মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

মানলে তালগাছ, না মানলে বালগাছ!!

বিনয় মজুমদারের একটা কবিতার উদ্ধৃতি আমি দিয়েছিলাম। ব্রাত্য রাইসু সেইটাকে ‘নর প্রাকৃতিক জৈব কবিতা’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। এই ধরনের অভিধার কথাও মনে হয় আর কেউ বলেন নাই। ফলে স্বত্ব রাইসুর, সন্দেহ নাই। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, সেই কবিতার শিরায় শিরায় রবীন্দ্রনাথের মনুমেন্টপ্রমাণ অবস্থান নিয়ে একটা পরিষ্কার বিদ্রুপ বহমান, যেটা রবীন্দ্রনাথের অবদানকে পাশ কাটায় না, সহমর্মী থাকে। বিনয়ের সময় হয়ত রবীন্দ্রনাথকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার স্পর্ধা অর্জন করে নাই, যেটা অর্জন করেছে ব্রাত্য রাইসুর সময়, বা তিনি হয়ত তার সময় থেকেও অনেকখানি এগিয়ে (এগিয়ে বলছি, যেহেতু তেমন কাউকেই পাচ্ছি না, যে, উইদ ফুল থ্রটল, রাইসুর সাথে একমত হইতে পারতেছে)।

আমি (ভুলক্রমে!) একটা পাটাতনের ইঙ্গিত করেছিলাম। যেহেতু আমি বিশ্বাস করি কোনোকিছুই রাতারাতি ডিম ফুইটা বাইর হয় না। আমার ধারণা ছিল, রবীন্দ্র প্রসঙ্গে ব্রাত্য রাইসুর র‌্যাডিক্যাল অবস্থান ঐতিহাসিকভাবেই বিকশিত হয়েছে। বিনয়কে একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে মানছিলাম। কিন্তু রাইসু’র মনে হয়েছে, এইটা উনার বক্তব্যের মেরিট যাবতীয় গরুগাধাকে বণ্টন করে দেয়ার একটি সুমন রহমানীয় চক্রান্ত। রাইসুর বক্তব্যের স্বত্ব তার কাছ থেকে ছিনায়া লইয়া যাওয়ার একটা স্নিগ্ধ চেষ্টা। সেই কোপ থেকে পাটাতনকে তিনি ‘পাঠাতন’ লিখলেন, তার মানে বিনয় বা অন্যান্য ‘পাঠা’দের সাথে একমঞ্চে উচ্চারিত হওয়ার কোনো খায়েশ উনার নাই।

ভাই রাইসু, আপনার বক্তব্যের মেরিট আপনারই। আমার বিবর্তনবাদ (বা ঐতিহাসিক বিকাশবাদ) আমারই থাক, ধইরা নিই যে আপনার রবীন্দ্র-অবধারণ মোটামুটি নবুয়তের ফর্মেই আপনের ওপর নাযিল হইছে। কিন্তু তাতেও একটা সমস্যা পাকাইতেছে আপনারই লেখা একটা কবিতা।

বিরহে পরাণ থরোথরো
ঘুরে মরিব একেলা
গাবো ঠাকুরের গান

এমন দিনেই তারে বলা যায়
যা বলিনি এতদিন
প্রথমত বৃষ্টির অভাবে

আর আমার জন্যই এল এই গান জলের ওপরে ভেসে ভেসে

(ব্রাত্য রাইসু, বর্ষামঙ্গল, আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি)

বিরহাক্রান্ত রাইসু একা একা ঘুরে ঘুরে ঠাকুরের গান গাইতেছে, এই কবিতার চিত্র যদি মোটামুটি এইরকমই হয়, তাইলে উহারে দয়া কইরা একটা অভিধা দিয়া দিবেন কি? আমাদের একটু বইলা দিবেন কি, এই কবিতার সাথে আপনের বর্তমান রবীন্দ্র-অবস্থানের কোনো ধারাবাহিকতা আছে কি না? জানতে ইচ্ছা করতেছে।

কবিসভা বড় অদ্ভূত জায়গা। এইখানে কোনো তর্কেরই মিমাংসা হয় না, এমন কি অনেক মিমাংসিত তর্কও এইখানে টগবগ কইরা ফোটে (এটা মন্দ না)। এইখানে প্রতিপক্ষ হইয়া যারা কোনো তর্ক আরম্ভ করেন, প্রতিপক্ষ থাইকাই তারা আলোচনা ক্ষান্ত দেন, বুঝি বা ক্লান্ত হৈয়া পড়ার কারণে। এইরকম অনেক ঈমানদারের সাক্ষাৎ এইখানে মিলে।

মানভাষা-ঊনভাষা তর্ক একটি পোস্ট কলনিয়াল চিন্তাদশা, এইটা বুঝতে আমার দুইটাকাও লাগে না। এই তর্কের পরিবেশ তৈরি হইছে ক্ষমতা-সম্পর্কের নানান ইতিহাস, নানান তত্ত্ব ও ঘটনার পাটাতনের (পাটাতনই লিখলাম, কী আর করা!) ওপর দাঁড়িয়ে। জাস্ট অ্যা মেয়ার পোস্ট-কলোনিয়াল ইমপ্লিকেশন! এইটা একটা ভাল এজেন্ডা বইলা আমার ধারণা, আমি এই এজেন্ডার খুব ভক্ত। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন এইটা কোনো ইতিহাস-নিরপেক্ষ দশা থেইকা তার ওপর হঠাৎ কইরা নাযিল হইছে, সেইটা তার ভাবনা, তার সুখ।

আরো স্পেসিফিক হইয়া বলি: ধরা যাক, বাংলা সাহিত্যে যত রবীন্দ্র বিরোধিতা আছে সব একজাতের, শুধু রাইসুরটা আলাদা জাতের। এক্ষণে আমি জানতে চাই, ব্রাত্য রাইসু তার রবীন্দ্র বিরোধিতায় এ পর্যন্ত যত বাক্য লিখেছেন, তাত্ত্বিকভাবে তার মধ্যে এমন কোনো বক্তব্য কি আছে, যেটি পোস্ট-কলোনিয়াল চিন্তার ধারাবাহিকতা ছাড়া এসেছে?

আমাদের গ্রামে লোকজন কয়, মানলে তালগাছ না মানলে বালগাছ। যারা এইটা কয়, বা যে অবস্থায় কয়, সেইটা হইল কাউরে তালগাছও না বানানো, বালগাছও না বানানো। কারণ, কাউরে তালগাছ বানানো সহজ, এর চেয়ে সহজ বালগাছ বানানো।


ঢাকা, ১৬ মে ২০০৫


কোন মন্তব্য নেই: