শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০০৮

মাহমুদুল হক, প্রতিদিনের রুমাল ও চিরদিনের সাহিত্য

এক.
প্রয়াত হলেন আমাদের অন্যতম প্রধান কথাশিল্পী মাহমুদুল হক। বিরাশি সালের পর থেকে আর কিছুই লেখেন নি এই প্রতিভাধর লেখক, সেই অর্থে এটি তাঁর দ্বিতীয় প্রয়াণ। যাঁর প্রয়াণের ব্যথাটুকু আমরা গত দুদশক ধরেই আমাদের প্রতিদিনের জীবনে ও রুমালে বয়ন করে চলেছি, তাঁর শরীরী প্রস্থানের ফলে কেবল আমাদের এই অভ্যাসটুকুরই ইতি ঘটল। প্রশ্নটি কিন্তু রয়েই গেল: মাহমুদুল হক আমাদের কেমন আত্মীয়? প্রতিদিনের, নাকি চিরদিনের?

মাহমুদুল হকের পাঠক কিন্তু এই প্রশ্নের জবাবে কোনো পরিষ্কার পজিশন নেয় না। তাঁকে প্রতিদিনের হুমায়ুনের কাতারে রাখতে সে অপারগ, আবার চিরদিনের হাসান-ইলিয়াস চত্বরেও তাঁর আসন পেতে দিতে দোনোমনা সে। কোনো খাপেই যেন এই তলোয়ার ঢোকে না। সমস্যা কি তলোয়ারটির? নাকি আমাদের সাহিত্যরুচির?



লণীয়, মাহমুদুল হক আটটি উপন্যাস এবং কমপে এগারটি গল্প লিখেছেন তাঁর দুদশকের সাহিত্যজীবনে। তুলনায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস দুটি, এবং হাসান আজিজুল হক তো এই কিছুদিন হল উপন্যাস লেখায় হাত দিলেন। তবু তাঁর পাঠকের দাবি, অনেক কম লিখেছেন এই লেখক। আবার কোনো কোনো বোদ্ধা ভাবেন যে, বিশাল ক্যানভাসের বা মহৎ কোনো উপন্যাস লেখেন নি তিনি। ধন্দ লাগে, এ হেন প্রত্যাশার হেতু কী? যা লিখেছেন মাহমুদুল হক তা নিয়েই আমরা কেন সন্তুষ্ট হতে পারি না? সে কি আমরা তাঁর মাঝে অমিত সম্ভাবনা দেখেছিলাম বলে, নাকি তিনি আমাদের ক্যাটাগোরাইজেশনের নৌকাটিকে মাঝ নদীতে ছেড়ে গিয়েছেন বলে? টানাহেঁচড়া কিছু হয়েছে, হয়ত আরো হবে, কিন্তু তাতে বিশেষ ফল হয় নি। মাহমুদুল হক আসন পেতেছেন এমন একটি নো-ম্যানস ল্যান্ডে যা বিদ্যমান সাহিত্য সমালোচনাধারার জন্য অস্বস্তির।

মনে পড়ে হুয়ান রুলফো-র কথা: নাতিদীর্ঘ একটা উপন্যাস, আরেকটা উপন্যাসের প্রতিশ্রুতি আর গোটা তের-চৌদ্দখানা গল্পই তাঁর সারাজীবনের সাহিত্যকীর্তি। তা দিয়েই তাঁকে গোটা লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের পুরোধা মেনে নিতে কষ্ট হয় না। কাফকা যেমন। মার্কেজ বলেন যে, গোটা লাতিন আমেরিকান যাদুবাস্তব সাহিত্য কাফকার মেটামরফোসিস পাঠের ফলাফল। বোঝা যাচ্ছে যে, মহৎ সাহিত্য মানেই ইউলিসিস বা ওয়র এন্ড পীস নয়, চল্লিশ পৃষ্ঠার একটি মেটামরফোসিস থেকে জন্মাতে পারে একটি গোটা মহাদেশের সাহিত্য, যেমন একটি ছেঁড়াখোড়া ওভারকোট থেকে বেরুতে পারে গোটা রুশ সাহিত্য। “জাতির বৃহত্তর ইতিহাস” রচনার দায় সাহিত্য কেন নেবে? সাহসী সাহিত্যিক তার পাঠক-সমালোচকের প্রত্যাশায় চালিত হবেন, নাকি তিনি চলবেন তার আত্মার আদেশে? দায় চাপাতে চাইলে তিনি তো দেখি অবলীলায় বলেন “বরং নিজেই তুমি লেখ নাক’ একটি কবিতা”! এ কারণেই হয়ত মহৎ-এর নেশা আর বৃহৎ-এর পেশা মাহমুদুল হকের সাহিত্যে আমরা দেখি না। যারা মহৎ মহৎ ভাবাদর্শের বাটখারা এজেন্ডা আকারে নিজের সাহিত্য আর প্রত্যাশা আকারে অন্যের সাহিত্যের ওপর চাপান, তারা ভুলে যান সাহিত্য অনেক রকম। কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের সংজ্ঞা সে নিজেই তৈরি করে।

এই আলাপ থেকে পাঠক আশা করি এটা ধরে নেবেন না যে আমি সাহিত্যকে স্বয়ম্ভূ থাকতে বলছি বা বলছি অন্যান্য জ্ঞানকাণ্ডের সাথে যোগাযোগহীনতাই কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের লক্ষণ। যোগাযোগ নিশ্চয়ই থাকবে, তবে সাহিত্যের দরকার স্বায়ত্তশাসন। সে কেন ইতিহাসের দাসত্ব করবে, বা সমাজবিজ্ঞানের? নিজের পাটাতনে শক্তপায়ে দাঁড়িয়েই সাহিত্য অপরাপর জ্ঞানকাণ্ডের সাথে যোগাযোগ করুক। নিজের জানলা দিয়েই জগত দেখুক, সর্বোপরি। মাহমুদুল হকের সাহিত্য আমাদের মনোভূমির দিকে তেমনি একটি জানলা খুলে দেয়।


দুই.
ভাষাব্যবহার দিয়েও মাহমুদুল হক আমাদের সাহিত্যে স্বতন্ত্র হয়ে থাকবেন। অসামান্য ভাষাশিল্পী তিনি, শামসুর রাহমান লিখেছিলেন জীবন আমার বোন-এর ব্যাক কাভারে। কিন্তু তাঁর ভাষা কি নৈরাজ্যময়? আমার মনে হয় না। ভাষার নৈরাজ্য অন্য জিনিস। কাব্যধর্মী বর্ণনামাত্রই যুক্তিহীন নৈরাজ্যময় এটা ভাবা বাতুলতা। বাংলাভাষার বিদ্যমান যুক্তিশৃঙ্খলার বাইরে মাহমুদুল হক খুব হাঁটাচলা করেছেন এমন মনে হয় নি। বরং ছুরির মত ধারালো, চাবুকের মত নির্মেদ, আয়নার মত ঝকঝকে যে ভাষাটি মানিক-তারাশঙ্কর হয়ে পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের অন্বিষ্ট হয়ে উঠছিল, মাহমুদুল হক সেই স্রোতে গা ভাসান নি। ভাষাপ্রশ্নে তিনি হাঁটলেন উল্টোদিকে, কিছুটা রবীন্দ্র-বঙ্কিম হয়ে সংস্কৃত নন্দনকাননে। তাঁর বর্ণনা অসম্ভব কাব্যভণিতায় ভরা, হাওয়াই মিঠাই-এর মত ফোলানো ও মনোলোভা। তিনি জানতেন এই ফোলানোটুকুই সাহিত্য, বাদবাকিটুকু হয় নিজ নিজ সময়ের দাস, না হয় মরিচার খাদ্য। কথার যাদুকর তিনি, প্রগলভতাই তাঁর সাহিত্যের শক্তি। বকবকাইন। এই কাব্যভণিতার কারণেই আমরা ভেবে বসি তিনি এক ফুরফুরে পাঞ্জাবি-পরা সাহিত্যিক, জানলা খুলে যতটুকু জগত দেখা যায় তাইই দিলখোশ লিখে দিয়েছেন! কতটা বালখিল্য এই ধারণা, তা বোঝার জন্য মাত্র দুটো গল্পই যথেষ্ট: ‘বুড়ো ওবাদের জমাখরচ’ এবং ‘সপুরা ও পরাগল’। ভয়ংকর দুটো গল্প, পড়তে পড়তে ভাবি, তাঁর ভাষার কী দারুণ মতা, কী অবলীলায় এমনিতর নিষ্ঠুরতার পাতালে সিঁড়ি নামিয়ে দেয়! এখানেই মাহমুদুল হক আলাদা, গদ্যের ভাষাকে তিনি মুক্তি দিয়েছেন দলিলি প্ররোচনা থেকে, প্রত্যবাদ থেকে, নিজে আষ্টেপৃষ্ঠে লিপ্ত হয়ে পড়েন ভাষা, চরিত্র ও বিষয়বস্তুর সাথে, সাহিত্যিকের নির্মোহ দূরত্ব তিনি মানেন নি। এখন পর্যন্ত তিনিই আমাদের একমাত্র ঘুমে-হাঁটা মোহগ্রস্ত সাহিত্যিক। এই সাহিত্যের পাঠ তাঁর কাছ থেকে নেয়ার জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত? আমরা কি গ্রহণে সক্ষম?

তিন.
পড়ছিলাম মাহমুদুল হকের একমাত্র গল্পগ্রন্থ প্রতিদিন একটি রুমাল। ঘটনাচক্রে সাহিত্যপাঠ আমার এবারের উদ্দেশ্য নয়, আমি মধ্য ষাট থেকে মধ্য সত্তর দশকের ঢাকাশহরের একটা চেহারা পেতে চাইছি তাঁর গল্প থেকে। প্রথমেই থমকালাম সপুরা ও পরাগল পাঠ করে। ১৯৬৪ সালে লেখা এই গল্প, যেখানে সপুরা এক নারী ভিক্ষুক যার পা নেই কিন্তু আছে “কলসীর কানা উপচানো ফেনার মতো স্বাস্থ্য” যা বিব্রত পথচারীর চোখে রঙ ধরায়। গল্পের কেন্দ্রীয় টেনশনটি ফ্রয়েডীয় যা বিস্তৃত সবুরা, পরাগল, মালগনি মিয়া ও মায়মুনা নামক চারটি চরিত্রের পারস্পরিক যৌন আচরণের মাঝে। আলাপের বিষয় এটা নয়, বরং এই টেনশনটি যে প্রেেিতর ওপর ছড়ানো তাকে খুলে দেখা যাক। গল্পের সময়কাল ষাট দশকের ঢাকা এবং প্রোপট ঢাকার ভিক্ষুক নেটওয়ার্ক। অবিশ্বাস্য এক চিত্র হাজির করেন মাহমুদুল হক ষাট দশকীয় ঢাকাই ভিক্ষাবৃত্তির। সেখানে মালগনি মিয়া এক ভিক্ষাব্যবসায়ী যে কিনা সপুরা, পরাগল মিয়ার মত আরো অনেক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকের সংগ্রাহক, ইম্প্রোভাইজার, নিয়ন্ত্রক ও আশ্রয়দাতা। এসব ভিুকের রোজগারের বেশির ভাগই চলে যায় মালগনি মিয়ার ট্যাকে। পরাগল মালগনির সহযোগী, নুলোভিখিরির পরিবহনের দায়িত্ব তার। আরো জানা যায় যে, ভিক্ষাবৃত্তির সুবিধার জন্য সপুরার পা কেটে ফেলে পরাগল, হাত মুচড়ে ভেঙে দেয় অন্য একটি কচি মেয়ের।

লণীয় যে, মালগনির আস্তানাটি কোনো বস্তিতে কি না সেটা গল্পে পরিষ্কার নয়। বরং মনে হয় এটা আলাদা কোনো জায়গা, পোড়োবাড়িমত, যেখানে ভিক্ষুকদের থাকার আবাস তৈরি করেছে মালগনি। অর্থাৎ তাদের বৃহত্তর সমাজ গড়ে ওঠেনি তখনো। এতদূর পর্যন্ত জিনিসটা সমাজবিজ্ঞানের জন্য স্বস্তিদায়ক, কারণ ষাট দশকের ঢাকা তখনো এমন ম্যাসিভ আকারে ‘সিটি অব স্লামস’ হয়ে ওঠে নি বলে সেও সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু ভিক্ষা ইন্ডাস্ট্রির যে চেহারা মাহমুদুল হক তুলে ধরেন, নিশ্চিত যে এটি সমাজ গবেষককে কিছু হলেও অপ্রতিভ করে দেবে। ঢাকাই ভিক্ষাবৃত্তির ওপর কোনো বড় ধরনের অনুসন্ধানী গবেষণা হয় নি, বস্তি-গবেষণার অংশ হিসেবে যতটুকু এসেছে সেটা ছাড়া। হালে সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকার ৩০ নভেম্বর ২০০৭ সংখ্যায় ‘কোটি টাকার ভিক্ষা ব্যবসা নেটওয়ার্ক’ নামে যে প্রতিবেদনটি রয়েছে মাহমুদুল হকের স্যা অনুযায়ী ষাট দশকের চিত্রটি তার চেয়ে বহুগুণে ভয়ানক। কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধু ভিক্ষুকদের নিয়ে একটি গবেষণাকর্ম করেছেন যেটির কথা তাঁর মুখে শুনেছি। কই, এত নারকীয় দশা তো তিনিও দেখেন নি এই কালে এসেও। তাহলে কি ভিুকদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে? নাকি সমাজবিজ্ঞানের পক্ষে সেই অতলে যাওয়া মুশকিল, যেখানে সাহিত্য পৌঁছায়?

এবার ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’ গল্পটির কথা ধরা যাক। ১৯৭৪ সালের ঢাকাকে নিয়ে গল্প। সেখানে আলতাফ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র যে কিনা ঢাকাশহরে মৌজমাস্তিমোটরকারমেয়েমানুষ করে বেড়ায়। তারও আনন্দ প্রদর্শনে, আর এর জন্য সে বেছে নেয় তার পুরনো বন্ধু মফস্বলের গোবেচারা কলেজ শিক সবুজকে। সবুজের তাড়না হল ঢাকায় বদলির, যেহেতু ওর স্ত্রী-সন্তান ঢাকায় বসবাস করে। ফলে এই নির্বিরোধী চরিত্রটিকে আলতাফের খেয়ালখুশির ঝড়ে বিপন্ন হতে হয়। মনে রাখতে হবে এটি স্বাধীনতা-উত্তর ঢাকা, কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী নয়। ঐ সময়ের যা ইতিহাস তাতে মাহমুদুল হক খোলাসা না করলেও আমরা আঁচ তরতে পারি আলতাফ চরিত্রটি কাদের রিপ্রেজেন্ট করে। তখন রীবাহিনীর যুগ, আবার গণবাহিনীরও যুগ, আওয়ামী সমাজতন্ত্রের ফিকে প্রতিশ্র“তির সামনে জাসদের তরুণ তুর্কিদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র! বৈশ্বিক মতাদ্বন্দ্বটির ছোট একটি রিহার্সাল ঘটানোর জন্য একটা খুব গোছানো পাপেট শো! এমতাবস্থায় আলতাফ চরিত্রটি যার কাছে বদলির তদবির করা যায় অর্থাৎ সে সরকারের কাছের লোক, আবার যে কিনা গলির মুখে ছেড়ে-আসা গাড়ি হাইজ্যাক হয়ে যায় কিনা সেই টেনশনেও থাকে, আবার স্রেফ ইতিবাচক ‘রেসপন্স’ না-পাওয়ায় রিকশারোহী এক অচেনা তরুণীকে গাড়িচাপা দিয়ে অবলীলায় সেই ঘটনাকে ফিলোসোফাইজ করে ফেলে। আলতাফ যেন শুধু তিয়াত্তরের ঢাকা নয়, গোটা সরকারব্যবস্থার প্রতীক হয়ে ফুটেছে এই গল্পে! গাড়িচাপা দিয়ে তরুণীকে খুন করার পর নির্ভার আলতাফ তার উদ্বিগ্ন ও বিপর্যস্ত বন্ধুকে উপদেশ দিচ্ছে, “ভুলে যাওয়ার মতা পর্বতপ্রমাণ হওয়া চাই।” সত্যিই তো! ভুলে যাওয়ার পর্বতপ্রমাণ মতারই প্রমাণ যেন আমরা দিয়েছি বাহাত্তর-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে। একদলীয় বাকশাল, প্রতিরোধের গণবাহিনী, রিলিফের কম্বলচুরি থেকে পঁচাত্তরের মুজিব হত্যাকাণ্ড সবই আমাদের ভুলে যাওয়ার অপরিসীম মতার স্মারক।

এই যে দুই দশকের দুরকম ঢাকার চেহারা আমরা দেখেছি মাহমুদুল হকের গল্পে, তাতে কি অতিরঞ্জন আছে খানিকটা? সমাজবিজ্ঞানী হয়ত বলবেন ’৬৪-র ঢাকাকে একটু বেশি যেন বীভৎস দেখায় ‘সপুরা ও পরাগল’ গল্পে, আবার ইতিহাসবিদ ভাবতে পারেন ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’ গল্পে তিয়াত্তরের যে ঢাকা তা যেন সামান্য বেশি নাটকীয়। এরকম ফয়সালা হলে সেটা তাদেরই, সাহিত্যিকের এই প্রশ্নের জবাব দেবার দায় নেই। দরকারও নেই। আমরাও চাই সাহিত্য অপরাপর জ্ঞানকাণ্ডগুলোকে আরো অনুসন্ধানী করে তুলুক। মাহমুদুল হকের ঢাকা আমার সামনে সে ধরনের পথ খুলে দেয়, দেখতে পাই।


চার.
শুরুর প্রসঙ্গে ফিরি। প্রতিদিনের সাহিত্যই রচনা করেছেন মাহমুদুল হক। সেটা করতে গিয়ে প্রতিদিনের কিশেগুলোকে তিনি তাঁর জাদুকরী ভাষার কারুকাজ দিয়ে রিপু করে দিয়েছেন। বড় একটি ক্যানভাসের এক কোনে তিনি তার ছবি এঁকেছেন, বাদবাকি ক্যানভাসে যা যা আছে বা থাকবে তার সুস্পষ্ট ইশারাসহ। ফলে বাকি ছবিটুকু আঁকার দায়িত্ব পাঠকের ওপর বর্তায়। দৃষ্টান্ত দিই: তাঁর প্রায় সব উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয় কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু সেই মুক্তিযুদ্ধ তাঁর উপন্যাসে সরাসরি নয়, বরং সবসময় কোন-না-কোন ভনিতার আড়ালে হাজির থাকে, হোক সেটা জীবন আমার বোন, কিংবা হোক সেটা খেলাঘর। এইই হল প্রতিদিনের দেখার ভঙ্গি।

আবার, প্রতিদিনের জীবন যতখানি ভাবাদর্শচালিত তারচে অনেক বেশি বৈপরীত্যময়, একঘেঁয়ে, পৌনঃপুনিক এবং অনাবশ্যক সব ডিটেইল-এ ভরা। তাকে সাহিত্যিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য যে অস্ত্রটি হাতে নিয়েছিলেন মাহমুদুল হক সেটি, আগেও বলেছি, তাঁর ভাষা। এই ভাষা নৈরাজ্যের নয়, এই ভাষা এর পাঠককে আক্রমণ করে না, কারণ নিজেই সে ঘোর-আক্রান্ত, ফেননিভ, উপশমমূলক। মাহমুদুল হক তাঁর সময়ের সেই বিরলতম লেখক যিনি জানতেন একমাত্র ভাষাব্যবহারের জাদুতেই পৃথিবী বারবার নবীনা হয়ে ওঠে। প্রতিদিন। চিরদিন।

কোন মন্তব্য নেই: