শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০০৮

বুড়ো হাবড়া তুঁত





কবি মুস্তফা আনোয়ার পিজি-র আইসিইউ-তে চুপচাপ মারা গেছেন। তিনদিন ধরেই কোমায় ছিলেন তিনি। একটা ফুসফুস পানিতে ভর্তি, তার ওপর আবার ম্যালিগন্যান্সিও ধরা পড়েছে। আজ সকাল থেকে কিছুতেই ব্লাড প্রেসার উঠানো যাচ্ছিল না। মারা যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার, ডিউটি ডাক্তারের নির্লিপ্ত গলা। আইসিইউ-র বাইরে বসে ছিলেন তার বোন। দেখে মনে হল, পিঠাপিঠি বোনই হবেন। চোখে কালি, কাকে যেন বারবার ফোনে ট্রাই করছিলেন।


এর মধ্যে এক টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক আর ক্যামেরাম্যানকে দেখে ডাক্তার রীতিমত থ। এসব কেন, কে ইনি? ডাক্তার-নার্সরা জিজ্ঞাসু। এতিমের মত প্রায়-একা পড়ে থাকে যে কোমা-নিবাসী লোকটা, তার জন্য ক্যামেরা কেন? আজকাল ক্যামেরা কি সস্তা হয়ে গেল নাকি? একজন এসে সাংবাদিককে নিরস্ত করতে চেষ্টা করলেন। বললেন, এখানে ছবি তুলতে পারমিশন লাগবে। পারমিশন নিয়ে আসেন। সাংবাদিক পোড় কম খান নাই। তিনি ান্ত দেয়ার ভাব করলেন, কিন্তু ক্যামেরা তার আপন গতিতে চলল।

হঠাৎ করেই ডিউটি নার্স আমাদের সবাইকে বাইরে যেতে বললেন। মুস্তফা ভাইয়ের বেডের চারপাশে দ্রুত পর্দা টেনে দেয়া হল। হাসপাতাল তার সবচেয়ে প্রিয়তম অকুস্থল, লিখেছিলেন তিনি। কিন্তু এখন পর্দা কেন? পর্দা মানে তো যবনিকা! তখনো তো তার বুক উঠানামা করছে। স্পষ্ট দেখছি যে!

ঐ টা আর্টিফিসিয়্যাল, ডাক্তার এবার আরো ঠান্ডা। মেশিনের ইফেক্ট। কার্ডিয়্যাক ম্যাসেজ দেয়া হল এই মাত্র, ফলাফল শূন্য। ‘এক্সপায়ার’ করার পরও এই ম্যাসেজ দিয়ে অনেককেই ‘ফেরত’ এনেছেন, ডাক্তার জানালেন ঐশ্বরিক হাসিযোগে। প্রযুক্তি মানুষের দেখার ধরণকেও বদলে বুঝি এভাবে। নইলে এখন বুক উঠানামা-করা কবি মুস্তফা আনোয়ারকে কত না সহজে একটি মৃতদেহ বলে মানছি আমরা! মৃতের সংজ্ঞা পাল্টে যাচ্ছে, মৃত্যুর সংজ্ঞা পাল্টে যাচ্ছে!

আইসিইউ-তে মড়াকান্না বারণ। তাই ভাইয়ের শোক প্রকাশের জন্য প্রৌঢ় বোনকে ব্লকের বাইরে আসতে হল। তিনি বুকফাটা কাঁদলেন আয়শা ঝর্নার গলা-ধরে। একাই। কী সব যেন বলছিলেনও? আমি শুনতে চেষ্টা করি। বোঝা যাচ্ছে না, ভাঙা ভাঙা সব বাক্য। হয়তো তাদের পিঠাপিঠি শৈশবের ফ্রেজিং, যার ধ্বনিমূল্য আছে। হয়তো তাদের অর্থমূল্য ভাইয়ের মৃত্যুর সাথে সাথে চিরকালের জন্য হারাল। হয়তো এই ধ্বনিগুলোরও মৃত্যু ঘটবে আজ। মনে পড়ল, মুস্তফা আনোয়ার লিখেছিলেন, এতোদিন রসায়ন লেখাপড়া শিখলাম খামাখা, চল্লাম, বিদায়।

কদিন ধরে বিকাল হলেই আকাশ কাল হতে আরম্ভ করে। শামিমা বিনতে রহমান বলছিলেন, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। মেঘলা আকাশের জন্য হয়ত নয়, হয়ত এই মরণটুকুর নিউজমূল্য নিয়ে বার্তাপ্রধানের সাথে ফাইট দেয়ার জন্য! লাশ কোথায় যাবে? যশোরে? যশোরে কি তুঁতগাছ আছে? যার নিচে ‘দুই রফিকের’ জন্য অমেয় জলের ধারা খুলে দেবেন এই কবি? আমাদের এই চিরতরুণ নিভৃতিপ্রিয় বান্ধব?

নিচে নামতে নামতেই বৃষ্টি। বৃষ্টি টিপটিপ করে পড়ছে হাসপাতালে, ম্যানহোলে, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ আর স্যালাইন ব্যাগ যেখানে ফেলে দেয় সেই ডাস্টবিনে। লম্বা করিডোর দিয়ে এক রোগীকে চাকাওলা স্ট্রেচারে শুইয়ে ঠেলতে ঠেলতে লিফটে ঢোকাচ্ছে কয়েকজন। বৃষ্টি আর বাতাস মিলে হাসপাতালের মত নীরব আর দর্শনার্থীর মত উদ্বিগ্ন একটি দ্বৈততা। আমার খুব চায়ের ইচ্ছা পেল।

আলকাৎরার রাতে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকব কবে, এমনি-দিনে,
বৃষ্টিতে, আ! সে ঘরকাতর সিঁড়িপথ, অজগর লম্বা।

ওপরে, পিজি-র আইসিইউ-তে শেষ ঘুমে তলিয়ে গেছেন আমাদের প্রিয় কবি মুস্তফা আনোয়ার। জীবিতাবস্থায়, কী কবিতায় কী জীবনে, তরুণদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তিনি। সাহসী আর স্বত্বাভিমানশূন্য এই কবি তাঁর কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন আমাদের মত মাত্র বিশোর্ধ তরুণ কবিদের। চার দশকের কবিতাচর্চা দিয়েও যে নিভৃতিকে তিনি ভাঙেন নাই, একটি সাদামাটা মৃত্যুসংবাদ সম্বল করে আমি সেটা ভাঙার জন্য পত্রিকা অফিসে যাচ্ছি!

২টি মন্তব্য:

dhuturafm বলেছেন...

আমি য্যনো মুস্তাফা ভাইকে জ্যান্ত দেখলাম এখানে।এটা আমার পরম সৌভাগ্য যে ওনার জানাজা পার্টিতে যেতে হয় নাই!

আমি এখনো বেহেস্তে বসে ওনার সাথে ইনোকটিন চিবাই।

চয়ন খায়হা

অগাস্ট ২০০৮

সুমন রহমান বলেছেন...

হা হা হা.... ইনোকটিনের ডেইট আছে কিনা দেইখ্যা লৈয়েন...