শুক্রবার, ২২ আগস্ট, ২০০৮

অন্ধ সঙ্গীতকার: ভ্লাদিমির করলেংকো



সে দ্রুত তার মাকে চিনতে শিখে ফেলল - পায়ের আওয়াজ শুনে, কাপড়ের খসখসানি শুনে, এবং অন্যান্য নানান শব্দের মাধ্যমে যেগুলো সেই-ই কেবল আলাদা করে বুঝতে পারত। ঘরে যত লোকই থাকুক না কেন অথবা তারা যেভাবেই চলাচল করুক না কেন - সে কোন ভুল না করেই তার মায়ের কাছে চলে যেতে পারত। মা যখন তাকে কোলে নিত - সেটা সে আশা করুক আর নাই করুক - সে সবসময়ই বুঝতে পারত যে এটা তার মা। অন্যরা যখন তাকে কোলে নিত, সে আলতোভাবে তাদের মুখের উপর আঙুল বুলাত এবং এভাবে ধীরে ধীরে চিনে ফেলল কোনটা তার নার্স, কোনটা ম্যাক্সিম চাচা এবং কোনটা তার বাবা। এর বাইরে অচেনা কেউ যখন তাকে কোলে নিত, ঐ মানুষটার মুখের উপর বুলাতে থাকা তার আঙুলগুলো শ্লথ হয়ে যেত। আস্তে আস্তে, কিন্তু সুনিশ্চিতভাবে, অচেনা মুখটিকে তার আঙুলগুলো সনাক্ত করে ফেলত, তার মুখমণ্ডলকে খুব নিবিষ্ট লাগত তখন, যেন তার আঙুলগুলো তার হয়ে ‘দেখছে’।



প্রকৃতিগতভাবে সে ছিল প্রাণবন্ত ধরনের শিশু। কিন্তু যতই দিন যেতে থাকল ততই যেন তার অন্ধত্বের ছাপ তার স্বভাবের উপর বসে যেতে থাকল। তার চলাফেরা হয়ে উঠতে থাকল কম চটপটে। ঘরের নিরিবিলি কোনাগুলোতে লুকিয়ে বসে থাকার একটা অভ্যাস গড়ে উঠল তার, সেখানে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত অচঞ্চল ভঙ্গিতে, এবং তার মুখ দেখে মনে হত যেন কিছু শোনার চেষ্টা করছে। ঘরে যখন কেউ থাকত না, এবং অন্যদের কথাবার্তা বা চলাফেরার শব্দ যখন তার মনোযোগ আকর্ষণ করত না, তাকে দেখে তখন নে হত গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে এবং তখন তার সুন্দর মুখটাতে থাকত একটা বিপন্ন্ বিস্ময়ের আভা, সেটি মোটেও শিশুসুলভ ছিল না।

ম্যাক্সিম চাচা ঠিকই বলেছিলেন। অন্ধ শিশুটির প্রাণবন্ত ও অনুসন্ধানী চরিত্র তাকে অনেক সাহায্য করল। তার স্পর্শের বোধ হয়ে উঠল অসাধারণ। একটা সময়ে মনে হতে থাকল যেন, এমনকি, তার মধ্যে রঙ-এর অনুভব জেগে উঠছে: উজ্জ্বল রঙ-এর কোন জিনিসের উটর তার আঙুলগুলো বেশি সময় ধরে খেলা করত, এবং সেই সময়ে তার মুখে একটা অতিনিবিষ্ট মনোযোগের ভাব ফুটে উঠত। সবচেয়ে বিস্ময়কর উন্নতি, যেটি সময়ের সাথে সাথে পরিষ্কার হয়ে উঠল, সেটি হল তার শ্রবণশক্তি।

শিগগিরই সে বিভিন্ন শব্দের পার্থক্যের মাঝ দিয়ে এই বাড়ির প্রতিটি ঘরকে আলাদা করে চিনতে শিখল। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের পায়ের শব্দ আলাদা করে চিনল - তার পঙ্গু চাচার চেয়ারের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ, মায়ের সেলাই মেশিনের একটানা ছন্দ এবং ঘড়ির একঘেয়ে টিকটিক। খখনো কখনো মেঝেয় হামাগুড়ি দিতে দিতে সে এমন কোন শব্দে থমকে যেত এবং কানখাড়া করত যা স্বাভাবিকভাবে কারো শ্রুতিগোচর হওয়ারই কথা নয়। দেখা গেল তখন সে হাত বাড়াচ্ছে ঘরের দেয়ালে অলসভাবে ঘুরতেফিরতে থাকা একটা মাছির দিকে। মাছিটা উড়ে গেলে তার মুখে কিন্তু একটা বেদনার আভা ফুটে উঠে, যেহেতু সে বুঝতে পারে না কোন দিকে মাছিটা উড়ে গেল। অবশ্য বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই বেদনাবোধ ফিকে হয়ে গেল তার। বরং মাছিটা যে দিকে উড়ে যেত, সেদিকে সে তার মাথা চকিতে ঘুরিয়ে ফেলতে পারত তখন। তার শ্রবণমতা এতটাই পোক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, মাছিটার ত্রস্ত পাখা-ঝাপটানিকে সে খুব ভাল করে চিনে ফেলেছিল ইতিমধ্যে।

তার চারপাশের পৃথিবী - গতি, শব্দ ও রঙের পৃথিবী - এই অন্ধ বালকটির কাছে মুখ্যত পৌঁছাল শব্দের আকারে; আর তার চারপাশের ধারণাবলী হয়ে উঠল শব্দের ধারণা। তার মুখে সবসময় থাকত একটা ব্যতিক্রমী ধরনের শোনার ভঙ্গি, এজন্য তার থুতুনিটা সবসময় সামনের দিকে একটু বাড়ানো থাকত। আশ্চর্যজনক ভাবে চোখের ভুরু নড়ত তার, কিন্তু সুন্দর চোখজোড়া থাকত অচঞ্চল। ফলে তার মুখ বয়ে বেড়াত শিশুসুলভ নিবিষ্টতা এবং দুঃখবোধের একটা যুগপৎ মনোভাব।




৬.

অন্ধ বালকের জীবনের তৃতীয় শীতকালটাও ক্রমে শেষ হয়ে এল। দরজাগুলো আটকে-দেয়া বরফ গলতে শুরু করল, এবং শুরু হতে লাগল বসন্তের ব্যস্তমস্ত জীবন। সারা শীতকাল সে অসুস্থ হয়ে ছিল ঘরের মধ্যে, বাইরের বাতাসের ছোঁয়া লাগে নি বলতে গেলে; বসন্তের ছোঁয়ায় তার স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে লাগল।

জানালার খড়খড়িগুলো উঠিয়ে দেয়া হল, বসন্তের আনন্দ বিপুল উদ্যমে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। সূর্যের প্রফুল্লচ্ছটায় ঘরগুলোতে বয়ে যেতে লাগল আলোর বন্যা। সমুদ্র সৈকত, তখনও জনশূন্য, বরাবরের মতই জানালার বাইরে নিমন্ত্রণের মত দোলা দিতে লাগল। আর দূরে, ফসল কেটে-নেয়া কালো মাঠগুলো শুয়ে, স্থানে স্থানে বরফের আস্তর তখনও মিলায় নি। ঘাসগুলো অনেক জায়গাতেই বিবর্ণ ধরনের সবুজ রঙ পেতে আরম্ভ করছিল তখন। বাতাস ছিল নরম, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য যথার্থ। পুরো বাড়িটারই নবায়ন হল বসন্তের যাদুকরী শক্তির পরশে।

অন্ধ বালকের কাছে বসন্ত উপস্থিত হল ঘর ভরে-দেয়া উচ্ছল শব্দরাশির রূপে। বসন্তের বন্ধনহারা জলরাশির শব্দ শুনতে পেল সে, ঢেউয়ের পেছনে ঢেউ ভাঙ্গছে নিরন্তর, পাথরের মাঝ দিয়ে কলকল করে বইছে, পথ করে নিচ্ছে নরম ও ভেজা মাটির বুক চিরে। বাতাসের কানে কানে কথা বলা সমুদ্র তীরের গান শুনল সে। ঘরের চাতালে যে বরফ জমেছিল, এখন তা সূর্যের আলোয় গলে গলে পড়ছে, কান পেতে সে শুনতে লাগল অবিরত জলবিন্দু পতনের টুপটাপ শব্দ। নিখুঁত ও পরিষ্কারভাবে এই শব্দসমূহ ঘরে এসে আছড়ে পড়তে থাকল, যেন বা গোল গোল নুড়ি পড়ছে এমন মনে হল। কখনো কখনো, এই শব্দসমূহের মাঝে সারসের ডাকও এসে মিশে যেতে লাগল, বিশেষত যখন সে সুদূর আকাশ থেকে মাটির দিকে ডাইভ দিয়ে নেমে আসে এবং তারপর সেই ডাক আস্তে আস্তে বাতাসে মিলিয়ে যায়।

বসন্তের এই মহড়া বালকটির মুখে এক ধরনের বিপন্নতা ও দুঃখবোধের আভা তৈরি করল। সে মুখ বাড়িয়ে, ভুরু কুঁচকে অনেক আয়েশ করে শুনত, তারপর, যেন এইসব শব্দ তাকে ভীত করছে, এমন ভঙ্গিতে মায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিত এবং তার কোলের সঙ্গে লেপ্টে থাকত।

“ওর সমস্যা হচ্ছে কিসে?” মা ভাবল আর আশেপাশের সবাইকে জিজ্ঞেস করল।

ম্যাক্সিম চাচা অভিনিবেশ নিয়ে দীর্ঘসময় বালকটির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, তার সাম্প্রতিক আচরণের কোনো ব্যাখ্যা পাবার প্রত্যাশায়। কিন্তু ব্যাখ্যা মিলল না।

“সে আসলে....বুঝতে পারছে না” মা দ্বিধাজড়িত গলায় বলল, ছেলের মুখের বিপন্নতা খেয়াল করতে করতে।

সত্যিকার অর্থে, সে ভীত এবং অসহজ হয়ে পড়েছিল, আর এখন পুরোপুরি বিমূঢ় হয়ে পড়ল এইসমস্ত নতুন শব্দ ও ধ্বনির আগমনে, ভাবছিল পুরানো শব্দগুলো যেসব সে চিনত, সেগুলো মিলিয়ে গেল কোথায় ?


৭.

নতুন বসন্তের কলকাকলি ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল। যতই দিন যেতে লাগল, সূর্যের উত্তাপ ততই প্রকৃতিকে তার নিজস্ব ছন্দ ফিরিয়ে দিতে লাগল। জীবন আবার পুরনো গতি পেতে শুরু করল। পুরো থ্রটল ঠেলে দেয়া ইঞ্জিনের মতই সে সামনের দিকে ছুটতে আরম্ভ করল। তৃণভূমি সবুজ হয়ে উঠল, বাতাস ভারী হয়ে উঠল আমের বোলের গন্ধে।

ঠিক হল যে, বালকটিকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হবে, মাঠের মাঝ দিয়ে কাছের নদীতীরে।

মা তাকে কোলে নিল। ম্যাক্সিম চাচা ক্রাচে ভর দিয়ে তাদের পাশে পাশে হেঁটে চলল। তারা মাঠ পার হয়ে নদীপারের একটা সবুজ-ছাওয়া টিলার দিকে হাঁটল, সূর্যের আলো ও বাতাস একে একেবারে খটখটে শুকনো করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। টিলার উপর থেকে চারপাশের এলাকাটি আরো পরিষ্কার ও বিস্তৃতভাবে দেখা গেল।

মা হঠাৎ তার ধরে রাখা বালকের ছোট্ট মুঠির মধ্যে একটা চাপ অনুভব করল। বসন্তের প্রমত্ত যৌবন বালকটির মাকেও উতলা করে দিয়েছে আজ, ফলে বরাবরের মত ছেলের অস্বস্তিতে তাকে সংবেদনশীল দেখা গেল না। মা হেঁটেই চলল, মাথা উপরের দিকে তুলে, বসন্তের বাতাসে বুকভরা গভীর নিঃশ্বাস নিতে নিতে। নিচের দিকে যদি সে একমুহূর্তের জন্যও তাকাত, তাহলেও সে তার ছেলের বিপন্ন মুখভঙ্গি দেখতে পেত। বালকের অন্ধ চোখ সরাসরি সূর্যের দিকে ফেরানো, ঠোঁটদুটো ফাঁক হয়ে থাকা, পরিষ্কার বিস্ময়। সে খুব ছোট ছোট কিন্তু দ্রুত নিঃশ্বাস নিতে লাগল, ডাঙ্গায় তুললে মাছ যেমন করে। একসময়, তার বিপন্ন বিস্ময়ের আভা ভেদ করে মুখে ফুটে উঠল অনাবিল আনন্দের এক ভঙ্গি, বিপন্নতাকে এক লহমায় হটিয়ে দিয়ে ছোট্ট মুখটিকে আলোকিত করে তুলল সেই আভা। এর পরের মুহূর্তেই আবার সেই বোবা বিস্ময়, ভীত অনুসন্ধান। শুধু তার দেখার চোখজোড়া থাকল অচঞ্চল, দেখল না কিছুই, প্রকাশও করল না কিছু।

তারা ছোট্ট টিলাটির ওপরে উঠে ঘাসে ছাওয়া চূড়াটিতে বসল। অন্ধ শিশুটিকে তার মা তুলে নিয়ে এমনভাবে বসাল যেন তার আরাম হয় এবং তখনো সে তার মার হাত খামচি দিয়ে ধরে থাকল, যেন ভয় পাচ্ছে পড়ে যাবে, যেন তার পায়ের নিচে মাটি ঠিকমত খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু আবারও, বসন্তের সৌন্দর্যে বিমোহিত মা সেসব খেয়াল করল না।

সময়টা ছিল মধ্যদুপুর, ঘন নীল আকাশে সূর্যের অবিচল মূর্তি। আর নিচ দিয়ে চওড়া এবং গভীর নদীটি বসন্তের আশির্বাদে পূর্ণ হয়ে কলকল বয়ে যাচ্ছে। সবেমাত্র শীতের খোলস ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছে সে, এখানে ওখানে এখনও বরফের খণ্ড খণ্ড টুকরো ভাসছে - উজ্জ্বল আয়নার মধ্যে যেন সাদা সাদা ফোঁটা। তীরের জলঘাসগুলো প্লাবিত হওয়ায় গোটা এলাকাটিকে একটা বড়সড় বিলের মত দেখাচ্ছে; সেখানে মেঘের সাদা মিনার প্রতিফলিত হয়ে ফিরে ফিরে হারিয়ে যাচ্ছে, নদীর মধ্যে বরফের টুকরোর মতই। আর মাঝেমধ্যে বাতাস এসে জলের মধ্যে ঢেউয়ের দোলা তৈরি করে, সূর্যের আলোয় চকচক করে ওঠে নদী। নদী ছাড়িয়ে, দূরে, কালো, ভেজা ও আবাদযোগ্য সারিসারি মাঠ বিছিয়ে, আর কাঁপা কাঁপা কুয়াশার ঐ পাড়ে দেখা যায় কার যেন খড়ে-ছাওয়া গোয়াল, একেবারে বনের ঘন নীল কিনারায়। মনে হচ্ছে ধরিত্রী যেন শ্বাস ফেলছে, লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস, আকাশের উপাসনা করতে গিয়ে ধূপের সুগন্ধি জ্বালছে এখানে ওখানে।

সমগ্র প্রকৃতি আসলে একটা বিশাল মন্দির, যেখানে সে একটা ছুটির আয়োজনের মাঝে বিন্যস্ত হয়ে আছে। কিন্তু অন্ধ শিশুটির কাছে তা শুধুই অন্ধকার, বিশাল এবং সীমাহীন; একটা অন্ধকার যা অনভ্যস্ত ক্রোধের মত তাকে ঘিরে রাখে, যা প্রতিটি নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাকে নাড়ায়, ঝাঁকায়, বাজায় - এবং এত বিচিত্রভাবে যে তার হৃৎস্পন্দন বেদনাদায়কভাবে বাড়তেই থাকে।

যখন সে দরজার বাইরে প্রথম পা দিল, যখন সূর্যের আলো সরাসরি তার মুখে এসে পড়ল, তার চামড়ায় উত্তাপ ছড়াল, সে তখন সহজাত প্রবৃত্তির বশেই তার অন্ধ চোখজোড়া সূর্যের দিকে ফেরাল, যেন বুঝতে পেরেছে সে এটাই জগতের কেন্দ্র। চারপাশের দিগন্তবিস্তার, উপরের অসীম নীল - এসব সে কিছুই জানে নি তখন। সে শুধু বুঝতে পেরেছিল যে কিছু একটা জিনিস, হালকা, ছুঁয়ে যাওয়া, তার মুখ ছূঁয়েছে এবং মুখে উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়েছে। আর তারপর কিছু একটা, ঠাণ্ডা ও আলোময়, কিন্তু সৌর আলোর চেয়ে কম উত্তাপময় - তার মুখ থেকে ঐ উত্তাপকে ঝেঁটিয়ে দিয়ে ঠাণ্ডা এক আবেশে মুখখানি ভরিয়ে দিল। বাড়ির ভিতরে কিভাবে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে হয় সেটা শিশুটি শিখেছিল। সেখানে স্পেস ছিল শূন্য। কিন্তু এখানে - এখানে সে এমন কিছু দিয়ে বেষ্টিত যা ঢেউয়ের মত তার দিকে ছুটে-ছুটে আসছে, ব্যাখ্যার অতীত বৈচিত্র্য নিয়ে; এই বুলাচ্ছে নরম হাত, এই আবার পেশী জাগছে, জাগিয়ে দিচ্ছে। সূর্যের গরম ভাপ তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে হারিয়ে যাচ্ছে, বাতাস তার গালে গ্রীবায় খেলছে, থুতুনি থেকে কপাল পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে, যতক্ষণ না তার কানে বেজে ওঠে বাতাসের মধুর সঙ্গীত, যেন তারা চাইছে এই অন্ধ বালকটিকে তুলে এমন এক জায়গায় নিয়ে যেতে যে জায়গাটি তার অন্ধ চোখের অধিগম্য নয়। এই অনুভূতি তার চেতনাকে বেভুলো করছে, অবসন্ন করে দিচ্ছে। শিশুটি তার মায়ের হাত জোরে আঁকড়ে ধরে রাখল, দ্রিম দ্রিম কাঁপছে তার হৃদপিণ্ড, বন্ধ হবার উপক্রম।


তাকে ঘাসের ওপর বসিয়ে দেয়া হলে সে প্রথমে কিছুটা সহজ বোধ করল। বিপন্নতার অনুভূতি তখনও তার ছিল, তার হৃদয় পূর্ণ করে ছিল, তবে এখন সে তার চারপাশের শব্দগুলোকে আলাদা করতে পারছে। অন্ধকার ও তার ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া ঢেউগুলো তখনও আগের মতই তার কাছে আসতেছিল। মনে হচ্ছিল ঢেউগুলো যেন তার শরীরের ভিতর ঢুকে পড়ছে; তার রক্তধারা শিরার ভিতর যেন সেই ছন্দেই বইছে। এখন অবশ্য নানান ধ্বনিও ভেসে আসছে: ভরত পাখির কাঁপা কাঁপা ডাক, বার্চ গাছের নতুন পাতার মৃদু মর্মর, নদীর ছলছলাৎ। কাছাকাছি একটা সোয়ালো পাখি চক্কর খেয়ে গেল, ওর হালকা ডানায় শিস ধরিয়ে; ডাঁশমাছিগুলো ভনভন করছিল, এবং, দূরের মাঠে কোন কৃষক তার হালের বলদজোড়াকে টেনে নিতে গিয়ে হেট হেট বলছিল, একটু থেমে থেমে, সেই বিষণ্ন শব্দগুলোই ভেসে ভেসে আসছিল।

কিন্তু অন্ধ শিশুটির পক্ষে এই সবগুলো শব্দকে তাদের ঐকতানের মধ্যে অনুধাবন করে ফেলা সম্ভবপর ছিল না। সে তাদেরকে একত্র করে বুঝতে পারছিল না, তাদের স্ব স্ব প্রেক্ষাপটের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বুঝতে পারছিল না। এগুলো সবই ছিল আলাদা আলাদা; এই দৃষ্টিহীন বালকের ছোট্ট মাথার ভিতরে একটা একটা করে ঢুকছিল: কোনোটা নরম, কোনোটা অস্পষ্ট, কোনোটা চড়া, পরিষ্কার এবং কানে তালা লাগানোর মত। কখনো কখনো শব্দগুলো একসঙ্গে আসে, একটা বেসুরো সমাবেশের মধ্যে যেন একটা অপরটার ওপর হামলে পড়ে। তখনো মাঠের শিস ধরানো বাতাস তার কানে শিস ধরিয়েই চলছিল।


[ভ্লাদিমির করলেংকো-র "দ্য ব্লাইন্ড মিউজিশিয়ান" উপন্যাসের একটা অংশ, অনুবাদ করেছিলাম "দেখা না-দেখার চোখ" বইটির জন্য]


কোন মন্তব্য নেই: