বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০০৮

অভেদ ঘটায়া দেন

(১)


বাংলার ভাবান্দোলন নিয়া টুকরা-টাকরা কথাবার্তা হৈতেছিল কবিসভায়। ব্রাত্য রাইসু এক পর্যায়ে শ্রদ্ধেয় ফরহাদ মজহারকে আমন্ত্রণ জানাইছিলেন ভাবান্দোলন নিয়া কিছু কওনের জন্য। তখনই আমরা জানতে পারলাম যে, ফরহাদ ভাই কবিসভা ‘আনসাব’ করছেন। অর্থাৎ, ভাবান্দোলনের পরিভাষায় কৈতে হয়, ফরহাদ ভাইয়ের কবিসভা বিষয়ে ‘ভেদবুদ্ধি’ হৈছে। ক্যান হৈল? ক্যান অভেদবাদী ফরহাদ মজহার আমাদের নগণ্য কবিসভার সাথে ‘ভেদ’ ঘটাইলেন?

যা পাওয়া গেল, তা হৈল দুধ ও মধুসমেত কবি মাসুদ খানের সৌরভ। তিনি বেশ বিস্তারিত ভাবে ভাবান্দোলন-এর প্রোপট এবং এই সময়ে এর যাথার্থ্য আলোচনা করলেন। তাতে আমরা অনেক বিষয় জানতে ও বুঝতে পারলাম। আবার অনেক বুঝা-বিষয় ঝাপসা হয়াও গেল। যেমন:

মডার্নিজম/পোস্টমডার্নিজম প্রসঙ্গ

মাসুদ খান বেশ যথোচিতভাবে মডার্নিজমকে তুলোধুনা করলেন। তাতে আমরাও আরাম পাইলাম খুব। যে রীতিতে এবং যেসব প্রশ্নে তিনি মডার্নিজমকে তুলোধুনা করলেন সেইগুলা আমরা এর আগে পাইছি নানান পোস্টমডার্ন তাত্ত্বিকদের (যেমন তালাল আসাদ, সমীর আমিন প্রমুখ) রচনায়। অর্থাৎ মাসুদ ভাই মডার্নিজম বধ করলেন পোস্টমডার্নিজমের কান্ধে বন্দুক রাইখা। আবার এর পরপরই তিনি পোস্ট মডার্নিজম বধ করতে চাইলেন, না জানি কার কান্ধে বন্দুক রাইখা! বুঝলাম না। তিনি লিখলেন:

নতুন সে বাহানার নাম পোস্ট-মডার্নিজম, যা, আমরা মনে করি, মডার্নিজমেরই স¤পূরক এবং তারই এক বাড়িয়ে নেওয়া রূপ; যদিও অনেকেই মনে করেন, পোস্ট-মডার্নিজম মডার্নিজমের অনুগামী তো নয়ই বরং বিরুদ্ধ এক দর্শনের নাম। আমরা অবশ্য তা মনে করছি না। আমাদের বিবেচনায়, নয়া-উপনিবেশবাদী কালপর্বে পোস্ট-মডার্নিজম হচ্ছে সেই অভিনব মলম, যা উদ্ভাবিত হয়েছে মডার্নিজমেরই কারখানায়, মডার্ন সভ্যতারই জখমগুলোর জ্বালাপোড়ায় উপরি-প্রলেপ দেবার জন্য, নজর নানা দিকে ঘুরিয়ে দেবার জন্য।

মডার্নিজমের কারখানায় কিভাবে পোস্টমডার্নিজম পয়দা হৈল, এইটা মাসুদ ভাইয়ের কাছে বুঝতে চাই।


অভেদতত্ত্ব

প্রাক্সিস-এর দিক থিকা অভেদবাদ একটি বিপদজনক ইস্যু মনে হয় আমার কাছে, বিশেষত আমার মত সাধারণ মানুষের জন্য। এমনকি যারা অসাধারণ মানুষ, তারাও এর নানাবর্ণের ফাঁদ সবসময় এড়ায়া যাইতে পারেন বৈলা আমার মনে হয় না। এই কথা মনে রাইখাই শুরুতে আমি ফরহাদ ভাইয়ের কবিসভা আনসাব করার কথা কৈছিলাম। মাসুদভাই সকল ভেদ-এর অবসান দেখেন বাংলার ভাবান্দোলনে। এই ভাবান্দোলনের প্রণোদনা থিকা যখন তিনি নিজেদের জন্য রাজনৈতিক এজেন্ডা খোঁজেন, তখন কিন্তু আমরা নানারকমের ‘ভেদ’এর ঘোষণা দেখতে পাই। আসল ও নকলের ভেদ, দেশী ও পশ্চিমের ভেদ, ভারতচন্দ্র ও বোদলেয়ারের ভেদ, ইত্যাদি। মাসুদ খান যখন (খুব সঙ্গতভাবেই) একটি মতাময় পশ্চিমকে এই বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে দেখেন, সেইটা কি উনার দৃষ্টিতে ‘আদার’ হয়া থাকতেছে না? তাইলে কিভাবে সার্বজনীন ভেদবুদ্ধিবিনাশ সম্ভব ?

(জ্ঞানের কর্তা ও বিষয়ের অভেদ নিয়াও একইরকম আপত্তি করা যায়)



অনেক-এর দাসত্ব

মাসুদ খান লিখেছেন:

মডার্নিজমের অন্যতম আরাধ্য বিষয় ছিল ব্যক্তির মুক্তি। মডার্নিজম হন্যে হয়ে খুঁজেছে মুক্তির পথ। শুনিয়েছে মহা- মহা কেচ্ছাকাহিনী। কিন্তু খুঁজে খুঁজে না পেয়ে পোস্টমডার্ন কালপর্বে এসে বলা হচ্ছে যে, মুক্তি অসম্ভব। অথচ বাংলার ভাবুকতার ধারা অনেক আগে থেকেই ইঙ্গিত দিয়ে আসছে যে, স্বেচ্ছায় ‘অনেক’-য়ের দাসত্ব গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই সম্ভব হয় ‘এক’-য়ের মুক্তি, অর্থাৎ ব্যক্তির মুক্তি। অনেক-য়ের মুক্তির মধ্য দিয়েই সম্ভব হয় এক-য়ের মুক্তি।

এইখানে একটা প্যারাডক্স আছে। মাসুদ খান কৈলেন, ব্যক্তির মুক্তি সম্ভব যদি সে ‘স্বেচ্ছায়’ অনেক-এর দাসত্ব গ্রহণ করে। আবার ‘মুক্ত’ ব্যক্তিসত্তা ছাড়া কি কারো পে স্বেচ্ছায় অনেক-এর দাসত্ব গ্রহণ করা সম্ভব? তাইলে কোনটা আগে হৈবে? ব্যক্তির মুক্তি, নাকি অনেক-এর দাসত্ব? সেই বিখ্যাত ডিম-মুরগির সমস্যা!

আরেকটা বিষয়: এই লেখার শিরোনাম ‘দুধমধুর সৌরভ’ ক্যান হৈল? নামকরণের সার্থকতা কি? দুধ আর মধুর মত দামী খাওয়াখাদ্য’র সাথে দৈন্যভাবের কী সম্পর্ক? (এইগুলা নিয়মিত খাইলে কি দৈন্যভাব আসনের সম্ভাবনা আছে ?) ‘দৈন্যভাব’ নিয়া আমার আরো কিছু জিজ্ঞাস্য আছে। একসাথে আর সেইটা না করি। আশা করতেছি, এই প্রশ্নগুলো থিকা মুক্ত হয়া যাইতে পারলে আপনে-আপনেই আমার বাদবাকি জিজ্ঞাস্য তিরোহিত হয়া যাইব।

আসেন মাসুদ ভাই, অধমের সাথে বাংলার ভাবান্দোলনের অভেদ ঘটায়া দেন।


ঢাকা, ২৭ আগস্ট ০৫


(২)

ভেদ ঘুচল না অধমের।

জনাব রাদ আহমেদ দয়াপরবশ হয়া আমার একটা প্রশ্নের ‘ভেদ’ ঘুচাইতে চাইলেন। বা, বলা যায়, ঐ প্রশ্নের বৈধতা বা যাথার্থ্য নিয়া কিঞ্চিৎ আশ্চর্য হৈলেন। তিনিও মনে করেন পোস্টমডার্ণিজম মডার্ণিজমেরই একটু সম্প্রসারিত চেহারা। গোরি গোরি মুখরি মে কালে কালে চশমা! আর কিছু নয় ইহা, মডার্নিজমেরই কারিশমা!!

রাদ লিখলেন:
modernism er ak_adorshe sobaire Taina anar jei attitude bidyoman
cHilo - taar protikriya hisabe jeisob jinisgula jonmo nitesilo (ba
akhono nitese), accentuated hoitesilo (brindo-jounota korum, cu-clax-
clan korum, neo_natsi korum, gay-lesbian bibaho korum etc. )
seigulare swikriti diya nijer dole Taina ainar jonyei pomo-r
obotarona korse sei aki pokkho - ei rokom bhaba jae. mane 'talgaacHta
tomari thak - kintu tumi amar' jatiyo akTa byapar ....

aar ekhan thekei suman rahman jei "modernism er karkhanae kibhabe
postmodernism poyda hoilo - eiTa Masud bhaier kacHe bujhte chai" -
proshno korsen - seiTar uttar nihito acHena?


নিহিত নাই, রাদ। এইটা একটা রাজনৈতিক ভাষ্য। আমি প্রশ্ন করতেছিলাম, জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রোপটে দাঁড়ায়া। যে জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়া মডার্নিজম বিকশিত হৈছে, পোস্ট মডার্ণিজম সেই ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ জানাইছিল। যে বুদ্ধির চর্চা পশ্চিমের হাতে মতা তুইলা দিছে, পোস্ট মডার্নিজম সেই বুদ্ধির চর্চাকে উদলা কৈরা দিতে চেষ্টা করছে। মাসুদ খান যে ভাষায় মডার্নিজম-রে তুলাধুনা করলেন, ঐটা পোস্টমডার্নিজম/ পোস্ট কলোনিয়ালিজম-এরই ভাষা। আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন যে, পোস্টমডার্ণিজম বা পোস্ট কলোনিয়ালিজমের মূল চিন্তকদের অধিকাংশই জগতের পেরিফেরির বাসিন্দা। কু-কাক্স-কান বা গে-লেসবিয়ান বিবাহ কোরামকে (বা আরো যেসব কোরামের কথা কৈলেন আপনে) পোস্টমডার্ণিজম কিভাবে স্বীকৃতি দিছে? এইটা তথ্য হৈলে দয়া কৈরা রেফারেন্স দিয়েন, আর আপনের নিজের ভাষ্য হৈলে বিস্তারিত জানাইয়েন। আপনের এই ব্যাখ্যা হয়ত আমার দৃষ্টিভঙ্গির খোলনলচা আগাগোড়া ফাটায়া দিতেও পারে।

মাসুদ খান (এবং শ্রদ্ধেয় ফরহাদ মজহারও) যখন মডার্নিজমের বিপে যুক্তি দাঁড় করাইতে যান, তখন পোমো পাটাতন ব্যবহার করেন। কিন্তু পোমো-র পাটাতন বড় নড়বড়ে, বা উহার কোনো স্থায়ী পাটাতনই নাই। উহা সর্বদা নিজকে চ্যালেঞ্জ জানাইতে ভালবাসে। ফলে পাটাতনবাসী লোকজন যাহারা নিজেদের কোথাও না কোথাও স্থায়ী দেখিতে চাহেন তাহাদের বড় অসুবিধা! কী ঘর বানাইবেন তারা শূন্যের মাঝার?

ফলে পোমো-র বিরূদ্ধে একটা রাজনৈতিক অবস্থান। এইটা বৈলা স্বস্তি পাওয়া যে, পোমো মডার্নিজমের-ই সম্প্রসারিত রূপ। আমার এক শিক ছিলেন, তিনি খুব ভাল পোমো পড়াইতেন। উনারে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, স্যার, আপনে কি পোমো? তিনি হাইসা কৈলেন যে তিনি পোমো নন, তবে তিনি ক্রিটিক অব পোমো। অর্থাৎ তিনি আসলে মডার্নিস্ট, আউটডেটেড হয়া যাওনের ভয়ে একটু ঘুরায়া বলেন।

তাইলে পোমো’র ক্রিটিসিজম কি? প্রধান ক্রিটিসিজম হৈল, পোমো এনার্কি পয়দা করে। এনার্কি বুদ্ধিবাদের অপছন্দের জিনিস, যেহেতু বুদ্ধি ফাইন্যালি স্বত্ব-ই প্রতিষ্ঠা করে। পোমো হৈল ‘এনিমি প্রপার্টি’র মত, লিজ নেওন যায়, কিন্তু এর ওপর দালানকোঠা বান্ধা যায় না। ফলে, আমাদের মডার্নিস্ট মিস্ত্রী-রা বেকার হৈয়া যাইবেন! তাই, মাসুদ খানের পোমো-ভাষ্য এবং রাদ আহমেদ এর সমর্থন দুইটাই রাজনৈতিক প্রণোদনাজাত এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক থিকা সেই সাবেকী মডার্নিস্ট পাটাতনের ওপর খাড়ায়া আছে দেখতেছি।

যেসমস্ত কুঠুরিতে মতা কেন্দ্রীভূত হয়, বা হৈতে পারে, পোমো তার পদ্ধতিগত এনার্কি লৈয়া সেইসব কুঠুরিতে হানা দেয়। ফলে, ভাবান্দোলনের সাথে পোমো-র একটা গেহেরি শত্র“তা হৈবার সম্ভাবনা। বাংলার ভাবান্দোলন নিম্নবর্গীয় মানুষের ভাবকে যেভাবে সাহিত্যে একটা সার্বজনীন প্রাক্সিস-এর জায়গায় নিয়া যাইতে চাইতেছে, একটা মতাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বাসনা তার দৈন্যভাবের মধ্যেও কি নাই? যদি থাকে, তবে সেইটা বিদ্যমান মধ্যবিত্ত রূচি, সাহিত্যের বিচিত্র সম্ভাবনা এবং আরো আরো কেন্দ্রাতিগ প্রান্তিক ভাবনারাশির ওপর জবরদস্তি হয়া যাইতেছে কি না, সেই প্রশ্ন পোমো করতেই পারে।


ঢাকা, সেপ্টেম্বর ০৫




২টি মন্তব্য:

Fahmidul Haq বলেছেন...

ব্লগ ঘুরে গেলাম। কিছু পড়লামও। ভালো লাগলো। এরকম ব্লগ খুলে ফেলতে প্রলুব্ধ হচ্ছি। নিজে না পারলে টিপস নিতে পারি। নতুন পোস্ট দিলে লিঙ্ক জানাবেন। শুভকামনা।
ফাহমিদুল হক

সুমন রহমান বলেছেন...

অনেক ধন্যবাদ ফাহমিদুল হক। নতুন পোস্টের লিংক দেয়ার জন্য ফেসবুকই মনে হয় ভালো জায়গা। দেখি...