শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

অতিগরিবের ক্ষুধা-ব্যবস্থাপনার ভেতরে কোনো এক দিপালীর আত্মহত্যা



ভৈরবের দিপালীদের পরিবারে এখন অন্য অবস্থা। চাল আসছে, ডাল আসছে, এনজিও আসছে, ভিজিএফ কার্ড আসছে, ওয়ার্ড কমিশনার এসে সকালসন্ধ্যা খোঁজ নিচ্ছে। মেঘ না চাইতেই ঝড়!

ঝড়-ই তো। দিপালী যখন গলায় দড়ি দিয়ে ক্ষুধার জ্বালা চিরতরে মিটাল, তখন দিপালীর পঙ্গু বাবা ভাবছিলেন মেয়ের অন্তিম সৎকারের অর্থ জোগান দেবেন কিভাবে? কিন্তু কোত্থেকে কী যেন ম্যাজিক হয়ে গেল, মেয়েটা মরে গেল, আর সঙ্গে-সঙ্গেই রূপকথার মত অদ্ভূত সব ঘটনা। যে সমস্ত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের স্বপ্নও তিনি দেখেন নি, তারা এসে হাজির: সমবেদনাসহ, খাদ্যসহ, চাকরিসহ। একের পর এক রিকশা আর মোটরসাইকেল এসে থামছে তার ছাপড়ার সামনে, হতভাগা মেয়েটার জন্য মনের মধ্যে এক পশলা শোকও জমতে দিচ্ছে না।

পালা করে খেত দিপালীর পরিবার। আটজনের এই পরিবারে নিয়ম ছিল, যে-চারজন দুপুরে খাবে, রাতে তারা উপোস করবে। রাতে খাবে অন্য-চারজন। এভাবেই চলছিল তাদের ক্ষুধা ব্যবস্থাপনা। ভালই চলছিল। গোলমালটা লাগল, যখন দিপালীর প্রতিবন্ধী এক ভাই নিয়ম ভেঙ্গে পরপর দুইবার খেয়ে বসল। তাতে দিপালীর কপাল পুড়ল, ক্ষুধার যন্ত্রণার চেয়ে তার কাছে মৃত্যুকেই বেশি শান্তির মনে হল।

এরকম হয়েই থাকে। ‘ক্ষুধা-ব্যবস্থাপনা’র যে দেশব্যাপী নীরব দযজ্ঞ চলে, তার খোঁজ সরকার নেয় না, এনজিও-র ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পে তাদের জায়গা নাই, সংবাদপত্রের পাতায় তার সংকুলান হয় না ঘটনাহীনতার কারণে। এরমধ্যে হঠাৎ কোনো এক দিপালী মাঝখান থেকে দুম করে মরে বসে, বিব্রত হয় মধ্যবিত্তের সিভিল বিবেকব্যবস্থা। কিন্তু না হলেও চলত! কারণ পরিসংখ্যানে ‘স্ট্যান্ডার্ড এরর’ বলে একটা বিষয় আছে না? ক্ষুধা ব্যবস্থাপনার এই যে সর্বব্যাপী আয়োজন, তাতে দুয়েকটা দিপালী তো পরিসংখ্যানের নিয়মেও ঝরে যেতে পারে! পারে না?

এই হল শাস্ত্রের আসল নাম: নিখাদ নিপাট ক্ষুধা ব্যবস্থাপনা। এসেটহারা গরিবের ক্ষুধা ব্যবস্থাপনা। এসেট নাই বলে সে ক্ষুদ্রঋণ পায় না, এনজিওর খাতা তার সামনে খোলে না। সরকারের তো দুইশ টাকার ভিজিএফ মশকরা, ক্ষুধার পেটে বয়স্কভাতার চুলকানি, তার দরজাতেও কত পেট-ভর্তি মানুষের ভিড়! আর বিত্তবান সমাজ? দিপালীর বাবা চেয়ে চেয়ে দেখেন ওদের। বুঝতেই পারেন না, জীবিত দিপালীর চেয়ে মৃত দিপালীর কদর এত বাড়ল কোন্ নিয়মে?


দিপালীদের পরিবারে যেভাবে ক্ষুধার ‘ব্যবস্থাপনা’ চলছিল, দিপালী আত্মহত্যা না করলে তা হয়ত সংবাদপত্রবাসী জানতই না। এভাবে নীরবে নিভৃতে ভয়ংকর ক্ষুধার সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে তাদের জীবন গড়িয়ে চলত। ষাট বছরের আয়ু তিরিশ বছরে ঠেকে যেত, অমর্ত্য সেন যাকে বলেছিলেন ‘নীরব দুর্ভিক্ষ’। সেই অবসরে জিনি ইনডেক্স লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ত, ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল-এর বাৎসরিক প্রতিবেদনের মুখে মন্ত্রী বাহাদুরদের আস্ফালন দেখে খোদ দুর্নীতির দেবতাই বিব্রতমুখ হয়ে থাকত, আর পলিথিনের ছাউনি-দেয়া ছাপড়ার ঘরে বসে বসে সর্বগ্রাসী ক্ষুধার সাথে দিপালীদের এই কুটনীতি চলতেই থাকত!

এখনও তো চলবে সব-ই। প্রকল্প পরিচালকের পাজেরো চলবে, মাইক্রোক্রেডিট সামিট চলবে, দারিদ্র গবেষণায় দেশ সয়লাব হয়ে যাবে। চলবে না খালি দিপালীদের সাবেক ‘ক্ষুধা-ব্যবস্থাপনা’। কিছু বিবেকবান মানুষের তৎপরতায় এখন তাদের খাওয়া হচ্ছে তিন বেলা (কিন্তু কতদিন?)। আবার গরিবের জন্য তিন বেলা খাওয়াও কম বিপত্তির নয়! কোষ্ঠ তরল হয়ে যায়, ঘন ঘন ল্যাট্রিনে যেতে হয়, একথা বেগুনটিলা বস্তির বৃদ্ধা গুলবানু বলেছিল।

দিপালীর পরিবার তাদের এই গরিবি জানান দিতে চায় নি। তাই নিজেরা নিজেদের ‘ব্যবস্থাপনা’ তৈরি করেছিলেন। দিপালী আত্মহত্যা করায় সিভিল সমাজের জ্ঞানপাপ হয়ে গেল! আমরা জেনে ফেললাম, গরিব কিভাবে তার সবচেয়ে মৌলিক চাহিদার সাথে খেলে। ফলে, দিপালীর পরিবারের মত আরো অতিগরিব যারা আছে, যাদের ধারণা গরিবি জানান দেয়ার বিষয় নয়, তারা আরো সতর্ক হয়ে যাবে। এমনিতেই তারা সমাজে অস্পৃশ্য হয়ে থাকে, এরপর থেকে অদৃশ্য হয়ে থাকবে। ক্ষুধার আরো নিবিড় ‘ব্যবস্থাপনা’ বের করবে তারা। যেখানে আত্মহত্যাজাতীয় কোনো স্ট্যান্ডার্ড এরর থাকবে না, ফলে সিভিল বিবেক আসন্ন ঈদের প্রাক্কালে রং ঝলমল প্লাজার সামনে কোনোরকম দংশনে পড়বে না।

‘অতিগরিব’ নামে সমাজের একটা অংশের কথা অনেকেই স্বীকার করেন শুনি, কিন্তু তাদের কাছে পৌঁছাবার কোনো ফর্মূলা এখনও বাজারে আসে নি। শোনা যায়, অতিগরিবের উন্নয়ন অনেক দুরূহ, কারণ তাদের এসেট নাই (ফলে বন্ধকী নেয়া যায় না!), তাদের ভয়েস নাই (ফলে ইন-ডেপথ ইন্টারভিউ দেয় না তারা!), তাদের এমনকি কোনো আকাঙ্ক্ষাও নাই (ফলে অ্যাডভোকেসী মাঠে মারা যায়!)। আপামর প্ররোচনাহীন এক জনগোষ্ঠী! তারা এমনিতেই তিলে তিলে মরে, তাদের মধ্যে দিপালীর মত কারো কারো হয়ত মৃত্যুর এই শম্বুক গতি পছন্দ হয় না। তখন অতিগরিবেরা শিরোনাম হয়।

দিপালীদের বাড়িতে আজ দেশের বিবেকবান মানুষের সাহায্য পৌঁছেছে, কিন্তু দরকার সুনির্দিষ্ট পলিসি, আর তার যথাযথ বাস্তবায়ন, এইসব অতিগরিব এবং বিপদাপন্ন মানুষের কার্যকরভাবে বেঁচে থাকার জন্য। নাহলে, ভেবে দেখুন, মাস ছয় পরে, দিপালীদের সাহায্যের টাকাই ফুরিয়ে যাবে না, এর সাথে তাদের এতদিনকার ‘ক্ষুধা ব্যবস্থাপনা’র অভ্যাসটিও হারাবে তারা। সেইসাথে, আরেকবার সংবাদ শিরোনাম হবার ভয়ে সমাজে তারা আরো ইনভিজিবল হয়ে যাবে। ফলে, দিপালীর পরিবার তথ্যপ্রবাহ হয়ে আমাদের বিবেকে আর হয়ত কামড় বসাবে না, কিন্তু ক্ষুধার কামড় থেকে তারা কি মুক্তি পাবে?

২০০৫
সংবাদের লিংক:
http://www.thedailystar.net/2005/10/16/d51016110280.htm

কোন মন্তব্য নেই: