শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

ব্লগারের মৃত্যু ও ভার্চুয়াল শোকের চেহারা


মুহম্মদ জুবায়ের মারা গেছেন। ইনি প্রথম যৌবনে লেখক হওয়ার জন্য ঘর ছেড়েছিলেন এবং শেষ জীবনে লেখালেখি করবার জন্য বেছে নিয়েছিলেন ব্লগকে। সেই অর্থে ব্লগার ছিলেন তিনি, লিখতেন সচলায়তনে। আমি যখন সচলায়তনে প্রবেশ করেছিলাম, তিনি রীতিমত ছেলেমানুষের মত খুশি হয়েছিলেন। আমার দ্রুত সদস্যভূক্তির ব্যাপারে সচলায়তন কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানিয়েছিলেন। তারপর একদিন কথাচ্ছলে জানিয়েছিলেন যে, তিনি সচলায়তন অঙ্গনে আর লিখবেন না। সেটি সম্ভবত ডুয়াল পোস্টিং নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপের জবাবে তাঁর অভিমানী সিদ্ধান্ত ছিল। আমরা যথারীতি তাঁকে তাঁর সিদ্ধান্ত পাল্টাতে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি তা করেছিলেন। তারপর আমি যখন সচলায়তন ছেড়ে আসি, তিনি আমার ছেড়ে আসার সিদ্ধান্তের সাথে একমত ছিলেন না। তাঁর মনে হয়েছিল আমি না ছেড়ে আসলেও পারতাম। এমনকি সচলায়তন বিষয়ে প্রথম আলো-তে লেখা আমার নিবন্ধের গীবতেও সামিল হয়েছিলেন তিনি।

মুহম্মদ জুবায়ের বিষয়ে এইটুকু লেখার পর আমি নিজে পরিষ্কার যে সচলায়তনের ব্যাপারে তাঁর শর্তহীন পক্ষপাত ছিল। খুবই ভালোবাসতেন এই ফোরামটিকে। কিছু খিটিমিটি হলেও সেখানেই লিখে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। এতই টান ছিল এই ফোরামের প্রতি যে, এই ফোরাম ত্যাগ করবার পর অন্য অনেকের মত তিনিও আমার সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রদ করে দিয়েছিলেন।

মুহম্মদ জুবায়ের-এর সাথে আমার প্রথম দেখা কবিসভায়। কবিসভা উত্তপ্ত তর্কবিতর্কের জায়গা, মনে পড়ে কোনো একটা বিষয়ে তাঁর সাথেও আমার তর্ক হয়েছিল। পরে অনিয়মিত হয়ে গিয়েছিলেন কবিসভায়। মেইল করতেন মাঝে মাঝে, আমার একটি গল্পের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন, শহীদ কাদরীর সাথে আমার গল্প নিয়ে তাঁর বিস্তর কথাবার্তা হওয়ার কথা। ফলে, মুহম্মদ জুবায়ের, যাঁকে আমি চর্মচক্ষে দেখি নি কোনোদিন, তাঁর ব্যাপারে একটা স্নিগ্ধ অনুভূতি আমার ছিল সবসময়।

সচলায়তনে ব্লগ লিখতেন তিনি, সত্তর দশকের জীবনযাপন ও স্বপ্ন নিয়ে তাঁর চিন্তাজাগানিয়া পর্যবেক্ষণ ছিল। একটা ধারাবাহিক উপন্যাসও লিখেছিলেন। বন্ধু ও প্রবাসী লেখক লুৎফর রহমান রিটনকে সচলায়তনে নিয়ে এসেছিলেন। এই ব্লগের মডারেটরদের সাথে তাঁর দহরম মহরমও ছিল। ব্লগাতিরিক্ত যোগাযোগ ছিল। ব্লগারদের কারো কারো সাথেও। একবার তাঁর অসুস্থতা এবং ধূমপান করা নিয়ে তাঁর কন্যাটি একটি মর্মভেদী চিঠি লিখেছিলেন তাঁকে, সেই চিঠি সচলায়তনে অনেক প্রশংসাও পেয়েছিল।

এহেন মানুষটি, যিনি তাঁর যাবতীয় পক্ষপাত ও সমালোচনাসহ আমার কাছে আদ্যোপান্ত ভার্চুয়াল একটি চরিত্র, তাঁর মৃত্যুসংবাদ ঘিরে আমার ভেতর জমতে থাকা শোকের চেহারাটি আঁচ করতে চেষ্টা করি। আঁচ করতে চেষ্টা করি, মুহম্মদ জুবায়ের তাঁর ভার্চুয়াল অস্তিত্বের বাইরে কে ছিলেন, কী ছিলেন। তাঁর স্মৃতিকথা থেকে টের পাই তিনি এক স্বাপ্নিক মানুষ ছিলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন, সেই ধারাবাহিকতায় সমাজতন্ত্রের স্বপ্নও দেখেছিলেন। তাঁর লেখক হয়ে-উঠার স্বপ্নের সাথে সেইসব স্বপ্নকে তিনি মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিলেন। এভাবে অনেক খুইয়ে, একসময় জীবনকে গুছিয়ে নেয়ার তাড়না অনুভব করেছিলেন, বেছে নিয়েছিলেন প্রবাস জীবন। কিন্তু স্বপ্ন আর স্বপ্নকে বাস্তবে দেখতে না-পাবার বেদনা তাঁর পিছু নিয়েছিল। নিপুণ আততায়ীর মত। প্রথম প্রজন্মের প্রবাসীর মত তিনিও তাঁর স্বদেশকে বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলেন। এর জন্য বেদনা পাবার দায় থেকে কখনো ছুটি নেন নি। ফলে, কর্মস্থলে, ভিন্ন সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা স্বজনবেষ্টনীর মাঝেও তিনি ছিলেন একা। একেলা।

কিন্তু এ তো মুখস্ত গল্প। এই গল্পের উপসংহার আমরা জানি। কিন্তু আশ্চর্য হই ভেবে যে মুহম্মদ জুবায়ের সেই উপসংহারটি বেছে নেন নি। প্রৌঢ়ত্বকে জয় করে নেমে এসেছিলেন তরুণদের ব্লগে। তরুণদের চোখভরা স্বপ্নের জগতে হয়ে জুবায়ের যেন বুড়ো বাতিওলা! এ এক জয়ের নেশাই বটে! মনে পড়ে, এমনিতর নেশার টানেই সরকারি চাকুরি থেকে অবসর নেয়া কবি মুস্তাফা আনোয়ার আমাদের উদ্দাম জীবনের সাথে সমানে সমানে পাল্লা দিতেন। গ্রেস নিতেন না একদমই। মুহম্মদ জুবায়েরও তাই। জরাগ্রস্ততার অমোঘ খপ্পরে পড়বার আগে মানুষের শেষ রোমান্টিক দ্রোহ!

কিন্তু আজ যখন মুহম্মদ জুবায়ের মারা গেলেন, আমি বিষণ্ণ হয়ে থাকলাম এই ভেবে যে এই নামটিকে ঘিরে আমাদের অন্তহীন ভার্চুয়াল জগতে আর কোনো গালগল্প তৈরি হবে না। মুহম্মদ জুবায়ের এর নামে আর কোনো ব্লগ বা উপন্যাস আপলোড হবে না, যেগুলো পাঠ করে করে আমরা তাঁকে চিনতে থাকবো, তাঁর ব্যক্তিত্ব তৈরি হতে থাকবে আমাদের পারসেপশনের আঁকাবাঁকা গলির ভেতর। শোকের অক্ষর উপচে পড়ছে সচলায়তনে, অন্যান্য ব্লগেও। ভাবি, এই শোকটি কেমন? কিছু টেক্সটের জন্য কিছু টেক্সটের শোক, নাকি টেক্সট-উত্তর অচেনা যোগাযোগহীন ব্যবহারিক জীবনে এর কোনো অভিঘাত তৈরি হয়? মুহম্মদ জুবায়েরকে আমরা তো চিনেছি তাঁর টেক্সট দিয়েই, অর্থাৎ তাঁর লেখাকে তাঁর ব্যক্তিত্বের উপরে আরোপ করে নিয়েছি আমরা। রলা বার্থ যেমন বলেন, লেখকের অস্তিত্ব বা বিদ্যমানতা তাঁর লেখার স্বাতন্ত্র্যকে বাধাগ্রস্ত করে। সেই অর্থে, ব্লগার মুহম্মদ জুবায়ের-এর মৃত্যু যেন প্রতীকী! যেন তিনি তাঁর মরণ দিয়ে মুক্ত করে গেলেন তাঁর রচনারাশিকে, আমাদের মননে তাঁর ব্যক্তিত্বের সংগঠন প্রক্রিয়া থেকে। টেক্সটের বাইরে সত্যিকারের যিনি জুবায়ের, যার একটা ফুসফুস অকেজো ছিল অনেকদিন, যিনি অনেকের বন্ধু, ভাই বা পিতা, তার শরীরী মৃত্যুতে আমাদের ভার্চুয়াল-পেরোনো ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীজীবন কতখানি শোকতপ্ত হবে? সেই অর্থে এটি অথরের মৃত্যু, একটি টেক্সচুয়াল মরণ। এই টেক্সচুয়াল মরণের স্মরণে আমরা যে শোকগ্রস্ত হচ্ছি সেটিও টেক্সচুয়াল, এবং টেক্সটের বাইরেও যদি এর সন্তাপ আমরা অনুভব করি, তবে সেও টেক্সটেরই সামর্থে।

আরেকটা বিষয়: মার্কেজ একটি উপন্যাসে যেমন লিখেছেন, কেবলমাত্র মৃত্যুই মাটির সঙ্গে মানুষের নাড়ির যোগ ঘটাতে সক্ষম। অর্থাৎ যে মাটিতে আমার অধিষ্ঠান সেখানে আমার পূর্বপুরুষের কবর থাকলেই সেটা অনেক দৃঢ় হয়ে ওঠে। মুহম্মদ জুবায়ের-এর মৃত্যুশোক তাঁর ব্লগিং ফোরাম সচলায়তনে সেইরকম ইতিবাচক একটি প্রভাব ফেলবে মনে হয়।