বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০০৮

"মধ্যরাতের নদী" নিয়ে মুজিব মেহদীর আলোচনা


পড়েছিলাম 'ময়মনসিংহ জং' নামক একটি লিটল ম্যাগাজিনে। কবি মুজিব মেহদী এই কাগজের সাথে সাক্ষাৎকারে সমসাময়িককালে তাঁর পছন্দের একটি কবিতার কথা বলতে গিয়ে "মধ্যরাতের নদী" কবিতাটির কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিছু আলোচনাও করেছিলেন। সাক্ষাৎকারের সেই অংশটি এখানে ব্লগস্থ হল:

......................
ময়মনসিংহ জং : একটি প্রিয় (অন্যের) কবিতার কথা বলুন। ভালো লাগার কার্যকারণসহ।

মুজিব মেহদী : একজন নিয়মিত পাঠক তাঁর পাঠেতিহাসে অনেক প্রিয় কবিতার সংস্পর্শে আসেন। এই প্রিয়তা আবার সময়ে বদলে বদলে যায়। সময়ে কোনো-কোনোটার প্রতি ভালো লাগা আরো প্রগাঢ় হয়, কোনোটা আর ভালো লাগে না। আবার নতুন নতুন ভালো লাগার কবিতা প্রিয়তালিকায় যুক্তও হয়। আমারও এমন হয়েছে। আমার ভালো লাগা কবিতার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তার ভিতর থেকে একটি কবিতা বেছে নিতে গিয়ে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের মোকাবেলা করতে হলো। কোনটি রেখে কোনটির কথা বলব। যেটির কথা বলব সেটি কি প্রিয়দের সেরা ? তা না হলে তো অবশ্যই অন্য কোনো বিবেচনা দরকার। সেটা কী হতে পারে ? ঠিক করে নিলাম নির্বাচিত কবিতাটিকে হতে হবে বাংলাদেশের কোনো কবির কবিতা এবং আমার সমসাময়িক কোনো কবির। এখানেও দেখলাম অনেক কবিতাই নির্বাচনপ্রার্থী। শেষাবধি আরেকটি বিবেচনা সামনে আনতে হলো। সেটা এই যে, জন্মে না হোক অন্তত কাব্যচর্চায় হলেও কবিকে হতে হবে আমার চেয়ে জ্যেষ্ঠ। এবার বেছে নেয়া গেল সুমন রহমান (১৯৭০) এর ‘মধ্যরাতের নদী’।
সুমন রহমান কবি হিসেবে আমাদের সমসাময়িক, তবে তাঁর কাব্যঅভিযাত্রার সূচনা অন্তিমআশিতে। ঈশান জয়দ্রথ লেখকনামে ১৯৯৪-এ বোরোয় তাঁর ‘ঝিঁঝিট’ নামক প্রথম কাব্যগ্রন্থ। দীর্ঘ প্রায় দেড় দশক পর সুমন রহমান লেখকনামে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সিরামিকের নিজস্ব ঝগড়া’ বেরিয়েছে ২০০৮-এ। কবিতাটি সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সিরামিকের নিজস্ব ঝগড়া’য় অন্তর্ভুক্ত হবারও আগে একাধিকবার পঠিত ওয়েবব্লগ ‘সচলায়তন’ এবং সম্ভবত লিটলম্যাগ ‘মান্দার’-এ।

কোনো শিল্পকর্মের প্রতি ভালো লাগা ব্যাপারটা সবসময় ব্যাখ্যাযোগ্য হয় না। ব্যাখ্যা যাও-বা কোনোরূপে সম্পন্ন করা যায় তা কখনো সর্বজনীন হয় না, ফলত হয় খণ্ডিত ও একপেশে। তবু খণ্ডিতকরণেরই কিছু চেষ্টা হোক।

নদীবহুল বাংলাদেশের কবিতা ও গানে নদীকে নিজের দুঃখের কথা শোনানোর রীতিটি আমাদের ঐতিহ্যসম্পৃক্তই। তবু কবিতাটি অন্যান্য নদীবচন থেকে আলাদা। সাধারণত নদী নিয়ে যেরকম কবিতা লিখিত হয়, কবিতাটিতে সেসব উপাদানের কোনো-কোনোটি হাজির থাকলেও এটি মোটেই সেরকম নয়। নদীসংক্রান্ত লেখায় নদীর চপলতা, নিষ্কলূষতা, সুদূরগমন ক্ষমতা ইত্যাদির প্রশস্তি গান থাকে, কিংবা রাতের নদী হলে তাতে পড়া চাঁদের ছায়ায় প্রিয়তমার মুখাবয়ব দেখাজনিত অধ্যাসের বর্ণনাও থাকে। এখানে সেসব নেই। এই কবিতাটি মহিমান্বিত নদীকে সাক্ষী মেনে একজন কবির নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার শিল্পসৌকর্যে। কবিতাটি পড়তে পড়তে নদীর মতো দীর্ঘ একটি হাহাকার হাতকয় দূর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়, দূরাগত কৃত্রিম আলোকসজ্জাকে ছাপিয়েও একটা নৈশ অন্ধকার সমাসীন বলে যা বস্তুত দেখা যায় না, কিন্তু জেলেনৌকার মৃদুআলোয় বোঝা যায় যে কথকের চোখজোড়া ভিজে উঠছে কবিতার সাথে সম্পর্কের টানাপড়েনে। অন্তত আমার অনুভবে ব্যাপারটি এরকমভাবেই ধরা দেয়। মৃদু অথচ বৃহদায়তন এ বিষাদ আমাকে ছুঁয়ে যায়, কেননা এরকম সংশয় আমার ঝোলায়ও আছে যে, কবিতা আমাকে বুঝতে পারছে কি না বা আমি কবিতাকে। এ বিবেচনায় আমি ভাবি যে, কবিতাকর্মী মাত্রকেই হয়ত কবিতাটি স্পর্শ করবে।

কালের ভারে কাবু শীর্ণতোয়া নদীর পাঁচমিশালী ক্যাজুয়াল গতিভঙ্গির মতো এ কবিতাটিরও কোথাও কোনো দ্রুততা নেই, এখানেও এসে মিশেছে অনেকস্রোত: জলদূষণ কারণে মাছের শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে কবিতা উসকে দেয়া খেয়ালী বালিকা, উঠতি শহরের অকার্যকর ও অপ্রতুল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, কারখানা শ্রমিকের দলবদ্ধ স্নান এবং সবিশেষ কবিতাদাম্পত্যের সাফল্যব্যর্থতা। পরিপার্শ্বকে দেখার বিরল দক্ষতা এবং সেসবকে রঙঢংতাৎপর্যসমেত মূর্ত করে তুলবার যে স্ফূর্তিময় সাফল্য কবি কবিতাটিতে দেখিয়েছেন, তা অনবদ্য। কবিতাটিতে একটি বাড়তি পাওনাও জুটে গেছে উপজাত হয়ে। সেটি এর পরিবেশ চিন্তন। ফলত এটি একটি পরিবেশবান্ধব কবিতারও উদাহরণ হয়ে গেছে।

সুমন রহমান এই কবিতায় কবিতাশিল্পের ক্লিশে অলংকার উপমা ব্যবহারে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। ধরা যাক, শুরুর দিকের ধীরে চলা নীরব নদীর বর্ণনার ব্যাপারটা। কেমন নীরব ও শ্লথ ওই চলন? কবি বলছেন, ‘যেন কারো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাচ্ছে মধ্যরাতের নদী’। কিংবা তৃতীয় অনুচ্ছেদে বর্ণিত ইউরিয়া ফ্যাক্টরির বর্জ্য-জঞ্জালে কাতর ইলিশের পরিণতি বর্ণনা: ‘তবু গুনগুনিয়ে যাচ্ছে নদী, যেন ওর গানের ভেতর ইলিশের/ বোকা-বোকা শ্বাসকষ্ট আছে। সহজ মরণ আছে।’ কিংবা শেষাংশে নিজেদের কবিতাপ্রয়াসকে ছোট শহরের অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সাথে করা তুলনাটা: ‘যেন আমার সম্ভাব্য কবিতা/ঐ উঠতি শহরের পয়ঃনিষ্কাশনের মতোই/একপেশে একটি বধির ব্যবস্থামাত্র!’

আমি কবিতাটির শব্দ নির্বাচন ও সজ্জার শৈল্পিক কারিগরিতে বিশেষভাবে মুগ্ধ। মুগ্ধ এর কেন্দ্রকে পরিপাটি রেখেও পরিপার্শ্বকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারার বিরল ক্ষমতাদৃষ্টে। সুমন রহমানের এ ভ্রমণ কাজেই যুক্ত হয়ে যায় আমার প্রিয় তালিকায়।


কোন মন্তব্য নেই: