বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০০৮

ব্যর্থ গল্প লেখার সাহস ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

অদিতি ফাল্গুনীর গল্প এবং গল্পগ্রন্থের প্রকাশ নানা কারণে বিশিষ্ট। প্রথমত, তিনি বিচিত্র সব বিষয়ের গল্প বলতে চান। দ্বিতীয়ত, তিনি সাদামাটা গল্প বলেন না। তৃতীয়ত, নিজের প্রকাশকে (হয়ত বিকাশকেও) তিনি যাচাই করেন মার্কেজ, দস্তয়েভস্কি, সারামাগো বা আবুল বাশারদের সাথে। চতুর্থত, এই পোড়া দেশে শিতি পাঠক-লেখক-সমালোচকের অভাব আছে জেনেও ‘বাণিজ্যিক প্লাবনে’ গা ভাসান না। পঞ্চমত, গল্পকে তিনি উপন্যাস বানাতে চান না, মালমশলা যতই হাতে থাকুক। ষষ্ঠত, অন্তত পাঁচশ’ পৃষ্ঠার নিচে কোনো উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা তার নাই। ঐতিহ্য কর্তৃক প্রকাশিত এই গল্পকারের ‘বানিয়ালুকা ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থের শুরুতেই এতসব বিশিষ্ট তথ্যের সন্ধান মেলে।

বইয়ের প্রথম গল্প ‘বানিয়ালুকা’র বৈচিত্র্য স্পাশিয়াল বা ভৌগোলিক। জাতিসংঘ মিশনের দায়িত্ব পাওয়া এক বাংলাদেশী বৈমানিকের বসনিয়া-অভিজ্ঞতা। বানিয়ালুকা এক বসনিয়ান মুসলিম মহিলা যার সার্বিয় স্বামীকে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মেরে ফেলে এবং তাকে নজরবন্দী করে। চিঠির মাধ্যমে সেই মহিলা শরণ নেয় একদা পরিচয় হওয়া ঐ বাংলাদেশী বৈমানিকের, যে চিঠি তার হাতে পৌঁছায় অনেকদিন পর। সময়মত পৌঁছালে ঐ বাংলাদেশী বৈমানিক কী করতেন সেটা জানা যায় না, কিন্তু পরে পৌঁছানোর কারণে ঐ বৈমানিকের পে নিজের কন্যাসন্তানের নামের সমস্যাটির সমাধান হয়। গল্পের বসনিয়া-প্রেতি বাদ দিলে এটি বিমল মিত্র ঘরানার গল্প, তবে ঐ প্রেতিটিই গল্পটিকে বিশিষ্ট করার চেষ্টা করে। বসনিয়া-পরিস্থিতিকে ক্রিটিক্যালি দেখার চেষ্টা আছে এই গল্পে, সেটি অবশ্য সার্বদের প্রতি মমত্ব জাগায়।

দ্বিতীয় গল্প ‘হেরূকের বীণা’র বৈচিত্র্য কালিক বা ঐতিহাসিক। ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুত্থানের মুখে দাঁড়িয়ে বৌদ্ধদের আত্মোপলব্ধি আর দ্রোহপ্রস্তুতির গল্প। গল্পবুনন রীতি মনে করিয়ে দেয় ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ এর শওকত আলীকে এবং ‘পোড়ামাটির কাজ’এর আবদুল মান্নান সৈয়দকে। পাদটীকায় কিন্তু উনাদের নাম নেই, কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়েছে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কাছে।

‘সৌভাগ্যের রজনী’ গল্পে তেমন কোনো দৃশ্যমান বৈচিত্র্য নেই। বুঝি বা সে কারণেই এটিকে এই বইয়ের সেরা গল্প মনে হয়েছে। বিষয় খুব সাদামাটা, পতিতাপল্লীতে পতিতাদের শবেবরাত পালন। চাঁদ ও রুটির মধ্যে সংবেদন-বিপর্যয় ঘটিয়ে এই অসাধারণ গল্পটি শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত পাঠককে এক গভীর মমতায় জড়িয়ে রাখে। এই গল্পের উৎকর্ষ অদিতির বিষয়বৈচিত্র্যস্পৃহাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে। সেই প্রশ্ন আরো পোক্ত হয় পরবর্তী গল্পগুলো পড়ার পর।

‘আক্কাস নিবাড়ন...’ এই বইয়ের আরেকটি ভাল গল্প যার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ‘মিস বাংলাদেশ’ জাতীয় সেরা সুন্দরী ইভেন্টকে ব্যঙ্গ করা। কিন্তু লেখক উদোর পিন্ডি চাপান বুধোর ঘাড়ে, উদ্দেশ্যের অসহায় বলী হয় বামন সম্প্রদায়। অবাক লাগে, যিনি বসনিয়া-পরিস্থিতিতে সার্বদের ওপর মমত্বজাগানিয়া গল্প দাঁড় করান, তিনি কি না বেঁটেবামনদের দেখতে গিয়ে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গেলেন না!

এরপরের গল্পগুলোর ইতিহাস অদিতি’র নানারকম অসফল পরীানিরীার ইতিহাস। ‘জাফর, চিনিজাতক’ আর ‘জয়নালউদ্দিনস ট্রাভেলস’ ভালো লাগে নি তাদের মেটাফিজিক্যাল ট্রিটমেন্টের কারণে। চিনিজাতক-এ রিপোর্টিং আর জাতকগ্রন্থের কোলাজ করা হয়েছে, এক গ্লাসের মধ্যে পানি আর সর্ষে তেলের কোলাজের মত। পানিটুকু খেয়ে তেলটুকু মাথায় মাখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না পাঠকের। একই অবস্থা ঘটেছে পরের গল্পে জয়নালউদ্দিন আর গালিভর-এর কোলাজ প্রচেষ্টার মাঝে। মেটাফিজিক্স আরো মূর্ত হয় জয়নাল-গল্পের উপসংহারে, যেখানে লেখক বলেন, ‘ফিরে ফিরে আসবে সেই অনন্ত কালচক্র’। এই লাইনটিই উক্ত দুটি গল্পের সারাংশ।

বাকি থাকে দুটো গল্প: ‘আর্থ-সামাজিক সমীা’ আর পুনর্মুদ্রিত ‘ব্রিংনি বিবাল’। এই দুই গল্পে (আগের জয়নালউদ্দীনস-এও) গল্পকার উপস্থিত হন একজন মাঠগবেষকের স্ট্যাটাসে, কিন্তু তার মন পড়ে থাকে ঢাকাই সাহিত্যের দেশে। অর্থাৎ তিনি সাহিত্যিক, মাঠগবেষণাকে তিনি সাহিত্যিক অভিজ্ঞতা জোগাড়ের একটা উপায় হিসেবে নিয়েছেন। এরকম একটা সৎ বয়ান আছে ‘আর্থ-সামাজিক সমীা’ গল্পে, যে সততার খপ্পরে-পড়া ডকুমেন্টারি ধাঁচের বৃহদায়তন গল্পটির পাঠ শেষপর্যন্ত একটি নির্ভেজাল পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়।

পুনর্মুদ্রিত ‘ব্রিংনি বিবাল’ পড়ে শেষ করার পর প্রথমেই স্বস্তি আসে এটা ভেবে যে, ভাগ্যিস এটাকে পাঁচশ পৃষ্ঠার উপন্যাস বানান নাই লেখক! আঠার পৃষ্ঠাতেই নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়! লেখকের পরিশ্রম হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায় গল্পটি পড়লে। মান্দি জাতির নানান বিষয় এসেছে এই গল্পে: তাদের ইতিহাস-পূরাণ, খৃস্টীয়করন এবং মান্দিদের ভূমিতে স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্টের নামে বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন ফর্মূলার অন্যায় আরোপ, ইত্যাদি। প্রত্যেকটি বিষয়ের ওপরই লেখকের পর্যবেণ ভাল, এমন কি মূল কাহিনী অর্থাৎ পার্লারে কাজ করা মান্দি কিশোরীর কাহিনীটাও ভাল। কিন্তু গল্পে এদের পারস্পরিক ল্যাপ্টালেপ্টির ধরনটা যুতসই লাগে নি। খুব বানিয়ে তোলা মনে হয়েছে। ‘ব্রিংনি বিবাল’ এ লেখক দুইটা জায়গা থেকে মান্দিজাতিকে দেখেছেন: পৌরাণিক আর সমাজতাত্ত্বিক। এদের মেলামেশা কখনো কখনো বিপজ্জনক হয়ে গেছে, বিশেষত যেখানে তিনি মান্দিদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চালুর পৌরাণিক ব্যাখ্যা হাজির করেন, যেটা সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থেকে অনেক দূরের, একটি পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যা।

‘বানিয়ালুকা’র অদিতি ফাল্গুনীর মাঝে অন্তত তিনটা ইতিবাচক লণ দেখা যায়। এক, ব্যর্থ গল্প লেখার সাহস আছে তার, দুই, গ্রামবাংলার কথাসাহিত্যবটিকা বিক্রি করেন না তিনি, এবং তিন, নিজের প্রায় গল্পেই হাজির থাকার চেষ্টা আছে তার। তার গল্পের বিষয় বিচিত্র, কিন্তু উন্মোচনের ধরন খুব হাতে গোণা। সেখানে তিনি প্রায়ই প্রি-অকুপাইড। এটা তার সীমাবদ্ধতা। ‘বানিয়ালুকা’ আর ‘সৌভাগ্যের রজনী’ ছাড়া এই বইয়ের বাদবাকি গল্প সুখপাঠ্য নয়, পাঠকের স্বস্তির ওপর সরাসরি আঘাত করে। এটা ঠিক সীমাবদ্ধতা নয়, এটা অদিতির সুচিন্তিত অবস্থান, ফলে এখানে সীমাবদ্ধতা যদি কিছু থাকে সেটা লেখকের বোঝাপড়ার এবং দৃষ্টিভঙ্গির। এই সবকিছু নিয়েই অদিতি ফাল্গুনী। বানিয়ালুকা-র গল্পগুলো অদিতি’র পরবর্তী গল্পপাঠের আগ্রহ জিইয়ে রাখে।

ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত এই বইয়ের ছাপা বাঁধাই ভাল। প্রচ্ছদ রিলিফ দেয়, ফলে ভাল। শেষ ফ্যাপে অদিতি’র ছবিটিও ভাল। কিন্তু টেক্সট ডিজাইন খুব ভাল লাগে না, সম্ভবত প্রতি পৃষ্ঠায় একটা করে আন্ডারলাইন রেখে পৃষ্ঠাসংখ্যা বসানোর কারণে।






1 টি মন্তব্য:

নামহীন বলেছেন...

অদিতি কি লেখেন পুরাই ফাউল লাগে ওনার লেখা .........।।