রবিবার, ২৪ আগস্ট, ২০০৮

সাবঅল্টার্ন প্রণোদনা


কথা হৈতেছিল কিছু সাম্প্রতিক গল্পপাঠের অভিজ্ঞতা সামনে রাইখা। ‘সাবঅল্টার্ন’ নামে একটা মনোভাবের কথাও হৈতেছিল। মানিক বন্দোপাধ্যায় বা তারাশংকরকে সামনে রাখা হয় নাই। তবে সাবঅল্টার্ন মনোভাবের বার্তা লৈয়া উনাদের সামনে একদিন খাড়াইতে হৈতই। আবীর সেই সুযোগ কৈরা দিলেন।

একটা ভূমিকা দেই। কয়দিন আগে একটা লেখা পড়লাম। নাম “অন্ধত্ব : সাহিত্য কি আমাদের বিপক্ষে” এই লেখার লেখক কেনেথ জার্নিগান নিজে জন্মান্ধ। তিনি আমেরিকার ন্যাশনাল ফেডারেশন ফর দ্য ব্লাইন্ড-এর পরিচালক। এই অন্ধ লেখক তার ইংরেজি ও ফরাসী সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা থিকা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাইছেন যে, অন্ধত্ব নিয়া এ যাবত যত সাহিত্য হৈছে, এর প্রায় সব-ই অন্ধত্বের মূল জায়গাটারে ধরতে পারে নাই। ভুল ব্যাখ্যা করছে। এমন কি কবি জন মিল্টনও, যিনি নিজেও অন্ধ হৈয়া গেছিলেন!


এইখানে, কেনেথ নিজে অন্ধ এবং সাহিত্য-পাঠক হওয়ায় আমাদের পক্ষে অন্ধত্ব নিয়া সাহিত্যের প্রকৃত কৃতিত্ব সম্পর্কে জানা সম্ভব হৈল। এখন মানিক তার ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ তে কতটুকু ‘জাস্টিস’ করছেন, সেইটার সাক্ষ্য দিতে পারত পদ্মা নদীর মাঝিরাই। কিন্তু উনারা কেউ মানিকের উপন্যাস পড়েন নাই। বা পড়লেও সেইটা নিয়া কথাবার্তা বলেন নাই। আর আমরা যারা নানান কৌশলবিচারে একটা উপন্যাসের উৎকর্ষ বিচার করি, তাদের থিকা মানিক পদ্মা নদীর মাঝিমাল্লার জীবন হয়তো বেশিই দেখছেন। ফলে, তিনি তার অভিজ্ঞতা এবং তার দেখা জনগোষ্ঠীর ওপর তিনি কতখানি ‘ন্যায়পরায়ণ ব্যবহার’ করেছেন, সেইটা যাচাইয়ের মতা শ্রেণীগতভাবে আমাদের নাই।

কিন্তু যখন মালোপাড়ার ছেলে অদ্বৈত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ লেখেন, তখন আমরা কিন্তু ‘আহরিত’ অভিজ্ঞতার ফাঁকফোকড়গুলো ধরতে পারি। তবে মানিক বা তারাশংকর নিশ্চয়ই তিনদিনের আর্থসামাজিক সমীক্ষা কৈরা আইসা গল্প লেখতে বসেন নাই। কিন্তু তারপরও মানিকের পক্ষে অদ্বৈতমল্ল বর্মনের জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। মানিকের পদ্মা নদীর মাঝি শক্তিশালী উপন্যাস, কিন্তু তিতাসের মূল শক্তি তার সাবঅল্টার্নিটি। সেইটা আমরা বুঝি, যখন আমরা এই দুই উপন্যাসেরে পাশাপাশি রাইখা পড়ি। সবক্ষেত্রে তো এইরকম সুযোগ হয় না।

মানিক বা তারাশংকর উঁচুমাপের লেখক। তারা (বিশেষ কৈরা তারাশংকর) অন্য শ্রেণীর জীবন বর্ণনায় প্রায় কখনই এলিটিস্ট হন নাই। কিন্তু তারা (বিশেষ কৈরা মানিক) খুব সাবঅল্টার্ন-ও নন। তারাশংকরের বিষয়টা আমার কাছে একটু ভিন্ন লাগে। তিনি যখন ‘গণদেবতা’ বা ‘পঞ্চগ্রাম’ লেখেন, তখন এসব উপন্যাসের কেন্দ্রে তিনি যে চরিত্রটাকে রাখেন সেইটা কিন্তু একটা শিক্ষিত নিম্নমধ্যবিত্ত চরিত্র। এই স্পেসটা থাকায় তারাশংকর ঐ চরিত্রটির মধ্য দিয়া নিজের উপন্যাসে সশরীরে উপস্থিত থাকার সুযোগ পান। বা স্পেসটা তৈয়ার কৈরা রাখেন। এইটা কিন্তু সাবঅল্টার্ন প্রণোদনা।

আমি মনে করি একজন লেখক যে কোনো শ্রেণীর কথাই লিখতে পারেন। কিন্তু তিনি যেই শ্রেণীতে অবস্থান করেন না, সেই শ্রেণীর কথা জানার একটা জ্ঞানতত্ত্বীয় সীমাবদ্ধতা তো তার আছেই। সেইটাকে ডিঙায়া যাওয়া হয়ত সম্ভব না, তবে বিপুল অধ্যবসায় থাকলে হয়ত একটু সুবাস অন্তত পাওয়া সম্ভব। মানিকের বা তারাশংকরের সেই অধ্যবসায় ছিল। অনেকেরই আছে বা ছিল। আবার অনেকেরই নাই বা ছিল না।

সাবঅল্টার্ন সাহিত্য সেই অধ্যবসায় নিয়া আগায় না। আমি যখন লিখি, আমি আমার চারপাশ এবং সেই প্রেক্ষাপটে আমার অবস্থান লৈয়াই লিখি। সাবঅল্টার্ন মনোভাবের গল্প যিনি বলেন, তার পজিশন কখনই উপরে বা নিচে হয় না, তিনি বিষয়ের দিকে সোজাসুজি তাকাইতে পারেন। আর যাদের এইটা থাকে না, তারা সেই বিষয়ের অনুপস্থিতি ঢাকতে ক্যানভাসের ওপর মহত্ত্ব ঢালেন, যাতে বিমূঢ় পাঠক চুপ মাইরা যান। এইটা ছিল আমার সাম্প্রতিক গল্প পাঠের অনুভূতি।

সাবঅল্টার্ন মনোভাব লয়া আরো আলোচনা হৈতেই পারে।


৩০ জুলাই ২০০৫


1 টি মন্তব্য:

নামহীন বলেছেন...

আলোচনা চালাইয়া যান, কান পেতে আছি।