও প্রহসনে উপহাসের বিষয় হয়ে থেকেছে। প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন রগড় নাটক ও প্রহসনে অন্ধরা উপহাসের বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে। মধ্যযুগে দেখা যেত অন্ধরা গাধার কান লাগিয়ে পথে পথে ঘুরছে, হাতপা নেড়ে উল্টাসিধা কথা বলে জনগণের মনোরঞ্জন করছে। এই ধারাবাহিকতায় চসার তার ‘মারচেন্টস টেল’এ এক তরুণী বধুর কথা বলেন যে এক অন্ধ বুড়োকে বিয়ে করে। স্বামীর সঙ্গে বাইরে ঘুরতে গিয়ে ঐ বধু তার গোপন প্রেমিকের সঙ্গে গাছের আড়ালে অভিসার করে অন্ধ স্বামীর সামনে। চসার সেখানেই থামেন না, বলতে থাকেন, সেই মোম সময়ে ঐ তরুণীর স্বামী হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায় এবং স্ত্রীকে গোপন প্রেমিকের সাথে অভিসাররত দেখতে পায়। কিন্তু চালাক স্ত্রী সাথেসাথেই অজুহাত খাড়া করায়: ঐ অভিসার আসলে ছিল স্বামীর দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশায়! শেক্সপিয়ারে অবস্থা আরো খারাপ। ‘কিং লিয়র’এ তিনি যে অন্ধ গ্লকেস্টারকে উপস্থাপন করেন, সে এতটাই অসহায় আর দ্বিধাগ্রস্থ যে, যেকোন কিছু দিয়েই তাকে ভজানো যায়, প্রতারিত হবার জন্য একেবারে আদর্শ চরিত্র।

অন্ধদের নিয়ে মজা করার রূঢ়তম দৃষ্টান্তটি পাওয়া যায় ষোড়শ শতাব্দীর এক জার্মান নাটকে। নাটকের নায়ক তিনজন অন্ধ ভিক্ষুককে একটা মূল্যবান মুদ্রা ভিক্ষা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন যেটা দিয়ে তারা খাদ্যসামগ্রী ও থাকার ব্যবস্থা করতে পারে। সেই মুদ্রা আসলে কাউকেই দেয়া হয়নি, আর তিনজন অন্ধের প্রত্যেকেই মনে করল অন্যজনকে মুদ্রাটি দেয়া হয়েছে। পরের অবস্থাটি সহজেই অনুমেয়।

অসহায় অন্ধলোক একটি সার্বজনীন ধারণা হয়ে উঠেছে। মেটারলিংক-এর ‘দ্য ব্লাইন্ড’ নাটকে দার্শনিক অবস্থান থেকে সবগুলো চরিত্রকে অন্ধ দেখানো হয়েছে। কিন্তু মঞ্চে গিয়ে দেখা গেল দর্শন নয়, বরং অন্ধদের হাস্যকর দলবাজি, হুমকিধামকিই ঐ নাটকের সার।

‘লা সিম্ফনি প্যাস্টোরাল’ এর আঁন্দ্রে জিদ হলেন অন্ধত্বের প্রকৃত সত্যের সবচেয়ে খারাপ বিরূদ্ধবাদীদের একজন। সেখানে অন্ধ কিশোরী গারট্রুড একেবারে নির্বোধ কিসিমের ছিল, প্যাস্টর এসে ওকে লেখাপড়া শিখাতে শুরু করার আগে। অন্ধত্বের কারণেই এই নির্বুদ্ধিতা, লেখক বলেন, দৃষ্টি না থাকায় কিশোরীটি সত্য সম্পর্কে জানতে পারে না। শিক প্যাস্টর তার ছাত্রী গারট্রুড-এর জন্য যে জগত তৈরি করে, সেখানেই অন্ধ গারট্রুড সুখেস্বাচ্ছন্দ্যে কাটায়। সত্যিকার জগতের খারাপ দিক সম্পর্কে কিশোরীটি কিছুই জানতে পারে না। দৃষ্টি না থাকায় সে পাপ সম্পর্কেও সচেতন নয়, আপেল খাওয়ার আগের আদম-ঈভের মত। গারট্রুড যখন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল, তখনই কেবল সে পাপ সম্পর্কে অবগত হল। না বুঝে প্যাস্টরের সাথে যেসব পাপকাজ সে করেছে, সেগুলোর অপরাধবোধ তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে।

সাহিত্যে অন্ধত্ব যেমন নির্বুদ্ধিতার অনুষঙ্গ হয়ে এসেছে, তেমনি এসেছে ধূর্ততার অনুষঙ্গ হয়েও: একেবারে খাঁটি শয়তানির মূর্ত মানবীয় রূপ হয়ে। স্টিভেনসনের ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’ এর বুড়ো জলদস্যু অন্ধ পিউ এর জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। উপন্যাসের নায়ক কিশোর জিম হকিন্স অন্ধ পিউকে যখন প্রথম দেখে তখনই তার মনে হয়েছে এই মৃদুভাষী এবং চোখহীন মানুষটির চেয়ে ভয়াবহ কোন চরিত্র সে জীবনেও দেখে নাই। যখন পিউ তাকে ক্রাচ বাগিয়ে ধরে ফেলে, জিমের মনে হয়েছে, এই অন্ধ লোকটির কণ্ঠের চেয়ে নিষ্ঠুর, ঠাণ্ডা আর কুৎসিত কণ্ঠও সে কোনোদিন শোনে নাই।

বহুযুগ ধরেই অন্ধত্ব ও নিচুতার সম্পর্ক সাহিত্যিকদের একটা প্রিয় প্রসঙ্গ, এবং পাঠকদের মধ্যেও এই সম্পর্কের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে, যেহেতু পাঠকেরা নানা লোককাহিনী থেকে শিক্ষা পেয়েছে যে, অন্ধত্ব মানবিক গুণাবলী হ্রাস করে। এই শিক্ষা অন্ধ বিষয়ে চক্ষুষ্মান সাধারণ মানুষের নিষ্ঠুরতার অ্যাটিচুডকে সমর্থন করে।

নিখাদ শয়তানির অনুষঙ্গে অন্ধত্বকে যেমন দেখা হয়েছে, এর বিপরীতে কোনো কোনো সাহিত্যে আবার অন্ধত্ব উপস্থাপিত হয়েছে পরম পূণ্যরূপে। আপাতভাবে এই দুটো দৃষ্টিভঙ্গিকে পরস্পরবিরোধী মনে হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে তারা একই মুদ্রার এপিঠওপিঠ। অন্ধত্বের প্রকৃত বাস্তবতা তুলে ধরার মত জোরালো অন্তর্দৃষ্টি কোনটিতেই পাওয়া যায় না। একটা বিষয়ে এই দুই দলই একমত: অন্ধত্ব হচ্ছে একটা অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা যা তার বহনকারীকে স্বাভাবিক জীবন থেকে পুরোপুরি উৎপাটিত করে।

অন্ধত্বকে হয় পাপ বা শয়তানির ফসল হতে হবে, নয় তাকে হতে হবে পূণ্যের অনুষঙ্গ। লরা রিচার্ডস এর ‘দ্য ব্লাইন্ড চাইল্ড’এ দেখা যায় অন্ধ শিশুটি গাছের বাকলে হাত রেখে বলে দিচ্ছে গাছের নাম, বলে দিচ্ছে কখন ফুল আসবে এবং কিভাবে। গ্রামে এমন কোনো কুকুর বিড়াল নেই যে ঐ শিশুর একটি ডাকে প্রভুর নাম ভুলে ছুটে আসবে না। সে শুধু পূণ্যবতীই নয়, পাশাপাশি যাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী। অগ্নিকাণ্ড থেকে এক শিশুকে রা করে, গান গেয়ে মানুষকে রোগমুক্ত করে, পাঁড় মদ্যপের মদের নেশা ছাড়িয়ে দেয়।

অন্ধত্ব নিয়ে যাবতীয় রোমান্টিক হেঁয়ালিপনার মধ্যে সবচেয়ে উদ্ভট হল, অন্ধত্বকে ছদ্মবেশী আশির্বাদ মনে করা। জন জি মরিসের ‘দ্য ব্লাইন্ড গার্ল অব উইটিনবার্গ’এ অন্ধ নায়িকাকে বলা হচ্ছে: ঈশ্বর তোমায় চোখের আলো থেকে বঞ্চিত করেছেন বলেই তোমার হৃদয় আরো মহান আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। আমার পরিচিতি এমন কোনো অন্ধ মেয়ে নেই যে এরকম অপমানসূচক এবং উদ্ভট বক্তব্য প্রদানকারীর গালে অন্তত একটি চড় না বসিয়ে ছেড়ে দেবে। তারপর এই অন্ধ নায়িকাকে দিয়ে প্রত্যুত্তরে যা বলানো হল তা আরো মারাত্মক: সে বলল, মহাত্মন আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন আমাদের অন্তর্জগত আপনাদের চেয়ে সুন্দর, এবং আপনাদের সূর্যের চেয়ে আমাদের অন্তরের আলো উজ্জ্বলতর?

কল্পকাহিনীতে আরেকটা সুপ্রাচীন এবং অন্যতম নিষ্ঠুর ধারণা হল, অন্ধত্ব হচ্ছে পাপের ফল। ঈদিপাস অন্ধ হন মাতৃসহবাসের কারণে, বেলেল্লাপনার কারণে চোখ হারান শেক্সপিয়ারের গ্লুকেস্টার। এর অব্যবহিত পরের ঘটনা হল, অন্ধত্ব শুদ্ধতা অর্জনের একটা স্তর, যে স্তরে কোনো মানবীয় চরিত্র আগের পাপতাপ ঝেড়ে পূণ্যবান হয়ে উঠতে পারে। যেমন দেখা যায় কিংসলের ‘ওয়েস্টওয়ার্ড হো’ এ অ্যামেয়াস লেই বজ্রপাতে অন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাতারাতি অপরাধী থেকে সাধুতে পরিণত হয়।

এ সমস্ত বিখ্যাত কল্পকাহিনীর মধ্যে অন্ধত্বকে মানবিকতা-বহির্ভূত কিছু একটা দাঁড় করানোর একটা প্রবণতা থেকেই গেছে। অন্ধত্ব যেন স্বাভাবিক জীবন বা মানবিক সম্পর্ক থেকে নির্বাসনের দরজা। ডিকেন্সের বার্থাই হোক, বা লিটনের নিদিয়াই হোক, প্রেমে পড়ে তারা ভুলেও ভাবে না যে তাদের কাক্সিতজনেরা তাদের প্রেমে পড়বে।

সর্বশেষ যে প্রবণতাটি দেখা যায় তা হল, অন্ধত্বকে আক্ষরিক অর্থে না নিয়ে প্রতীকী অর্থে নেয়া, ব্যঙ্গ বা প্যারাবল তৈরির জন্যে। লোকসাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র সর্বত্রই এই প্রবণতাটি অন্ধত্বকে মৃত্যু বা নরকযন্ত্রণার প্রতীক হিসেবে দাঁড় করায়, অথবা শারীরিক অন্ধত্বের প্রতীকে মানসিক অন্ধত্বকে মূর্ত করে তোলে। এই ক্যাটাগরিতে পড়বে এইচ জি ওয়েলস-এর ‘দ্য কান্ট্রি অব দ্য ব্লাইন্ড’, পল কোরে’র ‘দ্য প্লানেট অব দ্য ব্লাইন্ড’, মেটারলিংক-এর ‘দ্য ব্লাইন্ড’ ইত্যাদি। এছাড়াও কনরাড আইকেন-এর ছোটগল্প ‘সাইলেন্ট স্নো, সিক্রেট স্নো’-এ অন্ধত্বকে স্কিজোফ্রেনিয়ার রূপক হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এ সমস্ত উপস্থাপনায় অন্ধত্বকে দেখানো হয়েছে অজ্ঞতা ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের প্রতীকরূপে, স্বাভাবিক ধারণা ও মূল্যবোধের উল্টো অবস্থার প্রতীকরূপে, এবং মৃত্যুর চেয়ে খারাপ বা মৃত্যুসমান অবস্থার প্রতীকরূপে।

সাহিত্যের এই সমীক্ষা থেকে কী শিক্ষা নিতে পারি আমরা? কী বলতে চেয়েছে সাহিত্য আদতে? একটা শিক্ষা এটি যে, এই সমস্ত সাহিত্যকর্মের বদৌলতে আমরা এমন একদল তথাকথিত বিশেষজ্ঞ খুঁজে পেয়েছি যারা এই সাহিত্যের জ্ঞান সম্বল করে অন্ধত্ব নিয়ে গবেষণা করে নানান অশ্বডিম্ব প্রসব করছেন। তাদের মতে, অন্ধত্ব কেবল নিছক দৃষ্টিহীনতা নয়, বরং একজন মানুষের সম্পূর্ণ রূপান্তর। কোনো মানুষের কাছে তার অন্ধত্ব নিছক চোখ হারানোর গল্প দিয়েই শেষ হয় না, আসলে সেটি মৃত্যুসমান, সত্তার ওপর এক বিশাল আঘাত। তারা বলেন, চোখ হল সেক্স সিম্বল, তাই অন্ধ মানুষ কখনই পূর্ণ মানুষ নয়।

শিরোনামের প্রশ্নে ফিরে যাই: সাহিত্য কি আমাদের বিপক্ষে? এই প্রশ্নের সর্বজনগ্রাহ্য কোনো জবাব নেই। শুধু অতীত আমলের সাহিত্য নিয়ে যদি আলাপ হয়, তাহলে প্রশ্নের জবাব হবে, হ্যাঁ। সমসাময়িক সাহিত্য নিয়ে আলাপ হলে মিশ্রজবাব হবে। অন্ধত্বের ধারণায় অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন সমসাময়িক সাহিত্যে পাওয়া যায়, যদিও বস্তাপচা সাবেকী ধারণাগুলোই এখন পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় এটা যে, সমসাময়িক কালে এই সব ধারণা উৎসাহ পাচ্ছে আমাদের তথাকথিত অন্ধ বিশেষজ্ঞদের উদ্ভট গবেষণা থেকেই।

ভবিষ্যতের দিকে যদি ঐ প্রশ্ন নিয়ে তাকাই, জবাব হবে, ভবিষ্যতের সাহিত্য বর্তমান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যেমন বর্তমানের জীবন পারে না ভবিষ্যতের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অন্ধ জীবনগুলোকে সাজিয়ে তোলার মাধ্যমে আমরাই ভবিষ্যতের সাহিত্যকে নির্দেশনা দিতে পারব। অন্ধত্ব একটা ট্রাজেডী ততক্ষণই, যতক্ষণ আমরা এই সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গিটিকে মান্য করি। আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ একটাই: আমাদের সময়কে অন্ধত্ব নিয়ে সচেতন ও সবিবেক হতে সাহায্য করা। কল্পকাহিনীর ফ্যান্টাসী থেকে মুক্ত হয়ে সেগুলোকে বাস্তবতার নির্যাস দিয়ে ভরে দিতে হবে। তখনই কেবল আমরা সেই সাহিত্যের জন্য রাস্তা তৈরি করতে পারব যা বাস্তবতার সুবাস ধারণ করবে, সত্যের অপলাপ হবে না, সাহিত্য পড়ে আমরা সেখানে নিজেদের খুঁজে পাব।


(ঈষৎ সংক্ষেপিত)


কৃত্রিম গোলাপগুলো: গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোয়েজের গল্প


ভোরের আবছা আলোয় হাতড়ে হাতড়ে বিছানা থেকে নেমে মিনা হাতাছাড়া জামাটি গায়ে দিল যেটি সে গতরাতেই খাটের কাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল, এবং জামার আলগা হাতাগুলোকে ট্রাংকের ভেতর গরুখোঁজা করে খুঁজল। তারপর দেয়ালের হুকগুলিতে, দরজার পেছনে ভালমত খুঁজল, যতদূর সম্ভব শব্দ না করে, যাতে ওর সঙ্গে একই ঘরে ঘুমানো অন্ধ দাদীর ঘুম ভেঙ্গে না যায়। ভোরের আবছা অন্ধকার ওর চোখে সয়ে এলে সে দেখল দাদী ইতিমধ্যেই উঠে গেছে। মিনা রান্নাঘরে গেল, জামার হাতাগুলোর কথা দাদীকে জিজ্ঞেস করার জন্য।

‘ঐগুলো গোসলখানায়’ অন্ধ দাদী বলল। ‘গতকাল সন্ধ্যায় ধুয়ে দিয়েছি’।

গোসলখানায় হাতাদুটো পেল সে, কাঠের কিপে ঝুলছে। তখনও ভেজা সপসপে। মিনা রান্নাঘরে গিয়ে হাতাগুলো চুলার আঁচে মেলে দিল। সামনে অন্ধ দাদী তখন কফি বানাচ্ছে, তার ভাবলেশহীন চোখের মনি স্থির হয়ে আছে বারান্দার কোনার দিকে, যেখানে একসারি ফুলদানির মধ্যে ঔষধি গাছ লাগানো।

‘আর কনো তুমি আমার জিনিষপত্র ধরবে না’, মিনা বলল। ‘এইসব দিনে সূর্যের আলোর কি কোনো বিশ্বাস আছে?’

অন্ধ মহিলা তার মুখ ঘোরাল, মিনার গলার স্বর লক্ষ্য করে।

‘ভুলেই গিয়েছিলাম আজ প্রথম শুক্রবার’, বলল অন্ধ দাদী।

কফি তৈরি হল কিনা বোঝার জন্য দাদী কেতলির উপরে মুখ নিয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিল, তারপর চুলা থেকে কফি নামিয়ে রাখল।

‘নিচে একটা কাগজ বিছিয়ে হাতাগুলো শুকাতে দিস, চূলার মেঝে কিন্তু নোংরা’, অন্ধ দাদী বলল।

মিনা চুলার মেঝেয় আঙ্গুল বুলিয়ে দেখল। পাথরগুলো নোংরা ঠিক, তবে নোংরাগুলোও শক্ত হয়ে সেঁটে গেছে মেঝেতে। ফলে হাতাগুলো মেঝেয় না ঘষলে সেখান থেকে নোংরা হাতায় লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

‘হাতাগুলো নোংরা হলে তুমি দায়ী থাকবে’, মিনা ওর দাদীকে বলল।

অন্ধ দাদী নিজের জন্য এককাপ কফি ঢালল। ‘তুই রেগে আছিস’, বারান্দার দিকে একটা চেয়ার টেনে নিতে নিতে বলল সে। ‘রাগ নিয়ে প্রার্থনায় গেলে অসম্মান হয়’। কফির কাপটা নিয়ে গোলাপগুলোর সামনের বারান্দার চাতালে বসল দাদী। প্রার্থনা শুরুর তিন নম্বর ঘণ্টাটি বাজলে মিনা চুলার উপর থেকে জামার হাতাগুলো নিয়ে এল এবং তখনও সেগুলো ভেজাই ছিল। সেগুলোই পরল সে। হাতাছাড়া জামা পরে গেলে ফাদার এঞ্জেল ওকে কখনই রুটি দেবেন না। মুখও ধোয় নি সে। তোয়ালে দিয়ে খালি একটু মুছে নিয়েছে। তারপর ঘর থেকে প্রার্থনার বই আর শালটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। ফিরে এল মিনিট পনের পর।

‘তুই যেতে যেতে যীশূর শিক্ষা পর্যন্ত শেষ হয়ে যাবে’, গোলাপগুলোর উল্টোদিকের চাতালে বসে দাদী বলল।

মিনা সোজা টয়লেটে ঢুকল। ‘আমি প্রার্থনায় যেতে পারব না’, বলল সে। ‘হাতাগুলো একদম ভেজা আর জামাটাও কোঁচকানো।’ অনুভব করল একটা জিজ্ঞাসু মন তাকে অনসরণ করছে।
‘প্রথম শুক্রবার, আর তুই কিনা প্রার্থনায় যাবি না’, অন্ধ দাদী বিস্মিত।

টয়লেট থেকে ফিরে মিনা নিজের জন্য এককাপ কফি ঢালল এবং বসল দরজার চুনকাম করা কপাটটার উল্টোদিকে, ওর অন্ধ দাদীর পাশে। কফির কাপে চুমুক দিল না।

‘কাঁদছিস তুই!’ অন্ধ মহিলাটি আরো আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘কাঁদছি রাগে’, মিনা বলল। আর দাদীর পাশ থেকে উঠে যেতে যেতে বলল, ‘তোমার স্বীকারোক্তি দিতে অবশ্যই চার্চে যাওয়া উচিত, যেহেতু তোমার কারণেই আমার প্রথম-শুক্রবারের প্রার্থনায় যাওয়া হল না।’

অন্ধ দাদী স্থানু হয়ে বসে রইল, মিনা শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়া পর্যন্ত। তারপর সে হেঁটে গেল বারান্দার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। মিনার রেখে যাওয়া কফির কাপটা তুলে নেয়ার জন্য সতর্কভাবে একটু একটু করে সামনের দিকে বাঁকা হল সে। কাপটিতে আবার কফি ঢালতে ঢালতে বলে চলল:

‘আল্লা জানেন আমার মন পরিষ্কার ছিল।’

শোবার ঘর থেকে মিনার মা বেরিয়ে এল।

‘কার সাথে কথা বলছ তুমি?’ মিনার মা তার অন্ধ মাকে জিজ্ঞেস করে।

‘কারও সাথেই না। তোকে তো বলেছি আমার মাথা খারাপ হতে চলেছে।’

ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মিনা ওর অন্তর্বাসের বোতাম খুলে তিনটা ছোট ছোট চাবি বের করল, সেগুলো সেফটি পিন দিয়ে ওর জামার সাথে আটকানো ছিল। এর একটা দিয়ে আলমারির নিচের ড্রয়ারটা খুলল এবং কাঠের একটা ছোট বাক্স বের করল। তারপর আরেকটি চাবি দিয়ে ঐ বাক্সটির তালা খুলল। বাক্সটির ভেতর একতাড়া রঙিন কাগজে লেখা চিঠি ছিল, রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা। চিঠির তাড়াটা সে জামার ভেতরে লুকিয়ে নিল এবং বাক্সটি যথাস্থানে রেখে ড্রয়ারটায় তালা লাগিয়ে দিল। তারপর চিঠিগুলো টয়লেটে নিয়ে গিয়ে কমোডে ফেলে দিল।

‘আমি তো ভাবলাম তুই চার্চে চলে গেছিস’, মিনা রান্নাঘরে ঢুকলে ওর মা বলে।

‘নাহ, সে যেতে পারে নি’ অন্ধ দাদী বলে উঠল। ‘আমি শুক্রবারের কথা ভুলে গিয়ে কাল সন্ধ্যায় ওর জামার হাতাগুলো ধুয়ে দিয়েছিলাম।’

‘ওগুলো এখনও ভেজা’, মিনা বিড়বিড় করে।

‘খুব ধকল গেছে এই কয়দিন’, অন্ধ দাদী বলল।

‘ইস্টারের জন্য আমায় দেড়শ গোলাপ বানাতে হবে’, মিনা বলল।

সকাল সকালই সূর্য তেতে উঠল। সাতটা বাজার আগেই মিনা তাদের বসার ঘরে কৃত্রিম গোলাপের দোকানটা সাজিয়ে ফেলল: গোলাপের পাপড়ি এবং তারভর্তি একটা বাক্স, আরেক বাক্সে ক্রেপ কাগজ, দুইটি কাঁচি, একটা সূতাগুটি এবং এক পাত্র আঠা। এর কিছু পরই ত্রিনিদাদ ঢুকে সেখানে, তার হাতে পেস্টবোর্ডের বাক্সটা ধরা, জিজ্ঞেস করে মিনা কেন প্রার্থনায় যায় নি।

‘আমার জামার হাতা ছিল না’ মিনা বলে ওর বান্ধবীকে।
‘কারোটা ধার নিতে পারতি’, ত্রিনিদাদ বলে।

মিনা একটা চেয়ার টেনে পাপড়ির বাক্সটির কাছে বসে।

‘আমার দেরি হয়ে গিয়েছিল’, বলে সে।

একটা গোলাপ বানানো শেষ করল মিনা। তারপর কাঁচি দিয়ে পাপড়িগুলো ছাঁটার জন্যে বাক্সটি আরো কাছে টেনে আনে। ত্রিনিদাদও ওর বাক্সটি নিচে রেখে মিনার সাথে হাত লাগায়।

মিনা ত্রিনিদাদের বাক্সটি দেখে।

‘জুতা কিনলি নাকি?’ জিজ্ঞেস করে সে।

‘এটার ভেতরে মরা ইঁদুর’, বলে ত্রিনিদাদ।

ত্রিনিদাদ ভাল পাপড়ি বানাতে পারে, মিনা তাই সবুজ কাগজ ছেঁদা করে ভেতরে তার ঢুকিয়ে পাপড়ি বসানোর কাঠামো বানাতে থাকল। তারা নিঃশব্দে কাজ করতে থাকল, খেয়ালই করল না সূর্যের আলো এসে কখন পড়েছে বসার ঘরের পারিবারিক ফোটোগ্রাফগুলোর ওপর। কাঠামো বানানো শেষ করে মিনা ত্রিনিদাদের দিকে মুখ ঘোরাল, ওর দৃষ্টিতে কাজবহির্ভূত কিছু একটা ছিল। ত্রিনিদাদ কিন্তু নজরকাড়া নৈপুণ্যের সাথে কাজ চালিয়ে যেতে থাকল, মিনার আঙুলে-ধরা পাপড়িগুলোকে একটুও না নাড়িয়ে। মিনা খেয়াল করল বান্ধবীর পুরুষালি জুতোজোড়া। চোখাচোখি হবে, এমনটা ভেবে ত্রিনিদাদ মাথা তুলল না, নিজের পা যথাসম্ভব পেছনে চেপে রাখল, এবং এভাবে কাজ শেষ করল।

‘ব্যাপার কি?’ বলল সে।

মিনা তার দিকে ঝুঁকে এল।

‘সে চলে গেছে’, বলল মিনা।

ত্রিনিদাদের হাত থেকে কাঁচিটা তার কোলের উপর পড়ে গেল।

‘না’।

‘চলে গেছে সে’, মিনা আবার বলল।

শূন্য দৃষ্টিতে ত্রিনিদাদ মিনার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভুরু কোঁচকানো, পুরো দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে ভুরু ওর।

‘এখন কী হবে?’ ত্রিনিদাদের প্রশ্ন।

মিনা দৃঢ় গলায় উত্তর দিল।

‘কিছুই না’।

বেলা দশটার আগেই ত্রিনিদাদ বিদায় নিল।

ত্রিনিদাদের নৈকট্যের ভারমুক্ত হয়ে মিনা মরা ইঁদুরগুলি টয়লেটে ফেলে দিতে চলল, যাবার আগে দাদীর কাছে একমুহূর্ত থামল। অন্ধ দাদী তখন গোলাপঝোঁপে ছাঁট দিচ্ছিলেন।

‘বাজি ধরতে পারি, এই বাক্সে কী আছে তুমি বলতে পারবে না’, পাশ দিয়ে যেতে যেতে মিনা ওর দাদীকে বলল।

বাক্সটি নাড়ায় মিনা।

অন্ধ মহিলা মনোযোগী হতে শুরু করে। ‘আবার নাড়া দে’, বলল দাদী। মিনা বাক্সের মরা ইঁদুরগুলি আবার নাড়ায়, কিন্তু পরপর তিনবার শুনেও দাদী বুঝতে পারল না বাক্সে কী আছে।

‘গতরাতে চার্চে পাতা-ফাঁদে ধরা-পড়া ইঁদুর এইগুলো’, মিনা বলে দাদীকে।

ফিরে আসার সময় সে অন্ধ দাদীর পাশ দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে যায়। কিন্তু দাদী ওকে ঠিকই অনুধাবন করে এবং পেছন পেছন যায়। এভাবে বসার ঘরে, যেখানে মিনা একটা বন্ধ জানলার পাশে বসে গোলাপগুলো তৈরি করছে।

‘মিনা’, অন্ধ দাদী বলেন, ‘সুখী থাকতে চাইলে কখনই অচেনা কারো সামনে স্বীকারোক্তি দিস না’।

কিছু না বলে মিনা তাকিয়ে থাকল ওর দাদীর দিকে। অন্ধ মহিলাটি ঠুকে ঠুকে মিনার সামনের চেয়ারে গিয়ে বসল এবং ওর কাজে হাত লাগাতে উদ্যোগী হল। কিন্তু মিনা তা হতে দিল না।

‘তোকে অস্থির লাগছে’, অন্ধ দাদী বলে। ‘প্রার্থনায় যাস নি কেন?’ জিজ্ঞেস করে সে।

‘এটা তুমিই ভাল জান।’

‘এটা যদি জামার হাতা ভেজা থাকার কারণে হত, তাহলে তুই ঘরের বাইরে যেতে দ্বিধা করতিস না’, অন্ধ মহিলা বলতে থাকল, ‘কেউ একজন তোর জন্যে পথে অপেক্ষা করছিল, যার কোন বিষয় তোকে ছন্নছাড়া করে দিয়েছে আজ।’

মিনা দাদীর অন্ধ চোখের সামনে হাত দোলাল, মনে হল যেন মুছে দিচ্ছে কোনো অদৃশ্য কাঁচ।

‘তুমি একটা ডাইনী’, বলল মিনা।

‘সকালে দু’বার টয়লেটে গেছিস’, অন্ধ দাদী বলে। ‘তুই একবারের বেশি কখনই যাস না’।

মিনা গোলাপ বানাতেই থাকল।

‘আলমারির ড্রয়ারে কী রেখেছিস, দেখাবি আমায়?’ দাদী বলে।

মিনা ধীরেসুস্থে ওর অন্তর্বাসের ভেতর থেকে চাবি তিনটা বের করে এবং দাদীর হাতে দেয়। দিয়ে দাদীর হাতের মুঠো সজোরে বন্ধ করে দেয়।‘যাও, নিজের চোখে দেখে আসো’, বলে মিনা।

‘আমার চোখ তো টয়লেটের নিচে দেখতে পায় না’।

মিনা চোখ তুলল এবং তোলার পর ওর একটা অদ্ভূত অনুভূতি হল। মিনা অনুভব করে, অন্ধ মহিলাটি জানে যে এই মুহূর্তে মিনা তার দিকে তাকিয়ে।

‘টয়লেটের নিচে গিয়ে দেখ না কেন, আমার বিষয়ে যখন তোমার এত আগ্রহ’, বলে মিনা।

দাদী এই কথায় আমল দিল না।

‘রাতে শুয়ে শুয়ে ভোর পর্যন্ত কী যেন লিখিস তুই’, বলে দাদী।

‘তুমি তো বাতি নিভিয়েই দাও’, মিনা বলে।

‘আর সাথেসাথেই তুই হারিক্যানটা জ্বালাস’, অন্ধ দাদী বলে। ‘হারিক্যানের আলোয় সারারাত হৃদয়ের গতির সাথে লিখে যাস তুই’।

মিনা শান্ত থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করল। ‘চমৎকার’, মাথা না তুলেই বলল সে, ‘বুঝলাম তাইই করি আমি। তাতে হয়েছে কি?’

‘কিছুই না’ অন্ধ দাদী নিঃশ্বাস নেন। ‘শুধু তোর প্রথম-শুক্রবারের প্রার্থনা মিস হয়েছে।’

দুইহাতে মিনা সুতার গুটি, কাঁচি, আর শেষ-না-হওয়া কাজগুলো নিয়ে উঠে পড়ে। সবকিছু সে বাক্সে রেখে সে অন্ধ মহিলাটির মুখোমুখি হয়। ‘টয়লেটে আমি কেন গিয়েছিলাম, শুনতে চাও?’ জিজ্ঞেস করে মিনা। দু’জনেই একটা টানটান অবস্থার মধ্যে কিছুণ থাকে, যতণ না মিনা নিজেই ওর করা প্রশ্নটির জবাব দেয়:

‘হাগতে গিয়েছিলাম’।

অন্ধ মহিলা চাবি তিনটা বাক্সের ভেতর ছুঁড়ে দেয়। ‘এটা একটা ভাল অজুহাত হতে পারত’, বিড়বিড় করতে করতে দাদী রান্নাঘরের দিকে এগোয়। ‘আমি এটা বিশ্বাস করতাম যদি এই প্রথমবার তোকে আমি কসম কাটতে শুনতাম’। বারান্দার উল্টোদিক থেকে মিনার মা হেঁটে আসে, হাতে অনেকগুলো কাঁটাওলা গোলাপ।

‘কী কথা হচ্ছে?’ মিনার মা জিজ্ঞেস করে।

‘আমি একটা পাগল’, মিনার অন্ধ দাদী এবার নিজের মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে। ‘কিন্তু যতক্ষণ না পাথর ছোঁড়া শুরু করি, ততদিন পর্যন্ত কিন্তু তোরা আমায় পাগলা গারদে পাঠানোর কথা ভাবতে পারবি না’।