শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০০৮

"সুমন রহমান নাকি সিঙ্গারের গল্প! কার আয়না কে?": রাহমান নাসির উদ্দিনের আলোচনা

[আমার অনুবাদে আইজাক সিঙ্গারের "আয়না" গল্পটি ২০০৬ সালে "কবিসভা"য় সঞ্চালিত হবার পর রাহমান নাসির উদ্দিন "কবিসভা"তে নিম্নোক্ত পাঠপ্রতিক্রিয়া পাঠান।]


জনাব সুমন রহমান,

অশেষ শুকরিয়া আপনার একটি অনুবাদ গল্প পাঠ করবার-অনুবাদ করবার জন্য সাধারণ বা অসাধারণ কোনো শুকরিয়াই এখানে যথার্থ নয়-মওকা দেবার জন্য। সনাতন ধন্যবাদের বহরে বাড়তি একটা ‘ধন্যবাদ’ যোগ কিংবা বিয়োগে খুব হেরফের হয় না। তাই, ‘ধন্যবাদ’ দিলাম না। কিন্তু আপনার লেখার তারিফ না করার কোনো কুলকিনারা নাই। আপনার অনুবাদ গল্পটি মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। এটা কি সিঙ্গারের নাকি সুমন রহমানের গল্প; পাঠের আগায় আমার মাথায় এটা থাকলেও পাঠকালে, মাঝখানে এবং গোড়ায় গিয়ে আগার চেতনা হারিয়ে ফেলি। আগা-গোড়া আমার ভাবনাগুলো আর এক থাকে না। মন্ত্রমুগ্ধ-পাঠ যাকে বলে। যদি শুরুতেই সিঙ্গারের একটা ছবি না ছাপানো থাকতো, তবে পাঠের অব্যাহত ভালোলাগার মধ্যে ‘এটি একটি অনুবাদ গল্প...অনুবাদ গল্প...’ জাতীয় আলগা খুঁতখুঁতানি এটা অস্বস্তিকর ভাব থাকতো না। কেননা, পাঠকালে মনেই হয় নাই এটি একটি অনুবাদ গল্প। চিত্রকল্পগুলো অসাধারণ, তবে সাধারণ অসাধারণ নয়। শব্দের যে প্রকৌশল আপনি সু(স্ব)কৌশলে এখানে নির্মিতি দিয়েছেন, তাকে ‘অসাধারণ’ নামক একটি শব্দ দিয়ে শেষ-সত্যিকার অশেষ বলে-করা যায় না। আরো অসাধারণ তার বিন্যাস এবং বিস্তার। কয়েক পশলা উদ্ধৃতি দিই...:



“...যা কিছু গোপন তার প্রকাশ্য হওয়া লাগবে, প্রতিটা গহীন ভাবনার ব্যক্ত হওয়া দরকার, প্রতিটা প্রেমেই আছে প্রতারণার আকাক্সা, যা কিছু পবিত্র তারই মর্যাদাহানি হওয়া প্রয়োজন। দুনিয়া ও পরকালের চক্করে যেকোনো সুন্দর শুরুর-ই খারাপ ধরনের সমাপ্তি হৈয়া যাইতে পারে...”

“জ্ঞান কখনই পয়লা বেহেশতের নিচে নামে নাই। আর পয়লা বেহেশতের পর জ্ঞান বৈলা যা আছে তার সবই হৈল লালসা... গেরাসিম ফেরেশতা বালুর মধ্যে খেলাধুলা করে পোলাপানের মত, চেরুবিমটা তো গোনাগুনতিই পারে না, আর আরালিমটা ফেলনা জিনিস চিবায় খালি। খোদা নিজে সময় কাটান হাঙ্গরের লেজ টাইন্যা টাইন্যা, আর জংলী ষাঁড়ে তার পা চাটে...”

“... লও যা সোনাদানা আছে, দেনমোহরের কাগজটা পুড়ায়া দাও, আর কাবিননামা ছিঁড়া ফালাও। সোনাদানা ফালায়া দাও কসাইটুলির জানলার নিচে, বাড়ি ছাড়ার আগে প্রার্থনার বই ডাস্টবিনে ফালায়া দাও, মেথুরা শরীফে থুথু ছিটাও, বিশেষত যেখানে যেখানে ‘শাদাই’ লেখা আছে সেই স্থানগুলায়...আমরা উড়ব ব্যাঙের বিষ্ঠাভরা মাঠের ওপর দিয়া, নেকড়েভরা জংলার ওপর দিয়া, সমকামীদের আখড়া ডিঙায়া-যেখানে সাপ হৈল পণ্ডিত, হায়েনা হৈল শিল্পী, কাক হৈল মৌলভী, চোরে দেখাশুনা করে খয়রাতির টাকা। সেইখানে সকল অসুন্দর হৈল সুন্দর, বাঁকা হৈল সোজা, নির্যাতন হৈল আরামদায়ক, ব্যঙ্গ হৈল অতি উচ্চ প্রশংসা...”

এই রকম অসংখ্য শব্দবন্ধ, বাক্যবিন্যাস, চিত্রকল্প এবং শব্দের যাদুকরি অভিব্যক্তি কি কেবল ‘অসাধারণ’ চেহারার একটি সাধারণ শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায়! ঠাহর করতে পারি না, এ গল্প কি সুমন রহমানের নাকি সিঙ্গার মশাইয়ের! যাদু-বাস্তবতা নামক এক কিসিমের গাল্পিকতার কথাবার্তা সাহিত্যে জারি আছে। এই গল্পে ওরফে ‘আয়না’য় আসলে কয় আনা যাদু আর কয় আনা বাস্তবতা সেটা অনুভবের সময় গল্পকার (নাকি অনুবাদ!) পাঠককে দেয় না। অন্তত আমাকে দেয় নাই। নাকি সেটাই যাদু! যা যাদুমন্ত্রের মতো কাজ করে। কিংবা সেটাই বাস্তবতা যা যাদুকরের শাব্দিক মায়াজালে লটকে থাকে। আলো-আধাঁরির খেলা। সকাল-সন্ধ্যা আধাবেলা! লিমিনালিটি! মারহাবা...

‘আয়না’ একটি পরদেশী গল্প হলেও, এই অনুবাদের আগা-গোড়া কোথায় যেন একটা চড়া স্বদেশী গন্ধ আছে। কৃতিত্ব সুমন রহমানের নিঃসন্দেহে। কয়েকটা খুচরা উদ্ধৃতি দেয়া যাক...

“...খোদা দুনিয়ার রমণীকূলে দিছেন অন্তঃসারশূন্যতা-বিশেষত যেসব রমণী ধনী, সুন্দরী, বাচ্চাকাচ্চাহীন, যুবতী এবং যাদের খরচ করার মত সময় বিস্তর আছে, অথচ সঙ্গীসাথী নাই...”

“...ওর চামড়া ছিল সাটিনের মত শাদা, দুধজোড়া ছিল ফোলা ফোলা, চুল ছিল কাঁধ-ছাড়ানো আর পা দুইটা ছিল মাদী হরিণের পায়ের মত চিকন লম্বা। আয়নার সামনে বৈসা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে নিজের রূপ উপভোগ করতে পারত। ছিটকিনি আর ভারি হুড়কো দিয়া আটকানো থাকত দরজা, আর সে ভাবত এই বুঝি খুইলা যাইতেছে দরজা, ঘরে ঢুকতেছে কোনো রাজকুমার, শিকারী বা কোনো কবি...”

“...মন দিয়া শোন, সবচে শাদা যে ময়দা তার কাঁই বানাও প্রথম। তাতে মিশাও মধু, ঋতুস্রাব, নষ্ট ডিম, শুয়োরের চর্বি, ষাঁড়ের অণ্ডকোষের চর্বি এক চামচ, এক কাপ মদ। সাবাথের দিন কয়লার আগুনে এইটা সিদ্ধ কর। তারপর স্বামীরে লৈয়া বিছানায় যাও এবং এইটা খাইতে দাও। মিছা কথা বৈলা বৈলা জাগায়া রাখ তারে, তারপর খোদা-না-খাস্তা কথা বৈলা ঘুম পাড়াও। যখন সে নাক ডাকতে শুরু করবে, তার অর্ধেক দাড়ি আর একটা কানের লতি কাইট্যা লও...”।

এরকম এন্তার উদ্ধৃতি দেয়া যায়। অর্থাৎ খুচরা নয় পাইকারি উদ্ধৃতি দেয়া যায়। ভীনদেশ আর নিজদেশ-র মধ্যকার ফারাক আর ফাঁক থাকে সুমন রহমানের (অনুবাদ!) গল্পে। গল্প কাকে বলে, কতো প্রকার ও কী কী? এ প্রশ্ন কেন মাথায় আসলো মালুম হয় না। গল্প নাকি অনুবাদ বেমালুম হয়ে ‘আয়না’-র শিথান-পৈথান ভ্রমণ করে? মননে ও মগজে বড় আরাম পেলাম। সুমন রহমান আরো গল্পপ্রবণ হোন...প্রত্যাশা করি নিরন্তর।

গল্পের পৈথানে এসে আমি ঠাসকি খাই। “...পিচ্চি শয়তানদের পদোন্নতি হয় না খুব একটা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসে যায়, এক জিরেলের পর আরেক জিরেল, অযুত অযুত প্রতিচ্ছবির উস্কানি, অযুত অযুত আয়নার ভিতর...”। তাজ্জব বনে যাই। “অশেষ হইয়াও হইলো শেষ” নাকি “শেষ হইয়াও হইলো না শেষ”। সার্থক রবীন্দ্রনাথ। নাকি সিঙ্গার! নাকি সুমন রহমান! অনুবাদ সাহিত্য দীর্ঘজীবী হোক। সুমন রহমান দীর্ঘজীবী হোন। আমিন।

রাহমান নাসির উদ্দিন
কিয়োতো, জাপান, ১৫ ফাল্গুন ১৪১২; ২৭/২/২০০৬



২টি মন্তব্য:

Sushanta Das Gupta বলেছেন...

সাইট টা সুন্দর হইছে :)

সুমন রহমান বলেছেন...

ধন্যবাদ সুশান্ত। টেকি লোকের প্রশংসা পেতে টাকু লোকের কী যে ভালো লাগে!!!