
বিপুলা এই টেলিভিশন মিডিয়ার সম্ভাবনার কতটুকু জেনেছি আমরা? সর্বসাকুল্যে টেলিভিশন অনুষ্ঠান বলতে খালি দেখছি বিভিন্ন দৈর্ঘের নাটক, বিভিন্ন প্রস্থের টকশো, আর নানাবর্ণের আইডল প্রতিযোগিতা। এর বাইরে বিস্তীর্ণ অভিজ্ঞতার যে দেশ, সেখানে এই বাক্সটির সম্ভাবনা কীরকম? গতানুগতিক এই সমস্ত ফর্মাটের বাইরে নতুন কোনো বিনোদনের সুযোগ আছে কিনা টেলিভিশনে?
এরকম একটি জায়গা থেকেই চন্দ্রবিন্দুর কথা ভাবা। ২০০৫ সাল সেটি, আমি শিল্পসাহিত্যে দৃষ্টিসংবেদন নিয়ে গবেষণা করছি, একই বছরে এটি দেখা না-দেখার চোখ নামক বই হয়ে বেরোয়। ব্যতিক্রমধর্মী ঐ সংকলনের কাজ করতে করতে কথাশিল্পী শাহাদুজ্জামানের সাথে চন্দ্রবিন্দু নিয়ে অনেক আলাপ, কবি সাজ্জাদ শরিফের সাথেও। চিন্তার জট খুলতে থাকে, বন্ধু এবং মেধাবী নির্মাতা নূরুল আলম আতিক প্রবল উৎসাহে এগিয়ে আসেন। তারপর অনেকদিন ধরে চন্দ্রবিন্দু এগিয়ে চলছিল এই চতুষ্টয়ের চিন্তার মিথষ্ক্রিয়ায়। এই পর্যায়ে একটা ছন্দোপতন: আমাকে চলে যেতে হয় দেশের বাইরে। কিন্তু থেমে থাকে নি চন্দ্রবিন্দু, বরং আতিকের সুযোগ্য চিন্তায় ও সৃজনী দক্ষতায় তরতর করে বেড়ে উঠতে থাকে। আমি দূরদেশে বসে খবর পাই। পরম আনন্দ হয়।
চন্দ্রবিন্দু বানানোর মূল প্রণোদনা কি? এক কথায় এর উত্তর দিতে গেলে বলতে হয়, শ্রেণীনির্বিশেষে মানুষে মানুষে যোগাযোগের একটা পাটাতন তৈরি হয় কিনা সেটা খতিয়ে দেখা। ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের এই কালে মানুষ তার ধর্মের কিংবা শ্রেণীর ঘেরাটোপে যেভাবে বন্দী হয়ে পড়ছে, তার ফলে কবুতরের খোপের ভেতর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে আটকা পড়েছে চিরকালের কথকতা। কিন্তু ধনীর বারান্দায় যেমন বৃষ্টি পড়ে, গরিবের ঘরেও। তাদের প্রত্যেকেরই শৈশব আছে, আছে ভুতের ভয় কিংবা মায়ের কাছে যাবার আকূলতা। একই আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ছে বিভক্ত সমাজে, ফলে তার অর্থ ও অনর্থ স্থানবিশেষে ভিন্ন হয়ে যায়। আমরা ভিন্নবিভক্ত হয়েই একে মোকাবেলা করি, ভুলে যাই এর অভিন্ন উৎসের কথা। চন্দ্রবিন্দু আমাদের এই প্রতিদিনের খন্ডিত অনুভবগুলোকে আশ্রয় করেই চিরকালের বাঁশিটি বাজাতে চেয়েছে।
চিরকালের বাঁশি চিন্তায় বাজানো যত সহজ, পর্দায় বাজানো ততই কঠিন। বিশেষ করে যে পর্দায় স্টেরিওটাইপ ইমেজ আর বাণিজ্যের জংলীজটিল রাজনীতি দিয়ে মধ্যবিত্তের বিনোদন তৈরি হয়, সেখানে ভিন্নধারার একটি অনুষ্ঠানের জন্য জায়গা পাওয়া খুবই মুশকিল। কিন্তু নুরুল আলম আতিক দমে যাবার পাত্র নন, তাই তো নানান বৈরী অবস্থা পার হয়ে চন্দ্রবিন্দু আজ চ্যানেলআই-এর পর্দায়। এর মধ্যেই দর্শক এর প্রথম পর্বটি দেখে ফেলেছেন। চন্দ্রবিন্দু কতটা সফল কিংবা কতটা ব্যর্থ সে বিচারের ভার তাঁদের ওপর। কিন্তু আমি খুশি আমার একটি ভাঙাচোরা স্বপ্নকে এত নিপুণভাবে বাস্তবের পর্দায় হাজির হতে দেখে। আতিক সেটি করেছেন, তিনি এই স্বপ্নের যেমন সারথী ছিলেন তেমনি বাস্তবেরও রূপকার হয়ে দেখালেন। চমৎকার একটি সেটে অনবদ্য লাগছে শারমিন লাকী-র নাটকীয় উপস্থাপনা। চন্দ্রবিন্দু জয়যুক্ত হোক।
৩টি মন্তব্য:
প্রোগ্রামটা দেখছি ... ছাড়া-ছাড়া ভাবেই, যেভাবে টিভি দেখি আর কি ... কিছুক্ষণ পর পর চ্যানেল ঘুরে ঘুরে ... ভালো লাগে নাই খুব একটা ... যেমনটা আপনি বলছেন যে, শ্রেণীনির্বিশেষে যোগাযোগের একটা সম্ভাবনার চেষ্টা করা, এইরকম মনে হয় নাই ... খুব বাজেভাবে বলতে গেলে, খাপ-ছাড়া এবং সমন্বয়হীন একটা ব্যাপার বলে মনে হইছে, একই কারণে মনে হইছে ইন-কমপ্লিট, আর আসলে আমি তো পুরাটা দেখিও নাই, সেই অর্থে তো অবশ্যই ... আর একটা ব্যাপার, শিল্প-সাহিত্যের উদাহারণ হিসাবে যেমন নাটক-সিনেমা আসছে; গল্প-উপন্যাস-কবিতা আসে নাই (থাকলে দেখি নাই) ... নতুন একটা কিছু করার চেষ্টা হইছে, এইটাতে আমার কোন দ্বিমত নাই, কিন্তু একজন মধ্যবিত্ত দর্শক হিসাবে খুব বেশি পরিতৃপ্তি পাই নাই ... হয়তো এঙ্পেক্টশন বেশি ছিল, হয়তো মনোযোগ-ই ছিল না, হয়তো স্ত্রিপ্টটা ভালো ছিল না, সাজানোটা পছন্দ হয় নাই ... আরো কত কি-ই.তো হইতেই পারে ... একবার দেখলাম ব্রাত্য রাইসু একুশে টিভিতে সন্ধ্যাবেলার প্রোগ্রাম প্রযোজনা করতেছেন, সেইখানে তামিল নাচ, রাশিয়ান গান আর বাংলা-নাটক এর অংশ-বিশেষ চলতেছে, ব্যাপক বিনোদনের প্রয়াস ছিল সেইখানে, পরে উনি অবশ্য এর সাথে তাঁর সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করছেন ... অনেকটা ঐ টাইপেরই একটা ধারণা হইতেছিল, চন্দ্রবিন্দু দেখতে গিয়া ... যা-ই হোক, অন্য রকম একটা প্রোগ্রাম, আরো ভালো হবে নিশ্চয়ই, দেখারও আগ্রহ থাকলো ...
ইমরুল
চন্দ্রবিন্দু এখনো দেখা হয়নি। তবে প্রোমো দেখেছি। দেখে নিয়ে বিস্তারিত বলব।
খুব সুন্দর সাজিয়েছেন আপনার ব্লগটা। আমাদের নতুন পাড়ায় আসেন না ক্যান?
স্বপ্ন আর বাস্তবের ফারাক তো থাকেই। আমার মনে হয় আমি যেভাবে ভেবেছিলাম তা থেকে আতিক যেভাবে বানিয়েছেন, তার দূরত্ব কিছু আছে। কিন্তু আমার ভাবনাটা বাস্তবায়িত হলেই যে চন্দ্রবিন্দু আরো ভালো যোগাযোগ করতে পারতো এমনটাও নয়। এ ধরনের একটা প্রোগ্রাম করার জন্য দরকার অনেক বেশি রিসোর্স, সে আর্কাইভ হোক বা নতুন ফুটেজই হোক। সঙ্গত কারণেই সেই সুযোগ আমাদের দেশের নির্মাতারা খুব পাবেন এমনটার সম্ভাবনা তো দেখি না। তবে এটা নিশ্চয়ই ঠিক যে গতানুগতিক নাটক আর টকশো-র ভিড়ে চন্দ্রবিন্দু একটি ভিন্ন স্বাদ, একটা নতুন খোলা জানলা।
আরেকটা বিষয়, আতিকের মাথায় প্রতিদিনের টেলিভিশন দর্শককে খুব বেশি চমকে দেয়ার ইচ্ছা ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন দর্শক অন্যান্য প্রোগ্রামে যতটুকু মেধা বা মনোযোগ খরচ করেন তা দিয়েই যেন এই নতুন বিনোদনের নাগাল পান। ফলে চন্দ্রবিন্দু খুব ঘন বুনোটের হয়ে উঠে নি। আমার পরিকল্পনা ছিল একটু অন্যরকম। আমি রীতিমত "ভারী" জিনিসপত্র এই ভিজুয়ালের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।
অলৌকিক অনেক ধন্যবাদ। আসবেন অবসরে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন