মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০০৮

সাহিত্য কি আমাদের বিপক্ষে? : অন্ধত্ব ও সাহিত্য নিয়ে কেনেথ জার্নিগান-এর রচনা



সাহিত্যের উপাদান হিসেবে অন্ধত্বকে খোদ অন্ধরা কিভাবে মূল্যায়ন করে? আমেরিকার ন্যাশনাল ফেডারেশন অব দ্য ব্লাইন্ড এর ড. কেনেথ জার্নিগান-এর এই লেখাটি সাহিত্যের সেই চেহারা তুলে ধরেছে যেখানে চক্ষুষ্মান সাহিত্যিকগণ চক্ষুহীন মানুষকে সাহিত্যের উপাদান করতে গিয়ে তাদের স্বাভাবিক জগতের বাইরে ছুঁড়ে দিয়েছেন। এমন কি জন মিল্টনের মত খ্যাতিমান অন্ধ সাহিত্যিকেরাও, কেনেথ বলছেন, এইসব জনপ্রিয় ধারণার ফাঁদে পড়ে গিয়ে অন্ধত্ব নিয়ে দৃষ্টিবান মানুষ যা ভাবতে পছন্দ করে তারই প্রতিধ্বনি করেছেন।

কেনেথ-এর মতে, অতীতকালের সাহিত্য যেখানে অন্ধত্ব বিষয় হিসেবে এসেছে তা মোটেও অন্ধদের বাস্তবতাকে সমর্থন করে না, ফলত অন্ধদের জীবনে সেসব মোটেও কোনো উৎসাহ জোগায় না। বর্তমানের সাহিত্যে বেশ কিছু ইতিবাচক মোড়বদলের কথা তিনি বলেছেন, যদিও রেফারেন্স দেন নি। অবশ্য কেনেথ-এর বক্তব্য তৈরি হয়েছে প্রধানত তার চিরায়ত ইংরেজি ও ফরাসী সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা থেকে। আর সাহিত্যের কাছে তার প্রত্যাশার ধরনটিও বিতর্কের বিষয় হতে পারে।

["দেখা না-দেখার চোখ" এ এই অনুবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল]



ইতিহাস যেমন মানুষের কৃতকর্মের সন্নিবেশ তেমনি সাহিত্য হল তার চিন্তার সমাবেশ। আমি এখন বলতে চেষ্টা করব সাহিত্যে অন্ধদের উপস্থাপনার ধরন নিয়ে। কীভাবে দেখা হয়েছে আমাদের সেখানে? আমাদের ভূমিকা কী? কবি, উপন্যাসিক, প্রবন্ধকার ও নাট্যকারগণ কী ভেবেছেন আমাদের নিয়ে? অন্ধত্ব জিনিসটা আসলে যেরকম তারা কি সেইরকমই দেখেছেন, নাকি তারা যেরকম দেখতে চেয়েছেন, অন্ধত্বকে সেইরকম করেই তুলে ধরেছেন?

সাহিত্যে অন্ধজীবন নিয়ে কোনো একক বা একটি সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি নেই। বরং দেখা যায় সাহিত্য অনেকগুলো বিচিত্র এবং পরস্পরবিরোধী অন্ধত্বের ইমেজ হাজির করছে, সেটি শুধু যুগ বা সংস্কৃতিভেদে নয়, শুধু লেখকভেদে নয়, এমন কি একই বইয়ের বিভিন্ন পৃষ্ঠায়ও এই বৈপরীত্য বিদ্যমান।


বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাহিত্যে অন্ধত্বের বিষয়টি মোটামুটি নয় ধরনের বিষয়াশ্রিত হয়ে এসেছে: অলৌকিক ক্ষমতারূপে, নিরুদ্ধার ট্রাজেডী হিসেবে, নির্বুদ্ধিতা ও অসহায়ত্বের পূর্বগামী হয়ে, ধূর্ততা আর শয়তানি সহযোগে, নিখাদ পূণ্যের সহগামী হিসেবে, পাপের শাস্তিরূপে, অস্বাভাবিকতা এবং বিমানবিকীকরণের সূত্রপাত হিসেবে, শুদ্ধতার প্রতীকরূপে, অন্য কিছুর প্রতীক বা রূপক হিসেবে।

অলৌকিক বা আল্লাপ্রদত্ত ক্ষমতা হিসেবে অন্ধত্ব সাহিত্যে কিভাবে চিত্রিত? ধরা যাক আপনাদের কেউ আমায় জিজ্ঞেস করলেন, অন্ধ হওয়ার কি কি সুবিধা আছে বলে আমি মনে করি? এবং ধরা যাক আমি উত্তর দিলাম: কোনোই সুবিধা নেই, তবে এমন কিছু দিক আছে যা হয়ত আমরা ভেবে দেখি না। আবিষ্কারের জন্য একটা নতুন জগত, নতুন এবং অভিনব প্রত্যণ, নতুন জেগে উঠা মতা; অন্ধ জীবন চতুর্থ মাত্রার জীবন। এরকম শুনলে একজন অন্ধ হিসেবে আপনি কী বলবেন? অনুমান করি, হাসতে হাসতে বিষম খাবেন। আমার মনে হয় না এইসব বস্তাপচা বোকাভাষণ কাউকে আকৃষ্ট করবে। আপনারা এবং আমি নিজের মুখে ঝাল খাওয়া অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, অন্ধত্বের কোনো চতুর্থ মাত্রা নেই, অন্ধ হলে কোনো অলৌকিক ক্ষমতা জাগ্রত হয় না, কোনো অদ্ভূত অনুভূতি হয় না, উন্মোচিত হবার জন্য নতুন কোনো জগত এসে হাজির হয় না। কিন্তু আমি যে উদ্ধৃতি দিয়েছি সেটি কিছুকাল আগের এক জনপ্রিয় উপন্যাস থেকে নেয়া।

অলৌকিক বা প্রকৃতিপ্রদত্ত মতার সাথে অন্ধত্বের এই যে মেলবন্ধন, এটি সাহিত্যে একটি সর্বজনমান্য ঐতিহ্য, চিরায়ত পূরাণকাহিনীগুলোতেও এর শেকড় আছে। প্রাচীন গ্রিসের দেবতাদের মধ্যে মানুষকে শাস্তি দেয়ার একটা পছন্দনীয় প্রথা ছিল অন্ধ করে দেয়া। একে সাধারণভাবে মৃত্যুর চেয়েও খারাপ মনে করা হলেও, কখনো কখনো, দেবতার কৃপায় সেই অন্ধ হয়ে যাওয়া শাস্তিগ্রহীতা ব্যতিক্রমী কিছু ক্ষতিপূরণও পেয়ে যেতেন: যেমন ভবিষ্যকথন ক্ষমতা। মনে করা হয়, হোমার তার অন্ধত্বের ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেয়েছেন কবিত্বশক্তি। একইভাবে, সফোকিসের নাটকে যে টাইরেসিয়াসকে পাওয়া যায়, অন্ধ হবার বদলে নবুয়তপ্রাপ্তি ঘটেছিল তার।

উনবিংশ শতাব্দীর মহান উপন্যাসিক ভিক্টর হুগো’র ‘দ্য ম্যান হু লাফস’ উপন্যাসে অন্ধত্ব নিয়ে আধুনিক লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গি মেলে। সেখানে অন্ধত্ব শুদ্ধতা ও আনন্দের সহযোগী হয়েছে, যা কোনোভাবে দৃষ্টিহীনতাকে পুষিয়ে দিচ্ছে। তার উপন্যাসের অন্ধ নায়িকা দিয়াকে দেখা যায় এক পরমানন্দে বিভোর হয়ে থাকতে, যেটা অন্ধের পক্ষে বেমানান ঠেকে। এই পরমানন্দ কখনো কখনো আত্মার গহীনে অনুধাবনের জন্য অন্ধদের এক সঙ্গীত উপহার দেয় এবং তার মাধ্যমে তাদের অন্ধকার জীবনকে আলোকিত করে তোলে। হুগো’র মতে অন্ধত্ব হল সেই অন্তহীন গুহা যার মধ্যে অসীমের ঐকতান ধরা দেয়।

সম্ভবত, জনপ্রিয় কল্পকাহিনীর অন্ধ গোয়েন্দাদের কীর্তিকলাপের মাধ্যমেই অন্ধত্বের সাথে ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের যোগাযোগ পরিস্ফুট হয়। ম্যাক্স ক্যারেডস নামের ফোর্থ ডাইমেনশনাল চরিত্রটি আবির্ভূত হয়েছিল ১৯১৪ সালে এবং গোটা বিশের দশক ধরে নানান অতিমানবীয় ঘটনার নায়ক হয়ে থেকেছে সে। ১৯১৫ সালে আমরা পাই ডেমন গন্ট নামক আরেকজন অন্ধ গোয়েন্দাকে, যিনি একটা কেসও হারেন নি। এই তালিকায় থর্নলে কল্টন, ডানকান ম্যাক্সেইনসহ আরো অনেক চরিত্রের নাম যোগ করা যায়। যেমন হয়েছে গোয়েন্দা ডানকানের চরিত্রের বেলায়। এখানে ডানকানের নৈপুণ্যের ছটায় তার স্রষ্টাই ঢাকা পড়ে গেছেন। তবু এমন কিছু মুহূর্ত আসে, ডানকানের স্রষ্টা লিখেছেন, যখন সাধারণ মরণশীল মানুষের ক্ষমতার অতিরিক্ত কিছু মতা ডানকানের অধিগত হতে দেখা যায়। এসব মুহূর্ত তাকে উদ্বিগ্ন করে।

তারা সেইসঙ্গে আমাদেরও উদ্বিগ্ন করেন। অন্ধত্বের সাথে এসব অস্বাভাবিক এবং অতিমানবিক ক্ষমতারোপ নিঃসঙ্গ ও আলাদা, অসহজ এবং উদ্ভট একটি বস্তাপচা চরিত্রের আদলে ভাবা থেকে অন্ধকে একটুও রেহাই দেয় না। বরং পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটায়।

এটি শুধু অসত্যই নয়, অন্ধদের জন্য নেতিবাচকও। কারণ এতে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, কোনো অন্ধ মানুষ যা অর্জন করল তা নিজের যোগ্যতায় নয়, বরং অন্ধত্বে নিহিত কোনো ম্যাজিকের বদৌলতে। অন্ধত্বের ওপর এহেন অতিমানবীয় ক্ষমতারোপ এক লহমায় সাধারণ বাস্তবতা থেকে উঠিয়ে নিয়ে অন্ধকে দাঁড় করায় অস্বাভাবিকতার উদ্ভট এক মঞ্চের ওপর। অথচ অতিমানবীয় বা অস্বাভাবিক যাই হোক, এটিই ধ্রুবসত্য যে, অন্ধের কোন দায় নেই, অধিকার নেই, সমাজ নেই এই পৃথিবীতে।

কৃতকর্মের পুরষ্কার হিসেবে প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতা অর্জনের ধারণা অন্ধের জন্য কোনোভাবেই প্রশংসাসূচক নয়, বরং অপমানকর। এই ধারণা আমাদের যাবতীয় অর্জনকে ছিনিয়ে নেয়, এমন কি আমাদের ব্যর্থতার দায়ও আমাদের বহন করতে দেয় না। এই ধারণা অন্ধের জন্য একটা সুষম সমাজ গঠনের দায় থেকে বিদ্যমান সমাজকে মুক্তি দিয়ে দেয়। চারপাশের জীবনে উদ্দাম ও সমান অংশগ্রহণের সামর্থ অর্জনে আমাদের মোটেও উদ্দীপ্ত করে না। সংক্ষেপে এই ধারণা অনুযায়ী, অন্ধ অসাধারণ হতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই সাধারণ হতে পারে না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমরা অতি সাধারণ অন্ধলোক, আশির্বাদপুষ্টও নই, অভিশপ্তও নই।

অন্ধত্বের ওপর প্রকৃতিদত্ত মতারোপের ধারণা নেতিবাচক হলেও অনেক কম ক্ষতিকর, সাহিত্যে অন্ধত্বের সাথে এর চেয়েও ক্ষতিকর অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে। সবচেয়ে তিকর ধারণাটি আবার সবচেয়ে প্রাচীনও: সেটি হল অন্ধত্বকে একটি সম্পূর্ণ ট্রাজেডী হিসেবে দেখা। একটি হিব্রু প্রবাদ আছে, অন্ধলোক হল মৃত মানুষের মত। অন্ধকে জীবন্মৃত করে উপস্থাপনের চরম নিদর্শন পাওয়া যায় ইদিপাসকে নিয়ে লেখা গ্রিক নাটকগুলোতে। ইদিপাস রেক্সে রাজা নিজেই যখন নিজের চোখ তুলে ফেললেন তখন নাট্যকার বলছেন: অন্ধ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই ভাল ছিল। এই ঐতিহ্যের বিস্তার ঘটে ইংরেজি সাহিত্যেও। সেখানে একজন কবি, নিজেও যিনি অন্ধ, অন্ধত্বকে মহাদুর্যোগ আখ্যা দিয়ে শেষকথা বলছেন। স্যামসন অ্যাগনেষ্টিজ-এ জন মিল্টন:
শত্রুবেষ্টিত অন্ধের চেয়ে অনেক ভাল ছিল বন্দী হওয়া, পাতালে নিক্ষিপ্ত হওয়া, ভিক্ষা করা, বা ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া। তুচ্ছাতিতুচ্ছ পতঙ্গজীবনও আমার চেয়ে ভাল। তারা হামাগুড়ি দিয়ে চলে, তবুও তো দেখতে পায়। আমি, আলোর মধ্যে অন্ধকার, প্রতিদিনের প্রতারণা, প্ররোচনা, ঠগবাজি বা ভুলভালের কাছে প্রতিদিন ধরা খাই। দরজা খোলা থাকা না থাকা আমার জন্যে সমান, সেটা অন্যের বিষয়, আমার নয়। অর্ধেকের কম আমি জীবিত, অর্ধেকের বেশি আমি মৃত, একটা চলমান কবর।

এই মহাকাব্যিক কবিতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় এর মহাদুর্যোগ পরিস্থিতি নয়, উল্লেখযোগ্য হল আমাদের মহাকবি মিল্টন এর রচয়িতা। তার সব মহৎ রচনা (প্যারাডাইজ লস্ট সহ) লিখিত হয়েছে তিনি অন্ধ হয়ে যাবার পরে। তাহলে তিনি কেন অন্ধত্বকে এমনভাবে দেখতে গেলেন? উত্তরটা সহজ: আমরা অন্ধরা নিজেদের অবস্থাকে সেভাবে দেখতে চেষ্টা করি, যেভাবে চক্ষুষ্মান মানুষ আমাদের দেখতে চায়। এমন কি, যখন আমরা বুঝি ঐ দৃষ্টিভঙ্গি একদম ভুল, তারপরও সেই মতামতটিকেই আমরা নিজেদের ওপর চাপাতে দিই বা চাপিয়ে নিই। এভাবে অনেক সীমিত ও খণ্ডিত অনুধাবন আমাদেরই সহায়তায় আমাদের বাস্তবতা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে থাকে। সাহিত্যের গতানুগতিক ঐতিহ্য দ্বারা চালিত হয়ে মিল্টন নিজের এবং তাবৎ অন্ধদের জন্য একটি ভুল দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দিলেন। সত্যি বলতে কি, মিল্টন বরং অন্ধত্ব নিয়ে সাবেকী বস্তাপচা মতামতগুলোর পালেই হাওয়া দিলেন, এবং সেটি তিনি করলেন তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিপক্ষে গিয়ে। সাহিত্যের ক্ষমতা সত্যিই অনেক!

এক শতাব্দী পর অন্ধত্বের দুর্যোগের ধারণাটি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠে। কিপলিং-এর ‘দ্য লাইট দ্যাট ফেইলড’ পুস্তকে বলা হয়, অন্ধত্ব মৃত্যুর চেয়েও খারাপ। এই বইয়ের নায়ক যখন জানতে পারে যে, সে অন্ধ হতে চলেছে, তখন বলে: এটা হল চলমান মৃত্যু। অন্ধকারে আমাদের নিশ্চুপ হয়ে থাকতে হবে এবং আমরা কাউকেই দেখব না, যা চাই তা কোনোদিনই পাব না, শতবছরও যদি বাঁচি। পুস্তকটির পরবর্তী অংশে নায়ককে দেখা যায় সমগ্র পৃথিবীর বিরূদ্ধে আক্রোশে ফেটে পড়তে, যেহেতু সেই পৃথিবী দেখতে পায়, যেখানে সেই নায়ক অন্ধের মৃত্যুর মাঝে মৃত হয়ে আছে, সহযোগীদের কাঁধে দুর্বহ বোঝা হয়ে। যখন এই আত্ম-অনুকম্পায় ভরা চরিত্রটি আত্মহত্যা করতে সমর্থ হয় (কী যে স্বস্তির খবর!) কিপলিং বলে ওঠেন যে, এই অন্ধ নায়কের ভাগ্য শেষপর্যন্ত ওর সাথে প্রতারণা করে নাই, কারণ সে একটা দয়ালূ বুলেট অন্তত নিজের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে।

‘দ্য এন্ড অব দ্য টিদার’ উপন্যাসে জোসেফ কনরাড তার চরিত্র ক্যাপ্টেন হুয়েলীকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করেন, কারণ সেটি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে অনেক ভাল। ডি এইচ লরেন্সের উপন্যাস ‘দ্য ব্লাইন্ডম্যান’ এ মরিস যুদ্ধে অন্ধ হয়ে যায়, ভবিষ্যতের কোন সোনালি ইঙ্গিতই তার দুর্দশা লাঘব করে না। ‘ইনভাইটেশন টু দ্য ওয়াল্টজ’ উপন্যাসে লেখক রোজামন্ড লেম্যান আরো এককাঠি সরেস। তার উপন্যাসের যুদ্ধে-অন্ধ-হওয়া চরিত্রটি সমাজে সম্মানজনক জীবন যাপন করলেও, কোনো কাজে লাগে না, যেন একটা চলতে ফিরতে থাকা লাশ। যখন সে তার প্রাক্তন প্রেমিকার সাথে নাচে তখন পরিস্থিতি খুব বেদনাদায়ক হয়ে উঠে। অন্ধলোকটি তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে নিবিড় করে ধরে রাখলেও প্রকৃত প্রস্তাবে সে তখন অনেক দূরে, সঙ্গীত থেকে, জীবন থেকে, সমাহিত এবং পছন্দশূন্য। আর প্রেমিকা আসলে ঐ অন্ধলোকটির চক্ষুষ্মান যুবক বয়স আর বর্তমানের মৃত্যুর সাথে নাচে।

এই লেখকেরা মনে করেন, অন্ধত্বের তথাকথিত ট্রাজেডী এতটাই দুর্বহ যে, খোলা আছে দুইটি রাস্তা: হয় চোখ ফিরে পাওয়া, নয় মরে যাওয়া।

দেখা যাক অন্ধত্বের সাথে নির্বুদ্ধিতা আর অসহায়ত্বের প্রসঙ্গকে কিভাবে মেলানো হয়েছে। প্রাচীন কাল থেকেই অন্ধরা রগড় নাটক ও প্রহসনে উপহাসের বিষয় হয়ে থেকেছে। প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন রগড় নাটক ও প্রহসনে অন্ধরা উপহাসের বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে। মধ্যযুগে দেখা যেত অন্ধরা গাধার কান লাগিয়ে পথে পথে ঘুরছে, হাতপা নেড়ে উল্টাসিধা কথা বলে জনগণের মনোরঞ্জন করছে। এই ধারাবাহিকতায় চসার তার ‘মারচেন্টস টেল’এ এক তরুণী বধুর কথা বলেন যে এক অন্ধ বুড়োকে বিয়ে করে। স্বামীর সঙ্গে বাইরে ঘুরতে গিয়ে ঐ বধু তার গোপন প্রেমিকের সঙ্গে গাছের আড়ালে অভিসার করে অন্ধ স্বামীর সামনে। চসার সেখানেই থামেন না, বলতে থাকেন, সেই মোম সময়ে ঐ তরুণীর স্বামী হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায় এবং স্ত্রীকে গোপন প্রেমিকের সাথে অভিসাররত দেখতে পায়। কিন্তু চালাক স্ত্রী সাথেসাথেই অজুহাত খাড়া করায়: ঐ অভিসার আসলে ছিল স্বামীর দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশায়! শেক্সপিয়ারে অবস্থা আরো খারাপ। ‘কিং লিয়র’এ তিনি যে অন্ধ গ্লকেস্টারকে উপস্থাপন করেন, সে এতটাই অসহায় আর দ্বিধাগ্রস্থ যে, যেকোন কিছু দিয়েই তাকে ভজানো যায়, প্রতারিত হবার জন্য একেবারে আদর্শ চরিত্র।

অন্ধদের নিয়ে মজা করার রূঢ়তম দৃষ্টান্তটি পাওয়া যায় ষোড়শ শতাব্দীর এক জার্মান নাটকে। নাটকের নায়ক তিনজন অন্ধ ভিক্ষুককে একটা মূল্যবান মুদ্রা ভিক্ষা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন যেটা দিয়ে তারা খাদ্যসামগ্রী ও থাকার ব্যবস্থা করতে পারে। সেই মুদ্রা আসলে কাউকেই দেয়া হয়নি, আর তিনজন অন্ধের প্রত্যেকেই মনে করল অন্যজনকে মুদ্রাটি দেয়া হয়েছে। পরের অবস্থাটি সহজেই অনুমেয়।

অসহায় অন্ধলোক একটি সার্বজনীন ধারণা হয়ে উঠেছে। মেটারলিংক-এর ‘দ্য ব্লাইন্ড’ নাটকে দার্শনিক অবস্থান থেকে সবগুলো চরিত্রকে অন্ধ দেখানো হয়েছে। কিন্তু মঞ্চে গিয়ে দেখা গেল দর্শন নয়, বরং অন্ধদের হাস্যকর দলবাজি, হুমকিধামকিই ঐ নাটকের সার।

‘লা সিম্ফনি প্যাস্টোরাল’ এর আঁন্দ্রে জিদ হলেন অন্ধত্বের প্রকৃত সত্যের সবচেয়ে খারাপ বিরূদ্ধবাদীদের একজন। সেখানে অন্ধ কিশোরী গারট্রুড একেবারে নির্বোধ কিসিমের ছিল, প্যাস্টর এসে ওকে লেখাপড়া শিখাতে শুরু করার আগে। অন্ধত্বের কারণেই এই নির্বুদ্ধিতা, লেখক বলেন, দৃষ্টি না থাকায় কিশোরীটি সত্য সম্পর্কে জানতে পারে না। শিক প্যাস্টর তার ছাত্রী গারট্রুড-এর জন্য যে জগত তৈরি করে, সেখানেই অন্ধ গারট্রুড সুখেস্বাচ্ছন্দ্যে কাটায়। সত্যিকার জগতের খারাপ দিক সম্পর্কে কিশোরীটি কিছুই জানতে পারে না। দৃষ্টি না থাকায় সে পাপ সম্পর্কেও সচেতন নয়, আপেল খাওয়ার আগের আদম-ঈভের মত। গারট্রুড যখন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল, তখনই কেবল সে পাপ সম্পর্কে অবগত হল। না বুঝে প্যাস্টরের সাথে যেসব পাপকাজ সে করেছে, সেগুলোর অপরাধবোধ তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে।

সাহিত্যে অন্ধত্ব যেমন নির্বুদ্ধিতার অনুষঙ্গ হয়ে এসেছে, তেমনি এসেছে ধূর্ততার অনুষঙ্গ হয়েও: একেবারে খাঁটি শয়তানির মূর্ত মানবীয় রূপ হয়ে। স্টিভেনসনের ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’ এর বুড়ো জলদস্যু অন্ধ পিউ এর জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। উপন্যাসের নায়ক কিশোর জিম হকিন্স অন্ধ পিউকে যখন প্রথম দেখে তখনই তার মনে হয়েছে এই মৃদুভাষী এবং চোখহীন মানুষটির চেয়ে ভয়াবহ কোন চরিত্র সে জীবনেও দেখে নাই। যখন পিউ তাকে ক্রাচ বাগিয়ে ধরে ফেলে, জিমের মনে হয়েছে, এই অন্ধ লোকটির কণ্ঠের চেয়ে নিষ্ঠুর, ঠাণ্ডা আর কুৎসিত কণ্ঠও সে কোনোদিন শোনে নাই।

বহুযুগ ধরেই অন্ধত্ব ও নিচুতার সম্পর্ক সাহিত্যিকদের একটা প্রিয় প্রসঙ্গ, এবং পাঠকদের মধ্যেও এই সম্পর্কের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে, যেহেতু পাঠকেরা নানা লোককাহিনী থেকে শিক্ষা পেয়েছে যে, অন্ধত্ব মানবিক গুণাবলী হ্রাস করে। এই শিক্ষা অন্ধ বিষয়ে চক্ষুষ্মান সাধারণ মানুষের নিষ্ঠুরতার অ্যাটিচুডকে সমর্থন করে।

নিখাদ শয়তানির অনুষঙ্গে অন্ধত্বকে যেমন দেখা হয়েছে, এর বিপরীতে কোনো কোনো সাহিত্যে আবার অন্ধত্ব উপস্থাপিত হয়েছে পরম পূণ্যরূপে। আপাতভাবে এই দুটো দৃষ্টিভঙ্গিকে পরস্পরবিরোধী মনে হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে তারা একই মুদ্রার এপিঠওপিঠ। অন্ধত্বের প্রকৃত বাস্তবতা তুলে ধরার মত জোরালো অন্তর্দৃষ্টি কোনটিতেই পাওয়া যায় না। একটা বিষয়ে এই দুই দলই একমত: অন্ধত্ব হচ্ছে একটা অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা যা তার বহনকারীকে স্বাভাবিক জীবন থেকে পুরোপুরি উৎপাটিত করে।

অন্ধত্বকে হয় পাপ বা শয়তানির ফসল হতে হবে, নয় তাকে হতে হবে পূণ্যের অনুষঙ্গ। লরা রিচার্ডস এর ‘দ্য ব্লাইন্ড চাইল্ড’এ দেখা যায় অন্ধ শিশুটি গাছের বাকলে হাত রেখে বলে দিচ্ছে গাছের নাম, বলে দিচ্ছে কখন ফুল আসবে এবং কিভাবে। গ্রামে এমন কোনো কুকুর বিড়াল নেই যে ঐ শিশুর একটি ডাকে প্রভুর নাম ভুলে ছুটে আসবে না। সে শুধু পূণ্যবতীই নয়, পাশাপাশি যাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী। অগ্নিকাণ্ড থেকে এক শিশুকে রা করে, গান গেয়ে মানুষকে রোগমুক্ত করে, পাঁড় মদ্যপের মদের নেশা ছাড়িয়ে দেয়।

অন্ধত্ব নিয়ে যাবতীয় রোমান্টিক হেঁয়ালিপনার মধ্যে সবচেয়ে উদ্ভট হল, অন্ধত্বকে ছদ্মবেশী আশির্বাদ মনে করা। জন জি মরিসের ‘দ্য ব্লাইন্ড গার্ল অব উইটিনবার্গ’এ অন্ধ নায়িকাকে বলা হচ্ছে: ঈশ্বর তোমায় চোখের আলো থেকে বঞ্চিত করেছেন বলেই তোমার হৃদয় আরো মহান আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। আমার পরিচিতি এমন কোনো অন্ধ মেয়ে নেই যে এরকম অপমানসূচক এবং উদ্ভট বক্তব্য প্রদানকারীর গালে অন্তত একটি চড় না বসিয়ে ছেড়ে দেবে। তারপর এই অন্ধ নায়িকাকে দিয়ে প্রত্যুত্তরে যা বলানো হল তা আরো মারাত্মক: সে বলল, মহাত্মন আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন আমাদের অন্তর্জগত আপনাদের চেয়ে সুন্দর, এবং আপনাদের সূর্যের চেয়ে আমাদের অন্তরের আলো উজ্জ্বলতর?

কল্পকাহিনীতে আরেকটা সুপ্রাচীন এবং অন্যতম নিষ্ঠুর ধারণা হল, অন্ধত্ব হচ্ছে পাপের ফল। ঈদিপাস অন্ধ হন মাতৃসহবাসের কারণে, বেলেল্লাপনার কারণে চোখ হারান শেক্সপিয়ারের গ্লুকেস্টার। এর অব্যবহিত পরের ঘটনা হল, অন্ধত্ব শুদ্ধতা অর্জনের একটা স্তর, যে স্তরে কোনো মানবীয় চরিত্র আগের পাপতাপ ঝেড়ে পূণ্যবান হয়ে উঠতে পারে। যেমন দেখা যায় কিংসলের ‘ওয়েস্টওয়ার্ড হো’ এ অ্যামেয়াস লেই বজ্রপাতে অন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাতারাতি অপরাধী থেকে সাধুতে পরিণত হয়।

এ সমস্ত বিখ্যাত কল্পকাহিনীর মধ্যে অন্ধত্বকে মানবিকতা-বহির্ভূত কিছু একটা দাঁড় করানোর একটা প্রবণতা থেকেই গেছে। অন্ধত্ব যেন স্বাভাবিক জীবন বা মানবিক সম্পর্ক থেকে নির্বাসনের দরজা। ডিকেন্সের বার্থাই হোক, বা লিটনের নিদিয়াই হোক, প্রেমে পড়ে তারা ভুলেও ভাবে না যে তাদের কাক্সিতজনেরা তাদের প্রেমে পড়বে।

সর্বশেষ যে প্রবণতাটি দেখা যায় তা হল, অন্ধত্বকে আক্ষরিক অর্থে না নিয়ে প্রতীকী অর্থে নেয়া, ব্যঙ্গ বা প্যারাবল তৈরির জন্যে। লোকসাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র সর্বত্রই এই প্রবণতাটি অন্ধত্বকে মৃত্যু বা নরকযন্ত্রণার প্রতীক হিসেবে দাঁড় করায়, অথবা শারীরিক অন্ধত্বের প্রতীকে মানসিক অন্ধত্বকে মূর্ত করে তোলে। এই ক্যাটাগরিতে পড়বে এইচ জি ওয়েলস-এর ‘দ্য কান্ট্রি অব দ্য ব্লাইন্ড’, পল কোরে’র ‘দ্য প্লানেট অব দ্য ব্লাইন্ড’, মেটারলিংক-এর ‘দ্য ব্লাইন্ড’ ইত্যাদি। এছাড়াও কনরাড আইকেন-এর ছোটগল্প ‘সাইলেন্ট স্নো, সিক্রেট স্নো’-এ অন্ধত্বকে স্কিজোফ্রেনিয়ার রূপক হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এ সমস্ত উপস্থাপনায় অন্ধত্বকে দেখানো হয়েছে অজ্ঞতা ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের প্রতীকরূপে, স্বাভাবিক ধারণা ও মূল্যবোধের উল্টো অবস্থার প্রতীকরূপে, এবং মৃত্যুর চেয়ে খারাপ বা মৃত্যুসমান অবস্থার প্রতীকরূপে।

সাহিত্যের এই সমীক্ষা থেকে কী শিক্ষা নিতে পারি আমরা? কী বলতে চেয়েছে সাহিত্য আদতে? একটা শিক্ষা এটি যে, এই সমস্ত সাহিত্যকর্মের বদৌলতে আমরা এমন একদল তথাকথিত বিশেষজ্ঞ খুঁজে পেয়েছি যারা এই সাহিত্যের জ্ঞান সম্বল করে অন্ধত্ব নিয়ে গবেষণা করে নানান অশ্বডিম্ব প্রসব করছেন। তাদের মতে, অন্ধত্ব কেবল নিছক দৃষ্টিহীনতা নয়, বরং একজন মানুষের সম্পূর্ণ রূপান্তর। কোনো মানুষের কাছে তার অন্ধত্ব নিছক চোখ হারানোর গল্প দিয়েই শেষ হয় না, আসলে সেটি মৃত্যুসমান, সত্তার ওপর এক বিশাল আঘাত। তারা বলেন, চোখ হল সেক্স সিম্বল, তাই অন্ধ মানুষ কখনই পূর্ণ মানুষ নয়।

শিরোনামের প্রশ্নে ফিরে যাই: সাহিত্য কি আমাদের বিপক্ষে? এই প্রশ্নের সর্বজনগ্রাহ্য কোনো জবাব নেই। শুধু অতীত আমলের সাহিত্য নিয়ে যদি আলাপ হয়, তাহলে প্রশ্নের জবাব হবে, হ্যাঁ। সমসাময়িক সাহিত্য নিয়ে আলাপ হলে মিশ্রজবাব হবে। অন্ধত্বের ধারণায় অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন সমসাময়িক সাহিত্যে পাওয়া যায়, যদিও বস্তাপচা সাবেকী ধারণাগুলোই এখন পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় এটা যে, সমসাময়িক কালে এই সব ধারণা উৎসাহ পাচ্ছে আমাদের তথাকথিত অন্ধ বিশেষজ্ঞদের উদ্ভট গবেষণা থেকেই।

ভবিষ্যতের দিকে যদি ঐ প্রশ্ন নিয়ে তাকাই, জবাব হবে, ভবিষ্যতের সাহিত্য বর্তমান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যেমন বর্তমানের জীবন পারে না ভবিষ্যতের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অন্ধ জীবনগুলোকে সাজিয়ে তোলার মাধ্যমে আমরাই ভবিষ্যতের সাহিত্যকে নির্দেশনা দিতে পারব। অন্ধত্ব একটা ট্রাজেডী ততক্ষণই, যতক্ষণ আমরা এই সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গিটিকে মান্য করি। আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ একটাই: আমাদের সময়কে অন্ধত্ব নিয়ে সচেতন ও সবিবেক হতে সাহায্য করা। কল্পকাহিনীর ফ্যান্টাসী থেকে মুক্ত হয়ে সেগুলোকে বাস্তবতার নির্যাস দিয়ে ভরে দিতে হবে। তখনই কেবল আমরা সেই সাহিত্যের জন্য রাস্তা তৈরি করতে পারব যা বাস্তবতার সুবাস ধারণ করবে, সত্যের অপলাপ হবে না, সাহিত্য পড়ে আমরা সেখানে নিজেদের খুঁজে পাব।


(ঈষৎ সংক্ষেপিত)


কোন মন্তব্য নেই: