বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০০৮

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ-এর গল্প বিষয়ে

মাতৃমূর্তি ক্যাথিড্রাল। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ। পেঁচা/প্রতিরূদ্ধ ২০০৪। মূল্য ১২৫ টাকা।


বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাস যুক্তি, বুদ্ধি, শুদ্ধি ও দৃশ্যবর্ণনার দাপটের ইতিহাস। এই মহান রাজপথে অনেক সৈনিক অকাতরে তাদের মূল্যবান মেধার খরচ করেছেন, তারপরও একে ছোটগল্পের একমাত্র ডাইস ধরে নিয়ে এর উপরে মালমশলা চাপানোর অন্ত নেই। ব্যতিক্রম চেষ্টা যে কিছু হয় নি তা নয়, তবে তাদের জন্য (কিঞ্চিৎ ভ্রুকুটি/প্রশ্রয়সহ) ‘কাব্যিক’ বা অন্য কোন বাতাবরণে মূলধারার বাইরে অন্য একটি লঘু প্রকরণের দোকান খোলার বাজে অভ্যাসও রপ্ত করেছি আমরা। সব কারখানাতেই ডাইস বদলানোর রেওয়াজ আছে, বছরে একবার, আর মালিক খুব কাইস্টা হলে দু’বছরে-তিনবছরে। বাংলা ছোটগল্পের বর্তমান ডাইসের মালিক শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ কাইস্টা ছিলেন না, নানারকম ডাইসের সন্ধান তিনি নিজেও যে করেন নাই এমনও নয়, তবু পৌত্রপৌত্রাদিক্রমে তারই চালু করে দেয়া ডাইস আমরাও চালু রাখতেছি। ফলে, বাংলা ছোটগল্প শতায়ু হতে না হতেই জটায়ু হয়ে উঠেছে, কেমন যেন প্রবীণ-প্রবীণ ভাব তার হাবভাবে। এখনকার অধিকাংশ ছোটগল্পের সর্বাঙ্গে প্রসববেদনা প্রকাশ্য, পড়ার পর মনে হয়, ফিরিয়া যাই, লইয়া আসি এর পয়দাকারীকে, আগলাইয়া রাখি পরবর্তী রিলিজের মর্মযাতনা থেকে।


সৌভাগ্যবশত, ফিরিবার প্রাক্কালেই কেবল নদীকূলের শ্মশান দৃষ্টিগোচর হয়, পালে জোর হাওয়া লাগে, কর্তব্যবোধ-সংক্রান্ত দার্শনিকভাব জ্রাগ্রত হয়, এবং এক অপেশাদার প্রকাশক কর্তৃক ‘মাতৃমূর্তি ক্যাথিড্রাল’ নামক একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’র পর এটি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ’র দ্বিতীয় গদ্যকীর্তি। আয়তনের দিক থেকে মাতৃমূর্তি বেশ স্বাস্থ্যবান একটি সংগ্রহ, আমার মতে অন্তত তিনটি পুস্তকের সম্ভাবনাকে এখানে একত্রে পুরে দেয়া হয়েছে। সম্ভাব্য প্রথম পুস্তকটির (মাতৃমূর্তি ক্যাথিড্রাল, কালিদহ, খুনেরা, রীতিমত পর্ণোগ্রাফি, মিরাজ, ঘাতক, নোবডি ইত্যাদি) উদ্দেশ্য তার পাঠক/সমালোচককে চমৎকৃত করা, স্বস্তির মধ্যে রাখা, কোনোভাবেই অপ্রস্তুত করা নয়। এসব গল্প নিয়ে প্রগলভ হয়ে উঠার সুযোগ অনেক, কালিদহএর ইংরেজি শিক বা নোবডি’র ডেডবডিকে ধরে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ পর্যন্ত তরতর করে উঠে যাওয়া যায়। এই পর্বে পাওয়া যায় একজন গল্পকার সুব্রত অগাস্টিন গোমেজকে, যিনি বঙ্গগল্পসাহিত্যে তার অপ্রতিষ্ঠার যাবতীয় সম্ভাবনা নির্মূলের ব্যাপারে একটুও ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নন।
তবু একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলা দরকার: নোবডি একটি অসাধারণ রচনা, কথিত রাজপথের মার্চপাস্টের প্রোডাক্ট হলেও, এমনকি হ্রস্ব দৈর্ঘের বৃষ্টিও, যার আত্মায় কান পাতলে করলেংকোর নৈশঝড়ের (বনগর্জন-ভ­াদিমির করলেংকো) আভাস মিলবে হয়তো। আভাসেই ভালোবাসা মেলে, বইয়ে যাইই থাকুক, নাম নির্বাচনের জন্য হুমায়ুন আহমেদ যে খনিতে নামেন তার নাম রবীন্দ্রনাথ, সেটি তিনি আভাসের বাজারমূল্য বোঝেন বলেই। আসন পেয়ে যাওয়ার এটিও একটি তরিকা, কিন্তু সুব্রত’র মন মজে নি সেদিকে। তিনি সুদূরের পিয়াসী।

ফলত, তিনি অন্য এক ধরনের সুষমাসন্ধান করেছেন, এটাকে আমি ফেলছি দ্বিতীয় ক্যাটেগরিতে (ওমেগা, যৌবরাজ্য, বদলা, সেনবংশ ইত্যাদি)। এটি ছিল আশি দশকের আড্ডাগুলোর একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ফর্ম। দেখতে (বা শুনতে) তাদের উপকথার মত সাজানোগুছানো লাগলেও ভেতরে ভেতরে এরা ছিল অযুক্তির নৈরাজ্য-ভরা, যুক্তির নিরংকুশ আধিপত্যকে তারই অস্ত্রে পাল্টা আঘাত করার একটা স্বতঃস্ফূর্ত চর্চা । এই মৌখিক ঘরানার আধিকারিক ছিলেন জনাব শামসুল কবীর বা ইচক দুয়েন্দে (দ্রষ্টব্য: মাওলানা নাভাসি- কচিসমগ্র, পেঁচা/প্রতিরূদ্ধ ২০০৪)। যারা বঙ্গসাহিত্যে আশি দশকের ইম্প্যাক্ট নিয়ে নানান কটুকথা বলেন ও কটাসন্দেহ করেন, তাদের আমি এই বিষয়টি বিবেচনার আমন্ত্রণ জানাই। শামসুল কবীর চিন্তার যুক্তিশৃঙ্খলাকে পুরোপুরি পরাজিত করতে পেরেছিলেন তার ঐসব অনুগল্পে (দৃর্ভাগ্য, এদের অনেক গল্পই লিখিত নয়!)। সুব্রত কিন্তু পরাজিত করেন নি, পোষ মানিয়ে নিয়েছেন। ভাষার অলংকার কীভাবে উল্টো যুক্তিপরম্পরাকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করে Ñ ‘সেনবংশ’ এর উদাহরণ। ‘বদলা’ বা ‘আপেল পেকে এসো ক্রমে’ এই প্রবণতাটিকে আরও বড় প্রেেিত ফেলবার প্রচেষ্টা, যদিও খুব সফল হয়েছে এমনটা মনে হয় নাই।

তৃতীয় সম্ভাব্য পুস্তকটি (অফিস, প্রলয়পয়োধিজলে, যান, চরৈবেতি, রাইসুর বিচিত্র কান্ডকারখানা) বঙ্গসাহিত্যের পাঠ অভিজ্ঞতার বিচারে বিব্রতকর ব্যতিক্রম লাগতে পারে। সুব্রত তার অমরত্বের আকাক্সা রোপন করেছেন এই পর্বে এসে। এসব গল্পে তিনি উদ্দাম, অ-শাসিত, পূর্বাপর-অমনস্ক, চরিত্রচিত্রণে বায়াজড, নিজ জীবনাচরণে কমিটেড, এবং গতিধারায় প্রায়ই ইনটুইটিভ। প্রথম স্তরের গল্পগুলোতে তিনি যুক্তিপ্রক্রিয়ার গভীর বশ ছিলেন, দ্বিতীয় স্তরে উল্টো তাকেই পোষ মানিয়েছেন, আর এই স্তরে এসে ঐ পোষ-মানা জন্তুটির শেকল খুলে দিয়েছেন যাতে সে পালাতে পারে। আর শেকল-খোলা ঐ জন্তুটির আচরণ আরো বিস্ময়কর: কখনও সে পালায় দূরে, কখনও আবার পায়ে এসে মুখ ঘষে। এই টানাপোড়েনসমতে সুব্রত যে গদ্য তৈরি করেছেন সেটি তার সময়ের ভাষা, যদিও সেই সময়ের অনেক সাহিত্যকে আমরা ঐ ভাষায় কথা বলতে শুনি নি। এখানেই সুব্রত তার দশকের সাচ্চা প্রতিনিধিদের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন হয়ে উঠেছেন, যা তিনি কবি হিসেবে আগে থেকেই ছিলেন (কাব্যগ্রন্থ- তনুমধ্যা, পুলিপোলাও) , যদিও কবিতায় তিনি এতখানি স্বাধীনতা উপভোগ করেন নি বলেই আমার মনে হয়েছে।

এর আগে বাংলা গদ্যসাহিত্যের সম্ভাব্য যে গতিপথটিকে ধ্র“ব ধরে নেয়া হচ্ছিল কয়েক দশক ধরে Ñ সম্ভবত মার্কসবাদী এবং নিও-মার্কসিস্ট নন্দনতত্ত্বের প্রভাবে Ñ মেদহীন ঝরঝরে শাণিত ভাষা, নির্লোভ লেখকত্ব, নির্মম কাহিনীবিন্যাস, মনোদৈহিক জটাজাল Ñ সুব্রত’র এই পর্বের গল্পগুলো তার ধ্র“বত্বকে চ্যালেঞ্জ করে। সুব্রত আক্রমণ করেছেন ‘শাণিত’ ভাষাভঙ্গি-সম্পর্কিত আমাদের ধ্যানধারণাকে (প্রলয়পয়োধিজলে), লেখকসুলভ ‘নির্লোভ’ দূরত্বের মহিমা তিনি গ্রহণ করেন নি অনেক গল্পেই (অফিস, চরৈবেতি ইত্যাদি), তার বিবৃত কাহিনীর মধ্যে তিনি খুব ‘লিপ্ত’ থাকেন প্রায়ই (রাইসুর বিচিত্র কান্ডকারখানা। আরো দ্রষ্টব্য: ওমেগা এবং তৃতীয় প্রচ্ছদের উপসংহারগত সাযুজ্য)। সবচেয়ে বড় ব্যতিক্রম হল, যেসব প্রেতি লেখকের সাইকোঅ্যানালিসিস দাবি করে সেসব জায়গায় সুব্রত ফিজিক্যাল মুভমেন্ট ও সংলাপের দ্বারস্থ হয়েছেন (যান-এর শেষাংশ, নিশি, ঘাতক ইত্যাদি)। এসবই নতুন (বাংলা) ধরনের গল্পের আলামত, তাদের মধ্যে নৈরাজ্য থাকতে পারে, কিন্তু কেরাণিসুলভ কিষ্টতা নাই। এভাবেই সুব্রত’র গল্প আমাদের কাহিনীহীনতার দিকে আমন্ত্রণ জানায়, গদ্যকে যুক্তির শেকল থেকে মুক্ত করে এবং অযুক্তির বিনোদন পুরে দেয়। ‘মাতৃমূর্তি ক্যাথিড্রাল’ পাঠের বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে বাংলা গদ্যরীতি বা ছোটগল্পের ভবিষ্যত চেহারা ইত্যাদি ভাবনায় ফুর্তি আসে খুব, এটা উপরি পাওনা এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই।

বইটির প্রকাশক মানস চৌধুরী একজন অপেশাদার প্রকাশক, যদিও অপেশাদরিত্বের ছাপ তিনি গ্রন্থে রাখতে পারেন নি, দুয়েকটা বানানভুল ছাড়া। প্রচ্ছদ ভাল লাগে, তবে দূর থেকে। তৃতীয় প্রচ্ছদে লেখক সম্পর্কে একটি অতিনিরীহ বয়ান আছে যেটি গ্রন্থপ্রবেশে উদ্যোগী পাঠককে আরো ক্যাজুয়েল করে, আসন্ন রূদ্ধশ্বাস ভ্রমণের পূর্বাভাস দেয় না কোনমতেই। বিপদজনক ফাঁদ! ইচ্ছাকৃত?

কোন মন্তব্য নেই: