শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

দ্য ম্যাট্রিক্স মুভি নিয়ে জ্যাঁ বদ্রিয়াঁর সাথে আলাপ






দ্য ম্যাট্রিক্স (১৯৯৯) হলিউডের একটি ব্লকবাস্টার সাইন্স ফিকশন মুভি। ওয়াচোস্কি ভাইদের বানানো সেই মুভিতে নিও নামের এক কম্পিউটার হ্যাকারের সাথে মরফিউস নামে আরেক প্রবাদতুল্য হ্যাকারের দেখা হয় এবং সে তাকে ২০০ বছর পরের পৃথিবীতে নিয়ে যায় যেখানে সাইবার ইন্টেলিজেন্স দুনিয়াকে শাসন করছে। সেখানে এক যন্ত্রগোষ্ঠী মানুষের মধ্যে প্রভূত প্রভাব বিস্তার করে তাদের হৃদয়কে “ম্যাট্রিক্স” নামক একটি গাণিতিক বাস্তবতার মধ্যে বন্দী করে রাখছে। নিও, মরফিউস এবং ট্রিনিটি ম্যাট্রিক্সকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়।

জ্যাঁ বদ্রিঁয়া (১৯২৯-২০০৭) বর্তমান বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দার্শনিকদের একজন যার হাত ধরে উত্তরাধুনিকতাবাদের বিকাশ হয়েছে। জনপ্রিয় ও স্মরণীয় ইভেন্ট, সেলিব্রিটি এবং সংস্কৃতি নিয়ে তার অনেক চিন্তাজাগানিয়া রচনা আছে। “সিমুলেশন ও সিমুলাক্রা” তাঁর অসংখ্য রচনার একটি, যার উদ্ধৃতি এই সাক্ষাৎকারে আছে। ”সিমুলেশন” বলতে তিনি বোঝান সেই বানিয়ে তোলা বাস্তবতা বা ভার্চুয়াল-এর বর্ণন যা “সত্যিকারের” বাস্তবতা থেকেও সত্য ও শ্রেয়তর হতে আরম্ভ করে।

অদে ল্যান্সেলিন: ভার্চুয়াল ও বাস্তব নিয়ে তোমার ধারণাগুলোকে দ্য ম্যাট্রিক্স মুভির মূল ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। ম্যাট্রিক্সের প্রথম পর্বটি তো একেবারে সরাসরি সেরকম ইঙ্গিত দিয়েছে। মনে হয়েছে “সিমুলাক্রা ও সিমুলেশন” এর প্রচ্ছদ যেন রূপালি পর্দায়! অবাক হয়েছো?

জ্যাঁ বদ্রিয়াঁ: এখানে নিশ্চিতভাবেই একটা ভুল বোঝাবুঝি আছে, যে কারণে আমি এখনও দ্য ম্যাট্রিক্স নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। দ্য ম্যাট্রিক্স-এর প্রথম পর্ব মুক্তি পাবার পর ওয়াচোস্কি ভাইদের তরফ থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তাদের প্রত্যাশা ছিল পরের পর্বগুলোয় তারা আমার সঙ্গে কাজ করবেন। কিন্তু এরকম হবার প্রশ্নই ওঠে না (হাসি)। ১৯৮০ সালেও এরকম একবার হয়েছিল যখন ন্যু-ইয়র্কের সিমুলেশনবাদী চিত্রশিল্পীরা আমার সাথে দেখা করলেন। ভার্চুয়াল যে একটা অবধারিত বিষয়, আমার এই প্রকল্পকে তারা গ্রহণ করলেন এবং সেটাকে একটা পরিষ্কার ফ্যান্টাসির চেহারা দিয়ে দিলেন। কিন্তু আসলে এটা এমন এক জগত যেখানে বাস্তব জগতের ক্যাটাগরিগুলো খাটে না।

অদে ল্যান্সেলিন: কিন্তু ধরো, দ্য পারফেক্ট ক্রাইম-এ তুমি যে দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলছো, তার সাথে এই ফিল্ম অবিশ্বাস্যভাবে মিলে যায়। এই ফিল্ম যথার্থই “বাস্তবের পোড়োবাড়ি”র দিকে ধাবমান, যেখানে পুরোপুরি ভার্চুয়াল এবং কল্পনার মানুষেরা চিন্তাশীলতার সক্ষম বিষয়বস্তু থেকে খুব বেশি ভিন্ন কিছু না।

জ্যাঁ বদ্রিয়াঁ: ঠিক, তবে বাস্তব ও ভার্চুয়ালের মুছে যেতে-থাকা সীমানা নিয়ে আরো অনেক ফিল্ম হয়েছে: দ্য টুম্যান শো, মাইনরিটি রিপোর্ট, বা এমনকি মালহল্যান্ড ড্রাইভ, যেটি ডেভিড লিঞ্চ-এর মাস্টারপিস। দ্য ম্যাট্রিক্স-এর মূল কৃতিত্ব হল যে সে এই বিষয়টাকে মারখাপ্পা আক্রমণ করেছে। যদিও সেটা করেছে অনেক সরলভাবে। তার ম্যাসেজ হল, হয় চরিত্রগুলো ম্যাট্রিক্স বা ডিজিটাল জগতের বাসিন্দা, না হয় তারা র‌্যাডিক্যালভাবে এর বাইরে, যেটা দেখা যায় দ্য ম্যাট্রিক্স-এ জিয়ন শহরের অধিবাসীদের মাঝে। এই দুই জগতের দেখা যখন হয় তখন কী ঘটতে পারে এটা দেখানো খুব ইন্টারেস্টিং হতে পারে। কিন্তু এই ফিল্মের সবচেয়ে বিব্রতকর অংশ হল, যে-সমস্যাটির উদয় হয়েছে সিমুলেশন থেকে, সেটিকে সে মোকাবেলা করতে চেয়েছে প্লাতোনিক ট্রিটমেন্ট দিয়ে। এটি একটি মারাত্মক ত্রুটি। জগত যে একটি বড়সড় বিভ্রম ছাড়া আর কিছু নয় - এই ধারণাটি প্রায় সব বড়-বড় সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং শিল্পচর্চা ও প্রতীকায়নের মাধ্যমে এর সুরাহা হয়েছে। আর একই ধরনের ভোগান্তি ঠেকাতে আমরা যা বানিয়েছি, সেটা হল একটা গাণিতিক বাস্তব যেটি সাবেকি বাস্তবকে প্রতিস্থাপন করতে সম। আর এভাবে একটা চূড়ান্ত সমাধানের দিকে যাওয়া: এমন একটি ভার্চুয়াল জগত যেখানে যাবতীয় বিপজ্জনক ও নেতিবাচক বিষয় আশয়ের জায়গা নেই। এটাই দ্য ম্যাট্রিক্স মুভি-র পদ্ধতি। যা কিছু স্বপ্নে, ইউটোপিয়ায় বা ফ্যান্টাসিতে করবার কথা, সেগুলোকে একটা চেহারা দেয়া হয়েছে, “বাস্তবায়িত” করা হয়েছে। এটা একটি নিটোল স্বচ্ছতার জগত। এই মুভিটি সেই ধরনের একটা ম্যাট্রিক্স নিয়ে এবং সেখানে এরকম একটি ম্যাট্রিক্স গড়ে তোলা যেতে পারতো।

অদে ল্যান্সেলিন: কিন্তু এটা তো সেই মুভিও যেখানে প্রকাশ্যে মানুষের প্রযুক্তিজাত বিচ্ছিন্নতার বিরোধিতা করা হয়েছে। আবার একইসঙ্গে এটা সেই মুভি যেটা ডিজিটাল জগতের উন্মাদনা ও কম্পিউটারে-বানানো দৃশ্যের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করেছে।

জ্যাঁ বদ্রিয়াঁ: ম্যাটিক্স রিলোডেড মুভির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এটাতে সেই পরিহাসের সামান্যতম কণাও আর অবশিষ্ট নেই, এমন কিছুই নেই যা দর্শককে মুভির এই বিপুল স্পেশাল ইফেক্ট-এর বাইরে কিছু ভাবাবে। এমন একটাও সিকোয়েন্স নেই ঐ মুভিতে যেখানে কোনো অবিশ্বাস্য ডিটেইল তোমাকে একটা সত্য ইমেজের সামনা সামনি দাঁড় করিয়ে দেবে। আসলে, প্র্রযুক্তি নিয়ে রূপালি পর্দার মানুষদের যে মোহগ্রস্থতা আছে, সেটাই এই মুভিটাকে স্রেফ একটা তথ্যের আকর বানিয়ে ছেড়েছে। বাস্তব আর কল্পনাকে আলাদা করার কোনো রাস্তাই আর ঐ ছবিতে নেই। কিন্তু দ্য ম্যাট্রিক্স আদতে একটি অনিঃশেষ বিষয়বস্তুর কথা বলেছিল, যা একইসঙ্গে সরাসরি ও বিরোধী, কারণ এটা বাস্তব জগতের কোনোখানেই নেই। মুভিটার শেষে যে ছদ্ম-ফ্রয়েডীয় ভাষণটি আছে, সেখানে এটা সুন্দরভাবে বলা হয়েছে: যা কিছু গতানুগতিক নয় তাকে সমীকরণের ছাঁদে ফেলে দিতে হলে ম্যাট্রিক্স-কে আবার ঢেলে সাজাতে (গাণিতিক ভাষায়, রিপ্রোগ্রামিং করা) হবে। আর তুমি, প্রতিরোধকারী, তুমিও সমীকরণের অংশ। মনে হচ্ছে, এরকম একটি ভার্চুয়াল সার্কিটে আমরা যেন চিরকালের জন্য আটকা পড়ে গেছি, যা থেকে বাইরে বেরুনোর কোনো রাস্তাই নেই। এই জায়গাটায় আবার আমি তাত্ত্বিকভাবে দ্বিমত পোষণ করি (হাসি)। দ্য ম্যাট্রিক্স এমন একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তির চেহারা তুলে ধরেছে এবং তার বদলে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে, যার জুড়ি আজকাল বাস্তবে দেখা যায়। এটাকে একটা বৈশ্বিক মাপে দেখানো এই ছবির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। এখানে বরং মার্শাল ম্যাকলুহানের শরণ নেয়া ভাল: দ্য মিডিয়াম ইজ দ্য মেসেজ, বা, বলবার মাধ্যমটিই হল বক্তব্য। যে উদ্দাম ও দুর্দমনীয় সংক্রমণের মাধ্যমে দ্য ম্যাট্রিক্স নিজেকে দর্শকের মাঝে সঞ্চার করছে, সেটিই হল তার বক্তব্য।

অদে ল্যান্সেলিন: এটা খুব মজার যে বাণিজ্যিক বিচারে প্রায়-সব আমেরিকার ব্লকবাস্টারগুলো, হোক সেটা দ্য ম্যাট্রিক্স কিংবা ম্যাডোনা-র সর্বশেষ অ্যালবাম, সবাই দাবি করছে যে এরা এমন একটি সিস্টেমের সমালোচনা করছে, যে সিস্টেমটি আবার ব্যাপকভাবে ওদের প্রমোট করে।

জ্যাঁ বদ্রিয়াঁ: ঠিক এটাই আমাদের সময়টাকে এরকম নিপীড়নমূলক বানিয়েছে। বর্তমান সিস্টেমটা যে বিনোদন সামগ্রীগুলো উৎপাদন করছে তার মধ্যে কোথায় যেন একটা নেতিবাচক বিভ্রম গেঁথে দিচ্ছে সে। যেন কারখানা নিজেই মেয়াদোত্তীর্ণ জিনিস উৎপাদন করছে। সব ভাল ভাল বিকল্পগুলোকে ঠেকিয়ে রাখার এটাই হল কার্যকর পন্থা। জগত সম্পর্কে কারো প্রত্যক্ষণকে এক জায়গায় আটকে রাখবে, এমন কোনো ওমেগা পয়েন্ট নেই, এর বিপরীত ক্রিয়াটিও নেই; শুধু উদ্দীপনা নিয়ে লেগে-থাকা। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, একটা সিস্টেম যতই পূর্ণতার দিকে যায়, ততই সে একটা সার্বিক দুর্ঘটের দিকেও যায়। এই বস্তুগত পরিহাসটি সেই সত্যই প্রতিপাদন করে যে, কোনো কিছুই চূড়ান্ত নয়। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনাও সেটি প্রমাণ করে। সন্ত্রাসবাদ বিকল্প কোনো মতার আধার নয়। পশ্চিমের ক্ষমতা যে রীতিমত আত্মহন্তারক হয়ে উঠছে নিজেকে বদলাতে গিয়ে, সন্ত্রাসবাদ একটু বড় করে সেটাকেই প্রতীকায়িত করেছে। সেই সময়েই এটা আমি সরাসরি বলেছিলাম, কেউ আমল দেয় নি। তবে এসব মোকাবেলা করতে গিয়ে আমাদের দুঃখবাদী বা নৈরাজ্যবাদী হওয়ার দরকার নেই। এই সিস্টেম, এই ভার্চুয়াল কিংবা এই ম্যাট্রিক্স ― সবই সম্ভবত ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ফিরে যাবে। কিন্তু এই যে বদলানোর প্রক্রিয়া, এই যে প্রতিরোধ এবং মোহময়তা ― এর কোনো বিনাশ নেই।


বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

হারিয়ে যাওয়া একটি কবিতা

তুমুল বিভ্রমে হঠাৎ তাকে পাই
তুমুল সচেতনে হেরে
তমাল তার পণ বেঁধেছে নিজ ডালে
সে আসে মৃতদেহ ছেড়ে

প্রবল বাকরোধ আমায় পেয়ে বসে
প্রবল বমনের ঘাতে
প্রাচীন অনীহার ত্রিশির তাড়া খেয়ে
শুয়েছি এই নদীখাতে

সে আসে পোড়াদেহ খোলস পালটিয়ে
কুমারী নবভাষা পেয়ে
নিকোনো ঘর থেকে পালিয়ে যাদুঘরে
বলেছি ফিরে যাও মেয়ে

তোমার ফলভার যেখানে উপগত
একদা আদিবাস জেনে
দেখেছি নদীটির শাসন দুরকম
ঋতু ও বিবাহের গানে

(১৯৯০?)


[বহুদিন আগে লেখা, ছন্দ শিখছি কেবল তখন। তারপর ছন্দ বিস্মরণ। কোথায় লুকিয়েছিল এই লেখাটি? আজ বহুদিন পর, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে নিশ্চয়। এরই মধ্যে দু-দুটো কবিতার বই, একে বাইরে রেখেই। তাই কাগজ নয়, ওয়েবই সমাধি হোক তার।]




মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

মানলে তালগাছ, না মানলে বালগাছ!!

বিনয় মজুমদারের একটা কবিতার উদ্ধৃতি আমি দিয়েছিলাম। ব্রাত্য রাইসু সেইটাকে ‘নর প্রাকৃতিক জৈব কবিতা’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। এই ধরনের অভিধার কথাও মনে হয় আর কেউ বলেন নাই। ফলে স্বত্ব রাইসুর, সন্দেহ নাই। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, সেই কবিতার শিরায় শিরায় রবীন্দ্রনাথের মনুমেন্টপ্রমাণ অবস্থান নিয়ে একটা পরিষ্কার বিদ্রুপ বহমান, যেটা রবীন্দ্রনাথের অবদানকে পাশ কাটায় না, সহমর্মী থাকে। বিনয়ের সময় হয়ত রবীন্দ্রনাথকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার স্পর্ধা অর্জন করে নাই, যেটা অর্জন করেছে ব্রাত্য রাইসুর সময়, বা তিনি হয়ত তার সময় থেকেও অনেকখানি এগিয়ে (এগিয়ে বলছি, যেহেতু তেমন কাউকেই পাচ্ছি না, যে, উইদ ফুল থ্রটল, রাইসুর সাথে একমত হইতে পারতেছে)।

আমি (ভুলক্রমে!) একটা পাটাতনের ইঙ্গিত করেছিলাম। যেহেতু আমি বিশ্বাস করি কোনোকিছুই রাতারাতি ডিম ফুইটা বাইর হয় না। আমার ধারণা ছিল, রবীন্দ্র প্রসঙ্গে ব্রাত্য রাইসুর র‌্যাডিক্যাল অবস্থান ঐতিহাসিকভাবেই বিকশিত হয়েছে। বিনয়কে একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে মানছিলাম। কিন্তু রাইসু’র মনে হয়েছে, এইটা উনার বক্তব্যের মেরিট যাবতীয় গরুগাধাকে বণ্টন করে দেয়ার একটি সুমন রহমানীয় চক্রান্ত। রাইসুর বক্তব্যের স্বত্ব তার কাছ থেকে ছিনায়া লইয়া যাওয়ার একটা স্নিগ্ধ চেষ্টা। সেই কোপ থেকে পাটাতনকে তিনি ‘পাঠাতন’ লিখলেন, তার মানে বিনয় বা অন্যান্য ‘পাঠা’দের সাথে একমঞ্চে উচ্চারিত হওয়ার কোনো খায়েশ উনার নাই।

ভাই রাইসু, আপনার বক্তব্যের মেরিট আপনারই। আমার বিবর্তনবাদ (বা ঐতিহাসিক বিকাশবাদ) আমারই থাক, ধইরা নিই যে আপনার রবীন্দ্র-অবধারণ মোটামুটি নবুয়তের ফর্মেই আপনের ওপর নাযিল হইছে। কিন্তু তাতেও একটা সমস্যা পাকাইতেছে আপনারই লেখা একটা কবিতা।

বিরহে পরাণ থরোথরো
ঘুরে মরিব একেলা
গাবো ঠাকুরের গান

এমন দিনেই তারে বলা যায়
যা বলিনি এতদিন
প্রথমত বৃষ্টির অভাবে

আর আমার জন্যই এল এই গান জলের ওপরে ভেসে ভেসে

(ব্রাত্য রাইসু, বর্ষামঙ্গল, আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি)

বিরহাক্রান্ত রাইসু একা একা ঘুরে ঘুরে ঠাকুরের গান গাইতেছে, এই কবিতার চিত্র যদি মোটামুটি এইরকমই হয়, তাইলে উহারে দয়া কইরা একটা অভিধা দিয়া দিবেন কি? আমাদের একটু বইলা দিবেন কি, এই কবিতার সাথে আপনের বর্তমান রবীন্দ্র-অবস্থানের কোনো ধারাবাহিকতা আছে কি না? জানতে ইচ্ছা করতেছে।

কবিসভা বড় অদ্ভূত জায়গা। এইখানে কোনো তর্কেরই মিমাংসা হয় না, এমন কি অনেক মিমাংসিত তর্কও এইখানে টগবগ কইরা ফোটে (এটা মন্দ না)। এইখানে প্রতিপক্ষ হইয়া যারা কোনো তর্ক আরম্ভ করেন, প্রতিপক্ষ থাইকাই তারা আলোচনা ক্ষান্ত দেন, বুঝি বা ক্লান্ত হৈয়া পড়ার কারণে। এইরকম অনেক ঈমানদারের সাক্ষাৎ এইখানে মিলে।

মানভাষা-ঊনভাষা তর্ক একটি পোস্ট কলনিয়াল চিন্তাদশা, এইটা বুঝতে আমার দুইটাকাও লাগে না। এই তর্কের পরিবেশ তৈরি হইছে ক্ষমতা-সম্পর্কের নানান ইতিহাস, নানান তত্ত্ব ও ঘটনার পাটাতনের (পাটাতনই লিখলাম, কী আর করা!) ওপর দাঁড়িয়ে। জাস্ট অ্যা মেয়ার পোস্ট-কলোনিয়াল ইমপ্লিকেশন! এইটা একটা ভাল এজেন্ডা বইলা আমার ধারণা, আমি এই এজেন্ডার খুব ভক্ত। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন এইটা কোনো ইতিহাস-নিরপেক্ষ দশা থেইকা তার ওপর হঠাৎ কইরা নাযিল হইছে, সেইটা তার ভাবনা, তার সুখ।

আরো স্পেসিফিক হইয়া বলি: ধরা যাক, বাংলা সাহিত্যে যত রবীন্দ্র বিরোধিতা আছে সব একজাতের, শুধু রাইসুরটা আলাদা জাতের। এক্ষণে আমি জানতে চাই, ব্রাত্য রাইসু তার রবীন্দ্র বিরোধিতায় এ পর্যন্ত যত বাক্য লিখেছেন, তাত্ত্বিকভাবে তার মধ্যে এমন কোনো বক্তব্য কি আছে, যেটি পোস্ট-কলোনিয়াল চিন্তার ধারাবাহিকতা ছাড়া এসেছে?

আমাদের গ্রামে লোকজন কয়, মানলে তালগাছ না মানলে বালগাছ। যারা এইটা কয়, বা যে অবস্থায় কয়, সেইটা হইল কাউরে তালগাছও না বানানো, বালগাছও না বানানো। কারণ, কাউরে তালগাছ বানানো সহজ, এর চেয়ে সহজ বালগাছ বানানো।


ঢাকা, ১৬ মে ২০০৫