শনিবার, ৩০ আগস্ট, ২০০৮

কবিতার পাঠ: ইমরুল হাসানের একটি কবিতা

ইমরুল হাসানের কবিতাটি এল ইমেইলে:


পাগল

কেউ কি আর চেষ্টা করে যাচ্ছে না, তোমার কি মনে হয়?
আড়ালে আড়ালে কতই না শ্রেণীভেদ, শাসিয়ে যাচ্ছে
রাস্তার পাশে তোমাকে দাঁড় করিয়ে যাচ্ছে একা!

ইচ্ছা হয়, উবু হয়ে বসে থাকি, রাস্তার কোণায়
ড্রেনের পাশে, মাথানিচু; আগে, অনেক অনেক আগে যেমন
বসে থাকতো, পাগল! কিছুটা সুশ্রী আর যার সুস্থ হওয়ার আশা
মরে যাই নাই তখনো, তাকে দেখলে মনে হতো যে, সে আর
পাগল হতে চায় নাই, কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে বসে পড়েছে
যা আর স্বাভাবিক নয়, যাকে কিনা বলা হচ্ছে, ভাবা হচ্ছে
সে আর যা নয়, যা সে হতে চায় নাই, যা আসলে আর কিছুই না ...

এমনই একটা র্নিবিকল্প সময়, সন্ধ্যাবেলায়
কতকিছুই না ভাবছে মানুষ-জন, চলে যাচ্ছে, ফুসফাস করে
হাঁপাতে হাঁপাতে পার হয়ে যাচ্ছে, কতকিছুই তো করছে ...
কেউ কি আর ড্রেনের ভিতর থেকে টাকা খোঁজার মতো করে
অন্যকিছু বের করে আনার চেষ্টাটা করে যাচ্ছে না?
তোমার কি মনে হয়?

২৯.০৮.০৮


একঝলক পাঠ, তারপর আবার প্রতিদিনের জীবনে। কিন্তু সেই যে পাগল, যে কিছুটা সুশ্রী, এবং সুস্থ হবার আশা এখনো শেষ হয়ে যায় নাই যার, তাকে তাড়ানো গেল না। আশাহীন যে পাগলামি তাকে ভুলে যাওয়া সহজ, হয়ত জরুরিও, আবার পাগলামিহীনতায়ও কোনো গল্প নেই, মনে রাখাও নেই। প্রতিদিনের এই যে জীবন, পথে-পাওয়া জীবন, এই যে সব মৃদু অস্বস্তি বাড়ি ফিরবার পথে, এই যে একটুকরা বিষাদ... এগুলোই ইমরুলকে কবিতায় উবু করে। মনে হবে যেন মাখনে ছুরি চালাচ্ছে সে, কিন্তু আলাদা যে ইমেজটা হাজির থাকে মনে, কবিতাটি পড়বার বহুদিন পরেও, আমি খেয়াল করি ক্রমে সেটা গ্রানাইটের মত শক্ত হয়ে যায়!

একেকটা ইমেজের এত শক্তি! ভাবি।

ইমরুলের এই কবিতায় (অন্য অনেক কবিতায়ও বোধ করি) কবি কথা বলছে যার সাথে, বা যাকে আসলে কবিতাটি শোনানো হচ্ছে, তার ব্যক্তিত্ব অন্যরকম। সে যেন সব কিছু ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট বোঝে, তাই ইমরুল তাকে নানান ইমেজ দিয়ে, ইমেজের ভেতর গুপ্তির মত প্রশ্ন গুঁজে দিয়ে সংশয়ী করে তুলতে চায়। কবিতা পাড়ার জন্য এমন একজন সঙ্গী পেয়ে যাওয়া বেশ আরামের, কবির জন্য। জরুরিও বটে।

ইমরুলের কবিতা কানের কাছে ফিসফিস করে বলার মত, এবং বলার পর, যিনি বললেন এবং যিনি শুনলেন তারা ভুলে যাওয়ার ভান করবেন সত্যি, কিন্তু ঐ একটা-দুটা ইমেজ থাকবে যা আপনার সংবেদনার নরম মাটিতে গ্রানাইটের মত অনড় হয়ে পড়ে থাকবে। আপনি ভাববেন, ঠিক আছে পরে সরিয়ে দেবেন 'খন, কিন্তু... হাহাহা.... পারছেন কি?

পাগলা ভক্তের ধাওয়া!!


কবিসভায় ব্রাত্য রাইসু এবং আমি (ইমরুল এবং ভাস্করও) দুয়েকটি বিষয় নিয়া তর্ক করিতেছিলাম। আমরা পরস্পরের কিছু কিছু বিষয়ে একমত আর কিছু কিছু বিষয়ে দুইমত হইতেছিলাম। তাতে অনেক বিষয় আমার নাদান-চক্ষে পরিষ্কার হইবার সুযোগ পাইতেছিল, মান্যবর রাইসু-ও তর্কটিকে উপভোগ্য বইলা সায় দিতেছিলেন।

কিন্তু পাগলা ভক্তের মন ইহাতে মানিবে কেন?

ভক্তের মন তাই নানান মোক্ষম কৌশলের আশ্রয় খুঁজিল। একজন বেনামে সুমন রহমানের ভক্ত সাজিলেন। বিপরীত লিঙ্গের এই চরিত্রটি আমার কাছে সুমন রহমানের অনেক লেখা বিষয়ে আপ্লূত প্রশংসা করিলেন, যাতে আমার মহিলাবাঞ্ছা আর ভক্তবাঞ্ছা দুইটাই পুরা হয়। অনেক ইনায়া বিনায়া শেষে তিনি আমার ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর চাহিলেন। কিন্তু ততক্ষণে আমি আমার জানের ওপর খতরা টের পাইয়া গিয়াছি। তাই দরজায় রসুনের মালা ঝোলাইয়া হাতে ক্রুশ লইয়া বইসা রহিলাম। কোনো সাড়া দিলাম না। ফোন নম্বর দিলাম না। এরপর সেই ভক্তের প্রশংসা ক্রমে নিন্দায় পর্যবসিত হইতে থাকিল। স্বস্তি পাইলাম। মনে হইল এই যাত্রা ফাঁড়া কাটিয়া গেছে। বন্ধ দরজার ওপারের মোহনীয় হাসিখানি অবশেষে গগনবিদারী প্রেতচিৎকারিণীরূপে পাহাড়েপর্বতে প্রতিধ্বনি তুলিয়া বিদায় নিলেন।


স্ত্রীজাতীয় আরেকজন নিজনামে কবিসভার যৌথ ডাকবাক্স থিকা আমার ব্যক্তিগত মেইলবাক্সে আছর করিলেন। তিনি আসিলেন এক ‘ভয়ংকর’ ভালবাসার পয়গাম লইয়া। আমাকে নানান বিষয়াদি জিজ্ঞাস করিলেন, যথা: আমি বিবাহিত কি না, আমি দেখিতে ‘উত্তেজক’ কি না, ইত্যাদি। তিনি আমাকে লম্বা লম্বা চিঠি লিখিতে লাগিলেন এবং আমাকেও সেইমত আদেশ করিলেন। কিন্তু আমি একজন ভীতুবিবাহিত মানুষ বিধায় উনার উদাত্ত ডাকে সাড়া দিবার পারি নাই। শেষে আমার ‘অক্ষম’ পুরুষত্বে কুপিত হইয়া তিনি নিজ অভিসন্ধি সরাসরি প্রকাশ করিলেন: আর কোনোদিন যদি আপনি রাইসুরে.......

ইমেইল বাক্স খুলিলেই এইসব ভয়ংকর ভয়ংকর সব হুমকিতে ভরা চিঠি দেখিতে পাই, শেষে মনের দুঃখে ইমেইল ছাইড়া এমএসএন চ্যাটবাক্সে গিয়া ঢুকিলাম। সেইখানে ঘাপটি মাইরা ছিলেন আরেকজন, আমাকে দেখিবামাত্র একখানি জল্লাদের ইমোটিকন দেখায়া ভাগায়া দিলেন। আমি খাবি খায়া পলায়া যাইবার প্রাক্কালে তিনি আবার পেছন পেছন দুইখান ভাইরাস লেলাইয়া দিলেন। ইহার একটি লাগিল আমার কম্পিউটারের উইন্ডোজে। কম্পিউটার ক্র্যাশ করিল। আরেকটি লাগিল আমার ইমিউন সিস্টেমে। আমিও ক্র্যাশ করিলাম।

ভাবিলাম, ভালই হইল একদিকে, পাগলা ভক্তের মন শান্ত হইবেক। আমি ও আমার কম্পিউটার চুপচাপ পইড়া থাকি, মুক ও বধির ইস্কুলে যাওয়া-আসা করি বরং!!

কিন্তু টেলিফোন নামক আরেকটি যন্ত্র যে আছে এই জগতে! সেইখানে হানা দিলেন আরেকজন। বলিলেন, দেখছেন নাকি, আপনেরে নিয়া চিঠি লিখছে আইজগা....

তখনও দেখি নাই। পরে ল্যাচড়াইতে ল্যাচড়াইতে এক সাইবার ক্যাফেতে গিয়া দেখিলাম আরেক ভক্ত। টিপু সাহেব লেখছেন। ভালই লেখছেন। আমার বলিবার কিছু নাই। কারণ উনার স্কুলবিতর্কমার্কা বক্তব্যের উত্তরে আমার যা বলার তা আগের চিঠিতেই বলা আছে। সাশ্রয় করি বরঞ্চ!

একটা প্রস্তাব নিয়া ভাবিতেছি। রাইসু একদা নিন্দাসভার ডাক দিয়াছিলেন। তখন আমি অন্যরকম তর্কে মজিয়াছিলাম। এখন মনে হইতেছে নিন্দাসভা না হইলেও একখানি ভক্তসভা তৈয়ার করা অত্যন্ত জরুরি। যাবতীয় ভক্তকুলের একটা জন্য অভয়ারণ্য খুলিয়া দিলে উনারা যেমন নিজ নিজ আইকনদের ধামা ধরিয়া স্বচ্ছন্দে বিহার করিতে পারিবেন, তেমনি আমাদেরও অনেক তর্কসাশ্রয় হইয়া যাইবে।




ঢাকা, ৩১ মে ২০০৫


বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০০৮

"মধ্যরাতের নদী" নিয়ে মুজিব মেহদীর আলোচনা


পড়েছিলাম 'ময়মনসিংহ জং' নামক একটি লিটল ম্যাগাজিনে। কবি মুজিব মেহদী এই কাগজের সাথে সাক্ষাৎকারে সমসাময়িককালে তাঁর পছন্দের একটি কবিতার কথা বলতে গিয়ে "মধ্যরাতের নদী" কবিতাটির কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিছু আলোচনাও করেছিলেন। সাক্ষাৎকারের সেই অংশটি এখানে ব্লগস্থ হল:

......................
ময়মনসিংহ জং : একটি প্রিয় (অন্যের) কবিতার কথা বলুন। ভালো লাগার কার্যকারণসহ।

মুজিব মেহদী : একজন নিয়মিত পাঠক তাঁর পাঠেতিহাসে অনেক প্রিয় কবিতার সংস্পর্শে আসেন। এই প্রিয়তা আবার সময়ে বদলে বদলে যায়। সময়ে কোনো-কোনোটার প্রতি ভালো লাগা আরো প্রগাঢ় হয়, কোনোটা আর ভালো লাগে না। আবার নতুন নতুন ভালো লাগার কবিতা প্রিয়তালিকায় যুক্তও হয়। আমারও এমন হয়েছে। আমার ভালো লাগা কবিতার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তার ভিতর থেকে একটি কবিতা বেছে নিতে গিয়ে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের মোকাবেলা করতে হলো। কোনটি রেখে কোনটির কথা বলব। যেটির কথা বলব সেটি কি প্রিয়দের সেরা ? তা না হলে তো অবশ্যই অন্য কোনো বিবেচনা দরকার। সেটা কী হতে পারে ? ঠিক করে নিলাম নির্বাচিত কবিতাটিকে হতে হবে বাংলাদেশের কোনো কবির কবিতা এবং আমার সমসাময়িক কোনো কবির। এখানেও দেখলাম অনেক কবিতাই নির্বাচনপ্রার্থী। শেষাবধি আরেকটি বিবেচনা সামনে আনতে হলো। সেটা এই যে, জন্মে না হোক অন্তত কাব্যচর্চায় হলেও কবিকে হতে হবে আমার চেয়ে জ্যেষ্ঠ। এবার বেছে নেয়া গেল সুমন রহমান (১৯৭০) এর ‘মধ্যরাতের নদী’।
সুমন রহমান কবি হিসেবে আমাদের সমসাময়িক, তবে তাঁর কাব্যঅভিযাত্রার সূচনা অন্তিমআশিতে। ঈশান জয়দ্রথ লেখকনামে ১৯৯৪-এ বোরোয় তাঁর ‘ঝিঁঝিট’ নামক প্রথম কাব্যগ্রন্থ। দীর্ঘ প্রায় দেড় দশক পর সুমন রহমান লেখকনামে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সিরামিকের নিজস্ব ঝগড়া’ বেরিয়েছে ২০০৮-এ। কবিতাটি সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সিরামিকের নিজস্ব ঝগড়া’য় অন্তর্ভুক্ত হবারও আগে একাধিকবার পঠিত ওয়েবব্লগ ‘সচলায়তন’ এবং সম্ভবত লিটলম্যাগ ‘মান্দার’-এ।

কোনো শিল্পকর্মের প্রতি ভালো লাগা ব্যাপারটা সবসময় ব্যাখ্যাযোগ্য হয় না। ব্যাখ্যা যাও-বা কোনোরূপে সম্পন্ন করা যায় তা কখনো সর্বজনীন হয় না, ফলত হয় খণ্ডিত ও একপেশে। তবু খণ্ডিতকরণেরই কিছু চেষ্টা হোক।

নদীবহুল বাংলাদেশের কবিতা ও গানে নদীকে নিজের দুঃখের কথা শোনানোর রীতিটি আমাদের ঐতিহ্যসম্পৃক্তই। তবু কবিতাটি অন্যান্য নদীবচন থেকে আলাদা। সাধারণত নদী নিয়ে যেরকম কবিতা লিখিত হয়, কবিতাটিতে সেসব উপাদানের কোনো-কোনোটি হাজির থাকলেও এটি মোটেই সেরকম নয়। নদীসংক্রান্ত লেখায় নদীর চপলতা, নিষ্কলূষতা, সুদূরগমন ক্ষমতা ইত্যাদির প্রশস্তি গান থাকে, কিংবা রাতের নদী হলে তাতে পড়া চাঁদের ছায়ায় প্রিয়তমার মুখাবয়ব দেখাজনিত অধ্যাসের বর্ণনাও থাকে। এখানে সেসব নেই। এই কবিতাটি মহিমান্বিত নদীকে সাক্ষী মেনে একজন কবির নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার শিল্পসৌকর্যে। কবিতাটি পড়তে পড়তে নদীর মতো দীর্ঘ একটি হাহাকার হাতকয় দূর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়, দূরাগত কৃত্রিম আলোকসজ্জাকে ছাপিয়েও একটা নৈশ অন্ধকার সমাসীন বলে যা বস্তুত দেখা যায় না, কিন্তু জেলেনৌকার মৃদুআলোয় বোঝা যায় যে কথকের চোখজোড়া ভিজে উঠছে কবিতার সাথে সম্পর্কের টানাপড়েনে। অন্তত আমার অনুভবে ব্যাপারটি এরকমভাবেই ধরা দেয়। মৃদু অথচ বৃহদায়তন এ বিষাদ আমাকে ছুঁয়ে যায়, কেননা এরকম সংশয় আমার ঝোলায়ও আছে যে, কবিতা আমাকে বুঝতে পারছে কি না বা আমি কবিতাকে। এ বিবেচনায় আমি ভাবি যে, কবিতাকর্মী মাত্রকেই হয়ত কবিতাটি স্পর্শ করবে।

কালের ভারে কাবু শীর্ণতোয়া নদীর পাঁচমিশালী ক্যাজুয়াল গতিভঙ্গির মতো এ কবিতাটিরও কোথাও কোনো দ্রুততা নেই, এখানেও এসে মিশেছে অনেকস্রোত: জলদূষণ কারণে মাছের শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে কবিতা উসকে দেয়া খেয়ালী বালিকা, উঠতি শহরের অকার্যকর ও অপ্রতুল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, কারখানা শ্রমিকের দলবদ্ধ স্নান এবং সবিশেষ কবিতাদাম্পত্যের সাফল্যব্যর্থতা। পরিপার্শ্বকে দেখার বিরল দক্ষতা এবং সেসবকে রঙঢংতাৎপর্যসমেত মূর্ত করে তুলবার যে স্ফূর্তিময় সাফল্য কবি কবিতাটিতে দেখিয়েছেন, তা অনবদ্য। কবিতাটিতে একটি বাড়তি পাওনাও জুটে গেছে উপজাত হয়ে। সেটি এর পরিবেশ চিন্তন। ফলত এটি একটি পরিবেশবান্ধব কবিতারও উদাহরণ হয়ে গেছে।

সুমন রহমান এই কবিতায় কবিতাশিল্পের ক্লিশে অলংকার উপমা ব্যবহারে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। ধরা যাক, শুরুর দিকের ধীরে চলা নীরব নদীর বর্ণনার ব্যাপারটা। কেমন নীরব ও শ্লথ ওই চলন? কবি বলছেন, ‘যেন কারো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাচ্ছে মধ্যরাতের নদী’। কিংবা তৃতীয় অনুচ্ছেদে বর্ণিত ইউরিয়া ফ্যাক্টরির বর্জ্য-জঞ্জালে কাতর ইলিশের পরিণতি বর্ণনা: ‘তবু গুনগুনিয়ে যাচ্ছে নদী, যেন ওর গানের ভেতর ইলিশের/ বোকা-বোকা শ্বাসকষ্ট আছে। সহজ মরণ আছে।’ কিংবা শেষাংশে নিজেদের কবিতাপ্রয়াসকে ছোট শহরের অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সাথে করা তুলনাটা: ‘যেন আমার সম্ভাব্য কবিতা/ঐ উঠতি শহরের পয়ঃনিষ্কাশনের মতোই/একপেশে একটি বধির ব্যবস্থামাত্র!’

আমি কবিতাটির শব্দ নির্বাচন ও সজ্জার শৈল্পিক কারিগরিতে বিশেষভাবে মুগ্ধ। মুগ্ধ এর কেন্দ্রকে পরিপাটি রেখেও পরিপার্শ্বকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারার বিরল ক্ষমতাদৃষ্টে। সুমন রহমানের এ ভ্রমণ কাজেই যুক্ত হয়ে যায় আমার প্রিয় তালিকায়।


মধ্যরাতের নদী

খুব ক্যাজুয়েল, কোন জলদি নাই, যেন নিরবধি -
যেন কারো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাচ্ছে মধ্যরাতের নদী
পাঁচমিশালী ধারাস্রোতের দোটানা-সহ।

আলোকসজ্জার নৈশ অনুরোধ ঠেলে যেতে মন কি তার একদম সরছে না?
নাকি ভুলে গেছে,পাহাড়ের বেণী খুলবার দিনে সেও ক্রন্দনশীলা পথ -

আর জয়দ্রথ
কিংবা আমি
এসে বসলাম পা ডুবিয়ে - ইউরিয়া ফ্যাক্টরির সবুজ বিষ্ঠা মিশছে
ঘুমন্ত ইলিশের ফুলকায়
তবু গুনগুনিয়ে যাচ্ছে নদী, যেন ওর গানের ভেতর ইলিশের
বোকা বোকা শ্বাসকষ্ট আছে। সহজ মরণ আছে।

নদীকে বললাম আমার নানাবিধ পদ্যসম্ভাবনার কথা
এক বালিকার খেয়ালখুশির ভেতর তীব্র বেদনারাশিসমেত
লতিয়ে উঠত ওরা –
যাকে আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম ওর সহচরীদের কাছ থেকে
আগলে রেখেছিলাম পৃথিবীর সবাইকে তস্কর ভেবে

বলতে ইচ্ছা করছে: তাকে হারিয়ে ফেলেছি, অথবা তাকে
কোনদিনই পাই নি
তাকে আমি একদম বুঝি নি, সেও আমাকে নয়
আমি হয়ত তাকে একদিন বুঝে উঠতে পারবো, কিন্তু সে আমাকে
কোনদিনও বুঝবে না

একটি নিঃসঙ্গ জেলেনৌকার আলোয় আমার চোখ
ঝাপসা হয়ে আসছে

নদী বইছে ধীরে, সপ্রতিভ উপেক্ষার অল্প অল্প ঘূর্ণি ওর গায়ে
যেন আমি যে গল্পটি বলছি সেটি বহুবার তার বহুজন থেকে শোনা
যেন তার তীরে তীরে পুনরাবৃত্তি বোনা

যেন কোন উচ্চাভিলাষী শহরের পাশ দিয়ে
একবারও বয়ে না-গিয়ে
আমার বুঝবারই কথা নয় দাম্পত্য কাকে বলে
যেন আমার সম্ভাব্য কবিতা
ঐ উঠতি শহরের পয়ঃনিষ্কাশনের মতই
একপেশে একটি বধির ব্যবস্থামাত্র!

সমবেত স্নান শেষে শ্রমিকদের হল্লা মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে
ছুটি চেয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলছে ঘাটগুলো, যেন আমি উঠে গেলেই
একযোগে নাইতে নামবে –
সারাদিনের কান্তি আর লোহার অ্যাংকরের খামচিগুলোতে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে
ঘুমাতে যাবে তারা।

মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০০৮

সাহিত্য কি আমাদের বিপক্ষে? : অন্ধত্ব ও সাহিত্য নিয়ে কেনেথ জার্নিগান-এর রচনা



সাহিত্যের উপাদান হিসেবে অন্ধত্বকে খোদ অন্ধরা কিভাবে মূল্যায়ন করে? আমেরিকার ন্যাশনাল ফেডারেশন অব দ্য ব্লাইন্ড এর ড. কেনেথ জার্নিগান-এর এই লেখাটি সাহিত্যের সেই চেহারা তুলে ধরেছে যেখানে চক্ষুষ্মান সাহিত্যিকগণ চক্ষুহীন মানুষকে সাহিত্যের উপাদান করতে গিয়ে তাদের স্বাভাবিক জগতের বাইরে ছুঁড়ে দিয়েছেন। এমন কি জন মিল্টনের মত খ্যাতিমান অন্ধ সাহিত্যিকেরাও, কেনেথ বলছেন, এইসব জনপ্রিয় ধারণার ফাঁদে পড়ে গিয়ে অন্ধত্ব নিয়ে দৃষ্টিবান মানুষ যা ভাবতে পছন্দ করে তারই প্রতিধ্বনি করেছেন।

কেনেথ-এর মতে, অতীতকালের সাহিত্য যেখানে অন্ধত্ব বিষয় হিসেবে এসেছে তা মোটেও অন্ধদের বাস্তবতাকে সমর্থন করে না, ফলত অন্ধদের জীবনে সেসব মোটেও কোনো উৎসাহ জোগায় না। বর্তমানের সাহিত্যে বেশ কিছু ইতিবাচক মোড়বদলের কথা তিনি বলেছেন, যদিও রেফারেন্স দেন নি। অবশ্য কেনেথ-এর বক্তব্য তৈরি হয়েছে প্রধানত তার চিরায়ত ইংরেজি ও ফরাসী সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা থেকে। আর সাহিত্যের কাছে তার প্রত্যাশার ধরনটিও বিতর্কের বিষয় হতে পারে।

["দেখা না-দেখার চোখ" এ এই অনুবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল]



ইতিহাস যেমন মানুষের কৃতকর্মের সন্নিবেশ তেমনি সাহিত্য হল তার চিন্তার সমাবেশ। আমি এখন বলতে চেষ্টা করব সাহিত্যে অন্ধদের উপস্থাপনার ধরন নিয়ে। কীভাবে দেখা হয়েছে আমাদের সেখানে? আমাদের ভূমিকা কী? কবি, উপন্যাসিক, প্রবন্ধকার ও নাট্যকারগণ কী ভেবেছেন আমাদের নিয়ে? অন্ধত্ব জিনিসটা আসলে যেরকম তারা কি সেইরকমই দেখেছেন, নাকি তারা যেরকম দেখতে চেয়েছেন, অন্ধত্বকে সেইরকম করেই তুলে ধরেছেন?

সাহিত্যে অন্ধজীবন নিয়ে কোনো একক বা একটি সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি নেই। বরং দেখা যায় সাহিত্য অনেকগুলো বিচিত্র এবং পরস্পরবিরোধী অন্ধত্বের ইমেজ হাজির করছে, সেটি শুধু যুগ বা সংস্কৃতিভেদে নয়, শুধু লেখকভেদে নয়, এমন কি একই বইয়ের বিভিন্ন পৃষ্ঠায়ও এই বৈপরীত্য বিদ্যমান।


বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাহিত্যে অন্ধত্বের বিষয়টি মোটামুটি নয় ধরনের বিষয়াশ্রিত হয়ে এসেছে: অলৌকিক ক্ষমতারূপে, নিরুদ্ধার ট্রাজেডী হিসেবে, নির্বুদ্ধিতা ও অসহায়ত্বের পূর্বগামী হয়ে, ধূর্ততা আর শয়তানি সহযোগে, নিখাদ পূণ্যের সহগামী হিসেবে, পাপের শাস্তিরূপে, অস্বাভাবিকতা এবং বিমানবিকীকরণের সূত্রপাত হিসেবে, শুদ্ধতার প্রতীকরূপে, অন্য কিছুর প্রতীক বা রূপক হিসেবে।

অলৌকিক বা আল্লাপ্রদত্ত ক্ষমতা হিসেবে অন্ধত্ব সাহিত্যে কিভাবে চিত্রিত? ধরা যাক আপনাদের কেউ আমায় জিজ্ঞেস করলেন, অন্ধ হওয়ার কি কি সুবিধা আছে বলে আমি মনে করি? এবং ধরা যাক আমি উত্তর দিলাম: কোনোই সুবিধা নেই, তবে এমন কিছু দিক আছে যা হয়ত আমরা ভেবে দেখি না। আবিষ্কারের জন্য একটা নতুন জগত, নতুন এবং অভিনব প্রত্যণ, নতুন জেগে উঠা মতা; অন্ধ জীবন চতুর্থ মাত্রার জীবন। এরকম শুনলে একজন অন্ধ হিসেবে আপনি কী বলবেন? অনুমান করি, হাসতে হাসতে বিষম খাবেন। আমার মনে হয় না এইসব বস্তাপচা বোকাভাষণ কাউকে আকৃষ্ট করবে। আপনারা এবং আমি নিজের মুখে ঝাল খাওয়া অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, অন্ধত্বের কোনো চতুর্থ মাত্রা নেই, অন্ধ হলে কোনো অলৌকিক ক্ষমতা জাগ্রত হয় না, কোনো অদ্ভূত অনুভূতি হয় না, উন্মোচিত হবার জন্য নতুন কোনো জগত এসে হাজির হয় না। কিন্তু আমি যে উদ্ধৃতি দিয়েছি সেটি কিছুকাল আগের এক জনপ্রিয় উপন্যাস থেকে নেয়া।

অলৌকিক বা প্রকৃতিপ্রদত্ত মতার সাথে অন্ধত্বের এই যে মেলবন্ধন, এটি সাহিত্যে একটি সর্বজনমান্য ঐতিহ্য, চিরায়ত পূরাণকাহিনীগুলোতেও এর শেকড় আছে। প্রাচীন গ্রিসের দেবতাদের মধ্যে মানুষকে শাস্তি দেয়ার একটা পছন্দনীয় প্রথা ছিল অন্ধ করে দেয়া। একে সাধারণভাবে মৃত্যুর চেয়েও খারাপ মনে করা হলেও, কখনো কখনো, দেবতার কৃপায় সেই অন্ধ হয়ে যাওয়া শাস্তিগ্রহীতা ব্যতিক্রমী কিছু ক্ষতিপূরণও পেয়ে যেতেন: যেমন ভবিষ্যকথন ক্ষমতা। মনে করা হয়, হোমার তার অন্ধত্বের ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেয়েছেন কবিত্বশক্তি। একইভাবে, সফোকিসের নাটকে যে টাইরেসিয়াসকে পাওয়া যায়, অন্ধ হবার বদলে নবুয়তপ্রাপ্তি ঘটেছিল তার।

উনবিংশ শতাব্দীর মহান উপন্যাসিক ভিক্টর হুগো’র ‘দ্য ম্যান হু লাফস’ উপন্যাসে অন্ধত্ব নিয়ে আধুনিক লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গি মেলে। সেখানে অন্ধত্ব শুদ্ধতা ও আনন্দের সহযোগী হয়েছে, যা কোনোভাবে দৃষ্টিহীনতাকে পুষিয়ে দিচ্ছে। তার উপন্যাসের অন্ধ নায়িকা দিয়াকে দেখা যায় এক পরমানন্দে বিভোর হয়ে থাকতে, যেটা অন্ধের পক্ষে বেমানান ঠেকে। এই পরমানন্দ কখনো কখনো আত্মার গহীনে অনুধাবনের জন্য অন্ধদের এক সঙ্গীত উপহার দেয় এবং তার মাধ্যমে তাদের অন্ধকার জীবনকে আলোকিত করে তোলে। হুগো’র মতে অন্ধত্ব হল সেই অন্তহীন গুহা যার মধ্যে অসীমের ঐকতান ধরা দেয়।

সম্ভবত, জনপ্রিয় কল্পকাহিনীর অন্ধ গোয়েন্দাদের কীর্তিকলাপের মাধ্যমেই অন্ধত্বের সাথে ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের যোগাযোগ পরিস্ফুট হয়। ম্যাক্স ক্যারেডস নামের ফোর্থ ডাইমেনশনাল চরিত্রটি আবির্ভূত হয়েছিল ১৯১৪ সালে এবং গোটা বিশের দশক ধরে নানান অতিমানবীয় ঘটনার নায়ক হয়ে থেকেছে সে। ১৯১৫ সালে আমরা পাই ডেমন গন্ট নামক আরেকজন অন্ধ গোয়েন্দাকে, যিনি একটা কেসও হারেন নি। এই তালিকায় থর্নলে কল্টন, ডানকান ম্যাক্সেইনসহ আরো অনেক চরিত্রের নাম যোগ করা যায়। যেমন হয়েছে গোয়েন্দা ডানকানের চরিত্রের বেলায়। এখানে ডানকানের নৈপুণ্যের ছটায় তার স্রষ্টাই ঢাকা পড়ে গেছেন। তবু এমন কিছু মুহূর্ত আসে, ডানকানের স্রষ্টা লিখেছেন, যখন সাধারণ মরণশীল মানুষের ক্ষমতার অতিরিক্ত কিছু মতা ডানকানের অধিগত হতে দেখা যায়। এসব মুহূর্ত তাকে উদ্বিগ্ন করে।

তারা সেইসঙ্গে আমাদেরও উদ্বিগ্ন করেন। অন্ধত্বের সাথে এসব অস্বাভাবিক এবং অতিমানবিক ক্ষমতারোপ নিঃসঙ্গ ও আলাদা, অসহজ এবং উদ্ভট একটি বস্তাপচা চরিত্রের আদলে ভাবা থেকে অন্ধকে একটুও রেহাই দেয় না। বরং পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটায়।

এটি শুধু অসত্যই নয়, অন্ধদের জন্য নেতিবাচকও। কারণ এতে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, কোনো অন্ধ মানুষ যা অর্জন করল তা নিজের যোগ্যতায় নয়, বরং অন্ধত্বে নিহিত কোনো ম্যাজিকের বদৌলতে। অন্ধত্বের ওপর এহেন অতিমানবীয় ক্ষমতারোপ এক লহমায় সাধারণ বাস্তবতা থেকে উঠিয়ে নিয়ে অন্ধকে দাঁড় করায় অস্বাভাবিকতার উদ্ভট এক মঞ্চের ওপর। অথচ অতিমানবীয় বা অস্বাভাবিক যাই হোক, এটিই ধ্রুবসত্য যে, অন্ধের কোন দায় নেই, অধিকার নেই, সমাজ নেই এই পৃথিবীতে।

কৃতকর্মের পুরষ্কার হিসেবে প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতা অর্জনের ধারণা অন্ধের জন্য কোনোভাবেই প্রশংসাসূচক নয়, বরং অপমানকর। এই ধারণা আমাদের যাবতীয় অর্জনকে ছিনিয়ে নেয়, এমন কি আমাদের ব্যর্থতার দায়ও আমাদের বহন করতে দেয় না। এই ধারণা অন্ধের জন্য একটা সুষম সমাজ গঠনের দায় থেকে বিদ্যমান সমাজকে মুক্তি দিয়ে দেয়। চারপাশের জীবনে উদ্দাম ও সমান অংশগ্রহণের সামর্থ অর্জনে আমাদের মোটেও উদ্দীপ্ত করে না। সংক্ষেপে এই ধারণা অনুযায়ী, অন্ধ অসাধারণ হতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই সাধারণ হতে পারে না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমরা অতি সাধারণ অন্ধলোক, আশির্বাদপুষ্টও নই, অভিশপ্তও নই।

অন্ধত্বের ওপর প্রকৃতিদত্ত মতারোপের ধারণা নেতিবাচক হলেও অনেক কম ক্ষতিকর, সাহিত্যে অন্ধত্বের সাথে এর চেয়েও ক্ষতিকর অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে। সবচেয়ে তিকর ধারণাটি আবার সবচেয়ে প্রাচীনও: সেটি হল অন্ধত্বকে একটি সম্পূর্ণ ট্রাজেডী হিসেবে দেখা। একটি হিব্রু প্রবাদ আছে, অন্ধলোক হল মৃত মানুষের মত। অন্ধকে জীবন্মৃত করে উপস্থাপনের চরম নিদর্শন পাওয়া যায় ইদিপাসকে নিয়ে লেখা গ্রিক নাটকগুলোতে। ইদিপাস রেক্সে রাজা নিজেই যখন নিজের চোখ তুলে ফেললেন তখন নাট্যকার বলছেন: অন্ধ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই ভাল ছিল। এই ঐতিহ্যের বিস্তার ঘটে ইংরেজি সাহিত্যেও। সেখানে একজন কবি, নিজেও যিনি অন্ধ, অন্ধত্বকে মহাদুর্যোগ আখ্যা দিয়ে শেষকথা বলছেন। স্যামসন অ্যাগনেষ্টিজ-এ জন মিল্টন:
শত্রুবেষ্টিত অন্ধের চেয়ে অনেক ভাল ছিল বন্দী হওয়া, পাতালে নিক্ষিপ্ত হওয়া, ভিক্ষা করা, বা ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া। তুচ্ছাতিতুচ্ছ পতঙ্গজীবনও আমার চেয়ে ভাল। তারা হামাগুড়ি দিয়ে চলে, তবুও তো দেখতে পায়। আমি, আলোর মধ্যে অন্ধকার, প্রতিদিনের প্রতারণা, প্ররোচনা, ঠগবাজি বা ভুলভালের কাছে প্রতিদিন ধরা খাই। দরজা খোলা থাকা না থাকা আমার জন্যে সমান, সেটা অন্যের বিষয়, আমার নয়। অর্ধেকের কম আমি জীবিত, অর্ধেকের বেশি আমি মৃত, একটা চলমান কবর।

এই মহাকাব্যিক কবিতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় এর মহাদুর্যোগ পরিস্থিতি নয়, উল্লেখযোগ্য হল আমাদের মহাকবি মিল্টন এর রচয়িতা। তার সব মহৎ রচনা (প্যারাডাইজ লস্ট সহ) লিখিত হয়েছে তিনি অন্ধ হয়ে যাবার পরে। তাহলে তিনি কেন অন্ধত্বকে এমনভাবে দেখতে গেলেন? উত্তরটা সহজ: আমরা অন্ধরা নিজেদের অবস্থাকে সেভাবে দেখতে চেষ্টা করি, যেভাবে চক্ষুষ্মান মানুষ আমাদের দেখতে চায়। এমন কি, যখন আমরা বুঝি ঐ দৃষ্টিভঙ্গি একদম ভুল, তারপরও সেই মতামতটিকেই আমরা নিজেদের ওপর চাপাতে দিই বা চাপিয়ে নিই। এভাবে অনেক সীমিত ও খণ্ডিত অনুধাবন আমাদেরই সহায়তায় আমাদের বাস্তবতা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে থাকে। সাহিত্যের গতানুগতিক ঐতিহ্য দ্বারা চালিত হয়ে মিল্টন নিজের এবং তাবৎ অন্ধদের জন্য একটি ভুল দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দিলেন। সত্যি বলতে কি, মিল্টন বরং অন্ধত্ব নিয়ে সাবেকী বস্তাপচা মতামতগুলোর পালেই হাওয়া দিলেন, এবং সেটি তিনি করলেন তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিপক্ষে গিয়ে। সাহিত্যের ক্ষমতা সত্যিই অনেক!

এক শতাব্দী পর অন্ধত্বের দুর্যোগের ধারণাটি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠে। কিপলিং-এর ‘দ্য লাইট দ্যাট ফেইলড’ পুস্তকে বলা হয়, অন্ধত্ব মৃত্যুর চেয়েও খারাপ। এই বইয়ের নায়ক যখন জানতে পারে যে, সে অন্ধ হতে চলেছে, তখন বলে: এটা হল চলমান মৃত্যু। অন্ধকারে আমাদের নিশ্চুপ হয়ে থাকতে হবে এবং আমরা কাউকেই দেখব না, যা চাই তা কোনোদিনই পাব না, শতবছরও যদি বাঁচি। পুস্তকটির পরবর্তী অংশে নায়ককে দেখা যায় সমগ্র পৃথিবীর বিরূদ্ধে আক্রোশে ফেটে পড়তে, যেহেতু সেই পৃথিবী দেখতে পায়, যেখানে সেই নায়ক অন্ধের মৃত্যুর মাঝে মৃত হয়ে আছে, সহযোগীদের কাঁধে দুর্বহ বোঝা হয়ে। যখন এই আত্ম-অনুকম্পায় ভরা চরিত্রটি আত্মহত্যা করতে সমর্থ হয় (কী যে স্বস্তির খবর!) কিপলিং বলে ওঠেন যে, এই অন্ধ নায়কের ভাগ্য শেষপর্যন্ত ওর সাথে প্রতারণা করে নাই, কারণ সে একটা দয়ালূ বুলেট অন্তত নিজের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে।

‘দ্য এন্ড অব দ্য টিদার’ উপন্যাসে জোসেফ কনরাড তার চরিত্র ক্যাপ্টেন হুয়েলীকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করেন, কারণ সেটি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে অনেক ভাল। ডি এইচ লরেন্সের উপন্যাস ‘দ্য ব্লাইন্ডম্যান’ এ মরিস যুদ্ধে অন্ধ হয়ে যায়, ভবিষ্যতের কোন সোনালি ইঙ্গিতই তার দুর্দশা লাঘব করে না। ‘ইনভাইটেশন টু দ্য ওয়াল্টজ’ উপন্যাসে লেখক রোজামন্ড লেম্যান আরো এককাঠি সরেস। তার উপন্যাসের যুদ্ধে-অন্ধ-হওয়া চরিত্রটি সমাজে সম্মানজনক জীবন যাপন করলেও, কোনো কাজে লাগে না, যেন একটা চলতে ফিরতে থাকা লাশ। যখন সে তার প্রাক্তন প্রেমিকার সাথে নাচে তখন পরিস্থিতি খুব বেদনাদায়ক হয়ে উঠে। অন্ধলোকটি তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে নিবিড় করে ধরে রাখলেও প্রকৃত প্রস্তাবে সে তখন অনেক দূরে, সঙ্গীত থেকে, জীবন থেকে, সমাহিত এবং পছন্দশূন্য। আর প্রেমিকা আসলে ঐ অন্ধলোকটির চক্ষুষ্মান যুবক বয়স আর বর্তমানের মৃত্যুর সাথে নাচে।

এই লেখকেরা মনে করেন, অন্ধত্বের তথাকথিত ট্রাজেডী এতটাই দুর্বহ যে, খোলা আছে দুইটি রাস্তা: হয় চোখ ফিরে পাওয়া, নয় মরে যাওয়া।

দেখা যাক অন্ধত্বের সাথে নির্বুদ্ধিতা আর অসহায়ত্বের প্রসঙ্গকে কিভাবে মেলানো হয়েছে। প্রাচীন কাল থেকেই অন্ধরা রগড় নাটক ও প্রহসনে উপহাসের বিষয় হয়ে থেকেছে। প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন রগড় নাটক ও প্রহসনে অন্ধরা উপহাসের বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে। মধ্যযুগে দেখা যেত অন্ধরা গাধার কান লাগিয়ে পথে পথে ঘুরছে, হাতপা নেড়ে উল্টাসিধা কথা বলে জনগণের মনোরঞ্জন করছে। এই ধারাবাহিকতায় চসার তার ‘মারচেন্টস টেল’এ এক তরুণী বধুর কথা বলেন যে এক অন্ধ বুড়োকে বিয়ে করে। স্বামীর সঙ্গে বাইরে ঘুরতে গিয়ে ঐ বধু তার গোপন প্রেমিকের সঙ্গে গাছের আড়ালে অভিসার করে অন্ধ স্বামীর সামনে। চসার সেখানেই থামেন না, বলতে থাকেন, সেই মোম সময়ে ঐ তরুণীর স্বামী হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায় এবং স্ত্রীকে গোপন প্রেমিকের সাথে অভিসাররত দেখতে পায়। কিন্তু চালাক স্ত্রী সাথেসাথেই অজুহাত খাড়া করায়: ঐ অভিসার আসলে ছিল স্বামীর দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশায়! শেক্সপিয়ারে অবস্থা আরো খারাপ। ‘কিং লিয়র’এ তিনি যে অন্ধ গ্লকেস্টারকে উপস্থাপন করেন, সে এতটাই অসহায় আর দ্বিধাগ্রস্থ যে, যেকোন কিছু দিয়েই তাকে ভজানো যায়, প্রতারিত হবার জন্য একেবারে আদর্শ চরিত্র।

অন্ধদের নিয়ে মজা করার রূঢ়তম দৃষ্টান্তটি পাওয়া যায় ষোড়শ শতাব্দীর এক জার্মান নাটকে। নাটকের নায়ক তিনজন অন্ধ ভিক্ষুককে একটা মূল্যবান মুদ্রা ভিক্ষা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন যেটা দিয়ে তারা খাদ্যসামগ্রী ও থাকার ব্যবস্থা করতে পারে। সেই মুদ্রা আসলে কাউকেই দেয়া হয়নি, আর তিনজন অন্ধের প্রত্যেকেই মনে করল অন্যজনকে মুদ্রাটি দেয়া হয়েছে। পরের অবস্থাটি সহজেই অনুমেয়।

অসহায় অন্ধলোক একটি সার্বজনীন ধারণা হয়ে উঠেছে। মেটারলিংক-এর ‘দ্য ব্লাইন্ড’ নাটকে দার্শনিক অবস্থান থেকে সবগুলো চরিত্রকে অন্ধ দেখানো হয়েছে। কিন্তু মঞ্চে গিয়ে দেখা গেল দর্শন নয়, বরং অন্ধদের হাস্যকর দলবাজি, হুমকিধামকিই ঐ নাটকের সার।

‘লা সিম্ফনি প্যাস্টোরাল’ এর আঁন্দ্রে জিদ হলেন অন্ধত্বের প্রকৃত সত্যের সবচেয়ে খারাপ বিরূদ্ধবাদীদের একজন। সেখানে অন্ধ কিশোরী গারট্রুড একেবারে নির্বোধ কিসিমের ছিল, প্যাস্টর এসে ওকে লেখাপড়া শিখাতে শুরু করার আগে। অন্ধত্বের কারণেই এই নির্বুদ্ধিতা, লেখক বলেন, দৃষ্টি না থাকায় কিশোরীটি সত্য সম্পর্কে জানতে পারে না। শিক প্যাস্টর তার ছাত্রী গারট্রুড-এর জন্য যে জগত তৈরি করে, সেখানেই অন্ধ গারট্রুড সুখেস্বাচ্ছন্দ্যে কাটায়। সত্যিকার জগতের খারাপ দিক সম্পর্কে কিশোরীটি কিছুই জানতে পারে না। দৃষ্টি না থাকায় সে পাপ সম্পর্কেও সচেতন নয়, আপেল খাওয়ার আগের আদম-ঈভের মত। গারট্রুড যখন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল, তখনই কেবল সে পাপ সম্পর্কে অবগত হল। না বুঝে প্যাস্টরের সাথে যেসব পাপকাজ সে করেছে, সেগুলোর অপরাধবোধ তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে।

সাহিত্যে অন্ধত্ব যেমন নির্বুদ্ধিতার অনুষঙ্গ হয়ে এসেছে, তেমনি এসেছে ধূর্ততার অনুষঙ্গ হয়েও: একেবারে খাঁটি শয়তানির মূর্ত মানবীয় রূপ হয়ে। স্টিভেনসনের ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’ এর বুড়ো জলদস্যু অন্ধ পিউ এর জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। উপন্যাসের নায়ক কিশোর জিম হকিন্স অন্ধ পিউকে যখন প্রথম দেখে তখনই তার মনে হয়েছে এই মৃদুভাষী এবং চোখহীন মানুষটির চেয়ে ভয়াবহ কোন চরিত্র সে জীবনেও দেখে নাই। যখন পিউ তাকে ক্রাচ বাগিয়ে ধরে ফেলে, জিমের মনে হয়েছে, এই অন্ধ লোকটির কণ্ঠের চেয়ে নিষ্ঠুর, ঠাণ্ডা আর কুৎসিত কণ্ঠও সে কোনোদিন শোনে নাই।

বহুযুগ ধরেই অন্ধত্ব ও নিচুতার সম্পর্ক সাহিত্যিকদের একটা প্রিয় প্রসঙ্গ, এবং পাঠকদের মধ্যেও এই সম্পর্কের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে, যেহেতু পাঠকেরা নানা লোককাহিনী থেকে শিক্ষা পেয়েছে যে, অন্ধত্ব মানবিক গুণাবলী হ্রাস করে। এই শিক্ষা অন্ধ বিষয়ে চক্ষুষ্মান সাধারণ মানুষের নিষ্ঠুরতার অ্যাটিচুডকে সমর্থন করে।

নিখাদ শয়তানির অনুষঙ্গে অন্ধত্বকে যেমন দেখা হয়েছে, এর বিপরীতে কোনো কোনো সাহিত্যে আবার অন্ধত্ব উপস্থাপিত হয়েছে পরম পূণ্যরূপে। আপাতভাবে এই দুটো দৃষ্টিভঙ্গিকে পরস্পরবিরোধী মনে হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে তারা একই মুদ্রার এপিঠওপিঠ। অন্ধত্বের প্রকৃত বাস্তবতা তুলে ধরার মত জোরালো অন্তর্দৃষ্টি কোনটিতেই পাওয়া যায় না। একটা বিষয়ে এই দুই দলই একমত: অন্ধত্ব হচ্ছে একটা অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা যা তার বহনকারীকে স্বাভাবিক জীবন থেকে পুরোপুরি উৎপাটিত করে।

অন্ধত্বকে হয় পাপ বা শয়তানির ফসল হতে হবে, নয় তাকে হতে হবে পূণ্যের অনুষঙ্গ। লরা রিচার্ডস এর ‘দ্য ব্লাইন্ড চাইল্ড’এ দেখা যায় অন্ধ শিশুটি গাছের বাকলে হাত রেখে বলে দিচ্ছে গাছের নাম, বলে দিচ্ছে কখন ফুল আসবে এবং কিভাবে। গ্রামে এমন কোনো কুকুর বিড়াল নেই যে ঐ শিশুর একটি ডাকে প্রভুর নাম ভুলে ছুটে আসবে না। সে শুধু পূণ্যবতীই নয়, পাশাপাশি যাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী। অগ্নিকাণ্ড থেকে এক শিশুকে রা করে, গান গেয়ে মানুষকে রোগমুক্ত করে, পাঁড় মদ্যপের মদের নেশা ছাড়িয়ে দেয়।

অন্ধত্ব নিয়ে যাবতীয় রোমান্টিক হেঁয়ালিপনার মধ্যে সবচেয়ে উদ্ভট হল, অন্ধত্বকে ছদ্মবেশী আশির্বাদ মনে করা। জন জি মরিসের ‘দ্য ব্লাইন্ড গার্ল অব উইটিনবার্গ’এ অন্ধ নায়িকাকে বলা হচ্ছে: ঈশ্বর তোমায় চোখের আলো থেকে বঞ্চিত করেছেন বলেই তোমার হৃদয় আরো মহান আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। আমার পরিচিতি এমন কোনো অন্ধ মেয়ে নেই যে এরকম অপমানসূচক এবং উদ্ভট বক্তব্য প্রদানকারীর গালে অন্তত একটি চড় না বসিয়ে ছেড়ে দেবে। তারপর এই অন্ধ নায়িকাকে দিয়ে প্রত্যুত্তরে যা বলানো হল তা আরো মারাত্মক: সে বলল, মহাত্মন আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন আমাদের অন্তর্জগত আপনাদের চেয়ে সুন্দর, এবং আপনাদের সূর্যের চেয়ে আমাদের অন্তরের আলো উজ্জ্বলতর?

কল্পকাহিনীতে আরেকটা সুপ্রাচীন এবং অন্যতম নিষ্ঠুর ধারণা হল, অন্ধত্ব হচ্ছে পাপের ফল। ঈদিপাস অন্ধ হন মাতৃসহবাসের কারণে, বেলেল্লাপনার কারণে চোখ হারান শেক্সপিয়ারের গ্লুকেস্টার। এর অব্যবহিত পরের ঘটনা হল, অন্ধত্ব শুদ্ধতা অর্জনের একটা স্তর, যে স্তরে কোনো মানবীয় চরিত্র আগের পাপতাপ ঝেড়ে পূণ্যবান হয়ে উঠতে পারে। যেমন দেখা যায় কিংসলের ‘ওয়েস্টওয়ার্ড হো’ এ অ্যামেয়াস লেই বজ্রপাতে অন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাতারাতি অপরাধী থেকে সাধুতে পরিণত হয়।

এ সমস্ত বিখ্যাত কল্পকাহিনীর মধ্যে অন্ধত্বকে মানবিকতা-বহির্ভূত কিছু একটা দাঁড় করানোর একটা প্রবণতা থেকেই গেছে। অন্ধত্ব যেন স্বাভাবিক জীবন বা মানবিক সম্পর্ক থেকে নির্বাসনের দরজা। ডিকেন্সের বার্থাই হোক, বা লিটনের নিদিয়াই হোক, প্রেমে পড়ে তারা ভুলেও ভাবে না যে তাদের কাক্সিতজনেরা তাদের প্রেমে পড়বে।

সর্বশেষ যে প্রবণতাটি দেখা যায় তা হল, অন্ধত্বকে আক্ষরিক অর্থে না নিয়ে প্রতীকী অর্থে নেয়া, ব্যঙ্গ বা প্যারাবল তৈরির জন্যে। লোকসাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র সর্বত্রই এই প্রবণতাটি অন্ধত্বকে মৃত্যু বা নরকযন্ত্রণার প্রতীক হিসেবে দাঁড় করায়, অথবা শারীরিক অন্ধত্বের প্রতীকে মানসিক অন্ধত্বকে মূর্ত করে তোলে। এই ক্যাটাগরিতে পড়বে এইচ জি ওয়েলস-এর ‘দ্য কান্ট্রি অব দ্য ব্লাইন্ড’, পল কোরে’র ‘দ্য প্লানেট অব দ্য ব্লাইন্ড’, মেটারলিংক-এর ‘দ্য ব্লাইন্ড’ ইত্যাদি। এছাড়াও কনরাড আইকেন-এর ছোটগল্প ‘সাইলেন্ট স্নো, সিক্রেট স্নো’-এ অন্ধত্বকে স্কিজোফ্রেনিয়ার রূপক হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এ সমস্ত উপস্থাপনায় অন্ধত্বকে দেখানো হয়েছে অজ্ঞতা ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের প্রতীকরূপে, স্বাভাবিক ধারণা ও মূল্যবোধের উল্টো অবস্থার প্রতীকরূপে, এবং মৃত্যুর চেয়ে খারাপ বা মৃত্যুসমান অবস্থার প্রতীকরূপে।

সাহিত্যের এই সমীক্ষা থেকে কী শিক্ষা নিতে পারি আমরা? কী বলতে চেয়েছে সাহিত্য আদতে? একটা শিক্ষা এটি যে, এই সমস্ত সাহিত্যকর্মের বদৌলতে আমরা এমন একদল তথাকথিত বিশেষজ্ঞ খুঁজে পেয়েছি যারা এই সাহিত্যের জ্ঞান সম্বল করে অন্ধত্ব নিয়ে গবেষণা করে নানান অশ্বডিম্ব প্রসব করছেন। তাদের মতে, অন্ধত্ব কেবল নিছক দৃষ্টিহীনতা নয়, বরং একজন মানুষের সম্পূর্ণ রূপান্তর। কোনো মানুষের কাছে তার অন্ধত্ব নিছক চোখ হারানোর গল্প দিয়েই শেষ হয় না, আসলে সেটি মৃত্যুসমান, সত্তার ওপর এক বিশাল আঘাত। তারা বলেন, চোখ হল সেক্স সিম্বল, তাই অন্ধ মানুষ কখনই পূর্ণ মানুষ নয়।

শিরোনামের প্রশ্নে ফিরে যাই: সাহিত্য কি আমাদের বিপক্ষে? এই প্রশ্নের সর্বজনগ্রাহ্য কোনো জবাব নেই। শুধু অতীত আমলের সাহিত্য নিয়ে যদি আলাপ হয়, তাহলে প্রশ্নের জবাব হবে, হ্যাঁ। সমসাময়িক সাহিত্য নিয়ে আলাপ হলে মিশ্রজবাব হবে। অন্ধত্বের ধারণায় অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন সমসাময়িক সাহিত্যে পাওয়া যায়, যদিও বস্তাপচা সাবেকী ধারণাগুলোই এখন পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় এটা যে, সমসাময়িক কালে এই সব ধারণা উৎসাহ পাচ্ছে আমাদের তথাকথিত অন্ধ বিশেষজ্ঞদের উদ্ভট গবেষণা থেকেই।

ভবিষ্যতের দিকে যদি ঐ প্রশ্ন নিয়ে তাকাই, জবাব হবে, ভবিষ্যতের সাহিত্য বর্তমান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যেমন বর্তমানের জীবন পারে না ভবিষ্যতের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অন্ধ জীবনগুলোকে সাজিয়ে তোলার মাধ্যমে আমরাই ভবিষ্যতের সাহিত্যকে নির্দেশনা দিতে পারব। অন্ধত্ব একটা ট্রাজেডী ততক্ষণই, যতক্ষণ আমরা এই সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গিটিকে মান্য করি। আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ একটাই: আমাদের সময়কে অন্ধত্ব নিয়ে সচেতন ও সবিবেক হতে সাহায্য করা। কল্পকাহিনীর ফ্যান্টাসী থেকে মুক্ত হয়ে সেগুলোকে বাস্তবতার নির্যাস দিয়ে ভরে দিতে হবে। তখনই কেবল আমরা সেই সাহিত্যের জন্য রাস্তা তৈরি করতে পারব যা বাস্তবতার সুবাস ধারণ করবে, সত্যের অপলাপ হবে না, সাহিত্য পড়ে আমরা সেখানে নিজেদের খুঁজে পাব।


(ঈষৎ সংক্ষেপিত)


কৃত্রিম গোলাপগুলো: গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোয়েজের গল্প


ভোরের আবছা আলোয় হাতড়ে হাতড়ে বিছানা থেকে নেমে মিনা হাতাছাড়া জামাটি গায়ে দিল যেটি সে গতরাতেই খাটের কাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল, এবং জামার আলগা হাতাগুলোকে ট্রাংকের ভেতর গরুখোঁজা করে খুঁজল। তারপর দেয়ালের হুকগুলিতে, দরজার পেছনে ভালমত খুঁজল, যতদূর সম্ভব শব্দ না করে, যাতে ওর সঙ্গে একই ঘরে ঘুমানো অন্ধ দাদীর ঘুম ভেঙ্গে না যায়। ভোরের আবছা অন্ধকার ওর চোখে সয়ে এলে সে দেখল দাদী ইতিমধ্যেই উঠে গেছে। মিনা রান্নাঘরে গেল, জামার হাতাগুলোর কথা দাদীকে জিজ্ঞেস করার জন্য।

‘ঐগুলো গোসলখানায়’ অন্ধ দাদী বলল। ‘গতকাল সন্ধ্যায় ধুয়ে দিয়েছি’।

গোসলখানায় হাতাদুটো পেল সে, কাঠের কিপে ঝুলছে। তখনও ভেজা সপসপে। মিনা রান্নাঘরে গিয়ে হাতাগুলো চুলার আঁচে মেলে দিল। সামনে অন্ধ দাদী তখন কফি বানাচ্ছে, তার ভাবলেশহীন চোখের মনি স্থির হয়ে আছে বারান্দার কোনার দিকে, যেখানে একসারি ফুলদানির মধ্যে ঔষধি গাছ লাগানো।

‘আর কনো তুমি আমার জিনিষপত্র ধরবে না’, মিনা বলল। ‘এইসব দিনে সূর্যের আলোর কি কোনো বিশ্বাস আছে?’

অন্ধ মহিলা তার মুখ ঘোরাল, মিনার গলার স্বর লক্ষ্য করে।

‘ভুলেই গিয়েছিলাম আজ প্রথম শুক্রবার’, বলল অন্ধ দাদী।

কফি তৈরি হল কিনা বোঝার জন্য দাদী কেতলির উপরে মুখ নিয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিল, তারপর চুলা থেকে কফি নামিয়ে রাখল।

‘নিচে একটা কাগজ বিছিয়ে হাতাগুলো শুকাতে দিস, চূলার মেঝে কিন্তু নোংরা’, অন্ধ দাদী বলল।

মিনা চুলার মেঝেয় আঙ্গুল বুলিয়ে দেখল। পাথরগুলো নোংরা ঠিক, তবে নোংরাগুলোও শক্ত হয়ে সেঁটে গেছে মেঝেতে। ফলে হাতাগুলো মেঝেয় না ঘষলে সেখান থেকে নোংরা হাতায় লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

‘হাতাগুলো নোংরা হলে তুমি দায়ী থাকবে’, মিনা ওর দাদীকে বলল।

অন্ধ দাদী নিজের জন্য এককাপ কফি ঢালল। ‘তুই রেগে আছিস’, বারান্দার দিকে একটা চেয়ার টেনে নিতে নিতে বলল সে। ‘রাগ নিয়ে প্রার্থনায় গেলে অসম্মান হয়’। কফির কাপটা নিয়ে গোলাপগুলোর সামনের বারান্দার চাতালে বসল দাদী। প্রার্থনা শুরুর তিন নম্বর ঘণ্টাটি বাজলে মিনা চুলার উপর থেকে জামার হাতাগুলো নিয়ে এল এবং তখনও সেগুলো ভেজাই ছিল। সেগুলোই পরল সে। হাতাছাড়া জামা পরে গেলে ফাদার এঞ্জেল ওকে কখনই রুটি দেবেন না। মুখও ধোয় নি সে। তোয়ালে দিয়ে খালি একটু মুছে নিয়েছে। তারপর ঘর থেকে প্রার্থনার বই আর শালটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। ফিরে এল মিনিট পনের পর।

‘তুই যেতে যেতে যীশূর শিক্ষা পর্যন্ত শেষ হয়ে যাবে’, গোলাপগুলোর উল্টোদিকের চাতালে বসে দাদী বলল।

মিনা সোজা টয়লেটে ঢুকল। ‘আমি প্রার্থনায় যেতে পারব না’, বলল সে। ‘হাতাগুলো একদম ভেজা আর জামাটাও কোঁচকানো।’ অনুভব করল একটা জিজ্ঞাসু মন তাকে অনসরণ করছে।
‘প্রথম শুক্রবার, আর তুই কিনা প্রার্থনায় যাবি না’, অন্ধ দাদী বিস্মিত।

টয়লেট থেকে ফিরে মিনা নিজের জন্য এককাপ কফি ঢালল এবং বসল দরজার চুনকাম করা কপাটটার উল্টোদিকে, ওর অন্ধ দাদীর পাশে। কফির কাপে চুমুক দিল না।

‘কাঁদছিস তুই!’ অন্ধ মহিলাটি আরো আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘কাঁদছি রাগে’, মিনা বলল। আর দাদীর পাশ থেকে উঠে যেতে যেতে বলল, ‘তোমার স্বীকারোক্তি দিতে অবশ্যই চার্চে যাওয়া উচিত, যেহেতু তোমার কারণেই আমার প্রথম-শুক্রবারের প্রার্থনায় যাওয়া হল না।’

অন্ধ দাদী স্থানু হয়ে বসে রইল, মিনা শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়া পর্যন্ত। তারপর সে হেঁটে গেল বারান্দার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। মিনার রেখে যাওয়া কফির কাপটা তুলে নেয়ার জন্য সতর্কভাবে একটু একটু করে সামনের দিকে বাঁকা হল সে। কাপটিতে আবার কফি ঢালতে ঢালতে বলে চলল:

‘আল্লা জানেন আমার মন পরিষ্কার ছিল।’

শোবার ঘর থেকে মিনার মা বেরিয়ে এল।

‘কার সাথে কথা বলছ তুমি?’ মিনার মা তার অন্ধ মাকে জিজ্ঞেস করে।

‘কারও সাথেই না। তোকে তো বলেছি আমার মাথা খারাপ হতে চলেছে।’

ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মিনা ওর অন্তর্বাসের বোতাম খুলে তিনটা ছোট ছোট চাবি বের করল, সেগুলো সেফটি পিন দিয়ে ওর জামার সাথে আটকানো ছিল। এর একটা দিয়ে আলমারির নিচের ড্রয়ারটা খুলল এবং কাঠের একটা ছোট বাক্স বের করল। তারপর আরেকটি চাবি দিয়ে ঐ বাক্সটির তালা খুলল। বাক্সটির ভেতর একতাড়া রঙিন কাগজে লেখা চিঠি ছিল, রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা। চিঠির তাড়াটা সে জামার ভেতরে লুকিয়ে নিল এবং বাক্সটি যথাস্থানে রেখে ড্রয়ারটায় তালা লাগিয়ে দিল। তারপর চিঠিগুলো টয়লেটে নিয়ে গিয়ে কমোডে ফেলে দিল।

‘আমি তো ভাবলাম তুই চার্চে চলে গেছিস’, মিনা রান্নাঘরে ঢুকলে ওর মা বলে।

‘নাহ, সে যেতে পারে নি’ অন্ধ দাদী বলে উঠল। ‘আমি শুক্রবারের কথা ভুলে গিয়ে কাল সন্ধ্যায় ওর জামার হাতাগুলো ধুয়ে দিয়েছিলাম।’

‘ওগুলো এখনও ভেজা’, মিনা বিড়বিড় করে।

‘খুব ধকল গেছে এই কয়দিন’, অন্ধ দাদী বলল।

‘ইস্টারের জন্য আমায় দেড়শ গোলাপ বানাতে হবে’, মিনা বলল।

সকাল সকালই সূর্য তেতে উঠল। সাতটা বাজার আগেই মিনা তাদের বসার ঘরে কৃত্রিম গোলাপের দোকানটা সাজিয়ে ফেলল: গোলাপের পাপড়ি এবং তারভর্তি একটা বাক্স, আরেক বাক্সে ক্রেপ কাগজ, দুইটি কাঁচি, একটা সূতাগুটি এবং এক পাত্র আঠা। এর কিছু পরই ত্রিনিদাদ ঢুকে সেখানে, তার হাতে পেস্টবোর্ডের বাক্সটা ধরা, জিজ্ঞেস করে মিনা কেন প্রার্থনায় যায় নি।

‘আমার জামার হাতা ছিল না’ মিনা বলে ওর বান্ধবীকে।
‘কারোটা ধার নিতে পারতি’, ত্রিনিদাদ বলে।

মিনা একটা চেয়ার টেনে পাপড়ির বাক্সটির কাছে বসে।

‘আমার দেরি হয়ে গিয়েছিল’, বলে সে।

একটা গোলাপ বানানো শেষ করল মিনা। তারপর কাঁচি দিয়ে পাপড়িগুলো ছাঁটার জন্যে বাক্সটি আরো কাছে টেনে আনে। ত্রিনিদাদও ওর বাক্সটি নিচে রেখে মিনার সাথে হাত লাগায়।

মিনা ত্রিনিদাদের বাক্সটি দেখে।

‘জুতা কিনলি নাকি?’ জিজ্ঞেস করে সে।

‘এটার ভেতরে মরা ইঁদুর’, বলে ত্রিনিদাদ।

ত্রিনিদাদ ভাল পাপড়ি বানাতে পারে, মিনা তাই সবুজ কাগজ ছেঁদা করে ভেতরে তার ঢুকিয়ে পাপড়ি বসানোর কাঠামো বানাতে থাকল। তারা নিঃশব্দে কাজ করতে থাকল, খেয়ালই করল না সূর্যের আলো এসে কখন পড়েছে বসার ঘরের পারিবারিক ফোটোগ্রাফগুলোর ওপর। কাঠামো বানানো শেষ করে মিনা ত্রিনিদাদের দিকে মুখ ঘোরাল, ওর দৃষ্টিতে কাজবহির্ভূত কিছু একটা ছিল। ত্রিনিদাদ কিন্তু নজরকাড়া নৈপুণ্যের সাথে কাজ চালিয়ে যেতে থাকল, মিনার আঙুলে-ধরা পাপড়িগুলোকে একটুও না নাড়িয়ে। মিনা খেয়াল করল বান্ধবীর পুরুষালি জুতোজোড়া। চোখাচোখি হবে, এমনটা ভেবে ত্রিনিদাদ মাথা তুলল না, নিজের পা যথাসম্ভব পেছনে চেপে রাখল, এবং এভাবে কাজ শেষ করল।

‘ব্যাপার কি?’ বলল সে।

মিনা তার দিকে ঝুঁকে এল।

‘সে চলে গেছে’, বলল মিনা।

ত্রিনিদাদের হাত থেকে কাঁচিটা তার কোলের উপর পড়ে গেল।

‘না’।

‘চলে গেছে সে’, মিনা আবার বলল।

শূন্য দৃষ্টিতে ত্রিনিদাদ মিনার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভুরু কোঁচকানো, পুরো দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে ভুরু ওর।

‘এখন কী হবে?’ ত্রিনিদাদের প্রশ্ন।

মিনা দৃঢ় গলায় উত্তর দিল।

‘কিছুই না’।

বেলা দশটার আগেই ত্রিনিদাদ বিদায় নিল।

ত্রিনিদাদের নৈকট্যের ভারমুক্ত হয়ে মিনা মরা ইঁদুরগুলি টয়লেটে ফেলে দিতে চলল, যাবার আগে দাদীর কাছে একমুহূর্ত থামল। অন্ধ দাদী তখন গোলাপঝোঁপে ছাঁট দিচ্ছিলেন।

‘বাজি ধরতে পারি, এই বাক্সে কী আছে তুমি বলতে পারবে না’, পাশ দিয়ে যেতে যেতে মিনা ওর দাদীকে বলল।

বাক্সটি নাড়ায় মিনা।

অন্ধ মহিলা মনোযোগী হতে শুরু করে। ‘আবার নাড়া দে’, বলল দাদী। মিনা বাক্সের মরা ইঁদুরগুলি আবার নাড়ায়, কিন্তু পরপর তিনবার শুনেও দাদী বুঝতে পারল না বাক্সে কী আছে।

‘গতরাতে চার্চে পাতা-ফাঁদে ধরা-পড়া ইঁদুর এইগুলো’, মিনা বলে দাদীকে।

ফিরে আসার সময় সে অন্ধ দাদীর পাশ দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে যায়। কিন্তু দাদী ওকে ঠিকই অনুধাবন করে এবং পেছন পেছন যায়। এভাবে বসার ঘরে, যেখানে মিনা একটা বন্ধ জানলার পাশে বসে গোলাপগুলো তৈরি করছে।

‘মিনা’, অন্ধ দাদী বলেন, ‘সুখী থাকতে চাইলে কখনই অচেনা কারো সামনে স্বীকারোক্তি দিস না’।

কিছু না বলে মিনা তাকিয়ে থাকল ওর দাদীর দিকে। অন্ধ মহিলাটি ঠুকে ঠুকে মিনার সামনের চেয়ারে গিয়ে বসল এবং ওর কাজে হাত লাগাতে উদ্যোগী হল। কিন্তু মিনা তা হতে দিল না।

‘তোকে অস্থির লাগছে’, অন্ধ দাদী বলে। ‘প্রার্থনায় যাস নি কেন?’ জিজ্ঞেস করে সে।

‘এটা তুমিই ভাল জান।’

‘এটা যদি জামার হাতা ভেজা থাকার কারণে হত, তাহলে তুই ঘরের বাইরে যেতে দ্বিধা করতিস না’, অন্ধ মহিলা বলতে থাকল, ‘কেউ একজন তোর জন্যে পথে অপেক্ষা করছিল, যার কোন বিষয় তোকে ছন্নছাড়া করে দিয়েছে আজ।’

মিনা দাদীর অন্ধ চোখের সামনে হাত দোলাল, মনে হল যেন মুছে দিচ্ছে কোনো অদৃশ্য কাঁচ।

‘তুমি একটা ডাইনী’, বলল মিনা।

‘সকালে দু’বার টয়লেটে গেছিস’, অন্ধ দাদী বলে। ‘তুই একবারের বেশি কখনই যাস না’।

মিনা গোলাপ বানাতেই থাকল।

‘আলমারির ড্রয়ারে কী রেখেছিস, দেখাবি আমায়?’ দাদী বলে।

মিনা ধীরেসুস্থে ওর অন্তর্বাসের ভেতর থেকে চাবি তিনটা বের করে এবং দাদীর হাতে দেয়। দিয়ে দাদীর হাতের মুঠো সজোরে বন্ধ করে দেয়।‘যাও, নিজের চোখে দেখে আসো’, বলে মিনা।

‘আমার চোখ তো টয়লেটের নিচে দেখতে পায় না’।

মিনা চোখ তুলল এবং তোলার পর ওর একটা অদ্ভূত অনুভূতি হল। মিনা অনুভব করে, অন্ধ মহিলাটি জানে যে এই মুহূর্তে মিনা তার দিকে তাকিয়ে।

‘টয়লেটের নিচে গিয়ে দেখ না কেন, আমার বিষয়ে যখন তোমার এত আগ্রহ’, বলে মিনা।

দাদী এই কথায় আমল দিল না।

‘রাতে শুয়ে শুয়ে ভোর পর্যন্ত কী যেন লিখিস তুই’, বলে দাদী।

‘তুমি তো বাতি নিভিয়েই দাও’, মিনা বলে।

‘আর সাথেসাথেই তুই হারিক্যানটা জ্বালাস’, অন্ধ দাদী বলে। ‘হারিক্যানের আলোয় সারারাত হৃদয়ের গতির সাথে লিখে যাস তুই’।

মিনা শান্ত থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করল। ‘চমৎকার’, মাথা না তুলেই বলল সে, ‘বুঝলাম তাইই করি আমি। তাতে হয়েছে কি?’

‘কিছুই না’ অন্ধ দাদী নিঃশ্বাস নেন। ‘শুধু তোর প্রথম-শুক্রবারের প্রার্থনা মিস হয়েছে।’

দুইহাতে মিনা সুতার গুটি, কাঁচি, আর শেষ-না-হওয়া কাজগুলো নিয়ে উঠে পড়ে। সবকিছু সে বাক্সে রেখে সে অন্ধ মহিলাটির মুখোমুখি হয়। ‘টয়লেটে আমি কেন গিয়েছিলাম, শুনতে চাও?’ জিজ্ঞেস করে মিনা। দু’জনেই একটা টানটান অবস্থার মধ্যে কিছুণ থাকে, যতণ না মিনা নিজেই ওর করা প্রশ্নটির জবাব দেয়:

‘হাগতে গিয়েছিলাম’।

অন্ধ মহিলা চাবি তিনটা বাক্সের ভেতর ছুঁড়ে দেয়। ‘এটা একটা ভাল অজুহাত হতে পারত’, বিড়বিড় করতে করতে দাদী রান্নাঘরের দিকে এগোয়। ‘আমি এটা বিশ্বাস করতাম যদি এই প্রথমবার তোকে আমি কসম কাটতে শুনতাম’। বারান্দার উল্টোদিক থেকে মিনার মা হেঁটে আসে, হাতে অনেকগুলো কাঁটাওলা গোলাপ।

‘কী কথা হচ্ছে?’ মিনার মা জিজ্ঞেস করে।

‘আমি একটা পাগল’, মিনার অন্ধ দাদী এবার নিজের মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে। ‘কিন্তু যতক্ষণ না পাথর ছোঁড়া শুরু করি, ততদিন পর্যন্ত কিন্তু তোরা আমায় পাগলা গারদে পাঠানোর কথা ভাবতে পারবি না’।

রবিবার, ২৪ আগস্ট, ২০০৮

সাবঅল্টার্ন-লজিকো-লোয়ারমিডলক্লাশ

"What can be said can be said clearly; what we cannot talk about we must pass over in silence."
Wittgenstein, Tractatus Logico Philosophicus

কবিসভায় আমরা ভার্চুয়াল ভার্চুয়াল খেলি। তবু গতরের শান্তি খুঁজতে মাঝে মাঝে মন শাহবাগে ধায়।
আজকেও ধাইলো। গিয়া লিপুর সাথে কথা। লিপু মানে ইফতেখার মাহমুদ, কবিসভার প্রায়-সাইলেন্ট কমরেড। তার সাথে অনেক আলাপ। মধ্যবিত্তের সাবঅল্টার্ন সাহিত্য লৈয়া। তখন মানস আসলেন। রাইসু আসলেন। আবীর আসলেন। সাবঅল্টার্ন-রাও আসলেন। ভার্চুয়ালি।

তারপর হ্যালো করলাম আহমেদ নকীবকে। তিনিও কবিসভার নীরব গ্রাহক। জানাইলেন, সাবঅল্টার্ন প্রণোদনা নিয়া আমার পজিশন তার পছন্দ হৈছে। তবু যেন একটু ধোঁয়াশা আছে। কৈলেন, আচ্ছা আমি ঢাকাবাসী মানুষ কবিতায় যদি হলুদ ট্যাক্সি উঠায়া দেই.....

- সেইটা এলিটিজম হয়া যায় কি না?

এইবার ফতোয়া দিবার পালা আমার। জোরেশোরে কৈলাম, না। সেইটা এলিটিজম হয় না। হয় যখন আপনে ঢাকাবাসী হৈয়া না-দেখা গেরাম নিয়া পাতলা দরদে মাতেন।

কয় দিন আগে এক দৈনিকে আমি গেরামবর্তী একটা গল্প উল্টাইতেছিলাম। সেইখানে দেখলাম কিভাবে বাঁশের টাট্টি (হাগুখানা)তে যাইতে হয় এরকম একটা সহানুভূতিশীল ম্যানুয়াল আছে। সেইটা গল্পের বিষয়বস্তু ছিল না। তবু লেখক দিলেন। আটষট্টি হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে!

আমি ভাবতেছিলাম, ঐ লেখক যদি উনার ফ্যাটবাড়ির বাথরুমে যাওয়ার ঘটনা লেখেন, তাইলে কি তিনি ক্যামনে ফ্ল্যাশ করা লাগে সেইটা লেখতেন?

হয়ত লেখতেন না। কারণ ঐটাতো তিনি জানেন। ডেইলি যাওয়া-আসা করেনও। তাই লেখনের দরকার নাই। এগজটিক না হৈলে লেইখ্যা কি কোনো আরাম আছে!

তাই গেরাম নিয়া লেখছেন। কারণ গেরাম এগজটিক। মধ্যবিত্ত জাতির কাছে গেরাম প্রমোট করা লাগে। গেরাম থিকা মধ্যবিত্ত লেখকের দূরত্বও প্রমাণ করা লাগে। এইটা এলিটিজম।

সুতরাং বাঁশের টাট্টির ভিতরেও এলিটিজমের ভুত থাকতে পারে। আবার হলুদ ট্যাক্সির ভিতরে নাও থাকতে পারে।

শুইনা আহমেদ নকীবের শান্তি লাগল। কৈয়া আমার তো আরো বেশি।

এইবার মানস থিকা একটা রেফারেন্স দেই। তিনি লেখছেন:

আমি এখনো ঠাহর করে উঠতে পারিনি যে সাবঅল্টার্ন গল্পরীতি বলতে সুমন রহমান যা ব্যাখ্যা করেছেন, তা আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি কিনা; কিংবা সেটাকেই আমার অনুধাবনের পরিকাঠামো বিবেচনা করে আগাতে চাই কিনা।


বিবেচনায় আনেন কি ফালায়া দেন, সমস্যা নাই মানস। তার আগে চলেন একটু স্পষ্ট কৈরা লই। আপনেও বোঝেন। আমিও বুঝি।

মাহবুব পিয়ালের কাছে কয় দিন আগে একদল লেখক এসেছিলেন। উনারা কলকাতার। দলিত সাহিত্য করার মানসে ধোপদূরস্ত জীবন ছাইড়া অতি কষ্টে গ্রামে বাস করতেছেন (স্যাক্রিফাইস!)। অদ্বৈত মল্ল বর্মণ উনাদের আইডল। দলিত সাহিত্য বলতে উনারা নিম্নবিত্তের জন্য এবং নিম্নবিত্তের আশা-আকাঙ্ক্ষা লয়া সাহিত্য বুঝান। সেইকথা শুইনা আমি ভুত দেখলাম। দলিত সাহিত্যের ভুত।

এইত সেদিন পিপলস এমপাওয়ারমেন্ট ট্রাস্ট নামে একটা সংস্থা শ্রমজীবী লেখকদের একটা সম্মেলন করল ঢাকায়। সেই উপলক্ষে একটা ম্যাগাজিনও বাইর করল। বিষয়টা আমার খুব মনেও ধরল। আমি খুশিমনে ম্যাগাজিনটা উল্টাইলাম। সেইখানে প্রথমেই দেখলাম, শ্রেণীসংগ্রাম নিয়া একটা বেশ ভারি প্রবন্ধ ঘরানার লেখা। লেখকের পরিচয় আছে, তিনি রিক্সা চালান। আমি চমকাইলাম। একজন রিক্সাওয়ালা প্রাবন্ধিক। তার ওপরে বামপন্থী। ঘটনা তো গুরুতর! তারপর সন্ধান কৈরা জানা গেল যে, উনার বামপন্থী ওরিয়েন্টেশনের ইতিহাস রিক্সা চালানের ইতিহাস থিকাও অনেক লম্বা। ভাবলাম উনার পাইচার্ট কেমন হৈতে পারে ? কত পার্সেন্ট রিক্সাওয়ালা তিনি, আর কত পার্সেন্ট বামপন্থী?

এইটা মনে হয় দলিত সাহিত্যের চেহারা, মানস। আপনে যেমন সেইখানে নাই, আমিও নাই।

এইবার চলেন ভিটগেনস্টাইন-স্টাইলে খোলাসা কৈরা কৈ। আমার পজিশন কিছু প্রিমাইজের ওপর দাঁড়ানো। যেমন:

১. আমার বিবেচনায় সাহিত্য একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিনোদন বা সৃষ্টিমাধ্যম। সাহিত্যের লেখক ও পাঠক উভয়ই মূলত মধ্যবিত্ত। লেখকের বিত্ত-প্রমোশন হৈলে তিনি আর সাহিত্য করেন না, আর বিত্ত-ডিমোশন হৈলে কিছুদিন রক্তবমি করেন, তারপর আস্তে আস্তে নদী নিস্তরঙ্গ হয়া যায়।

১.১ যেসব বিত্তশালী লোকদের আপনেরা লেখক হিসেবে দেখেন, উনাদের পয়সা থাকলেও উচ্চবিত্তের সংস্কৃতি নাই। কালচারালি উনারা মধ্যবিত্ত।

১.২ আবার যেনারা বস্তিতে থাকেন আর সাহিত্য করেন, আকারে বা প্রকারে তেনারা কোনোদিনই মধ্যবিত্তসীমানার বাইরে যাইতে চান নাই। আমি নিজে দেখছি, বস্তির মধ্যেও উনারা আপার কাশ তৈয়ার কৈরা রাখেন। ঘরে পর্দা টাঙ্গান।

২. এই আমাদের শ্রেণী। আমরা এই শ্রেণীমধ্যে গুরুসঙ্গ করি। তাহাদের কথা ভাবি। যাহারা ছোটলোক। গরীব। গ্রামে থাকে। বাঁশের টাট্টিতে হাগে। এই টাট্টি লৈয়া আমাদের মন সমব্যথায় ভৈরা ওঠে। অথচ টাট্টি থিকা বাইর হৈয়া গরীবের কত আরাম! আরাম নাই খালি আমাদের বিবেকের!

৩. এইটা হৈল বাংলাদেশের প্রগ্রেসিভ মধ্যবিত্ত লেখকের ক্যাসিক চেহারা। উনারা ভাবাদর্শের সন্তান। উনাদের শৈশব নীতিকথা-শাসিত।

৪. তাই, রাইসুরে আমি কৈতেছিলাম নিম্নমধ্যবিত্ত হওনের সাহিত্যিক সুবিধার কথা।

৪.১ আপওয়ার্ড মবিলিটি না থাকায় তাদের ভাবাদর্শের যন্ত্রণা খুব একটা পোহাইতে হয় না। পরন্তু, নীতিশাস্ত্রও তাদের জন্য ক্যারিয়ার হিসাবে ভাল দাঁড়ায় না। ফলে নীতিশাস্ত্র লংঘনের প্রশিণও লাগে না তার।

৪.২ মধ্যবিত্ত হৈয়াও সাবঅল্টার্ন শ্রেণীর নিকটতম দূরত্বে থাকে সে।
৪.৩ শ্রেণীচরিত্র লোপ পাইবার ভয় আছে তার। প্রগ্রেসিভ মধ্যবিত্ত লেখক নিজেরে ‘গ্রামবর্তী’ হিসেবে সখের ভাবনা ভাবতে পারে, কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত আরিক অর্থেই সাবঅল্টার্ন শ্রেণীতে পরিণত হৈবার ঝুঁকি মধ্যে থাকে। তাই সে আপন শ্রেণীর মিথলজি তৈয়ার করে। সেইখানে সাবঅল্টার্ন টেস্টের জন্য অনেক স্পেস রাখা লাগে তার। কিনশীপ নেটওয়ার্ক।

৪.৪ সাবঅল্টার্নের সাথে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর লেখক যতটুকু দূরত্ব এবং নৈকট্য রক্ষা করেন, সেইটাই নতুন সাহিত্যের বড় প্লাসপয়েন্ট। তার নৈকট্য ভাবাদর্শজাত নয়, বরং অভিজ্ঞতাবলয়ের, আর দূরত্ব এলিটিজমের নয়, স্পেসের।

৪.৫ এই প্রেক্ষাপটে নন-এলিটিস্ট সাহিত্যের গ্যারান্টি কতটুকু? আমার মনে হয় এলিটিজমের ট্র্যাপ এইখানেও আছে, যেহেতু সে (নিম্ন)মধ্যবিত্ত। তবে সাহিত্যে এলিটিজম বিষয়টা আমার কাছে হার্ডল রেসের মত লাগে। দৌড়ানোর সময় যদি আপনের হার্ডল পইড়া যায়, তাইলে আপনি ডিসকোয়ালিফাই করেন না। কিন্তু পিছায়া যান।

সংস্কৃতি অধ্যয়নশাস্ত্র নয়, বা সাংস্কৃতিক ইন্ডাস্ট্রির উৎপাদ নয়, বা অন্য কোনোরকম উৎপাতও নয়, আমি কৈছিলাম এইরকম সাদামাটা কয়েকটা কথা। ইহাদের নন্দনতাত্ত্বিক লেভেলিং আমার সাধ্যের/ইচ্ছার বাইরে, পদে পদে হঠকারী হৈয়া যাওনের ভয় তো আছেই। আমি শুধু ওয়ার্কিং ম্যানুয়াল খুঁজতেছি। বাঁশের টাট্টিতে হাগার ম্যানুয়াল না-বানাইবার সাহিত্য যাতে করতে পারি।

আসেন, এই প্রিমাইজগুলারে চ্যালেঞ্জ করা যাক।


ঢাকা, ১২/৮/৫


সাবঅল্টার্ন প্রণোদনা


কথা হৈতেছিল কিছু সাম্প্রতিক গল্পপাঠের অভিজ্ঞতা সামনে রাইখা। ‘সাবঅল্টার্ন’ নামে একটা মনোভাবের কথাও হৈতেছিল। মানিক বন্দোপাধ্যায় বা তারাশংকরকে সামনে রাখা হয় নাই। তবে সাবঅল্টার্ন মনোভাবের বার্তা লৈয়া উনাদের সামনে একদিন খাড়াইতে হৈতই। আবীর সেই সুযোগ কৈরা দিলেন।

একটা ভূমিকা দেই। কয়দিন আগে একটা লেখা পড়লাম। নাম “অন্ধত্ব : সাহিত্য কি আমাদের বিপক্ষে” এই লেখার লেখক কেনেথ জার্নিগান নিজে জন্মান্ধ। তিনি আমেরিকার ন্যাশনাল ফেডারেশন ফর দ্য ব্লাইন্ড-এর পরিচালক। এই অন্ধ লেখক তার ইংরেজি ও ফরাসী সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা থিকা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাইছেন যে, অন্ধত্ব নিয়া এ যাবত যত সাহিত্য হৈছে, এর প্রায় সব-ই অন্ধত্বের মূল জায়গাটারে ধরতে পারে নাই। ভুল ব্যাখ্যা করছে। এমন কি কবি জন মিল্টনও, যিনি নিজেও অন্ধ হৈয়া গেছিলেন!


এইখানে, কেনেথ নিজে অন্ধ এবং সাহিত্য-পাঠক হওয়ায় আমাদের পক্ষে অন্ধত্ব নিয়া সাহিত্যের প্রকৃত কৃতিত্ব সম্পর্কে জানা সম্ভব হৈল। এখন মানিক তার ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ তে কতটুকু ‘জাস্টিস’ করছেন, সেইটার সাক্ষ্য দিতে পারত পদ্মা নদীর মাঝিরাই। কিন্তু উনারা কেউ মানিকের উপন্যাস পড়েন নাই। বা পড়লেও সেইটা নিয়া কথাবার্তা বলেন নাই। আর আমরা যারা নানান কৌশলবিচারে একটা উপন্যাসের উৎকর্ষ বিচার করি, তাদের থিকা মানিক পদ্মা নদীর মাঝিমাল্লার জীবন হয়তো বেশিই দেখছেন। ফলে, তিনি তার অভিজ্ঞতা এবং তার দেখা জনগোষ্ঠীর ওপর তিনি কতখানি ‘ন্যায়পরায়ণ ব্যবহার’ করেছেন, সেইটা যাচাইয়ের মতা শ্রেণীগতভাবে আমাদের নাই।

কিন্তু যখন মালোপাড়ার ছেলে অদ্বৈত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ লেখেন, তখন আমরা কিন্তু ‘আহরিত’ অভিজ্ঞতার ফাঁকফোকড়গুলো ধরতে পারি। তবে মানিক বা তারাশংকর নিশ্চয়ই তিনদিনের আর্থসামাজিক সমীক্ষা কৈরা আইসা গল্প লেখতে বসেন নাই। কিন্তু তারপরও মানিকের পক্ষে অদ্বৈতমল্ল বর্মনের জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। মানিকের পদ্মা নদীর মাঝি শক্তিশালী উপন্যাস, কিন্তু তিতাসের মূল শক্তি তার সাবঅল্টার্নিটি। সেইটা আমরা বুঝি, যখন আমরা এই দুই উপন্যাসেরে পাশাপাশি রাইখা পড়ি। সবক্ষেত্রে তো এইরকম সুযোগ হয় না।

মানিক বা তারাশংকর উঁচুমাপের লেখক। তারা (বিশেষ কৈরা তারাশংকর) অন্য শ্রেণীর জীবন বর্ণনায় প্রায় কখনই এলিটিস্ট হন নাই। কিন্তু তারা (বিশেষ কৈরা মানিক) খুব সাবঅল্টার্ন-ও নন। তারাশংকরের বিষয়টা আমার কাছে একটু ভিন্ন লাগে। তিনি যখন ‘গণদেবতা’ বা ‘পঞ্চগ্রাম’ লেখেন, তখন এসব উপন্যাসের কেন্দ্রে তিনি যে চরিত্রটাকে রাখেন সেইটা কিন্তু একটা শিক্ষিত নিম্নমধ্যবিত্ত চরিত্র। এই স্পেসটা থাকায় তারাশংকর ঐ চরিত্রটির মধ্য দিয়া নিজের উপন্যাসে সশরীরে উপস্থিত থাকার সুযোগ পান। বা স্পেসটা তৈয়ার কৈরা রাখেন। এইটা কিন্তু সাবঅল্টার্ন প্রণোদনা।

আমি মনে করি একজন লেখক যে কোনো শ্রেণীর কথাই লিখতে পারেন। কিন্তু তিনি যেই শ্রেণীতে অবস্থান করেন না, সেই শ্রেণীর কথা জানার একটা জ্ঞানতত্ত্বীয় সীমাবদ্ধতা তো তার আছেই। সেইটাকে ডিঙায়া যাওয়া হয়ত সম্ভব না, তবে বিপুল অধ্যবসায় থাকলে হয়ত একটু সুবাস অন্তত পাওয়া সম্ভব। মানিকের বা তারাশংকরের সেই অধ্যবসায় ছিল। অনেকেরই আছে বা ছিল। আবার অনেকেরই নাই বা ছিল না।

সাবঅল্টার্ন সাহিত্য সেই অধ্যবসায় নিয়া আগায় না। আমি যখন লিখি, আমি আমার চারপাশ এবং সেই প্রেক্ষাপটে আমার অবস্থান লৈয়াই লিখি। সাবঅল্টার্ন মনোভাবের গল্প যিনি বলেন, তার পজিশন কখনই উপরে বা নিচে হয় না, তিনি বিষয়ের দিকে সোজাসুজি তাকাইতে পারেন। আর যাদের এইটা থাকে না, তারা সেই বিষয়ের অনুপস্থিতি ঢাকতে ক্যানভাসের ওপর মহত্ত্ব ঢালেন, যাতে বিমূঢ় পাঠক চুপ মাইরা যান। এইটা ছিল আমার সাম্প্রতিক গল্প পাঠের অনুভূতি।

সাবঅল্টার্ন মনোভাব লয়া আরো আলোচনা হৈতেই পারে।


৩০ জুলাই ২০০৫


সখী এলিটিজম কারে কয়?

Elitism kake bole, ami jani naa -- dhonira doridro loker 'taste' ke opochhondo korle take'i ki elitism bole?
....
Elitism kake bole ? ....income inequality'r birud'dhe lorai korte giye ki class er differential preference er birud'dhe lorai korte hoy ? Utopia te ki manushe manushe pochhondo opochhondo bhed thakte parbe
na ? Polash Rizia othoba Momtaz ke ki amake pochhondo kortei hobe ? Naa kole ki ami 'kharap manush' hoye jabo ?
(Abeer-er chithi theke)

“তোমরা যে বলো দিকস রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা, সখী ভালোবাসা কারে কয়”
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান থিকা)

রবীন্দ্রনাথ জিগাইছেন ভালোবাসা কারে কয়। আর এদিকে আবীর জিগাইতেছেন এলিটিজম কারে কয়। ভালোবাসা কারে কয় এইটা রবীন্দ্রনাথ হাড়ে হাড়ে বোঝেন, তাই একটা আপাতসরল জিজ্ঞাসা নিজের ওপর ন্যস্ত করছেন। মধ্যবিত্তরে এলিটিজম বোঝানো আর দাদারে ..... শিখানো কি একরকম পণ্ডশ্রম হৈতেছে না?

আজকে আবার আরেক কাণ্ড হৈল। ডিজ্যাবিলিটি’র ওপর দিনব্যাপী একটা সেমিনারে বৈসা থাকতে হৈছিল। সেইখানে শুনতেছিলাম অটিজম (Autism) এর ওপর লেকচার আর ভাবতেছিলাম এলিটিজম নিয়া। অটিজম আর এলিটিজম মিল্যামিশ্যা সন্ধ্যাবেলা আমি হঠাৎ চলৎশক্তিহীন বোধ করলাম। মনে হৈল আমার পেশি যেন সংবেদনশীলতা হারায়া ফেলতেছে। অটিজম থিকা সাবধান, ভাই আবীর!

কেউ যখন কোনো সুবিধাজনক অবস্থানে থাইকা ডিসএডভান্টেজড কোনো শ্রেণীর রূচিকে নির্বাচন/পছন্দ করে, যে পছন্দের মধ্যে অনুমোদন ও করুণার মিশাল থাকে, কখনো প্রমোশনের প্রণোদনা থাকে, কখনো মতাদর্শের প্রেরণা ’বড়’ হয়া থাকে ....তখন সেই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা মানুষটার নির্বাচন/পছন্দের মধ্যে এলিটিজমের ঝুঁকি থাকে। এইটা একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সিনড্রম, বাই ডিফল্ট। তবে, প্রত্যেকটা বেটার-অফ শ্রেণীর রূচি-ই তার চেয়ে ওরস-অফ (worse-off) শ্রেণীর রূচির কাছে, কখনো কখনো, মতার সহজাত গরমে, এলিটিস্ট হয়া উঠতে পারে।

আর প্রত্যাখ্যান কিন্তু একটা অনেক কম বিপদজনক অবস্থান। প্রত্যাখ্যানকারীর জন্যও, আবার প্রত্যাখ্যাতের জন্যও। এইখানে আধা গ্রহণবর্জনের সমস্যা তৈয়ার হয় না। মধ্যবিত্ত হৈয়া মমতাজরে অপছন্দ করা একটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এইখানে কোনোই সমস্যা নাই। কিন্তু যদি আপনের পছন্দ হয়, দুইবার ভাবেন, দেখেন রেফারেন্স কোনখানে।

আয়-বৈষম্যের বিরূদ্ধে সমাজে কারে লড়াই করতে দেখলেন? আমি তো বছর বছর জিনি (Gini Index) বাইড়া যাইতেই দেখি। ভাইবা দেখেন তো, ভিন্নতা বা বৈচিত্র্য বিষয়ে পুঁজিবাদ আর সাম্যবাদের পজিশনে কতটুকু ফারাক আছে? কিন্তু তারপরেও সাবঅল্টার্ন-এর রূচি কখনো কখনো ড্রাইভিং সিটে বৈসা পড়ে। যেমন, একটা উদাহরণ দিই: বাংলাদেশের অডিও ক্যাসেট ব্যবসা এখন গরিব মানুষের রূচি দিয়া নিয়ন্ত্রিত হৈতেছে। ফলে এখন শাকিলা জাফর থিকা মমতাজ অনেক বড় প্রেফারেন্স, গিটার ফালায়া হাসান দোতারা হাতে লৈছে, জেমসের কান্ধে গামছা উঠছে, জিন্স খুইলা আমাদের বিপ্লব গেরুয়া পৈরা মমতাজের লগে ডুয়েট অ্যালবাম করতেছে, রিক্সাওলা আকবর আইসা হিট হয়া যাইতেছে।

এইভাবে, সমাজের একটা সাইলেন্ট এবং এক্সক্লুডেড শ্রেণী নিজেরা নিজেদের বিনোদন ঠিক কৈরা নিছে, সেইখানে তাদের পপুলেশন তাদের শক্তি হৈয়া দাঁড়াইছে...আর তারা মধ্যবিত্তের হাত থিকা অডিও ক্যাসেট ইন্ডাস্ট্রি নিজেদের দখলে নিয়া নিছে। এই কারণেই আমারে মমতাজ লৈয়া থিসিস লেখতে হয়, নির্মলেন্দু গুণের কানে মমতাজের গান পৌঁছায়, আর মৌসুমী কাদের-এর বাসায় মমতাজের ক্যাসেটের কালেকশন তৈয়ার হৈতে থাকে।

মধ্যবিত্ত হিসাবে নিম্নবর্গীয় সংস্কৃতির ধারেকাছে যাওয়ার যে কৃতিত্ব আমরা নিতেছি, এইগুলাই সেইখানে ইনভিজিবল ফ্যাক্টর। আসেন, এইগুলারে উদঘাটন কৈরা আমাদের ‘কৃতিত্বরে’ চ্যালেঞ্জ কৈরা দেখি, কতদূর উনি অম্লান থাকতে পারেন!



ঢাকা, ০৫/০৮/০৫