বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০০৮

হালের ইসলামি চিন্তা: কতটুকু র‌্যাডিক্যাল, কোথায় লিবারাল

ইসলামী চিন্তার পুনর্পঠন: সমকালীন মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের সংগ্রাম। প্রথম খণ্ড। সংকলন ও অনুবাদ রেহনুমা আহমেদ। মে ২০০৬। একুশে পাবলিকেশন্স লিমিটেড, ঢাকা। প্রচ্ছদ অজ্ঞাত। ৪৬৪ পৃষ্ঠা। ৩৭৫ টাকা।


গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ইসলামী চিন্তার পুনর্পঠনের একটি প্রক্রিয়া দেখা যাচ্ছে বিশ্ব জুড়ে। অর্থনীতির বিশ্বায়ন এবং উত্তর-উপনিবেশ চিন্তাস্বাতন্ত্র্যের ফলশ্র“তি হিসাবেই এই প্রক্রিয়াটি বেগবান হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। একই সময়ে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি, পুঁজিবাদের নিঃস্বায়ন প্রক্রিয়া এবং আরো নানান প্ররোচনায় প্রথম ও তৃতীয় বিশ্বে ইসলামী জঙ্গিবাদেরও পুনরুত্থান ঘটেছে। ফলে, ইসলাম ধর্ম তথা মুসলিম জীবনব্যবস্থাকে গোটা পশ্চিমাশক্তির কোপানলে পড়তে হয়েছে নানাভাবে। ইসলামকে নিয়ে পশ্চিমের বুদ্ধিজীবীরা যে ধরনের সরলীকৃত এবং কনকুসিভ মন্তব্য করেছেন, তার বুদ্ধিবৃত্তিক জবাব আমরা পাই তালাল আসাদ, এডোয়ার্ড সাঈদ কিংবা একবাল আহমাদ-এর লেখায়। রেহনুমা আহমেদ সংকলিত এবং অনূদিত ‘ইসলামী চিন্তার পুনর্পঠন: সমকালীন মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের সংগ্রাম’ নামক গ্রন্থে ঐ ত্রয়ীর কোনো লেখা স্থান পায় নি। তাদের অব্যবহিত উত্তরসূরী এবং জীবিত (একজন বাদে) মুসলমান বুদ্ধিজীবী, অ্যাক্টিভিস্ট এবং ধর্মতাত্ত্বিকদের সাাৎকার, রচনা, এবং বাহাস নিয়ে এই বই। লেখক তালিকায় আছেন আমিনা ওয়াদুদ যিনি মুসলমান নারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম নামাজের ইমামতি করেন। আছেন টাইমস-এর বিচারে পৃথিবীর জীবিত চিন্তাবিদদের সেরা বিশজনের তালিকায় স্থান পাওয়া তারিক রামাদানসহ আরো অনেক খ্যাতনামা/অখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ। গ্রন্থভূক্ত লেখার বিষয়ও বহুবিধ: সাম্রাজ্যবাদ, ইসলামী রাষ্ট্র, নারীবাদ, কোরআন পঠনরীতি, শরীয়া ইত্যাদি। বিষয় বহুবিধ হলেও প্রণোদনা একটিই: যুক্তি ও প্রপঞ্চের নিরিখে পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতায় ইসলামকে পুনর্ব্যাখ্যা।


এসব সমকালীন মুসলমান চিন্তাবিদদের অনেকেই সরবে বা নীরবে দশম খৃস্টীয় শতকের মুসলিম চিন্তাগোষ্ঠী ‘মুতাযিলা’ সম্প্রদায়কে তাদের পূর্বসুরী মেনেছেন। একথা অনেকের অজানা নয় যে, যুক্তি এবং পদ্ধতিনির্ভর মুতাযিলা-চিন্তা সেসময়ের মেইনস্ট্রিম মুসলিম মানসে খুব একটা পাত্তা পায়নি। এই বই থেকে আরো জানা গেল যে, আব্দোলকরিম সোরোউশ-এর প্রকাশিতব্য একটি বইয়ের নাম ‘রিইনভেন্টিং দ্য মুতাযিলাইট এক্সপেরিয়েন্স’ বা মুতাযিলা-অভিজ্ঞতার পুনরুদ্ভাবন। এই নাম থেকেই ইসলামী চিন্তার পুনর্পঠনের একটি সূত্র পাওয়া যায়। এই তাত্ত্বিকেরা ইসলামী ঐতিহ্যের পরাজিত দার্শনিক আন্দোলনগুলোকে পুনর্নিরীা করতে চান। বিশ্বব্যাপী ইসলামী চিন্তার যখন পুনর্পঠন হচ্ছে, তখন এ ধরনের নিরীা নিশ্চয়ই অনেক জরুরি। কেন মুতাযিলা সম্প্রদায়ের যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যায় না-মজে ইসলাম ধর্ম আশআরীয় কাব্যে মজেছিল সেসময়ে?

যাক সে কথা। ইসলামী চিন্তার এই যে পুনর্পঠন, তা চরিত্রগত অর্থে সমরূপী (যড়সড়মবহড়ঁং) মনে হয় নি। এই মিছিলে সামিল আছেন এমন চিন্তক (আমিনা ওয়াদুদ) যিনি নিজেকে পোস্টমডার্ণ এবং ইসলামী চিন্তার পুনর্পঠনকে একটি ‘পোস্টমডার্ণ’ চেষ্টা মনে করেন। আবার অনেকেই আছেন, যথা: আব্দোলকরিম সোরোউশ, যার মূল সমস্যা ইসলামের সাথে ‘আধুনিকতা’ তথা গণতন্ত্রের মেলবন্ধন ঘটানো। এটি বেশ চিত্তাকর্ষক বৈচিত্র্য এই গ্রন্থের। বোঝা যাচ্ছে, পশ্চিমা চিন্তার লিগ্যাসীর দিক থেকে যে যেই পাটাতনেই থাকেন না কেন, প্রত্যেকেই সামিল হচ্ছেন ইসলামের পুনর্পঠনে। কেন?

জবাব পাওয়া যায় রাদওয়ান আল সাইয়িদ-এর লেখায়। তিনি লেখেন, “নৃশংস খুনী, ধর্মীয় উন্মাদ, শয়তান, আত্মঘাতী হামলাকারী, গলা জবাই করে Ñ আর অবশ্যই খুব-সাধারণ ‘স’[ন্ত্রাস] শব্দটি: গত এক দশকে ইসলাম সম্বন্ধে এই ইমেজ পশ্চিমে পাবলিক আলাপচারিতাকে আকার-আকৃতিদান করেছে” [পৃষ্ঠা ৩৭৩]। অর্থাৎ ইসলামের নামে জঙ্গীবাদের এই উত্থান-ই প্রকারান্তরে লিবারাল মুসলিম চিন্তাবিদদের ইসলামী চিন্তার পুনর্পঠনে উদ্যোগী করেছে। গ্রন্থভূক্ত অনেক লেখক আবার পশ্চিমের নানান দেশের অভিবাসী হওয়ায় তাদের ওপর বাড়তি একটা চাপ আছে যেটি সহজে বোধগম্য। কিন্তু তারপরও তাদের লেখায় জঙ্গীবাদ নিয়ে সমাজতাত্ত্বিক আলাপের জায়গা খুবই অপ্রতুল মনে হয়েছে। দার্শনিক ও যৌক্তিকভাবে জঙ্গীবাদকে প্রত্যাখ্যান করলেই যেন দায়িত্ব ফুরাবে, এমন মনে হয় তাদের লেখা পাঠ করলে। কেউ কেউ অবশ্য প্রথম বিশ্বে গজিয়ে-ওঠা জঙ্গীবাদের সামাজিক শেকড় খুঁজেছেন। কিন্তু যে আর্থসামাজিক বাস্তবতায় তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলোতে জঙ্গীবাদ গড়ে ওঠে, তার ব্যাপারে মুখ খোলেন নি এদের প্রায়-কেউই। অথচ এই লেখকদের অনেকেই তৃতীয় বিশ্বের বাসিন্দা।

সামান্য ব্যতিক্রম ছিলেন গুটিকয় চিন্তক: যেমন ফাহমী হাওয়েদী। তিনি বলছেন, “উগ্রপন্থী দলগুলোর জঙ্গীপনার কথা যখন বলা হয়, তখন একইসাথে এই দলগুলোর প্রতি রাষ্ট্রের সহিংসতার কথা বলা হয় না কেন, সহিংসতার যে চক্রে এগুলো সৃষ্টি হচ্ছে তার কথা বলা হয় না কেন?” [পৃষ্ঠা ৩১৭] অর্থাৎ সেটা বলা কিংবা উদঘাটন করার দায়িত্ব তিনি অন্য কাউকে ন্যস্ত করতে চান। রাদওয়ান আল সাইয়িদও এেেত্র রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দোষী মনে করেন। তার মতে, একটি প্রাণবন্ত রাজনৈতিক আবহ না-থাকার কারণে জঙ্গীবাদের রাজনৈতিক আকাক্সা প্রকাশ্য হওয়ার আশায় শেষমেষ সহিংস হয়ে উঠতে বাধ্য হয়। [ পৃষ্ঠা ৩৭৯]

এ প্রসঙ্গে এই গ্রন্থের সংকলক এবং অনুবাদক রেহনুমা-র একটি মন্তব্যকেও বিপদজনক সরলীকরণ মনে হয়েছে। প্রাককথন অংশে তিনি বাংলাদেশের জঙ্গী সম্পর্কে মন্তব্য করছেন, “ইসলামী/জঙ্গী ইসলামী শক্তি রাষ্ট্র-বিপীয় শক্তি না। ....বরং, তারা আম-জনতার প্রতিপ শক্তি।” [পৃষ্ঠা ২২] নানান পাবলিক স্থানে বোমা হামলার কারণে তিনি এই ‘জনপ্রিয়’ অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। আমল দেন নাই ধরা-পড়া জঙ্গীরা আমাদের বিচারব্যবস্থা নিয়ে কী কী কথা বলছে তার ওপর, এই বই যখন তিনি (রেহনুমা) লিখছেন তখন জঙ্গী শায়খ রহমান কিংবা বাংলা ভাই আদালতে দাঁড়িয়েই আদালত ব্যবস্থাকে প্রকাশ্যে বিদ্রুপ করছে। সেটি কি কেবলি নাটকীয়তা? সেটি কি তাদের রাষ্ট্রবিরোধী পজিশন নয়?

ইসলামী চিন্তার পুনর্পঠনের এই কালে চিন্তকদের নিজেদের মতের ভিন্নতা এবং বিষম অবস্থানের কথা আলোচনা হচ্ছিল। একটা ভাইব্র্যান্ট চিন্তাপ্রক্রিয়া চলমান আছে, এ ধরনের প্রপঞ্চ থেকে এটিই প্রমাণিত হয়। যেমন, রাশেদ ঘান্নুশী তালিবান প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আফগানিস্তানকে একটা অশিতি, ট্রাইবাল ও ভাঙ্গাচোরা সমাজ বলে অভিহিত করেন [পৃষ্ঠা ৫৪], অথচ হেবা এজ্জাত-এর কাছে পূর্ব এশিয়া, ইরান, আফগানিস্তান হচ্ছে বহু ফিকহ্ শাস্ত্রের উৎসস্থল [পৃষ্ঠা ৫৮]। এ কারণে চিন্তার েেত্র হেবা এজ্জাত ভৌগোলিক উৎকৃষ্টতা বা সিনিয়রিটির ধারণার সাথে একমত হন না। আবার আমিনা ওয়াদুদ-এর মতে, শরীয়া সম্পূর্ণরূপে পিতৃতান্ত্রিক [পৃষ্ঠা ৩৫]। কিন্তু তারিক রামাদান শরীয়ার পালম্বন করতে গিয়ে বলেন যে, শরীয়া কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা নয়, এটি মূল্যবোধের ব্যবস্থা। স্যাটেলাইট ধর্মযাজক শেখ ইউসুফ আল-কারাদাউয়ি-র মতে শরীয়ার ভিতর পাঁচটি বিষয় আছে: ধর্ম, আত্মা, মন. উত্তরাধিকার এবং ধনসম্পদ [পৃষ্ঠা ১৯০]। এটি পরিষ্কার যে, শেষোক্ত দুইজন শরীয়াকে একটা কোজড পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে মানছেন না।

মিসরের সেক্যুলার নারীবাদীদের বিষয়ে হেবা এজ্জাতের মন্তব্যটি খুব গুরুত্বপূর্ণ লেগেছে। তিনি বলছেন, আইনের পরিবর্তন করে রাষ্ট্রকে মতায়িত করার মাধ্যমে মিসরের নারীবাদীরা রাষ্ট্রমতা দ্বারা আত্মসাৎকৃত হয়ে গেছেন। [পৃষ্ঠা ৬৪] কারণ চূড়ান্ত বিচারে রাষ্ট্রই যখন জয়ী হয়, তখন সেই নারীবাদীরা কার্যত রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ হয়ে পড়েন। এই পর্যবেণ বাংলাদেশের নারীবাদের েেত্রও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে।

‘সহনশীলতা’ প্রসঙ্গে তারিক রামাদানের অবস্থানটি বেশ চিন্তা উদ্রেককারী। তিনি বলছেন, “আমি সহনশীলতার ধারণার ঘোর বিরোধী। বেশির ভাগ সময়ে এর অর্থ হচ্ছে: ‘আমি গ্রহণ করি যে আপনি এখানে আছেন, যেহেতু আপনার এখানে থাকার ব্যাপারে আমার কোনো চয়েস নাই। কিন্তু আপনার এখানে থাকায় আমার কিছু যায়-আসে না, আমি [শুধু] আপনাকে বরদাশত করি।” [পৃষ্ঠা ১৪৩] একইভাবে, ‘বিশ্বাস’কে একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক বৃত্তি হিসাবে দেখার উস্কানি পাওয়া যায় শাবেস্তারির প্রসঙ্গ আলোচনায়। এই চিন্তকের মতে, বিশ্বাস কখনোই অন্ধ অনুকরণ নয়। [পৃষ্ঠা ৪০৭] বিশ্বাস হচ্ছে যাচাই করতে পারা। ফলে তার জন্য চিন্তার স্বাধীনতা একান্ত দরকার। আবার, রাষ্ট্রগঠন আর উম্মাহগঠন যে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস সেটি শেখ তাহা-র জবানিতে পাওয়া যায়। তার মতে, ইসলাম রাষ্ট্রগঠন নয়, বরং উম্মাহগঠন নিয়ে ভাবিত। এসব-ই চিন্তার ঐতিহ্যে সমকালীন মুসলিম দার্শনিকদের মৌলিক অবদান বলে মনে হয়েছে।

খুবই চমৎকার লেগেছে আব্দোলকরিম সোরোউশ-এর কথাবার্তা। মুসলমানদের নীতিনৈতিকতার ঐতিহাসিক পতন বিষয়ে সুন্দর একটি ভাষ্য দাঁড় করান তিনি। তার মতে, ঐতিহাসিক কালে ইসলামে ফিকহ্ শাস্ত্রের চর্চা যতটুকু হয়েছে, এথিক্সের চর্চা/বিকাশ তত পরিমাণে হয়নি। তিনি মনে করেন, ফিকহ্ শাস্ত্রের বিধানকে এথিক্সের বিধানের চেয়ে শ্রেয়তর ভাবার কারণ নেই। এমনটা ভাবা হয়েছে বলেই ইসলামে মানবাধিকার-বিষয়টি দুর্বলভাবে এসেছে। কিন্তু, তার নৈতিক ভাষ্য দাঁড়িয়ে থাকে ‘আমাদের নৈতিক হতে হবে’ জাতীয় একটি পূর্বানুমানের ওপর। এরকম একটি পূর্বানুমান নীতিশাস্ত্রের ঐতিহাসিক বিকাশকে পাশ কাটিয়ে যায় বলে মনে হয়। কেন নৈতিক হতে হবে, এটি কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ কোনো অনুসন্ধান নয়, বিশেষত এই উত্তরাধুনিক যুগে। আরেকটি লেখায় আব্দোলকরিম সোরোউশ অধিকার বনাম কর্তব্যের তর্ক হাজির করেছেন ইমানুয়েল কান্ট তথা আধুনিক পাশ্চাত্যচিন্তার চোখরাঙানির সামনে। তার মতে, কী ইসলাম কী ক্রিশ্চিয়ান ধর্মের ভাষা হল দায়িত্বপালনের ভাষা। আপনি ঠিকমত দায়িত্ব পালন করছেন কিনা সেটা দেখা ঈশ্বরের কাজ। কিন্তু আজকের আধুনিক মানুষ ঈশ্বরের এবাদত করাকে ‘দায়িত্ব’ ভাবতে রাজি নন, ঈশ্বরের এবাদত তার ‘অধিকার’। আর এই ধ্যানধারণাই হল লিবারাল পশ্চিমের লিগ্যাসী। এই লিগ্যাসী নিয়েই ইসলামের পুনর্পঠন করতে চান সমকালীন এই মুসলমান চিন্তাবিদেরা।

রেহনুমা আহমেদ-এর অনুবাদ ঝরঝরে Ñ এমনটা বলা যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও তার ভাষা আড়ষ্ট, আর হাইফেন-ব্যবহারে যথেচ্ছাচার ল্য করা যায়। বাংলা পরিভাষা প্রণয়নে তিনি বহু জায়গাতেই কনভিন্সিং হয়ে উঠতে পারেন নি, হয়ত বাংলা শব্দের ইটিওমোলজিক্যাল দিকটা বিবেচনায় না-আনার কারণে। যেমন ঊীঃবৎহধষরঃু শব্দের বাংলা করেছেন তিনি ‘বহিরাগততা’, আবার জবষধঃরারংধঃরড়হ শব্দটিকে বাংলায় লিখছেন ‘আপেকিতা-করা’ শব্দবন্ধে, যার অর্থ কী হয় সেটা নিয়ে ধন্দ জাগে। বাক্য গঠনেও তাকে নানা জায়গায় অমনোযোগী লাগে, যেমন ৪০২ পৃষ্ঠায় লিখছেন ‘বিতর্ক তার পিছু অনুসরণ করেছে’। কিংবা ৫০ পৃষ্ঠায়, ‘ঘান্নুশীর চিন্তা প্রকাশ করে পশ্চিমা এবং ইসলামী দর্শন, দুটোরই ওস্তাদী বোধগম্যতা’। এসব বাক্যের অর্থ অস্পষ্ট, দূরান্বয়ী এবং ফলত কখনো কখনো পীড়াদায়ক।

তবে, সমকালীন ইসলামী চিন্তকদের লেখা বাংলায় প্রকাশ করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় (এবং শ্রমসাধ্য) অনুমতিটুকু নিতে কার্পণ্য করেননি অনুবাদক। এটি প্রশংসার দাবিদার, কারণ এই দেশে গ্রন্থস্বত্ব কিংবা লেখাস্বত্ব স্বীকারের সংস্কৃতি এখনও গড়ে ওঠেনি। গ্রন্থটির একটি ভূমিকাও লিখেছেন তিনি (ভাগ্যিস সাঈদ ফেরদৌস এবং নাদিম মণ্ডল অনুরোধ করেছিলেন!)। তাতে, স্বল্প পরিসরে ইসলাম, জঙ্গীবাদ এবং বর্তমান দুনিয়ার হালঅবস্থা নিয়ে রেহনুমা আহমেদ একটি আলাপ পেশ করেছেন। ভূমিকাটি আরো বিস্তৃত হতে পারত।

সব মিলিয়ে, রেহনুমা আহমেদ-এর এই সংকলনে স্থান পাওয়া অধিকাংশ লেখকই ইসলামী সিভিল সোসাইটির লোক। দেখা যাচ্ছে, তারা কোরআনের পঠনপাঠন বিষয়ে যতখানি র‌্যাডিক্যাল, পশ্চিমের চিন্তা অ্যাকোমোডেট করার ব্যাপারে ঠিক ততখানিই লিবারাল। ইসলামের শুরুর দিকে গ্রিকচিন্তা-প্রভাবিত মুতাযিলা আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল, তার একটা পুনর্নিরীা করতে চান এই সমকালীন মুসলমান দার্শনিকেরা। এখন মনে হচ্ছে, সেই নিরীার ফল হাতে পেলেই কেবল এই পুস্তকের শিা সম্পূর্ণ হতে পারে। অপোয় থাকলাম, রেহনুমা আহমেদ বা অন্য কেউ হয়ত ‘রিইনভেন্টিং দ্য মুতাযিলাইট এক্সপেরিয়েন্স’ নামক বইটি বাংলাভাষার পাঠকদের পড়ার সুযোগ করে দেবেন।

কোন মন্তব্য নেই: