শনিবার, ১৬ আগস্ট, ২০০৮

ভাষাবিতর্কের আগুনে আরো দুই ফোঁটা ঘি

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রে নাটকে এবং সাহিত্যে আটপৌরে ভাষার ব্যবহার নিয়ে একটি উদ্বেগের কথা উঠে এসেছে। মেহতাব খানম, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও সৌমিত্র শেখরকে ধন্যবাদ জানাই বিষয়টি নিয়ে তাদের সুচিন্তিত মতামত জানানোর জন্য। মেহতাব খানমের উত্থাপিত প্রসঙ্গটি ছিল মূলত টেলিভিশন নাটকের সংলাপ নিয়ে, ফলে আশা ছিল নাট্যজনদের কেউ মতামত দেবেন এবং দেখলাম সরয়ার ফারুকী সেটা দিয়েছেনও। ফলোআপ হিসেবে ১১ নভেম্বর প্রথম আলো-য় সৌমিত্র শেখর তার আলোচনাটিকে শুধু নাটকের সংলাপে সীমিত রাখেন নি, বরং সাম্প্রতিক সাহিত্যচর্চায় আটপৌরে ভাষার “যথেচ্ছ” অনুপ্রবেশ নিয়েও তার উদ্বেগের কথা বলেছেন।


টেলিভিশন নাটকে, সিনেমায় বা সাহিত্যে আটপৌরে ভাষার অনুপ্রবেশকে “যথেচ্ছ” মনে হওয়ার কারণ কি? সরয়ার ফারুকীর বক্তব্যে তো মনে হচ্ছিল যে, আটপৌরে ভাষার প্রয়োগ নিয়ে তাদের সুনির্দিষ্ট চিন্তা রয়েছে। কার ইচ্ছায় ও চিন্তায় তাহলে আটপৌরে ভাষা “মানভাষা”য় প্রবেশাধিকার পাবে? সৌমিত্র শেখর বলছেন সেটা শতবর্ষ আগের অবিভক্ত বাংলার ভাষাচিন্তক ও সংস্কৃতিবোদ্ধাদের ইচ্ছায় বা সিদ্ধান্তে। তারা বহু গবেষণা করে নদীয়া শান্তিপুর অঞ্চলের বাংলাকে প্রমিত বাংলা বলে ঠিক করে গিয়েছিলেন। তাদের সেই সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের পর একশ বছর গত হল, অবিভক্ত বাংলা বিভক্ত হল, এবং দুই বাংলার সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতা দুই মেরুর দিকে ধাবমান হল। অল্প কিছু সাহিত্য আর সামান্য কিছু “জীবনমুখী” গান ছাড়া আর কোন্ বিষয়টা দুই বাংলার কনজিউমাররা এখন শেয়ার করে বলা মুশকিল। একদা অবিভক্ত, কিন্তু বর্তমানে পরস্পর থেকে নানাভাবে দূরে সরতে- থাকা দুই বাংলা চিরকাল একইভাবে ভাষাব্যবহার করতে থাকবে, এটা কেমন আবদার? আর রাষ্ট্রীয় বাস্তবতার কারণেই গ্লোবালাইজেশনের চাহিদা দুইবাংলার কাছে দুরকম, যেহেতু পশ্চিমবাংলা একটা বড় ন্যাশন স্টেটের অংশ আর পূর্ববাংলা নিজেই একটা ন্যাশন স্টেট। যে বাংলায় পশ্চিমবঙ্গ আজ সাহিত্য সাংবাদিকতা কি টেলিভিশন নাটক করছে, তার মধ্যে হিন্দি বা “হিংলিশ” ভাষার দাপট কীরকম আছে? কতটা প্রমিত আজ প্রমিত বঙ্গের বাংলা? প্রমিত বাংলার জন্য শতবর্ষ আগে বেঁধে দেয়া সেই স্ট্যান্ডার্ড থেকে একা পূর্ববাংলাই সরে আসছে, এটা বোধহয় ঠিক নয়।

মেহতাব খানমের উদ্বেগ তবু সময়োচিত, ঢাকাই উচ্চবিত্তের “ডিজুস” কালচার দিয়ে আমাদের কল্পনার আবহমান বাংলা নিয়ন্ত্রিত হোক সেটা তিনি বা সরয়ার ফারুকী কেউই চান না। ফারুকীও তার লেখায় সেই উদ্বেগের পে সাফাই গেয়েছেন এবং “জাতীয়” মিডিয়াকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে উত্তরণের পথ বাতলেছেন। কিন্তু ভাষা মূলত মতাসম্পর্কের দ্যোতক, এবং সে কারণেই এই ধরনের উদ্বেগ মূলত মধ্যবিত্তের, যেহেতু মধ্যবিত্ত এটা ভাবতে পছন্দ করে যে তারাই “জাতীয়” সংস্কৃতির মুখ্য আধিকারিক। এই যুদ্ধ দৃশ্যত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মধ্যকার একটি সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধ যেখানে তাদের উভয়ের কুরুত্রে হচ্ছে মিডিয়া। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের নিজ নিজ শক্তিশেল তো আছেই। উচ্চবিত্তের টাকা থাকলেও মধ্যবিত্তের আছে লোকবল আর উচ্চকিত হবার নৈতিক অধিকার। মিডিয়াব্যক্তিত্ব সরয়ার ফারুকী যেভাবে মেহতাব খানমের উদ্বেগকে সমর্থন জানিয়েছেন তা দেখে মনে হচ্ছে এই কৌরব-পান্ডবের যুদ্ধে তিনি যেন কর্ণ! মন মধ্যবিত্তের দিকে, কাজ করছেন উচ্চবিত্তের ভাষায়!

বলাবাহুল্য, নিম্নবিত্ত সমাজ এই যুদ্ধে উপেতি। গরিব রিক্সাঅলার আবার ভাষা কি? সে তো আমাদেরই বেঁধে-দেয়া ভাষাব্যবস্থায় চলবে, নাকি? অথচ, আমরা খেয়াল করিনা যে, “ডিজুস” বাংলার আগেই নিম্নবিত্তের নিজস্ব বাংলা প্রমিত বাংলার বিরূদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তাদের মিডিয়ায়। তাদের মিডিয়া? কেন, দেখছেন না সেই মিডিয়ার দাপটে আমাদের নামী ব্যান্ডশিল্পীদের কাঁধে গামছা, পরনে জিনসের বদলে আলখাল্লা, আর মমতাজকেও দেখুন! সবচে বেশি এলবামের গায়িকা হিসেবে ইতোমধ্যেই গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এ নাম উঠেছে তার। হ্যাঁ, অডিও ক্যাসেটই নিম্নবিত্তের মিডিয়া এবং এই কেন্দ্রাতিগ মিডিয়াটি কোনোরকম বিজ্ঞাপনী প্রশ্রয় ছাড়াই বর্তমানে দেশের সবচে দ্রুত বর্ধনশীল মিডিয়াগুলোর একটা। খেয়াল করে শুনে দেখুন, সেখানেও একরকমের বাংলার চল আছে, যা নিম্নবিত্ত বা নগর গরিবের বাংলা। আমার প্রস্তাব এই ধারার বাংলাকেও বর্তমান তর্কে সামিল করা হোক। তাকে পাশ কাটানোর একাডেমিক আভিজাত্য থেকে মুক্ত হোক ঢাকাই মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত।

এবার সাহিত্যের ভাষা প্রসঙ্গে আসা যাক, যেহেতু সৌমিত্র শেখর সাহিত্যে আটপৌরে ভাষার ব্যবহারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তার ঔচিত্যবোধ প্রখর, আটপৌরে বাংলায় রচিত সাহিত্য জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে প্রচার অনুচিত বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু কেন? ঢাকাই মিশ্র আটপৌরে বাংলা শেষবিচারে এক ধরনের আঞ্চলিক বাংলাই বটে। মেহতাব খানমের আপত্তির কারণ তো বোধগম্য, তিনি আজকালকার টেলিভিশন-দেখা ছেলেমেয়েদের “শুদ্ধ” বাংলায় কথা বলার েেত্র নাটকের ভাষাকে প্রতিবন্ধক ভাবছেন। কিন্তু আঞ্চলিক বাংলায় সাহিত্য তো নতুন কিছু নয়। তাহলে এখন আপত্তি উঠছে কেন? বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করি।

প্রথাগত ধারণাটি হল, আঞ্চলিক বাংলা ততণ পর্যন্ত “বৈধ”, যতণ তা উদ্ধৃতি এবং বন্ধনীচিহ্নের মধ্যে থাকে। যেমন, সংলাপ আঞ্চলিক হতে পারে, যদি সেই সাহিত্য কোনো এক আঞ্চলিক জীবনযাত্রার আখ্যান হয়। কিন্তু কথকের বা বর্ণনাকারীর ভাষা হতে হবে অবশ্যই “মানভাষা”, যেহেতু তিনি সাহিত্যিক হিসাবে বাইডিফল্ট মধ্যবিত্ত। তিনি “শুদ্ধ” বাংলায় চাষাভুষার জীবন নিয়ে আলেখ্য রচনা করবেন, আর সততার খাতিরে চাষাভুষার মুখের ভাষা সেরকমই বহাল রাখবেন। তাতে আপত্তি নেই। আপত্তিটা তখনই বাঁধে যখন সাহিত্যের ন্যারেটর বা বর্ণনাকারীর ভাষা প্রমিত বাংলা থেকে বিচ্যুত হয়। এ যেন সাহিত্যিকের এবং সাহিত্য-বিচারকের কেন্দ্রীয় চরিত্র থেকে মধ্যবিত্তের আধিপত্যকে খারিজ করে দেওয়ার সামিল! সাহিত্যে আটপৌরে ভাষার ব্যবহার নিয়ে আপত্তির জায়গাটা, আমার ধারণা এখানেই।

বর্তমান পরিসরে এ নিয়ে বিস্তারিত বলবার সুযোগ নেই। ঐতিহাসিকভাবে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে কেন্দ্রে বিবেচনা করেই সাহিত্যের প্রতিষ্ঠান এবং নন্দনতত্ত্বের প্রতীকগুলো গড়ে ওঠেছে। এখন কোনো সাহিত্যিক যদি সেই নির্মাণকে মান্য না করেন, তবে আশংকার ঘণ্টি স্বাভাবিকভাবে প্রথমেই বাজবে সাহিত্যের প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কারণ তারাই মানদন্ডের রক এবং এর মাধ্যমে সহজেই তাদের আধিপত্য ধরে রাখা যায়। কিন্তু এটা আমরা ভাবি না যে প্রাতিষ্ঠানিক মধ্যবিত্ত ভাবনা আর সমাজে বিদ্যমান মধ্যবিত্ত ভাবধারা এক নয়। আবার এটাও হাস্যকরভাবে মনে করি যে, কেবল মধ্যবিত্তই চিরকাল অপরাপর শ্রেনীসমূহের পে শিল্পসাহিত্য করবে। কিন্তু ভাষা তো প্রবহমান ঘটনা, সে সমাজে বিদ্যমান শ্রেনীসমূহের মতাসম্পর্কের দর্পণও বটে। তাকে “প্রমিত” বাংলা নাম দিয়ে শতবর্ষ আগের কোনো সমঝোতার ঘেরাটোপে আটকানোর চেষ্টা অর্থহীন, কিভাবে অর্থহীন ফারুকী সেটা সংেেপ বলেছেন। আমার বলবার বিষয় হল, যে বিচারে আমরা সাহিত্যের চরিত্রগুলোর মুখে আঞ্চলিক ভাষাকে বৈধ ভাবি, সেই একই বিচারে বর্ণনাকারীর আঞ্চলিক ভাষাকেও বৈধ ভাবতে পারি। সাহিত্যিকের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি থেকে মধ্যবিত্তকে রেহাই দেয়ার দরকার কিছু আছে, কারণ মুষ্টিমেয় কিছু বাদে মধ্যবিত্তের একটি বিরাট অংশ কিন্তু সাবঅল্টার্ন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছে। বর্তমানের সাহিত্যিক মধ্যবিত্ত কিন্তু সেই উদ্বেগ থেকে বিকশিত হচ্ছে। ফলে, জীবনের প্রয়োজনে, হরহামেশাই তাকে প্রমিত বাংলার বাউন্ডারি টপকাতে হচ্ছে।

আরেকটা বিষয়, প্রমিত বাংলার সাথে শুধু যে উচ্চবিত্তের গ্লোবালাইজড ডিজুস বাংলা মিশছে তা নয়, মিশছে শাহআলম সরকার/মমতাজের “ফাইট্টা যায়” বাংলাও। একইভাবে, নিম্নবিত্তের বাংলায়ও গ্লোবালাইজেশনের প্রভাব পড়ছে এমন দেখতে পাই। এটাকে মিলনমেলা বা কুরুত্রে যাই বলুন, তা থেকে মধ্যবিত্তীয় প্রমিত দূরত্ব বজায় রাখা অসম্ভব, কার্যত সেটি প্রমিত বাংলাকে আরেকটা মৃতভাষায় পরিণত করার সামিল। বরঞ্চ এই নেয়াদেয়ার প্রক্রিয়ায়, শ্রেণীসমূহের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের এই প্রকাশ্য ও গোপন যুদ্ধে কোন্ শ্রেণীর ভাষা কিভাবে বদলাচ্ছে সেটা দেখার বিষয়। শিল্পসাহিত্য বা নাটক সেই যুদ্ধের ময়দান হতে প্রস্তুত, আর অন্যান্য “আনুষ্ঠানিক” প্রয়োজন মেটাবার জন্য না হয় প্রমিত বাংলাই থাকুক।

কোন মন্তব্য নেই: