শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০০৮

বস্তির আগুন ও 'দুর্ঘটনা'র মিথ

বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক বছর পূর্তির দিনটি আর কারো মনে না থাকলেও নিমতলী বালুর মাঠ বস্তির হতভাগ্য মানুষদের আজীবন মনে থাকবে। কারণ ঐ দিনটিতেই এক “রহস্যজনক” আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে গেছে এই বস্তির দুহাজার ঘর। পত্রপত্রিকায় সেই লতিয়ে-ওঠা ইনফার্নোর ছবি দেখতে দেখতে মনে পড়ল মাত্র কিছুদিন আগে এমনি এক আগুনে বেগুনবাড়ি বস্তির পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার কথা। মনে পড়ল: মহাখালি, কমলাপুর, মোহাম্মদপুরসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলো বস্তিতে একের পর এক আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে গত এক বছরে। বস্তিলোভী আগুনের কি অদ্ভূত ডিসিপ্লিনড ধারাবাহিকতা, এই সরকারের আমলে!


বস্তিতে আগুন লাগে কিভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজেই দেন অনেকে, চুলা থেকে! চুলার আগুন নাকি কাচা ঘরবাড়িতে নিমেষেই ছড়িয়ে পড়ে! আর আমাদের মাননীয় ফায়ার ব্রিগেডের মহান দমকল গাড়ি বস্তির চিপাগলিতে ঢোকার রাস্তা পায় না! এত এত প্রশিণ তাদের দেয়া হয়, কিন্তু বস্তিতে গিয়ে আগুন নেভানোর কোন প্রশিণ পান না তারা! অথচ কিছুদিন আগেও জীবনবাজি রেখে তাদের আমরা এনটিভি ভবনের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছি। আশ্চর্য লাগে, যেখানে ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক লোক (পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০০৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৩৭.৪%) বস্তিতে বসবাস করে, সেখানে বস্তিতে কাজ করার মত প্রস্তুতি ফায়ার ব্রিগেড-এর মত এমন একটা সংস্থার নেই!

তবে বস্তিতে আগুন নেভানোর জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নেয়ার কী দরকার, তারাও বলতে পারেন, যেখানে ঢাকা শহরের ৯৬ ভাগ বস্তিতে কোনোদিন নাকি আগুনই লাগেনি (সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের ২০০৫ এর মেজার ইভালুয়েশন)! চমকে ওঠার মত তথ্য, বিশেষত যারা পত্রিকা পড়েন বা আমার মত যারা দাতাসংস্থার শাদা ছাতা ছাড়াই বস্তিতে ঘোরাঘুরি করেন। মাত্র ৪ভাগ বস্তিতে যদি আগুন লাগার ঘটনা ঘটে থাকে, তবে এই সংখ্যা নিশ্চয়ই ঢাকা শহরের অন্যান্য জায়গায় (যথা অফিস আদালত, রাজপথ, বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন, উচ্চ/মধ্যবিত্ত আবাসন) আগুন লাগার ঘটনা থেকেও কম।

কিন্তু আসলে কি তাই? কড়াইল বস্তির আগুনের হলকা এখনো আমার গা থেকে বেরয়, নিমতলী বালুর মাঠ বস্তি এই নিয়ে তিনবার পুড়ল, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের বস্তি কিংবা বেগুনবাড়ি বস্তি তো আগুনে পুড়ে ছাই হয়েই গেছে। এভাবে বলতে থাকলে এক পৃষ্ঠা শুধু নিশ্চিহ্ন বস্তির নামই লিখতে হবে। জানতে ইচ্ছা হয়, সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের প্রতিবেদন কি পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বস্তিগুলোকে হিসাবে ধরেছে? পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বস্তির হিসাব কি রাখেন কেউ? সরকার, এনজিও, বা দাতাসংস্থা? তারা না লিখলে কারা লিখবেন সেসবের ইতিহাস?

বস্তি নিয়ে কাজ করার স্বল্প অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সব বস্তিই পোড়ে না। প্রথমত, যেসব বস্তি আকারে বড় এবং প্রকারে সংগঠিত, বুলডোজার ঢুকলে লোকজন একে প্রতিহত করতে দাঁড়িয়ে যায়, আগুন লাগে সেসবেই। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেকটি অগ্নিকাণ্ডের েেত্রই ফায়ার ব্রিগেড সময়মত অকুস্থলে পৌঁছাতে পারে না, কিংবা পেীঁছালেও কাজ করতে পারে না, আর কাজ করতে পারলেও বস্তির সবগুলো ঘর পুড়ে ছাই হওয়ার আগে আগুন নেভাতেও পারে না! তৃতীয়ত, বেশির ভাগ েেত্রই সরকারী সংস্থাগুলো এটাকে বলে “দুর্ঘটনা”, বস্তিবাসী বলে “নাশকতা”, আর পত্রপত্রিকা লেখে “রহস্যজনক”। লিখেই তারা খালাস, কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চোখে পড়েনি কখনও, বস্তির অগ্নিকাণ্ডের “রহস্যভেদ” করেন নি কেউ, না সাংবাদিক, না তদন্ত কমিটি। চতুর্থত, উচ্ছেদ করলে সরকার তবু পুনর্বাসনের আশ্বাস দেয়, আগুনে পোড়া মানুষের কপালে পুনর্বাসনের বিবৃতিও জোটে না। আমাদের আপামর বধিরতার সৌজন্যে এভাবেই তলিয়ে যায় তাদের দুর্বল গলার হাহাকার!

তৃতীয় বিশ্বে, বিশেষত ট্রপিক্যাল দেশগুলোতে পরিকল্পিত নগরায়ন আর পরিকল্পিত বস্তি উচ্ছেদ সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এর পেছনে মদদ আছে নব্য-উদারনৈতিক অর্থনীতির প্রবক্তা বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ-এর মত সংস্থার। বস্তিবাসী গরিব মানুষ নগর অর্থনীতিতে কি ভূমিকা রাখছে সেটা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তারা ঠেকাতে চায় অ-প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিকে। ফলে তাদের নানারকম ফর্মুলা। সরকারের ধরন অন্যরকম হলে এই ফর্মুলাগুলো ঘাড়ে চেপে বসে। এরকম দৃষ্টান্ত কম্পুচিয়া, কেনিয়া, থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ায় বিস্তর দেখা গেছে। সেসব দেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে যারা লিখেছেন, তাদের প্রায় সবাই একমত যে, বস্তি উচ্ছেদের সবচেয়ে নির্মম কিন্তু ধন্বন্তরী পদ্ধতি হল আগুন লাগিয়ে দেয়া। শারীরিকভাবে উচ্ছেদ করা হলে আপনি হয়ত সাততলা বস্তি থেকে সহায় সম্পদ নিয়ে খিলতে বস্তিতে গিয়ে উঠতে পারবেন, “পরিকল্পিত” নগরায়নের স্বার্থে আপনাকে আপনার ভুখা পেটসমেত শহরের বাইরে তো পাঠানো যাবে না! কিন্তু আগুনের শক্তি অনেক! সে শুধু আপনার ঘরই পোড়ায় না, কপালও পোড়ায়, সংগ্রাম করার দুর্মর ইচ্ছাকেও পুড়িয়ে দেয়। পোস্ট ট্রম্যাটিক ডিসঅর্ডার নিয়ে লেখা একটি নিবন্ধে দেখেছি কিভাবে, ঢাকা শহরের বস্তিপোড়া মানুষেরা এই রোগের শিকার হয়ে থাকেন। এভাবে, বছরের পর বছর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে জীবনকে যে কয়েক ইঞ্চি ওপরে তুলতে পেরেছিলেন আপনি, এক আগুনে ওখান থেকে আবার সেই পুরনো জায়গায়। কিংবা তার চেয়েও আরো গভীর তিমিরে। এই শহরের আগ্রাসী চাহিদাকে দু’দিন ঠেকিয়ে রেখে সংগ্রামে নামার মত সামর্থও বাকি থাকে না তখন। জয়তু, পরিকল্পিত নগরায়ন! লাগে রাহো, দুর্ঘটনার মিথ!

বলছিলাম, পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বস্তির ইতিহাস কোথায় লেখা হয়? সেই ইতিহাস লেখা হয় হতভাগ্য নগর গরিবের বোবা বেদনায়, তার ভাগ্যবদলের সংগ্রামে নিদারুণ পরাজয়ে, আর প্রফেসর ইউনুসের নির্মীয়মান জাদুঘরের দরজা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা দারিদ্র্যের ঠা ঠা অট্টহাসির মাঝে। সেই ইতিহাস আর এই পরিহাস সরকার ও তার উন্নয়ন সহযোগী এবং সামাজিক ব্যবসায়ীদের তুলার প্যাড-পরা কান পর্যন্ত পৌঁছাবে কবে?

কোন মন্তব্য নেই: