বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০০৮

মধ্যবিত্তের কানসাট ও আন্তঃবিত্তীয় যোগাযোগ

কবিসভায় তর্ক হৈতেছিল কানসাট, মধ্যবিত্ত এবং আন্তঃবিত্তীয় যোগাযোগ লৈয়া। কানসাটের বিক্ষোভের সাথে সংহতি প্রকাশ করার জন্য কয়েকজন সংবেদনশীল কবি-সাহিত্যিক-রাজনীতিক একটা সভা আহ্বান করছিলেন টিএসসি-তে, সেইখানে উনারা উনাদের উদ্দিষ্ট শ্রোতৃমন্ডলীর ভিতর দুইচাইরজন ‘শ্রমিক শ্রেণীর’ লোক দেখতে চাইছিলেন। সেইটা ছিল জনাব ব্রাত্য রাইসুর আপত্তির বিষয়। ১. রাইসু মধ্যবিত্তের আয়োজন-করা সমাবেশে শ্রমিক শ্রেণীসদস্যদের এইরকম প্যাসিভ অংশগ্রহণের মধ্যে কোনোই মাহাত্ম্য পান নাই। তার কাছে একটা বহুচর্চিত ফর্মাটের মতই লাগতেছিল এই ধরনের আমন্ত্রণ। এবং ২. এই ধরনের সভাকে নিম্নবিত্তের তরফে মধ্যবিত্তের মতা কুক্ষিগত করা বা জাতির বিবেক হৈয়া উঠার প্রচেষ্টা লাগে রাইসুর।

রাইসুর প্রথম যুক্তি না-মানার কোনো কারণ দেখি না। প্রতিবাদ সংহতির উদ্দেশ্য যদি হয় ‘কানসাটের ঘটনাকে মধ্যবিত্ত সমাজে চাউর করা’ (ফারুক ওয়াসিফের চিঠি) তাইলে সেখানে শ্রমিক শ্রেণীর ‘স্যাম্পল’ রাখার কী ফায়দা? সেটা কি এজন্য যে, এতে কৈরা কানসাট লৈয়া মধ্যবিত্ত সমাজে আরো যা যা আলোড়ন-বিলোড়ন চলতেছে, তাদের সবার থিকা এই সংহতিসভার আয়োজকবৃন্দ যে বেশি ‘মূলানুগ’, কিংবা প্রতিনিধিত্বশীল -- সেই দাবি করতে পারেন? (বাক্যটা জটিল হৈয়া গেল! একটু ভাইঙ্গা ভাইঙ্গা বুইঝা লৈয়েন সবাই।)

অরূপ রাহী, ফারুক ওয়াসিফ কিংবা ইফতেখার মাহমুদ (আরো যারা যারা যুক্ত ছিলেন এই সংহতিসভায়) প্রমুখের নিম্নবিত্ত-দরদে আমার ব্যক্তিগতভাবে কোনো সন্দেহ নাই। এমনকি, গোটা মধ্যবিত্তসমাজে দলিত-সমব্যথী যারা যারা আছেন এবং নানাভাবে সেইটা প্রকাশ কৈরা যাইতেছেন, তাদের সবার মধ্যে এই ভাইদের (রাহী-ওয়াসিফ-লিপু)অগ্রগণ্য বিবেচনা করতেও আমি পিছপা নই। কিন্তু উনাদের সংহতিসভায় শ্রোতাশ্রেণীর যে সাম্যবাদ, বা ক্রস-শ্রেণী-অভিসার, সেইটা উদ্দেশ্যের দিক থিকা মহৎ মনে হৈলেও যোগাযোগের জ্ঞানগত বিবেচনায় কিছুটা অবাস্তব, তাতে সন্দেহ নাই আমার।

কিন্তু, মধ্যবিত্ত যদি নিম্নবিত্তের (তথা জাতির) কণ্ঠস্বর হৈবার চায়, তাইলে কী ক্ষতি (রাইসু এবং ভাস্করকে প্রশ্ন)? ইতিহাসে দেখা গেছে, নিম্নবিত্ত তাদের প্রয়োজনে সমব্যথী মধ্যবিত্ত সমাজের কাউকে নেতা বানায় (স্পার্টাকাস, লেনিন, মাও, হালে রব্বানী)। হয়ত এজন্য যে, একক কণ্ঠস্বর হৈয়া উঠার যে মধ্যবিত্তীয় সংস্কৃতি, সেইটা নিম্নবিত্ত আয়ত্ব করতে চায় না। কিংবা এজন্য যে, অভিজাতের সাথে লড়াইটা কয়েকধাপ ওপর থিকা আরম্ভ করবার যোগাযোগগত সুবিধা। নিম্নবিত্ত যদি মধ্যবিত্তরে তাদের প্রয়োজনে নেতা বানায়া ‘ইউজ’ করবার পারে, তাইলে মধ্যবিত্তও শ্রেণীগত নেতৃত্বলাভের বাসনা থিকা নিম্নবিত্তের আন্দোলনের পুরোভাগে (সমব্যথাসহ) দাঁড়ায়া যাইতে পারে। পারে না? এখানে বিষয়টাকে স্ট্র্যাটেজি অর্থে বিবেচনা করা ভাল, নীতিশাস্ত্রের দিকে না গিয়া। কারণ, নীতিশাস্ত্র প্রথমেই এই তর্কের প্রিমাইজটাকে চ্যালেঞ্জ করে: যা কিছু মহত্ত্ব সবই নিম্নবিত্তের আর যা কিছু ‘খাউজানি’ সবই মধ্যবিত্তের? এই ধরনের মূল্যারোপ নীতিশাস্ত্রসম্মত নয়।

কানসাট বিষয়ে প্রশ্নজাগর হওয়ায় রাইসুরে উছিলা কৈরা ‘কবিসভা’ তথা কবি সাহিত্যিকদের রাজনৈতিক ‘নিষ্ক্রিয়তা'কে বেশ একচোট নিলেন কেউ কেউ (উনারা নিজেরাও কবিসভার মেম্বার!)। এইটা দৃষ্টিকটু ও শ্রুতিকটু শোনাইছে। কে কখন কোন্ উদ্দীপনায় গরম হৈয়া উঠবে, সেইটা আন্দোলনের মাহাত্ম্য দিয়া ডিকটেট করা যায় না (তাইলে আমবাগানের জনগণ পলাশীর যুদ্ধের দর্শক হৈয়া থাকতেন না!) বাংলা সাহিত্য কার পানে ‘ভেটকাইয়া’ পৈড়া আছে সেইটা বাংলা সাহিত্যের অন্তর্যামী জানেন, আর বাংলা রাজনীতি কার পানে ভেটকাইতেছেন সেইটাও আগাম বৈলা দেওনের ব্যবস্থা নাই। থাকলে যে সংহতিসভার দাওয়াত আমরা পাইছি, সেইটা আরো আগে আয়োজিত হৈতে পারত। হয় নাই, কারণ আমাদের উদ্দীপ্ত হওনের নিজ নিজ ধরন আছে, ব্যক্তিভেদে, গোত্রভেদে, সংগঠনভেদে।

‘মহান’ কোনো মিশন নাই এমন সাহিত্যের দিকে অতীতের বামরাজনীতি একটু চোখ গরম কৈরাই তাকাইছে। যেন সাহিত্যের পুলিপিঠা একমাত্র তারই ভাপে সিদ্ধ হওয়া উচিত। মহাত্মা সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি, মায়াকভস্কি প্রমুখ এই কর্মকাণ্ডে বিস্তর ইন্ধন (অজ্ঞাতসারে) জোগাইছেন। উনাদের কর্মকান্ডের ওপর ভর কৈরা বামপন্থা ‘ঈমানপাতলা’ সাহিত্যিকের জন্য একটা ম্যানুয়াল বানাইবার চাইছে সেই সোভিয়েতকাল থিকা। সেই ম্যানুয়াল যুগে যুগে চাপান হৈছে পাস্তরনাক কিংবা সোলঝেনিৎসিন প্রমুখের কলমের আগায়। উনারা পলায়া পলায়া বাঁইচা ছিলেন, অনেকে পলায়াও বাঁচবার পারেন নাই। সেই আমলে স্ট্যালিনের হাত নাকি খোদার হাত থিকাও লম্বা আছিল!

সেই রামও নাই, অযোধ্যাও নাই। তবু মাঝে মাঝে ফোঁসফাঁস ফোঁসফাঁস শোনা যায়।

আরেকটা বিষয়: মানি আর নাই মানি, মধ্যবিত্ত মূলত প্রদর্শনের রাজনীতির-ই ভোক্তা। কানসাটের বিক্ষোভ নাগরিক মধ্যবিত্তের কাছে একটা টেলিভিজুয়াল রিয়েলিটি। অর্থাৎ, যারে ‘কর্পোরেট’ বৈলা গালি দেই, সেই মিডিয়াই কানসাট-কে আমাদের মত ‘বিবেকবান’ মধ্যবিত্তের সামনে হাজির করছে। আমাদের দিলে সহমর্ম তৈয়ার করছে। এইসবের কিউমিলিটিভ পরিণামেই সরকার তার মারদাঙ্গানীতি বদলাইতে বাধ্য হৈছে। কানসাটের বিজয় উদযাপনে টিএসসি-র সংহতিসভার যে ভূমিকা, তার চেয়ে সেই বিজয় অর্জনে মিডিয়ার গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। বেশি কি না, সেইটা হিসাব করলেই বোঝা যায়। যদি না বোঝা যায়, ‘কর্পোরেট’ মিডিয়ার এই রোল প্লে-কে যেসমস্ত রাজনৈতিক তত্ত্বকাঠামোর মধ্যে প্রশংসা করা না যায়, সেসমস্ত রাজনীতির খোলনলচা পাল্টাইবার সময় আসছে।




২০০৬




পরিশিষ্ট (কানসাট তর্কের নির্বাচিত অংশ)




`jeishob KLSB-sramik-peshajibi-rajnoitik-shangskritk kormi'- punjibad, purushtantra-shoshon-nipiron-nirjaton er biruddhe kaj korte chai, tader moddhe amar nam thakle amar bhaloi lagbo. ei lobh amar ase.ami ei lobher charcha kori. porishkar. porichoy to shamajik-rajnoitik nirman.

shobhar shobbho ra ki bolen?
[অরূপ রাহীর চিঠি]

টিএসসিতে আয়োজিত প্রতিবাদ সংহতির একটা লক্ষ্য ছিল, কানসাটের ঘটনার তাৎপর্যকে মধ্যবিত্ত সমাজে চাউর করা। আরেকটি লক্ষ্য ছিল, কানসাট যেভাবে পল্লীবিদ্যুতের শোষণ এবং রাষ্ট্রের খুনী চরিত্রকে তুলে ধরেছে, মধ্যবিত্ত মহলে তার জের টেনে লড়াইয়ের
ধ্বনিকে প্রতিধ্বনিত করা।
[ফারুক ওয়াসিফের চিঠি]

আমরা সুশীল লেখকেরা পরিচিত সম্ভাবনাময় সুশীল শ্রমিককূলেরে নিয়া একটি সংহতি সমাবেশ আসলে কী কারণে করুম! আর তাও আমাগো এলাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা সংলগ্ন! কারণ সেই প্রচার! আমি এই উদ্দেশ্যরে নেতিবাচক দেখি না অবশ্যই! কিন্তু এই অভিপ্সারে আমার মধ্যবিত্তের কুরকুরানীবৎ-ই লাগে!
[ভাস্কর আবেদীন-এর চিঠি]

shobkisui rajniti hoite pare hoito, tobe rajnitir ekta kaj hoilo shatru-mitra bhed, pokkho-bipokho-niropekkho khela chinte para.apne kar pokkhe ba niropokkhe? na ki gorib, borolok, moddhobitto shobar bibhinno bishoy e nijer pokkhe kotha bolen?


somaj shongshar nia apner kono nirdisto bekkha ase naki? ja dia amra 'shathik' upaye cholte firte bolte ebong na bolte pari? na ki , `tui cholte lag, ami tor pison thika shoja-dan-bam komu' ei line-e asen?


[অরূপ রাহীর প্রশ্ন, ব্রাত্য রাইসুকে]

gorib-er andolon luth koira nia buddhijibira je jatir konthoshor hoiya othar cheshtai roto kintu hoite partese na eita sthitabostha? sramik-ra je lekhok kabi buddhijibigo loge ek pongktite boshtei partese na eita sthitabostha?

[ব্রাত্য রাইসুর প্রশ্ন, অরূপ রাহীকে]


এক সাক্ষাৎকারে চমস্কিরে জিজ্ঞেস করা হইছিলো, বুদ্ধিজীবীর দায় কী। উত্তরে চমস্কি কইলো, কাজ হইলো সহজ জিনিসরে জটিল কইর‌্যা তুইল্যা ধরা।...... রব্বানী কানসাটের মানুষগরে আকাঙ্ক্ষারে ধারণ করতে পারছিলো বইল্যাই হেরে নেতা বানাইছে মানুষ। যখন আর ধারণ করতে পারবো না, তখন লাথ মাইর‌্যা সরাইয়া দিবো। আমার স্বল্পজ্ঞানে এতটুকুই বুঝতাছি।
[বাঁধন অধিকারী]


lekhok, kabi, buddhiji-go loge jokhon sromikgo kotha tola hoi tokhon shurutei sromik je lekhok, kabi ba buddhijibi hoite pare na ba parbo na ei shiddhanto deoya
hoiya jai. tokhon oi shobhai alongkarer adhik kono kam thake na sromik shahebgo.

[ব্রাত্য রাইসু]


এই শহরে সভা করিয়া ‘কলা’ করা হয়। কলার (আর্ট) নানান ছাল-বাকলা ছিড়িয়া রসাস্বাদন চলে। বাংলা সাহিত্য আপনাদের পথপানে ভেটকাইয়া পইড়া আছে, আপনারা তাকে উদ্ধার করবেন এই ভরসায় আছিলাম, আর দেখছিলাম সেইখানে কত কত বিষয়, কত মহার্ঘ আলোচনা উঠিতেছে আর পড়িতেছে, কত আগডুম বাগগুডুম ধ্বনিতে কান জারবার হইতেছে-তারপরও ভালই ছিল। খামাখা রাজনীতির কথা আনা রাহীর ঠিক হয় নাই। আপনারা তো ওইসব ভাবেন না।

[ফারুক ওয়াসিফের চিঠি]